আবিষ্কারের কাহিনি
প্রসন্ন দ্বীপদেশে হাইজেনবার্গ
পরমাণুর ভেতরের ছোট্ট ইলেকট্রনদের নিয়ে সমস্যাটা। অথচ বিজ্ঞানীরা সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। অসুস্থ হাইজেনবার্গ হাওয়া বদল করতে গেলেন হেলিগোল্যান্ড দ্বীপে। পাহাড়ের মাথায় বসে তাঁর সামনে খুলে গেল নতুন এক জগতের দরজা...
১৯২৫ সালের মে মাস। জার্মানিতে তখন গ্রীষ্মকাল চলছে। প্রকৃতিতে রংবেরঙের নানা ফুলের সমাহার। চোখধাঁধানো সৌন্দর্য চারদিকে। সুগন্ধি বাতাসে নেচে বেড়াচ্ছে মধুলোভী মৌমাছির দল।
কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ফুলের হাসি সর্বনাশ ডেকে আনল ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের জন্য। অতি সূক্ষ্ম পরাগরেণুতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলেন তিনি। এ অ্যালার্জির নাম হে ফিভার। ডাক্তারি ভাষায়, অ্যালার্জি রাইনাইটিস। তাঁর চোখ ভীষণ জ্বলতে লাগল। মুখ ফুলে ঢোল, জবা ফুলের মতো রক্তবর্ণ হয়ে গেল। ভয়াবহ চেহারা। নাক বন্ধ। আর অনবরত হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো। নাক-চোখের জলে একাকার। সারাক্ষণ তীব্র মাথাব্যথাও। জ্বরগ্রস্ত হাইজেনবার্গের তখন প্রায় পাগলপারা অবস্থা।
জার্মান এই পদার্থবিদের বয়স তখন সবে ২৩। তখনো বিজ্ঞানী হিসেবে নাম করেননি। তবে তিনি যে জিনিয়াস, তার আঁচ পেতে শুরু করেছেন তাঁর শিক্ষক ও সহশিক্ষার্থীরা। সদ্য নোবেলজয়ী ডেনিশ বিজ্ঞানী নীলস বোরের সেরা ছাত্রদের একজন এই হাইজেনবার্গ। কোপেনহেগেনে বোরের গড়ে তোলা স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর কাটিয়ে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছেন। যোগ দিয়েছেন গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাথায় তখন বোরের ছুড়ে দেওয়া একটা সমস্যা ঘুরপাক খাচ্ছে। সমস্যাটা বস্তুর ক্ষুদ্র জগৎ পরমাণু তথা ইলেকট্রনসংক্রান্ত। সেকালে আরও অনেক বিজ্ঞানী সমস্যাটি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন।
সমস্যার সূত্রপাত ১৯১৩ সালের দিকে। সে বছর পরমাণুর নতুন এক তত্ত্ব দেন নীলস বোর। সে জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করলেন। সেটি পুরোনো কিছু সমস্যার সমাধান দিল বটে, কিন্তু একই সঙ্গে নতুন কিছু জটও পাকিয়ে তুলল। বোরের পরমাণুতত্ত্বের সারকথা হলো—পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের প্রতিটি বৃত্তাকার কক্ষপথের শক্তি নির্দিষ্ট। শুধু তা–ই নয়, ইলেকট্রনের অনুমোদিত কক্ষপথগুলো নির্দিষ্ট, এমনকি কক্ষপথগুলোর দূরত্বও নির্দিষ্ট। পরমাণুতে ইলেকট্রন শক্তি অর্জন করে নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে লাফ দিতে পারে। আবার শক্তি নিঃসরণ করে উচ্চ শক্তিস্তর থেকে চলে যেতে পারে নিম্ন শক্তিস্তরে। এভাবেই ফোটন শোষণ বা নিঃসরণ করে পরমাণু। অর্থাৎ এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম লাফের কারণেই পরমাণু বিকিরণ নিঃসরণ করে, বললেন বোর। কিন্তু পরমাণুর ভেতর কেন এসব কার্যকলাপ ঘটে, তার সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ দেখাতে পারেননি তিনি। ইলেকট্রনের এই কোয়ান্টাম লাফ আসলে কী? এর পেছনে কি কোনো বল কাজ করে? বোরের মডেলে তার উত্তর নেই। জিম্যান ইফেক্ট ও স্টার্ক ইফেক্টের ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না এ মডেলে (কোনো চুম্বকীয় ক্ষেত্রে বর্ণালি রেখা বিভক্ত হয়ে যাওয়াকে বলা হয় জিম্যান ইফেক্ট এবং কোনো বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে বর্ণালি রেখা বিভক্ত হওয়াকে বলে স্টার্ক ইফেক্ট)। পরমাণুই সব পদার্থের গাঠনিক একক। তাই সেটা কীভাবে কাজ করে, ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর কীভাবে চলাচল করে, এর বলবিদ্যা বা মেকানিকস কী, সেগুলো নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী চিন্তাভাবনা করছিলেন। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছিলেন না কেউ।
