কোয়ার্ক আবিষ্কারের কাহিনি

১৯৫৫ সাল। সেবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন মার্কিন পদার্থবিদ উইলিস ল্যাম্ব। হাইড্রোজেন বর্ণালির সূক্ষ্ণ কাঠামো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণার কারণে মিলল এ স্বীকৃতি। নির্ধারিত দিনে সুইডেনে গিয়ে পুরস্কার নিলেন তিনি। তারপর নোবেল বক্তৃতায় বললেন অদ্ভুত এক কথা। ল্যাম্ব বললেন, ‘এতদিন নতুন মৌলিক কণা আবিষ্কার করলে আবিষ্কর্তাকে নোবেল দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। কিন্তু এখন এমন কিছু আবিষ্কারের জন্য তাকে ১০ হাজার ডলার জরিমানা করা উচিত।’

ল্যাম্বের কথা শুনে লাল হয়ে গেল কারও কারও চোখ-মুখ। কিন্তু কথাটা শুনতে যত হাস্যকরই মনে হোক না কেন, পদার্থবিজ্ঞানের তখনকার বাস্তবতায় ল্যাম্বের কথায় যুক্তি ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর দশকে। ভাবছেন, কেন? সেটা বুঝতে হলে তাকাতে হবে একটু পেছনে। 

পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে পরমাণুর প্রথম মৌলিক কণা আবিষ্কারের ঘটনা ১৮৯৭ সালে। সেবার ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে জে টমসন। পরে, ১৯১৭ সালে প্রোটন আবিষ্কার করেন নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। নিউট্রন আবিষ্কৃত হয় ১৯৩২ সালে। তার চার বছর পর মেলে পজিট্রন—ইলেকট্রনের প্রতিকণা। এ কটি কণা দিয়ে পরমাণুর গঠন-কাঠামো কিংবা পরমাণু সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিঘটনা মোটামুটি বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করা চলে। অবশ্য কিছু রহস্য রয়ে গেলেও সেটাই ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ সরল ও সহজবোধ্য।

অনেকে এসব কণাদের ডাকতে লাগলেন ‘স্ট্রেঞ্জ পার্টিকেল’ নামে। সত্যিই অদ্ভুতুড়ে কণা। তাতে এতদিনের চেনা-পরিচিত পরমাণুর সরল চিত্রটা বিজ্ঞানীদের কাছে পরিণত হলো স্রেফ এক জগাখিচুড়িতে।

কিন্তু নতুন কিছু প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবনে পরীক্ষণবিদদের সামনে খুলে যায় সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। কয়েকজন কণাপদার্থবিজ্ঞানীর অদম্য প্রচেষ্টায় কণার তালিকা দীর্ঘ হতে শুরু করে। তাই পরের দুই দশকে একে একে নতুন কণা আবিষ্কৃত হতে থাকে। এদের অনেকগুলোর নামকরণ করা হতে লাগল গ্রিক বর্ণমালায়। পায়ন, প্রতিপ্রোটন, জে/সাই মেসন, কেয়ন, ডেল্টা, সিগমা, ওগেমা, ল্যাম্বডা নটসহ কত কত সব নাম! দিন দিন গ্রিক বর্ণমালার অক্ষরও ফুরিয়ে আসতে লাগল। ১৯৬০ সাল আসতে না আসতেই কণার সংখ্যা দাঁড়াল ১৬টিতে। সে সব কণার আচার-আচরণও বেশ অদ্ভুত। দারুণ রহস্যময়।

অনেকে এসব কণাদের ডাকতে লাগলেন ‘স্ট্রেঞ্জ পার্টিকেল’ নামে। সত্যিই অদ্ভুতুড়ে কণা। তাতে এতদিনের চেনা-পরিচিত পরমাণুর সরল চিত্রটা বিজ্ঞানীদের কাছে পরিণত হলো স্রেফ এক জগাখিচুড়িতে। কণাদের এই দঙ্গলকে বলা হতে লাগল পার্টিকেল জু। মানে, কণাদের চিড়িয়াখানা। 

পরীক্ষণবিদেরা একের পর এক নতুন কণা আবিষ্কার করেই খালাস, কিন্তু মাথার ঘাম ছুটে যেতে লাগল তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের। কারণ কণাগুলো তাঁদের কাছে ধাঁধার চেয়েও জটিল। বিজ্ঞানীরা সেগুলো তালিকাবদ্ধ করলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের আগা-মাথা কিছুই বোঝেন না, এমন অবস্থা। শুধু তালিকাবদ্ধ করাই তো আর বিজ্ঞানের কাজ নয়। তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো সম্পর্ক বা যোগসূত্রই যদি আবিষ্কার করা না যায়, তাহলে তো সেটা স্রেফ ডাকটিকিট সংগ্রহের শামিল। পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ডও তাই মনে করতেন!

