পাউলির বর্জন নীতি যদি না থাকত

কোয়ান্টাম তত্ত্বের অতিপরিচিত একটি নীতির নাম পাউলির বর্জন নীতি। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি এটি প্রণয়ন করেছিলেন। শুরুতে ইলেকট্রন কণার জন্য নীতিটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, পরে তা সব ফার্মিয়ন কণাতেই প্রয়োগ করা হয়। চলুন, বিষয়টি একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।

পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি
ছবি: উইকিপিডিয়া

পাউলির বর্জন নীতি অনুসারে, একটা পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো অনুমোদিত যেকোনো কোয়ান্টাম তরঙ্গ দখল করতে পারে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব মতে, এটাই আসলে কক্ষপথ। বোরের পরমাণুর মডেলে নিউক্লিয়াসের চারদিকে বেশকিছু কক্ষপথ থাকে। এই কক্ষপথগুলোতেই ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। বাস্তব জগতে সবকিছুই তার শক্তি কমিয়ে সর্বনিম্ন শক্তি দশায় যেতে চায়। যেমন একটা ফুটবল বা ক্রিকেট বল নিজের মহাকর্ষীয় শক্তি কমিয়ে পাহাড়ের ঢালে গড়িয়ে পড়বে। কিংবা একটা টেনিস বলকে মেঝেতে ছুড়ে মারলে, সেটা ড্রপ খেতে খেতে একসময় থেমে যাবে। ইলেকট্রনের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যায় জোরালোভাবে। তাই যদি হয়, তাহলে যুক্তি অনুসারে, একটা পরমাণুর সবগুলো ইলেকট্রন শক্তি হারিয়ে সর্বনিম্ন শক্তি দশায় চলে আসার কথা। মানে সবগুলো তখন চলে আসবে একই শক্তি দশায়। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না কেন? কেন ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর সবচেয়ে কাছের কক্ষপথে বা সর্বনিম্ন শক্তির কক্ষপথে ভিড় জমায় না?

তেমনটি যদি ঘটত, তাহলে ঘটত ভয়াবহ বিপর্যয়। আমরা যে পরমাণুকে যেরকম জানি, তার কোনো অস্তিত্বই থাকত না। আলো বলেও কিছু থাকত না। কারণ আলোর কণা বা ফোটন শুধু তখনই নিঃসৃত হয়, যখন একটা ইলেকট্রন এক শক্তি স্তর থেকে আরেকটা শক্তি স্তরে নেমে আসে। এর ফলেই ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ফোটন হিসেবে বের করে দেয়। কিন্তু সব ইলেকট্রন যদি একই দশায় বা একই শক্তি স্তরে থাকত, তাহলে কখনই কোনো শক্তি নিঃসৃত হতে পারত না।

আরও পড়ুন

আরও গুরুতর সমস্যা দেখা দিত রাসায়নিক কর্মকাণ্ডে। আসলে পরমাণুর সবচেয়ে বাইরের বা নিউক্লিয়াস থেকে সবচেয়ে দূরের ইলেকট্রনগুলোই আসলে তার রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে। এসব ইলেকট্রন অন্য পরমাণুর ইলেকট্রনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যৌগ বা অণু গঠন করে। যেমন কিছু পরমাণুর বাইরের দিকে একটা ইলেকট্রন থাকে, কোনোটার থাকে দুটি, তিনটি বা অন্য কোনো সংখ্যায়। এ ব্যাপারটার কারণে গড়ে ওঠে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় পরমাণুর ভাণ্ডার—সবচেয়ে হালকা পরমাণু হাইড্রোজেন থেকে সবচেয়ে ভারী পরমাণু ইউরেনিয়াম পর্যন্ত। কিন্তু সব ধরনের পরমাণুর সবগুলো ইলেকট্রন যদি তার সবচেয়ে কাছে কক্ষপথে জড়োসড়ো হয়ে থাকত, তাহলে সব পরমাণুর বাইরের অংশ আসলে প্রায় একই রকম হতো। কাজেই প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভুত ৯২ ধরনের পরমাণুর বদলে স্রেফ এক ধরনের পরমাণু দেখা যেত। তাতে রসায়ন বলে কোনো ব্যাপার থাকত না। প্রকৃতিতে কোনো জটিলতাও থাকত না। আমাদের মতো জটিল জীব আর চারপাশের জটিল রাসায়নিক জগতেরও অস্তিত্ব থাকত না। সবকিছু হতো রস-কষহীন এবং সহজ-সরল। এরচেয়ে আর নিরস মহাবিশ্ব আর কী হতে পারে!

