মহাকর্ষ না থাকলে কী হতো?

অসুখে না পড়লে সুস্থতার মূল্যটা ঠিক বোঝা যায় না। একইভাবে আমাদের এই মহাবিশ্ব কতোটা সুন্দরভাবে চলছে, সেটা আমরা ভুলে যাই। অসুস্থতার মতোই মহাবিশ্বের নিয়ম-কানুনে কোথাও যদি একটু গোলমাল হতো, তাহলে বুঝতে পারতাম আমরা কতটা ভালো আছি।

সামান্য একটা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কিংবা একটা ধ্রুবক যদি এদিক-ওদিক হয়ে যায়, তাহলে দেখা যাবে সেই কারণে এই মহাবিশ্ব গ্রহ, নক্ষত্র, অণু-পরামাণু বা জীবনের গঠন সবকিছুই মুহূর্তে হয়ে যাচ্ছে এলোমেলো।

বর্তমানে আমরা প্রকৃতির চারটা মৌলিক বল সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানি। মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল। এর মাঝে মহাকর্ষ ছাড়া বাকি তিনটি বলই কাজ করে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে, অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরের পারমাণবিক পর্যায়ে। একমাত্র মহাকর্ষই ব্যতিক্রম। এ বলের শক্তি অন্যান্য বলের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু এর বিস্তৃতির কোনো পরিসীমা নেই। পুরো মহাবিশ্ব জুড়েই মহাকর্ষ ছড়িয়ে আছে। কোন বস্তুর অতি সামান্য ভর থাকলেও সেটা মহাবিশ্বের অন্যান্য বস্তুর দ্বারা প্রভাবিত হয়। সহজ করে বললে, মহাকর্ষ কাজ করে তার ওপর।

মহাকাশ জুড়ে এই যে রাশি রাশি গ্রহ, নক্ষত্র, অন্যান্য বস্তু তার গঠনের পিছনে যে বলটা সবচেয়ে বেশি দায়ী, সেটা মহাকর্ষ। দৈনন্দিন জীবনে অন্য কোনো বলের প্রভাব তেমন একটা টের না পেলেও, মহাকর্ষের প্রভাব প্রতিটা সময় আমরা বুঝতে পারি। সবচেয়ে পরিচিত এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে রহস্যময় মৌলিক বল এটা। এখন মহাবিশ্বে যদি এই মহাকর্ষের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আসলে কী হতো?

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যাণ্ডে অবস্থিত টাওসন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ জেমস ওভারড্যুন এই প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, মহাকর্ষ না থাকলে এই পুরো মহাবিশ্ব হতো সমতল ও বৈচিত্র্যহীন।

ওভারড্যুন কেন এই উত্তর দিলেন, তা জানতে মহাকর্ষ বিষয়টা আমাদের একবার বুঝতে হবে। প্রায় ১০০ বছর আগে আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্বে দেখান, আমাদের পুরো মহাবিশ্বটা বিশাল এক স্থান-কালের জটিল চাদর। বস্তুর ভর এই চাদরে তৈরি করে বক্রতা। সহজ করার জন্য বলি, কাপড়ের চাদর চারপাশ থেকে টান টান করে বেঁধে এর ওপরে ভারী কিছু রাখলে যেমন নিচের দিকে বেঁকে যায় অনেকটা তেমন। এই যে স্থান-কালের বক্রতা তৈরি হয়, এটাই মূলত মহাকর্ষ শক্তি আকারে পুরো চাদর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

নক্ষত্র ধ্বংসের পর সেখান থেকে বিস্ফোরিত ধুলিকণা, মৌল কিছু কিছু করে একত্রিত হয় স্থান-কালকে বাঁকাতে থাকে। বক্রতার কারণে আরও অণু-পরমাণুর এসে জমা হয় সেখানে। অণু-পরমাণুর যোগ হওয়াতে ভর বাড়ে। ফলে আরও বেঁকে যায় স্থানকাল। চলতেই থাকে এভাবে। এদিকে জমা হওয়া অণু-পরমাণুর মাঝে বাড়তে থাকে চাপ। অন্যকথা বললে, বাড়তে থাকে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ। ভরের পরিমাণ পর্যাপ্ত হলে একসময় এই অণু-পরামাণুর স্তুপই রূপ নেয় গ্রহ কিংবা নক্ষত্রের মতো মহাজাগতিক বস্তুতে।

এখন চিন্তা করুন, মহাকর্ষ বল যদি না থাকত, অর্থাৎ স্থান-কালের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি না হতো, তাহলে কি গ্রহ নক্ষত্র তৈরি হতো? আমাদের এখনকার পদার্থবিজ্ঞানের সুত্র বলে সেটা সম্ভব হতো না। সমতল সেই মহাকাশ শুধু তড়িৎচুম্বকীয় বল, সবল আর দুর্বল নিউক্লিয় বল এতো এতো বিশাল বিশাল গ্রহ নক্ষত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট হতো না। পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে হয়ত ছড়িয়ে থাকত সব অণু-পরমাণু। তাহলে তখন আর আমার বা আপনার অস্তিত্বও থাকত না।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স