কিন্তু প্রকৃতিতে এত সব কণা থাকার মানে কী? একটার সঙ্গে আরেকটার কি কোনো সম্পর্ক আছে? পরমাণুতে তাদের কাজটাই-বা কী? কেউ জানে না তার উত্তর।

১৯৬২ সালে ঘটালেন সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি। সেবার এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গিয়েছেন গেল-মান। সেখানে নতুন আবিষ্কৃত দুটি কণার কথা জানতে পারলেন। সেগুলোর ভৌতধর্ম জেনে নিলেন বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে।

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ১৯৫৫ সালে কেন অমন জরিমানার প্রস্তাব দিয়েছিলেন উইলিস ল্যাম্ব। কণাপদার্থবিজ্ঞানের যখন এরকম নড়বড়ে অবস্থা, তখন নতুন যুগের মেন্ডেলিভ হিসেবে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন পদার্থবিদ মারে গেল-মান। সে সময় তাঁর কর্মক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকে। অধ্যাপনার পাশাপাশি কণাদের এই গোলমেলে ধাঁধাটা নিয়ে ভাবছিলেন তিনি। কিছু দিন পর এক আলোর দিশা পান। সমস্যা সমাধানে তিনি একটি পদ্ধতি প্রস্তাব দেন, যাকে বলা হয় এইটফোল্ড ওয়ে।

বাংলায় অষ্টাঙ্গিক মার্গ। ইংরেজিতে নোবেল এইটফোল্ড পাথ। এটা আসলে বৌদ্ধধর্মের একটি নিয়ম। গৌতম বুদ্ধের বাণী। আরও ভালো করে বললে, দুঃখ দূর করার আটটি উপায়। আসলে বুদ্ধের সেই বাণী থেকে ধার করে পদ্ধতিটির নামকরণ করেন মারে গেল-মান। এভাবে যেন কণাপদার্থবিজ্ঞানের, তথা কণাদের দুঃখ দূর করার উপায় বাতলে দিলেন তিনি। এ পদ্ধতিতে মেসন কণাগুলোকে স্ট্রেঞ্জনেসের পরিমাণ ও আইসোস্পিনের (স্পিনের মতো একধরনের ভৌতধর্ম) ভিত্তিতে একটা গ্রাফ পেপারে সাজালেন গেল-মান। মজার ব্যাপার হলো, তাতে একটা ষড়ভূজ পাওয়া গেল। ৬টি কণা ষড়ভূজের ছয়টি কোণায় এবং ২টি কণা একদম কেন্দ্রে। হালকা ব্যারিয়ন কণাদের ক্ষেত্রেও আরেকটা ষড়ভূজ পেলেন তিনি। এভাবে একটা প্যাটার্নের খোঁজ মিলল।

এখানেই শেষ নয়। ১৯৬২ সালে ঘটালেন সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি। সেবার এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গিয়েছেন গেল-মান। সেখানে নতুন আবিষ্কৃত দুটি কণার কথা জানতে পারলেন। সেগুলোর ভৌতধর্ম জেনে নিলেন বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। তারপর আগের সমগোত্রীয় কিছু কণার সঙ্গে একটা গ্রাফ পেপারে বসালেন। একদিকে কণাদের স্ট্রেঞ্জনেস, আরেকদিকে তাদের আইসোস্পিন (স্পিনের মতো একধরনের ভৌতধর্ম)। এবার আর ষড়ভূজ নয়, পাওয়া গেল একটা ত্রিভূজ। তাও আবার উল্টো।

