১৮৯৫ সালের ঘটনা। আইনস্টাইনের বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। সবকিছুতে ছোঁক ছোঁক করার বয়স। অনেকে বয়সটাকে বলেন ‘সুইট সিক্সটিন’। তা সেই মিষ্টি, রোমান্টিক বয়সে আইনস্টাইন মিষ্টি–মধুর ছিলেন কি না, জানি না। তবে ছোটবেলা থেকেই তাঁর কৌতূহল ছিল প্রকৃতির রহস্যের প্রতি। সেসবের জবাব খুঁজতেন বিজ্ঞানে।
এমনিভাবে একদিন অদ্ভুত এক কল্পনার আশ্রয় নিলেন। ভাবলেন, আলোর পাশাপাশি সমান গতিতে চললে ব্যাপারটা কেমন হবে কিংবা আলোর পিঠে চড়ে বসলে কী হবে? ঘোড়ার পিঠে যেভাবে মানুষ চেপে বসে, সে রকম আরকি! বাস্তবে আলোর পিঠে ওভাবে সওয়ার হওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মনে মনে তো আকাশকুসুম ভাবাই যায়! আইনস্টাইনও কল্পনা করলেন সে কথা।
নিউটনের সূত্রমতে, যথেষ্ট জোরে ছুটতে পারলে যেকোনো কিছুর নাগাল পাওয়া সম্ভব। আপনি যদি গাড়িতে থাকেন, তাহলে পাশ দিয়ে আরেকটি গাড়ি একই বেগে চলতে থাকলে কী হবে? তখন মনে হবে, পাশের গাড়িটা মোটেও চলছে না, স্থির। কিন্তু কেউ যদি আলোকরশ্মির পিঠে চড়ে বসে, তাহলে কী ঘটবে? তাহলে কি পাশ দিয়ে চলা আরেকটি আলোকরশ্মিকেও থেমে আছে বলে মনে হবে?
নিউটনের বলবিদ্যা অনুযায়ী, এর উত্তর—হ্যাঁ। এভাবে যদি কোনোভাবে আলো বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের পিঠে সওয়ার হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে আলোটা স্থির দেখতে পাওয়ার কথা। বরফে হিমায়িত সাগরে জমে যাওয়া ঢেউয়ের মতো। সেটা হবে অচল, অনড় তরঙ্গ। বাস্তবে সেটি কি হওয়া সম্ভব?
ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তত্ত্ব থেকে এর উত্তর পাওয়া যায় একদমই আলাদা। ১৮৬৩ সালের দিকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা আবিষ্কার করেছিলেন এই স্কটিশ বিজ্ঞানী। আবিষ্কারটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তিনি দেখতে পান, বিদ্যুৎ, চুম্বক ও আলোর মধ্যে দারুণ একটি সম্পর্ক আছে। দেখা গেল, আলো হলো অদৃশ্য বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একটি তরঙ্গ। পরস্পরের সমকোণে থাকা অদৃশ্য বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ঢেউ এই তরঙ্গকে স্থানের ভেতর দিয়ে বয়ে নিয়ে চলে। আরও জানা গেল, আলোর গতি অসীম নয়, সসীম। আলোর বেগ নির্দিষ্ট। শূন্য মাধ্যমে যা সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো বলে, কেউ কখনোই কোনো আলোকরশ্মির নাগাল পাবেন না। যত জোরেই ছোটুন না কেন, আলো সব সময় একই বেগে চলতে থাকবে। কাজেই ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে এ রকম স্থির তরঙ্গ বা ঢেউয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। সোজা কথায়, আলো এ রকম স্থির হতে পারে না। সেটা অসম্ভব।
মোদ্দাকথা, আলোর চরিত্র সম্পর্কে নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের কথার মিল নেই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, দুটির যেকোনো একটি সঠিক। হয় নিউটন, নয়তো ম্যাক্সওয়েল। এই দুইয়ের যেকোনো একটি অবশ্যই ভুল। কিন্তু কোনটি? সে এক অদ্ভুত প্যারাডক্স।
আলো যদি ধরা না যায় বা তার নাগাল যদি না পাওয়া যায়, তাহলে মহাবিশ্বে আমাদের দৈনন্দিন অন্যান্য গতির তুলনায় আলোর গতি প্রায় অসীমের মতো। কারণ, আলোর গতি আসলে অকল্পনীয়।