পরমাণু, তথা গোটা মহাবিশ্বকে এই সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এ তত্ত্ব থেকে জন্ম নিয়েছে পাউলির বর্জন নীতি বা পাউলি এক্সক্লুসন প্রিন্সিপল।
আরও পড়ুন

তাহলে ব্যাপারটা ঘটছে কীভাবে? আমাদের চেনা জগৎটা টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে কীভাবে?

এর ব্যাখ্যা মেলে কোয়ান্টাম তত্ত্বে। পরমাণু, তথা গোটা মহাবিশ্বকে এই সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এ তত্ত্ব থেকে জন্ম নিয়েছে পাউলির বর্জন নীতি বা পাউলি এক্সক্লুসন প্রিন্সিপল। সংক্ষেপে বললে, এই নীতি অনুসারে, একটা পরমাণুর দুটি ইলেকট্রন একই কক্ষপথে থাকতে পারবে না। আরও স্পষ্টভাবে বলা যায়, কোনো দুটি ইলেকট্রন একই কোয়ান্টাম সংখ্যা ভাগ করতে পারে না। এরকম চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা রয়েছে। সেগুলো হলো, প্রিন্সিপল কোয়ান্টাম নাম্বার (ইলেকট্রনের শক্তি স্তর বা শেল বর্ণনা করে), অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম কোয়ান্টাম নাম্বার (কৌণিক ভরবেগ কোয়ান্টাম সংখ্যা বর্ণনা করে ইলেকট্রনের সাবশেল বা আকৃতি), ম্যাগনেটিক কোয়ান্টাম নাম্বার (চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা বর্ণনা করে ইলেকট্রনের কক্ষপথের সজ্জা) এবং স্পিন কোয়ান্টাম নাম্বার (ইলেকট্রনের স্পিনের দিক বর্ণনা করে)। পাউলির বর্জন নীতি বলে, দুটি ইলেকট্রন কোনোভাবেই একইরকম চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা থাকতে পারবে না। তা ভিন্ন ভিন্ন হতে হবে। যেমন একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে একটা ইলেকট্রনের স্পিন হয় আপ হবে, নয়ত হবে ডাউন। তাই এই নীতি অনুযায়ী, একই কক্ষপথে দুটি ইলেকট্রন একই সঙ্গে আপ বা ডাউন হতে পারবে না। একটা স্পিন আপ হলে অন্যটিকে অবশ্যই স্পিন ডাউন হতে হবে।

আরও পড়ুন

পাউলির এই নীতিটাই সবগুলো ইলেকট্রনকে পরমাণুর একই কক্ষপথে জড়ো হতে বাধা দেয়। এ কারণে প্রকৃতিতে আমরা ৯২টি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের পরমাণু দেখতে পাই। আমাদের চারপাশের জগৎ, পৃথিবী, তথা মহাবিশ্বে তাই এত বৈচিত্র্য।