হেলিগোল্যান্ড অনেকের কাছে হেলগোল্যান্ড নামেও পরিচিত। উত্তর সাগরের বুকে জেগে ওঠা জার্মানির একমাত্র দ্বীপ। মূল ভূখণ্ড থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৬৯ কিলোমিটার। আয়তন এক বর্গকিলোমিটারের কিছুটা কম।
গুরুতর অসুস্থ হলেও হাইজেনবার্গের মাথায় তখন সেটা সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁর ধারণা, ধাঁধাটির সমাধানের প্রায় দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরে ভাবছেন। এসব ভাবনাচিন্তার সঙ্গে গাণিতিক হিসাব কষে অবশেষে একটা দিশা পেয়েছেন বলে মনে হলো তাঁর। এটাই হয়তো ইলেকট্রনের এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে কোয়ান্টাম লাফের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে। তবে তাঁর সমাধানটি বেশ দুঃসাহসী। একদম স্রোতের বিপরীতে। কারণ, এটি সমাধানের জন্য অন্যদের মতো কয়েক শতক ধরে চলে আসা নিউটোনিয়ান বলবিদ্যার আশ্রয় নেননি তিনি। তার কারণও আছে। হাইজেনবার্গের জোরালো বিশ্বাস, পরমাণুর গহিনে আইজ্যাক নিউটনের বলবিদ্যা অচল। কাজেই অতি খুদে কণার গভীরে জমাট বাঁধা সমস্যাটির সমাধানে নতুন কোনো পথে হাঁটতে হবে।
সে পথেই হাঁটছিলেন হাইজেনবার্গ। জিনিয়াসদের চিরচেনা ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রমে নতুন একটা ধারণা গড়ে তুলতে লাগলেন। শুরুতে তার জন্য তেমন জটিল কোনো গণিতও প্রয়োজন হলো না। তবে ধারণাটি বিকশিত করতে গিয়ে কোনো ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ পরমাণুর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটি ফাংশন হিসেবে বর্ণনা করতে হলো তাঁকে। কিন্তু ফাংশনগুলো চিরায়ত বলবিদ্যার সমীকরণে বসাতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। তাতে যে ফলাফল পাওয়া গেল, তাকে আসলে স্রেফ জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। হিসাব কষতে গিয়ে দেখা গেল, একক সংখ্যাগুলো দ্রুতই একেকটা সংখ্যার সিরিজে পরিণত হচ্ছে। প্রচলিত বীজগণিত দিয়ে সেটা সমাধান করতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সমাধানের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। বিরক্তির একশেষ। ধৈর্য হারাতে লাগলেন হাইজেনবার্গ। অপর দিকে মারাত্মক হে ফিভারেও পর্যুদস্ত দেহ-মন। কোনো একটি পরিবর্তন দরকার বলে ভাবলেন। শহরের কোলাহল ছেড়ে পালাতে চাইলেন। দূরে, বহুদূরে কোথাও।
জার্মানির গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় হাইজেনবার্গের বস নামকরা পদার্থবিদ ও গণিতবিদ ম্যাক্স বর্ন। তাঁর সামনে জ্বরগ্রস্ত, ভাঙাচোরা চেহারা নিয়ে একদিন হাজির হলেন হাইজেনবার্গ। অবস্থা দেখে বিশেষ ছুটি মঞ্জুর করলেন বর্ন। একটানা দুই সপ্তাহ।
পরাগরেণুর অত্যাচার ও শহুরে কোলাহল থেকে বাঁচতে রাতেই ট্রেন চেপে বসলেন হাইজেনবার্গ। দিনটি ছিল ৭ জুন, রোববার। প্রথম গন্তব্য ক্রুকসহেভেন বন্দর। পরদিন সকালে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় বন্দরে পৌঁছান তিনি। নাশতা সেরে সেখান থেকে ফেরি ধরলেন। এবার গন্তব্য হেলিগোল্যান্ড।
২.