কৈশোর পার হয়ে যৌবনে এসে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের ওপর ভর করে আইনস্টাইন যুক্তি দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তিনি বুঝতে পারলেন, আলোর নাগাল পাওয়া কখনো সম্ভব নয়। আসলে তখন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আর কাজ করবে না। আপনার পাশের আলোকরশ্মিকেও তখনো আলোর বেগেই চলছে বলে মনে হবে। আপনি কোথায় আছেন বা কত জোরে ভ্রমণ করছেন, তা আলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। মানে হলো, শূন্যমাধ্যমে আলো সব সময় চলবে একই বেগে।
আইনস্টাইন তাঁর এই চিন্তা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন আরও পরে, সেই ১৯০৫ সালে। সে বছর ২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিখ্যাত এক বৈজ্ঞানিক জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তাঁর। শিরোনাম—‘অন দ্য ইলেকট্রোডায়নামিকস অব মুভিং বডিজ’। এতে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন, তা মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমাদের বহুদিনের ধারণাকে ধূলিসাৎ করে দেয়।
আলো যদি ধরা না যায় বা তার নাগাল যদি না পাওয়া যায়, তাহলে মহাবিশ্বে আমাদের দৈনন্দিন অন্যান্য গতির তুলনায় আলোর গতি প্রায় অসীমের মতো। কারণ, আলোর গতি আসলে অকল্পনীয়। তাই আমরা যে গতিতেই চলি না কেন, আলোর গতি সব সময়ই আমাদের কাছে প্রায় অসীমের মতো মনে হবে। কারণ, আলোর গতির কাছে আমাদের গতি নগণ্য। তুচ্ছ গতি। কাজেই ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে আইনস্টাইন সিদ্ধান টানেন, আলোর গতি সবার কাছে ধ্রুব ও সমান হওয়া উচিত। আলোর গতি যে মাপছে, তার গতি যা–ই হোক না কেন, এর কোনো নড়চড় হবে না, অর্থাৎ আলোর বেগ পর্যবেক্ষকের গতির সাপেক্ষে নিরপেক্ষ। আবার তা সব দিকে একই থাকবে। এটিই আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রথম স্বতঃসিদ্ধ বা স্বীকার্য। দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধটি হলো, মুক্তভাবে চলমান সব পর্যবেক্ষক বা দর্শকের কাছে বিজ্ঞানের সব সূত্র সব সময় একই রকম হওয়া উচিত। এগুলো আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তি।
প্রথম স্বীকার্যটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পদার্থবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে, গতি মানে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো কিছুর একটা দূরত্ব পাড়ি দেওয়া। ধরা যাক, একটি গাড়ি ১ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার যেতে পারে। তাহলে গাড়িটির গতি ঘণ্টায় ৬০ কিমি বা ৬০ কিমি/ঘণ্টা। একে আরও ছোট একক যেমন মিটার/সেকেন্ডেও হিসাব করা যায়। ধরা যাক, একটি বাস ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার এবং আরেকটি বাস ২০ কিলোমিটার বেগে একই দিকে চলছে। এখন দ্বিতীয় বাসে থাকা কোনো দর্শকের কাছে প্রথম বাসটির আপেক্ষিক গতি মনে হবে ১০ কিলোমিটার। আবার বাস দুটি যদি বিপরীত দিকে চলে, তাহলে বাসের ভেতরে থাকা দর্শকের কাছে প্রথম বাসটির আপেক্ষিক গতি ৫০ কিলোমিটার মনে হবে। বাস দুটি যদি একই বেগে (৩০ কিমি) পাশাপাশি চলতে থাকে, তাহলে রাস্তায় দাঁড়ানো যেকোনো দর্শকের কাছে মনে হবে বাস দুটির গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু বাসের যাত্রীদের কাছে বাস দুটিকে মনে হবে পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির। পৃথিবীও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। তবু আমাদের কাছে একে স্থির মনে হয়। কারণ, আমরা নিজেরাও পৃথিবীর সঙ্গে সেকেন্ডে ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে চলমান।