তবে ত্রিভূজের একটা শীর্ষবিন্দুতে কোনো কণা ছিল না। জায়গাটা ফাঁকা। গেল-মান ভাবলেন, জায়গাটা ফাঁকা থাকতে পারে না। এখান থেকে নতুন একটি কণার ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তিনি। সে কণাটির চার্জ, স্পিন ও ভর কত হতে পারে, তাও অনুমান করলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মাত্র এক বছরের মাথায়, মানে ১৯৬৩ সালে সেই কণাটি আবিষ্কৃত হয়। সেটা তার পদ্ধতির বড় একটা সফলতা বলা চলে। এই সাফল্যের কারণে গেল-মানের পদ্ধতিটা বৈজ্ঞানিক সমাজে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পেল। অনেকেই তাঁকে নতুন যুগের মেন্ডেলিভ হিসেবে মেনে নিলেন। কারণ প্রায় ১০০ বছর আগে মৌলের পর্যায় সারণি প্রণয়নের সময় সারণিতে তিনটি ঘর ফাঁকা রাখেন ওই রুশ রসায়নবিদ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ভবিষ্যতে তিনটি মৌল আবিষ্কৃত হবে। সেগুলোর ভৌত ধর্ম কেমন হবে, তাও অনুমান করেন মেন্ডেলিভ। কয়েক বছর তা সত্যি প্রমাণিত হয়।

গেল-মান কোয়ার্ক মডেল প্রস্তাবের পর থেকেই কোয়ার্ক কণার সন্ধানে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টারে (SLAC) আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়।

এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৪ সালে গেল-মান এক ধাপ এগিয়ে আরেকটা অনুমান করলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, প্রোটন ও নিউট্রন আসলে পরমাণুর মৌলিক কণা নয়। এসব কণা আরও ক্ষুদ্র কোনো মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত এক ধরনের যৌগিক কণা। তবে খুদে এই মৌলিক কণার নাম কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন গেল-মান। কোনো নামই তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। একদিন ইউলিসিস-খ্যাত লেখক জেমস জয়েসের ফিনেগানস ওয়েক বইটি পড়ছিলেন গেল-মান। বইয়ের একটি ছড়ার লাইনে হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল। ছড়াটির একটি লাইন ছিল: ‘থ্রি কোয়ার্কস ফর মাস্টার মার্ক!’ ‘কোয়ার্ক’ শব্দটা বেশ মনে ধরল গেল-মানের। এই লিমেরিক থেকে তিনি ক্ষুদ্র সেই মৌলিক কণার নাম দিলেন কোয়ার্ক।

ঠিক একই সময়ে ক্যালটেকে একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন রাশান পদার্থবিদ জর্জ জোয়াইগ। গেল-মানের প্রায় এক বছর পর স্বাধীনভাবে প্রায় একই ধরনের এক পদ্ধতির প্রস্তাব করেন তিনিও। এই কণার নাম প্রস্তাব করেন এইস (Ace) বা তাসের টেক্কা। কিন্তু তাঁদের কোয়ার্ক মডেল অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপকভাবে গৃহীত হওয়ার পর কোয়ার্ক নামটিই জনপ্রিয় হয়ে যায়।

নাম-ধাম তো হলো, কিন্তু প্রমাণ কই? কোয়ার্ক বলে কি প্রকৃতিতে কিছু আছে? নাকি পুরোটাই স্রেফ গেল-মানের কল্পনা? কোনো গাণিতিক কারসাজি? 

গেল-মান কোয়ার্ক মডেল প্রস্তাবের পর থেকেই কোয়ার্ক কণার সন্ধানে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টারে (SLAC) আপ, ডাউন এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। সে বছরই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান মারে গেল-মান। 

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে আবিষ্কৃত হয় চার্ম কোয়ার্ক। একই দিনে দুটি আলাদা দল স্বাধীনভাবে এই কোয়ার্কটি আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এরপর আবিষ্কৃত হয় বটম কোয়ার্ক। সেটি ১৯৭৭ সালে। অন্যদিকে সবচেয়ে ভারী কোয়ার্ক কণা শনাক্ত করা হয় ১৯৯৫ সালে। সর্বশেষ আবিষ্কৃত কণাটি ছিল টপ কোয়ার্ক। সংক্ষেপে এই হলো কোয়ার্ক আবিষ্কারের কাহিনি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: পার্টিকেল ফিজিকস/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ

হাউ টু ফাইন্ড আ হিগস বোসন/ ইভো ভেন ভালপেন

উইকিপিডিয়া