হেলিগোল্যান্ড অনেকের কাছে হেলগোল্যান্ড নামেও পরিচিত। উত্তর সাগরের বুকে জেগে ওঠা জার্মানির একমাত্র দ্বীপ। মূল ভূখণ্ড থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৬৯ কিলোমিটার। আয়তন এক বর্গকিলোমিটারের কিছুটা কম। দ্বীপটির নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কেউ বলেন, মধ্যযুগে জার্মান ভাষায় এটি পরিচিত ছিল ‘হোলি ল্যান্ড’ বা পবিত্র ভূমি নামে। সেখান থেকে কালক্রমে এ নামের উৎপত্তি। কিংবদন্তি আছে, এককালে এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল ভয়ংকর জলদস্যুরা। তখন দ্বীপটিতে নাকি মড়ার খুলি আর হাড়ের ক্রসচিহ্নের পতাকা উড়ত পতপত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে ঘাঁটি গাড়ে জার্মান সেনাবাহিনী। যুদ্ধের পর থেকে সেটা পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। নির্জনতা আর মুক্ত বাতাসের লোভে অনেকে মূল ভূখণ্ড থেকে ছুটে যান সেখানে।
দ্বীপটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সেটা পাথুরে। রুক্ষ, অনুর্বর। সেখানে গাছ জন্মে না বললে চলে। তাই প্রায় ফুল বা পরাগরেণুমুক্ত। খোলা সাগরের নির্মল হাওয়া আর এই পরাগরেণুহীনতা হে ফিভার থেকে সুস্থ করে তুলবে বলে আশা ছিল হাইজেনবার্গের। সঙ্গে পরমাণুর চলমান রহস্য নিয়ে নিবিড়ভাবে ভাবার আশা করছিলেন।
হাইজেনবার্গের তখন বিভিন্ন পরীক্ষায় পরমাণুর কিছু মাপজোখের একটা তালিকা ছিল। সেগুলো কাজে লাগালেন হাইজেনবার্গ। ‘মাঝখানে’র ব্যাপারটা উল্লেখ না করে একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য কোয়ান্টাম দশা থেকে আরেক কোয়ান্টাম দশার রূপান্তরের বর্ণনা করতে গাণিতিক পরিভাষা ব্যবহার করলেন।
হাইজেনবার্গ যখন দ্বীপে পৌঁছালেন, তখন তাঁর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হোটেলের কর্ত্রী ভাবলেন, হাইজেনবার্গ নিশ্চয়ই কোথাও হামলার শিকার হয়েছেন। যুদ্ধ–পরবর্তী জার্মানিতে সেটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। নিজের ব্যাগে সামান্য কিছু জিনিস এনেছেন হাইজেনবার্গ। কিছু পোশাক, এক জোড়া হাইকিং বুট। বিখ্যাত জার্মান কবি, নাট্যকার গ্যেটের লেখা ওয়েস্ট-ইস্টার্ন ডিভান বইয়ের একটা কপি। আর আছে ইলেকট্রনের কক্ষপথ নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক হিসাব-নিকাশের খাতা। এটাই এখন তাঁর কাছে মহামূল্যবান।
হাইজেনবার্গকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হলো দোতলায়। দ্বীপের লালরঙা পাথুরে ক্লিফের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে ঘরটি। সামনেই খোলা বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে সাগর পেরিয়ে আসা দূরদেশের বাতাস জাপটে ধরে। নিমেষে অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে গা জুড়িয়ে দেয়। প্রসন্ন করে মনও।