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আলোর ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটবে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আলোর বেগ হবে পর্যবেক্ষকের গতির সাপেক্ষে নিরপেক্ষ। তা সব দিকেই একই থাকবে। এ কথার অর্থ হলো, আলোর দিকে কিংবা বিপরীত যেদিকেই যাওয়া যাক না কেন, আলোর গতি সব সময়ই থাকবে একই। মানে সব সময় সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার (আসলে ২৯৯৭৯২৪.৫৮ কিমি) থাকবে। কোনো নড়চড় হবে না। সোজা কথায়, কেউ যদি আলোর গতির দিকে সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার যায়, তাহলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে আলোর গতিবেগ কমে সেকেন্ডে ৩০০,০০০-১০০ = ২৯৯,৯০০ কিলোমিটার হওয়ার কথা কিংবা আলোর বিপরীত দিকে গেলে তার গতি বেড়ে ৩০০,০০০+১০০ = ৩০০,১০০ কিলোমিটার হওয়ার কথা। নিউটনীয় গতিবিদ্যার ধারণা আমাদের এমনটিই হওয়ার কথা বলে। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, এর কোনোটাই হবে না। বরং আলোর গতি সব ক্ষেত্রেই থাকবে সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার। একমাত্র আলো আপেক্ষিকতা দিয়ে প্রভাবিত হবে না, সব সময় পরম থাকবে। আইনস্টাইন ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব মেনে নিলেন, বিসর্জন দিলেন নিউটনের গতিসূত্র।
আইনস্টাইনের কথা যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রত্যেক দর্শক বা পর্যবেক্ষক আলোর একই গতি মাপতে পারবেন, যদি দূরত্ব ও সময়ের পরিমাপে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। সেটা আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ওলট–পালট করে দেওয়ার মতো। ধরা যাক, আপনি একটি রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছেন। পাশ দিয়ে একটা ট্রেন ধ্রুবগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও ধরা যাক, ট্রেনের বগিতে একটি সাধারণ ঘড়ি আছে। ঘড়িটি একটি লেজার আলো দিয়ে তৈরি। সেটি ট্রেনের বগির ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বভাবে লেজার রশ্মি ছুড়ে দেয়। মেঝে ও ছাদে—দুই জায়গাতেই আয়না রাখা আছে। আয়না দুটি লেজার রশ্মিকে প্রতিফলিত করে পাঠিয়ে দেয় বিপরীত দিকে। মানে ছাদ থেকে মেঝেতে এবং মেঝে থেকে ছাদে লেজার রশ্মি প্রতিফলিত হয়। ধরে নিচ্ছি, লেজার রশ্মির বগির ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত একবার দূরত্ব পাড়ি দিলে ঘড়িটি একবার টিক করে। মানে এক সেকেন্ড সময় লাগে। এভাবে ঘড়িটি অনবরত টিক টিক করছে।
মানস পরীক্ষাটির জন্য আমাদের আরও কিছু ব্যাপার কল্পনা করে নিতে হবে। ধরে নিই, ট্রেনের বগিটি স্বচ্ছ, অর্থাৎ বগির ভেতরে কী হচ্ছে, তা ট্রেনের বাইরে দাঁড়িয়ে আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার। তাহলে ট্রেনের ওই বিশেষ ঘড়িও বাইরে থেকে দেখতে পাবেন আপনি। স্বাভাবিকভাবেই আলোর গতির তুলনায় ট্রেনের গতি তুচ্ছ। ট্রেনের বাইরে থেকে হাওয়া খেতে খেতে ঘড়িটির একটি অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক ব্যাপার আপনার চোখে পড়বে। আপনার কাছে মনে হবে, ঘড়িটি বগির ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে ওঠানামা করছে না, বরং ট্রেনের চলার পথ বরাবর একটা লম্বা ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। সেটা কী রকম, তা–ই ভাবছেন?