পাউলির এই বর্জন নীতির কারণে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াস থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ক্রমেই বেশি দূরত্বের কক্ষপথে অবস্থান করে। প্রথম কক্ষপথে সর্বাধিক দুটি ইলেকট্রন থাকতে পারে, পরের কক্ষপথে ৮টি, তার পরেরটায় ১৮টা ইত্যাদি। যেমন ধরা যাক, একটা পরমাণুতে ৬টি ইলেকট্রন আছে। তাহলে তার নিউক্লিয়াসের কাছের বা প্রথম কক্ষপথে থাকবে দুটি ইলেকট্রন এবং বাইরের কক্ষপথ বা নিউক্লিয়াস থেকে দূরের কক্ষপথে থাকবে ৪টি ইলেকট্রন। আর ১২টি ইলেকট্রনধারী একটা পরমাণুর ক্ষেত্রে প্রথম কক্ষপথে থাকবে দুটি ইলেকট্রন, দ্বিতীয় কক্ষপথে থাকবে ৮টি এবং তৃতীয় বা শেষ কক্ষপথে থাকবে ২টি ইলেকট্রন। তাই এই দুটি পরমাণুর ইলেকট্রন সংখ্যা আলাদা হলেও তাদের প্রায় একই রকম রাসায়নিক ধর্ম দেখা যাবে। যেমন লিথিয়াম, সোডিয়াম, এবং পটাশিয়ামের বাইরের কক্ষপথে একটা মাত্র ইলেকট্রন থাকে। তাই বাইরে থেকে তাদের আচরণ প্রায় একইরকম মনে হয়।

পরমাণুতে দুটি ইলেকট্রন বা দুটি কণা যদি একই অবস্থায় যেতে চায় কোনো কারণে, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রন দুটির মধ্যে একধরনে রিপালশন বা বিকর্ষণ বল তৈরি হয়।

আমাদের জগতের স্থিতিশীলতা এবং বৈচিত্র্যের উৎস আসলে এখানেই। পরমাণুর তরঙ্গের মতো প্রকৃতি তাদের ইলেকট্রনগুলোকে সর্পিলভাবে নিউক্লিয়াসে পড়ে যেতে বাধা দেয়। সেটা যদি ঘটত, তাহলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে পরমাণু ধ্বংস হয়ে যেত। তখন পদার্থ বা বস্তুকণার বলে কিছু থাকত না। এদিকে ইলেকট্রনগুলোকে একটার ওপর আরেকটা জমা হতে বাধা দেয় পাউলির বর্জন নীতি। তাই প্রকৃতিতে স্রেফ এক ধরনের পরমাণুর বদলে অনেক সংখ্যক পরমাণু দেখতে পাওয়া যায়।

পরমাণুতে দুটি ইলেকট্রন বা দুটি কণা যদি একই অবস্থায় যেতে চায় কোনো কারণে (বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে হতে পারে), সেক্ষেত্রে ইলেকট্রন দুটির মধ্যে একধরনে রিপালশন বা বিকর্ষণ বল তৈরি হয়। এই বলের কারণে এদের একটি ওপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। তখন ওপরের শক্তিস্তরে যাওয়া ইলেকট্রনটি উত্তেজিত অবস্থায় থাকে। অতিরিক্ত শক্তি সে আলোর মাধ্যমে নিঃসরণ করে আবারও তার পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে।

আরও পড়ুন

পাউলির এই নীতিটি শুধু ইলেকট্রনই নয়, বরং অর্ধ-পূর্ণসংখ্যার স্পিনের সব উপপারমাণবিক কণার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ যেসব উপপারমাণবিক (অতিপারমাণবিক কণা হিসেবে প্রচলিত) কণার স্পিন ১/২, ৩/২, ৫/২ ইত্যাদি। যেমন কোয়ার্ক কণার স্পিনও ইলেকট্রনের মতোই ১/২। এসব কণা ফার্মিয়ন নামে পরিচিত। এ নামসকরণ করা হয়েছে ইতালির বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে। পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলার কারণে এদের অসামাজিক কণাও বলা যায়। অন্যদিকে যেসব কণার স্পিন পূর্ণসংখ্যার—অর্থাৎ ১, ২, ৩ ইত্যাদি—সেগুলো পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে না। এসব কণার দলে রয়েছে বোসন কণারা। যেমন ফোটন। এদের সামাজিক কণা বলা চলে। সে কারণেই বিপুল সংখ্যক ফোটনকে একজায়গায় জড়ো করে লেজার আলো তৈরি করা যায়।

সূত্র:

টু বিগ ফর আ সিঙ্গেল মাইন্ড/ টোবিয়াস হুটার

কোয়ান্টাম/ মনজিৎ কুমার

হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড/ মার্কাস চোন

উইকিপিডিয়া