হেলিগোল্যান্ড দ্বীপে প্রতিদিন কখনো বারান্দায় বসে, কখনো সাগরতীরে হেঁটে বেড়ান কিংবা দ্বীপের দক্ষিণে ছোট ছোট শৃঙ্গ বেয়ে উঠে সময় কাটান হাইজেনবার্গ। কিংবা সাগরের ঢেউ পেরিয়ে সাঁতরে চলে যান পাশের ছোট্ট দ্বীপে। কখনো খুলে বসেন গ্যেটের গীতিময় কবিতার সংকলন ওয়েস্ট-ইস্টার্ন ডিভান-এর পাতা। পারস্যের মধ্যযুগের কবি হাফিজের অনুপ্রেরণায় ইসলামের প্রতি গ্যেটের ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে বইটিতে। আরবি ‘দিয়ান’ থেকে এসেছে ‘ডিভান’ শব্দটি। হাইজেনবার্গ বিড়বিড় করে আওড়ান বইটির প্রিয় কোনো পঙ্ক্তি। প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে একটা কথাও খরচ করেন না। এ রুটিনের বাইরে আরেকটি কাজ করেন সারা দিন, সারা রাত—মগজের কোষে বয়ে আনা পরমাণুর রহস্যের কথা ভাবেন, যতক্ষণ জেগে থাকেন।
হেলিগোল্যান্ড হাইজেনবার্গের প্রিয় জায়গা। তিনি সব সময় প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় খুঁজে বেড়ান—পাহাড়ে, বনজঙ্গলে কিংবা নদী, হ্রদ বা সাগরের মতো বহমান পানির কাছাকাছি। যেখানে কোলাহল নেই, শহুরে ব্যস্ততা নেই, সবকিছু নিস্তব্ধ। সেই নেশায় একসময় ভারতের দার্জিলিংয়েও এসেছিলেন, হিমালয়ে হাইকিং করতে।
প্রকৃতি তাঁর রোগ শুষে নিতে থাকে। ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে তাঁর শরীর। নাক খুলতে শুরু করে। কেটে যেতে থাকে মনের জমাট মেঘ। গটিঙ্গেনে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে প্রথাগত চিন্তাভাবনায় গভীরভাবে ডুবে থাকতেন। কিন্তু এখানে এসে পেলেন দিগন্তবিস্তৃত বাধাহীন দৃষ্টিভঙ্গি। মহাবিশ্বের অসীমত্বের কাছে মানুষ কত ছোট, কত তুচ্ছ; তা অনুভব করলেন হাইজেনবার্গ। একবার হাইকিংয়ে গিয়ে নীলস বোর তাঁকে বলেছিলেন, ‘যাঁরা সাগরের ওপারে তাকান, অসীমত্বের খানিকটা হয়তো তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারেন।’ হেলিগোল্যান্ডের নির্জন সৈকতে দাঁড়িয়ে গুরু বোরের কথা হৃদয় দিয়ে অনুভব করলেন হাইজেনবার্গ। সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণমান গ্রহগুলোর মতো করে পরমাণুকে কল্পনা করা কতটা সরলীকরণ, তা–ও বুঝতে পারেন। পরমাণু তো তার চেয়ে জটিল। ইলেকট্রন বাঁধাধরা কোনো সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে থাকতে পারার কথা নয়—ভাবেন হাইজেনবার্গ। এভাবে কোয়ান্টাম লাফের জটিল ধাঁধার জট ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে তাঁর কাছে।