ট্রেন তো চলমান। তাই ছাদ থেকে লেজার রশ্মি ছোড়ার মুহূর্ত থেকে মেঝে স্পর্শ করার আগে ট্রেনটি বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাবে। তেমনি মেঝে থেকে রশ্মিটি প্রতিফলিত হয়ে ছাদে আঘাত করার মধ্যবর্তী সময়েও ট্রেনটি আরও সমানে এগিয়ে যাবে। ছাদের আয়নাটিও এগিয়ে যাবে একই সঙ্গে। কাজেই আপনার কাছে মনে হবে আলোটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। অবশ্য ট্রেনের যাত্রীদের কাছে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হবে। তাঁরা আলোকে স্বাভাবিক লম্বালম্বি দূরত্ব পাড়ি দিতে দেখতে পাবেন। কিন্তু ট্রেনের যাত্রীদের তুলনায় আপনার মনে হবে আলো একবার টিক করতে বেশি সময় নিচ্ছে।
ওপরের পরীক্ষাটি কল্পিত হলেও এর মাধ্যমে একটি গভীর সত্য উন্মোচিত হয়। সেটা হলো, কেউ যদি ধ্রুবগতিতে আপনাকে পেরিয়ে যায়, তাহলে তার সময় হয়ে যাবে আপনার তুলনায় ধীরগতির। আপনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো বাস, ট্রেন বা গাড়ির ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেটুকু সময় ধীর হয়, তা অতি অতি ক্ষুদ্র। তাই সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু আলোর গতিতে কোনো কিছু চললে সে প্রভাব আর উপেক্ষা করা যাবে না।
এখান থেকে আরও দেখা যায়, চলমান বস্তুর জন্য স্থানের দূরত্ব সংকুচিত হয়। সেটা হয় গতির দিক বরাবর। তবে সেটা আমাদের জন্য কল্পনা করা কঠিন। আবার আমার সময় ও আপনার সময় এক নয়। মহাবিশ্বের প্রত্যেকের সময় আলাদা। একইভাবে প্রত্যেকের স্থানও আলাদা। পরম সময় ও পরম স্থান বলে কিছু নেই। এর মাধ্যমেই প্রত্যেকের নিজ নিজ মাপে আলোর গতি পাওয়া যাবে একই মানের। মহাবিশ্বে এমন কোনো পটভূমি নেই, যার সাপেক্ষে সবকিছু মাপা যাবে; বরং সবকিছুই নির্ভর করে পর্যবেক্ষক বা দর্শকের আপেক্ষিক গতির ওপর। এ কারণেই আইনস্টাইনের এ তত্ত্বকে বলা হয় আপেক্ষিক তত্ত্ব বা ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’। আবার এই ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’কে বলা হয় ‘বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’। কারণ, এটি বিশেষ গতির ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য। এ ছাড়া পরে একে সাধারণীকরণ করেছেন আইনস্টাইন। সেই তত্ত্বকে বলা হয় ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’।
যা–ই হোক, বিশেষ আপেক্ষিকতায় আলোর গতিই হলো মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা। এর চেয়ে বেশি গতিতে মহাবিশ্বের অন্য কিছু চলতে পারে না। আলোর গতিকেই বলা হয় সেই ভিত্তি পাথর বা মাপকাঠি, যার ওপর গড়ে উঠেছে আমাদের মহাবিশ্ব। অন্যদিকে স্থান ও কাল হলো পরিবর্তনশীল বালুর মতো। তার মানে, আপনি যদি দ্রুত ধাবমান কোনো স্পেসশিপে থাকেন, তাহলে তার ভেতরের ঘড়িগুলোর স্পন্দন পৃথিবীর ঘড়িগুলোর তুলনায় ধীর হবে। যত জোরে ছুটবেন, সময় ধীরগতির হবে তত বেশি। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এই পরিঘটনা বর্ণনা করা হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সময় আসলে কী? এর উত্তর নির্ভর করবে আপনি কতটা জোরে ছুটছেন, তার ওপর।
ধরা যাক, একটা রকেটশিপ আলোর কাছাকাছি গতিতে চলাচল করছে। ভূপৃষ্ঠে বসে টেলিস্কোপে রকেটশিপটা পর্যবেক্ষণ করলে এর ভেতরের সবাই ধীরগতিতে চলছে বলে মনে হবে। সেই সঙ্গে মনে হবে যে রকেটশিপের সবকিছু সংকুচিত হয়ে গেছে। অবশেষে রকেটশিপের সবকিছু ভারী হয়ে উঠবে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, রকেটশিপের ভেতরে থাকা কোনো ব্যক্তির কাছে সবকিছু মনে হবে স্বাভাবিক। ধ্রুবগতিতে কেউ আপনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার কারণে এই আপাতধীরগতিকে বলা হয় টাইম ডাইলেশন বা সময় প্রসারণ। আর স্থানের এই সংকোচনকে বলা হয় লরেন্টজ কন্ট্রাকশন বা সংকোচন। এর প্রভাবটা ভালোভাবে বোঝা যায় টুইন প্যারাডক্সের মাধ্যমে।
আগেই বলেছি, আপেক্ষিতার তত্ত্বে প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের সময়ের মাপ নিজস্ব। অন্যজনের চেয়ে আলাদা। এ থেকেই জন্ম নেয় টুইন প্যারাডক্স বা যমজ বিভ্রান্তি। ধরা যাক, দুই যমজ ভাইয়ের একজন নভোচারী হয়ে মহাকাশ ভ্রমণে গেলেন। তিনি মহাকাশে ভ্রমণ করলেন আলোর গতিতে বা আলোর কাছাকাছি গতিতে। অন্য ভাই রয়ে গেলেন পৃথিবীতে। আলোর গতিতে চলার কারণে প্রথম ভাইয়ের সময় বইবে ধীরগতিতে। পৃথিবীতে ফিরে এসে তিনি দেখতে পাবেন, তাঁর ভাইয়ের বয়স তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে বুড়ো হয়ে গেছেন। সে তুলনায় নভোচারী ভাই রয়ে গেছেন তরতাজা তরুণ। এটি কাল্পনিক একটি পরীক্ষা। প্রশ্ন উঠবে, তত্ত্বটা সঠিক হওয়ার কোনো বাস্তব প্রমাণ আছে?
১৯৭১ সালে আরেকটি পরীক্ষা করেছেন মার্কিন নেভাল অজারভেটরির বিজ্ঞানীরা। এতে দুটি অতি নির্ভুল সিজিয়াম বিম পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল।
২.
আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রমাণ মেলে বেশ কিছু পরীক্ষায়। এর একটি হলো মিউয়ন কণা। এ কণা তৈরি হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মির সংঘর্ষে। যার আয়ু খুবই অল্প। গড়ে মাত্র ১ সেকেন্ডের ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ ভাগের ১ ভাগ। গড়ে ২.২ মাইক্রোসেকেন্ডে মিউয়ন ক্ষয়ে অন্য কণায় পরিণত হয়। এ আয়ু নিয়ে মিউয়ন তৈরি হওয়ার পর যদি আলোর গতিতেও চলে, তাহলে মাত্র ৬০০ মিটার পথ পেরিয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কণাটি পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে তৈরি হওয়ার পর পাড়ি দেয় আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার। এভাবে নেমে আসে একদম ভূপৃষ্ঠে। সমুদ্রসমতলে প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ১০০টি মিউয়ন শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সে জন্যই সেখানে এ কণা অসংখ্যবার শনাক্ত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, এটা কীভাবে সম্ভব?