হাইজেনবার্গের মনে পড়ল, গটিঙ্গেনে কেউ একজন, সম্ভবত উলফগ্যাং পাউলি একবার বলেছিলেন, পরমাণু বা এ রকম কোনো খুদে সিস্টেমের মধ্যে কী ঘটছে, তা খুঁজে বের করার একটিমাত্র উপায় আছে। সেটা হলো, পরিমাপ করে দেখা। কোনো পরমাণুর কোয়ান্টাম দশা মাপা যায়, তারপর তার নতুন দশা নিশ্চিত করতে তাকে আবারও মাপা যায়। সে সময় পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ইলেকট্রন হুট করে উদয় হয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায় হুট করেই। একদম ভুতুড়ে ব্যাপার। কোনো কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বা সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কেবল তাদের অবস্থান ও ভরবেগ জানা যায়। অর্থাৎ তাদের অস্তিত্ব থাকে। আরও সহজ করে বলা যায়, পরমাণুর এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে তাদের কোয়ান্টাম লাফের সময় কেবল তাদের বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায়। বাকি সময় যেন তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এক মিথস্ক্রিয়া থেকে আরেক মিথস্ক্রিয়া বা এ দুটো দশার মাঝখানে ইলেকট্রন কোথায় থাকে? তখন কী ঘটে? আবার এই ‘মাঝখানে’ কথাটির অর্থ কী?
১৯৩৯ সালে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হেলিগোল্যান্ডে আবারও ঘাঁটি গাড়ে জার্মান সেনাবাহিনী। এবার হিটলারের নাৎসি বাহিনী। মিত্রবাহিনীর কাছে যুদ্ধে হিটলার আত্মসমর্পণ করেন ১৯৪৫ সালের ৭ মে।
গটিঙ্গেনে পদার্থবিদদের গ্রুপের ধারণা ছিল, পরমাণু তথা ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে পরিমাপের বাস্তবতাই হলো একমাত্র বাস্তবতা। কাজেই এ–সংক্রান্ত কোনো ভৌত তত্ত্বের ক্ষেত্রে পরিমাপযোগ্য বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত। শুরুতে ধারণাটি মেনে নিতে ইতস্তত হয়েছিল হাইজেনবার্গের, তবে পরে তা মানতে বাধ্য হন।
হাইজেনবার্গের তখন বিভিন্ন পরীক্ষায় পরমাণুর কিছু মাপজোখের একটা তালিকা ছিল। সেগুলো কাজে লাগালেন হাইজেনবার্গ। ‘মাঝখানে’র ব্যাপারটা উল্লেখ না করে একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য কোয়ান্টাম দশা থেকে আরেক কোয়ান্টাম দশার রূপান্তরের বর্ণনা করতে গাণিতিক পরিভাষা ব্যবহার করলেন। সেটি করতে গিয়ে অদ্ভুত ধরনের গাণিতিক ব্যাপার আমদানি করতে হলো তাঁকে। সেটা সংখ্যার টেবিল। প্রতিটি সংখ্যার টেবিল এ ধরনের রূপান্তর বর্ণনা করে। প্রতিটি টেবিল একটার সঙ্গে আরেকটা গুণ করে বেশ ভালো ফল পেলেন হাইজেনবার্গ। তবে সে জন্য নতুন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হলো তাঁকে। অসংখ্যবার কাটাকাটি, ভুল হিসাব, সংশোধনের পর সমাধানের একটা বেশ জুতসই উপায় খুঁজে পেলেন তিনি। সেটা নতুন করে শিখতেও হলো। গটিঙ্গেনে ফিরে গিয়ে তিনি জানতে পারবেন, এ পদ্ধতির নাম ম্যাট্রিক্স গণিত। এর বিশেষত্ব হলো, a গুণন b এবং b গুণন a সমান নয়। অর্থাৎ a×b = b×a নয়।
এভাবেই একসময় পৌঁছে গেলেন চূড়ান্ত সমাধানে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত তিনটা। তাঁর গায়ের জ্বর হয়তো সেরে গেছে অনেক আগে, কিন্তু মনে তখন উত্তেজনার জ্বর বইছে। ছটফট করে কাটালেন বাকি রাত। একরত্তি ঘুমাতে পারলেন না।