এর জবাব মেলে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে। এরই মধ্যে জেনেছেন, এ তত্ত্ব অনুসারে কোনো বস্তু বা কণা প্রায় আলোর গতিতে চললে আমাদের চোখে বা সাপেক্ষে তার সময় ধীর হয়ে যাবে। কমে যাবে তার বয়স বাড়ার হার। এমনকি তার চলার পথও সংকুচিত হয়ে যাবে। মিউয়ন কণার ক্ষেত্রেও ঘটে ঠিক সেটাই। তাই কণাগুলো ক্ষয় হওয়ার আগে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে পারে এবং তাদের ভূপৃষ্ঠে দেখা যায়।
এখানেই শেষ নয়, ১৯৭১ সালে আরেকটি পরীক্ষা করেছেন মার্কিন নেভাল অজারভেটরির বিজ্ঞানীরা। এতে দুটি অতি নির্ভুল সিজিয়াম বিম পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। এর একটি রাখা হয়েছিল গবেষণাগারে। আরেকটি ঘড়ি বিমানে করে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল পৃথিবীর চারপাশে। ঘড়িটি ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিরিয়ে আনার পর দেখা যায়, গবেষণাগারের ঘড়ির চেয়ে বিমানে চক্কর খাওয়া ঘড়িটির সময় কিছুটা ধীরগতির হয়ে গেছে। আবার রুশ পদার্থবিদ ইগর নোভিকভের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আরও অদ্ভুত একটা ব্যাপার। সোভিয়েত সালইয়ুত স্পেস স্টেশনের নভোচারীরা টানা এক বছর পৃথিবীর কক্ষপথে চক্কর খেয়ে ১৯৮৮ সালে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। কক্ষপথে তাঁদের গতি ছিল সেকেন্ডে প্রায় ৮ কিলোমিটার। পরে পৃথিবীর ও নভোচারীদের ঘড়ি মিলিয়ে দেখা গেছে, তাঁরা ১ সেকেন্ডের ১০০ ভাগের ১ ভাগ সময় ভবিষ্যতে চলে গেছেন। এগুলোই বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রভাব বা বাস্তব প্রমাণ।
আপেক্ষিকতার আরও পরিণতি হলো, স্থান ও কাল আলাদা কিছু নয়, বরং দুটি মিলে একটি অস্তিত্ব—স্থান-কাল বা স্পেস-টাইম। আইনস্টাইনের এক কালের শিক্ষক হারমান মিনকোভস্কি সেটি আবিষ্কার করেন। ফলে আমাদের মাত্রা তিনটি নয়, চারটি। এর তিনটি হলো স্থান—উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম ও ওপর-নিচ বা ডান-বাঁ, সামনে-পেছনে ও ওপর-নিচ। আরেকটি মাত্রা হলো সময়—অতীত-ভবিষ্যৎ।
বিশেষ আপেক্ষিকতার আরও ফলাফল আছে। শুরুর প্রশ্নে ফেরা যাক। আলোররশ্মি ধরা যায় না কেন কিংবা আলোর সমান গতি অর্জন করা যায় না কেন? মনে করুন, একটা ভারী বস্তু ক্রমেই আলোর গতির কাছাকাছি যাচ্ছে। সেটা করতে গেলে, বস্তুটা ক্রমেই বেশি বেশি বাধার মুখে পড়বে। আর আলোর গতিতে গেলে বস্তুটা যে বাধা পাবে, তার পরিমাণ হবে অসীম। তাই ভারী বস্তুর পক্ষে আলোর গতি অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের পক্ষেও কখনো সম্ভব নয় আলোর গতি বা আলোর কাছাকাছি গতি অর্জন করা। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন করে বসবেন, এই বাধা আসে কোত্থেকে?
ভেবে দেখুন, একটি চায়ের কাপ বা একটি বই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নড়ানো যতটা সহজ, ততটাই কঠিন একটি ফ্রিজ কিংবা এক বস্তা চাল সরানো। কোনো কিছু সরানোর এই বাধা বা প্রতিরোধের আরেক নাম জড়তা। এ জড়তার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানে ভরকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিশ্বাস না হলে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। কোনো বস্তুর ভরের সঙ্গে তার জড়তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই কোনো বস্তুকে যত দ্রুত ধাক্কা দেবেন, তা বাধার মুখে পড়বে তত বেশি। কারণ, বস্তুটার ভর তখন আরও বেশি হয়ে যাবে।
বস্তুটির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র পরিবর্তনীয় বিষয় হলো তার গতির শক্তি বা গতিশক্তি। চলন্ত কোনো বাস বা নিদেনপক্ষে একটি চলন্ত সাইকেলের ধাক্কা খেলে এই শক্তি টের পাবেন! তখন সাইকেলটি বিপুল শক্তিতে আপনাকে ধাক্কা দেবে। আপনিও রাস্তায় পড়ে যাবেন চিৎপটাং হয়ে। এখানে কী পরিমাণ ধাক্কা খেলেন, সেটা হিসাব করতে পারবেন নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র ব্যবহার করে (F=ma, এখানে m হলো সাইকেলের ভর এবং a হলো ত্বরণ। আর F হলো বল বা ধাক্কার পরিমাণ।)।
যা–ই হোক, আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, এর অনিবার্য মানে হলো গতির শক্তির একটা ভর আছে। আর এই ভরই বস্তুকে আলোর গতি অর্জনে বাধা দেয়। আসলে এর মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেন যে শুধু গতির শক্তিরই নয়, বরং সব ধরনের শক্তির একটি কার্যকর ভর রয়েছে। এভাবে প্রমাণ করেন, শুধু শক্তির সমতুল্য ভরই থাকে না, সেই সঙ্গে ভরের মধ্যে শক্তিও থাকে, অর্থাৎ ভর ও শক্তি পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। একটি বিখ্যাত সমীকরণের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন তিনি। সমীকরণটি হলো: E = mc2। E হলো শক্তির পরিমাণ, m বস্তুর ভর এবং c আলোর গতি। এ সমীকরণ অনুসারে, শক্তি হলো ভর ও আলোর বেগের বর্গের গুণফল।
এ সমীকরণের কারণে একসময় বোঝা গেল, ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ফিশন (বিভাজন) প্রক্রিয়ায় দুটি নিউক্লিয়াসে ভাগ করা হলে তাদের যোগফলে কিছুটা কম ভর পাওয়া যাবে। আর এই হারিয়ে যাওয়া ভর থেকে পাওয়া যাবে বিপুল শক্তি, অর্থাৎ ১ কিলোগ্রাম বস্তু থেকে ২০ মিলিয়ন টন টিএনটির সমপরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে। এই সমীকরণের কাঁধে চেপে একসময় পরমাণুর হৃদয় খুঁড়ে কোয়ান্টাম পদার্থবিদেরা বের করে আনেন বিপুল পরিমাণ শক্তি। সেই শক্তির দাপটে ১৯৪৫ সালে তছনছ হয়ে গিয়েছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর।
আবার সূর্য কিংবা নক্ষত্রগুলোতে শক্তি বা আলো তৈরি হচ্ছে কীভাবে, সেটাও জানা সম্ভব হয়েছিল এই সমীকরণের কারণে। ১৯৩৮ সালে জার্মান পদার্থবিদ হ্যানস বেথে বললেন, সূর্যের হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশন প্রক্রিয়ায় একত্র হয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করছে। হাইড্রোজেন বোমাতেও ঘটে এই একই ঘটনা। দুই ক্ষেত্রেই আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ অনুযায়ী, বেরিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। নক্ষত্রগুলো কোটি কোটি বছর কীভাবে আলো আর তাপ ছড়াচ্ছে, এভাবেই বোঝা গেল।
এক কিশোরের ছোট্ট একটি আকাশকুসুম কল্পনার ফলাফল কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, বুঝতে পারছেন?