খুব ভোরে ঘর ছেড়ে বেরোলেন হাইজেনবার্গ। হাঁটতে লাগলেন দ্বীপের দক্ষিণে। গন্তব্য খাড়া একটা পাথুরে শৃঙ্গ। যার উচ্চতা প্রায় ১৮০ ফুট। পাহাড়ে ওঠার অভ্যাস ছোটবেলা থেকে। তাই চূড়ায় উঠে গেলেন তরতর করে। অন্ধকার ভেদ করে সকালের প্রথম আলো ঠিকরে পড়ল চারদিকে। রাতের জমাট রহস্যের পর্দা ছিঁড়ে গেল। ঠিক যেন পরমাণুর রহস্য ভেদ করার মতো। সেই মোহনীয় দৃশ্য চূড়ায় বসে উপভোগ করলেন হাইজেনবার্গ। একসময় নেমে এলেন নিচে।
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একে বলা হয় সবচেয়ে ভয়ংকর পবর্তারোহণ। কারণ, পরমাণুর নতুন তত্ত্বটির অস্তিত্ব তখন একমাত্র হাইজেনবার্গের মগজে। আর কেউ জানে না তার খবর। অচিরে যার নামকরণ হবে কোয়ান্টাম মেকানিকস বা ম্যাট্রিক্স মেকানিকস। তিনি যদি সেদিন সেখান থেকে পা ফসকে পড়ে যেতেন, তাহলে তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম মেকানিকসের তত্ত্বও হারিয়ে যেত চিরতরে।
৩.
সৌভাগ্যের ব্যাপার, হেলিগোল্যান্ড থেকে ভালোয় ভালোয় গটিঙ্গেনে ফিরে এলেন হাইজেনবার্গ। তত দিনে তিনি পুরোপুরি সুস্থ। কিছুদিন পর তাঁর নতুন তত্ত্ব জার্মানির নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হলো। এর মাধ্যমে খুলে গেল পরমাণুর বহুল আলোচিত বেশ কিছু রহস্যের জট।
বিজ্ঞানী নীলস বোরের সেরা ছাত্রদের একজন এই হাইজেনবার্গ। কোপেনহেগেনে বোরের গড়ে তোলা স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর কাটিয়ে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছেন।
১৯৩৯ সালে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হেলিগোল্যান্ডে আবারও ঘাঁটি গাড়ে জার্মান সেনাবাহিনী। এবার হিটলারের নাৎসি বাহিনী। মিত্রবাহিনীর কাছে যুদ্ধে হিটলার আত্মসমর্পণ করেন ১৯৪৫ সালের ৭ মে। যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া বিপুল গোলাবারুদ, অবিস্ফোরিত আর্টিলারি শেল ও টর্পেডো দ্বীপটির একটি সেলারে জড়ো করল বিজয়ী ব্রিটিশ বাহিনী। যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৭ হাজার ৭০০ টন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণটি ছিল জাপানের হিরোশিমা শহর ধ্বংসকারী পারমাণবিক বোমার শক্তির প্রায় অর্ধেক। এত শক্তিশালী বিস্ফোরণেও দ্বীপটি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল সাগরে মাথা তুলে। তবে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সদ্য আবিষ্কৃত তত্ত্ব মাথায় নিয়ে প্রায় ২৩ বছর আগে হাইজেনবার্গ যে ছোট্ট পাহাড়চূড়ায় উঠেছিলেন, তা সশব্দে ভেঙে পড়ল সাগরের বুকে।
অবশ্য কোয়ান্টাম মেকানিকসের জয়যাত্রা কখনো থামেনি। একদিন সেটাই স্পর্শ করে পদার্থবিজ্ঞানের এভারেস্টের চূড়া। হয়ে ওঠে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি।