মহাকর্ষ কী দিয়ে তৈরি

প্রকৃতি শাসন করে মাত্র চারটি বল। এর তিনটি কী দিয়ে তৈরি, কীভাবে কাজ করে—এর সবই জানি আমরা। অথচ যে মহাকর্ষ বল আমাদের অতিপরিচিত, তারই ভেতরের কাহিনি আমাদের আজও অজানা। কী দিয়ে তৈরি মহাকর্ষ? এরও কি কণা আছে? থাকলে, সে কণা শনাক্ত করার উপায় কী?

প্রকৃতির নিগুঢ় রহস্য, মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনার সূচনা সেই আদিম কাল থেকে। কিন্তু আমরা এর চালচিত্র প্রায় সঠিকভাবে বুঝতে শুরু করেছি মাত্র কয়েক শতক আগে। মহাবিশ্ব, সৃষ্টি রহস্য, প্রকৃতির রহস্য সম্পর্কে এখন সবটা না হলেও অনেক কিছুই জানে আধুনিক বিজ্ঞান। গত কয়েক শতকের জ্ঞান একত্রিত করে এখন আমরা জানি, প্রকৃতি তথা মহাবিশ্ব শাসন করছে মাত্র চারটি বল। এই বলগুলো এবং নির্দিষ্ট কিছু বস্তুকণা মহাবিশ্বের একান্নবর্তী সংসার গড়ে তুলেছে। এই চারটি প্রাকৃতিক বলই সবকিছুকে একত্রিত করে রেখেছে।

প্রাকৃতিক সেই চারটি বল হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং মহাকর্ষ। প্রথম তিনটিকে ব্যাখ্যা করা হয় কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে। এ ত্রয়ী বলকে বলা হয় নন-গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স বা অমহাকর্ষীয় বল। আর শেষেরটি—মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটিকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। আরও সঠিকভাবে বললে, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয়, শক্তিশালী ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ব্যাখ্যা করে পরমাণুর মতো অতিক্ষুদ্র জগৎ। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বড় পরিসরের কাঠামো (যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি) ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলে তিনটি বলের ব্যাখ্যায় বলা হয়, এসব বলে বলবাহী অতিপারমাণবিক কণা বিনিময় হয়। বস্তুকণাদের একত্রিত রাখার পেছনে কাজ করে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক বল। এরকম ব্যাখ্যায় স্ট্যান্ডার্ড মডেল এখন পর্যন্ত দারুণ সফল একটি তত্ত্ব। যেমন বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের কথা ধরা যাক। এই বলটি পরমাণুকে একত্রে ধরে রাখে। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনকে। এর বাহক বা বলবাহী কণার নাম ফোটন। অর্থাৎ আলোর কণা।

অন্যদিকে সবল বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল নিউক্লিয়াসে দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে গ্লুয়ন কণার মাধ্যমে। এভাবে কোয়ার্ক কণাদের একসঙ্গে জুড়ে রাখে, একত্রে বেঁধে রাখে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে। সেইসঙ্গে নিউক্লিয়ার ফিশন বা পারমাণবিক বিভাজন এবং পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসা বিপুল শক্তির জন্য দায়ী এ বল।

দুর্বল পারমাণবিক বল দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে ডব্লিউ প্লাস, ডব্লিউ মাইনাস এবং জেড জিরো (W+, W-, Z0) বলাবাহী কণার মিথস্ক্রিয়ায়। শক্তিশালী বলের মতো এটাও কাজ করে শুধু অতিপারমাণবিক (আসলে উপপারমাণবিক) পরিসরে। দুর্বল বলই একমাত্র বল, যা সব কণার ওপর কাজ করে। এমনকি চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনও এ বল অনুভব করে। তবে বলটি কণাদের একত্রে বেঁধে রাখার বদলে অন্য কাজ করে। সেটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোয়ার্কের পরিচয় পাল্টে দেয়। যেমন রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউট্রন চেহারা পাল্টে পরিণত হয় প্রোটন কণায়।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, চতুর্থ বল মহাকর্ষকেও কি এভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ ছড়ায় কীভাবে? এরও কি কোনো বলবাহী কণা আছে?

সে উত্তর দেওয়ার আগে বলে নিই, চরিত্রগত দিক দিয়ে মহাকর্ষ আসলে অন্য তিনটি বলের চেয়ে আলাদা। প্রথমত অন্য তিনটির তুলনায় মহাকর্ষ বহু গুণ দুর্বল। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, বলটি শক্তিশালী পারমাণবিক বলের চেয়ে ১০৩৮ ভাগ দুর্বল। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের তুলনায় ১০৩৬ ভাগ এবং দুর্বল পারমাণবিক বলের তুলনায় ১০২৯ ভাগ দুর্বল। তবু প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বল এই মহাকর্ষ। কারণ এই বল না থাকলে আজকের পরিচিত মহাবিশ্বের একান্নবর্তী সংসার গড়ে উঠতে পারত না কোনোদিন। মহাকর্ষ না থাকলে গোটা মহাবিশ্বে কোনো গ্রহ, নক্ষত্র বা ছায়াপথ থাকত না। স্রেফ কালিমাখা গাঢ় কালো এক অন্ধকার মহাবিশ্ব গড়ে উঠত। মহাবিশ্বে তখন রাজত্ব করত ধুলিকণা আর গ্যাস। আর কিছু নয়।

পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা, অন্য বলগুলোর মতো মহাকর্ষের জন্যও একই ধরনের ব্যাখ্যা আছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তালিকায় মহাকর্ষকে জায়গা দিতে নানারকম জল্পনা-কল্পনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেটি করতে হলে মহাকর্ষের বলবাহী কণার (সহজভাবে বলা যায়, মহাকর্ষ কণা) চরিত্র কেমন হবে, তাও বোঝার চেষ্টা করেছেন।

প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মহাকর্ষ বল

পদার্থবিজ্ঞানের খাতায় মহাকর্ষ কণা এখনও কাল্পনিক। এই হাইপোথেটিক্যাল কণার নাম দেওয়া হয়েছে গ্র্যাভিটন। ইংরেজি শব্দ ‘গ্র্যাভিটি’ থেকে এই ‘গ্র্যাভিটন’ নামকরণ। এর চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তাও হিসেব কষে বের করা হয়েছে। যেমন কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী, যে কণা যত ভারী, সেটি গড়ে উঠতে তত বেশি শক্তি দরকার। সেই সঙ্গে তার আয়ুও হবে ক্ষণস্থায়ী। তাই ওই কণা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। তার দৌড় অতি অল্প দূরত্বে সীমাবদ্ধ। যেমন দুর্বল বলের বাহক ডব্লিউ প্লাস বোসনের কথা বলা যাক। এই ভারী কণা গড়ে উঠতে অনেক শক্তি দরকার। সে কারণেই এর চৌহদ্দি পরমাণুর অতিক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ। বড় দূরত্বে এর কোনো প্রভাব নেই। অন্যদিকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের বাহক ফোটন কণা ভরহীন। তাই সেটি ছুটতে পারে সীমাহীন দূরত্বে।

আমাদের আলোচ্য মহাকর্ষও কাজ করতে পারে অসীম দূরত্বে। যেমন আমাদের সৌরজগতে বহুদূর থেকেও সূর্য পৃথিবীসহ অন্য গ্রহগুলোকে মহাকর্ষ বলে বেঁধে রেখেছে। একইভাবে কোটি কোটি নক্ষত্র নিয়ে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, কৃষ্ণগহ্বরের মতো বিশাল কাঠামো তৈরি হয়েছে ওই মহাকর্ষের কারণেই। কাজেই যুক্তি অনুসারে, গ্র্যাভিটন তৈরিতে কোনো শক্তির প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। তাই তার ভরও হবে শূন্য।

আবার গ্র্যাভিটনের স্পিন কেমন হবে, সেটাও হিসেব কষে বের করা সম্ভব। কোয়ান্টাম জগতে স্পিন স্থানের ঘূর্ণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি মৌলিক কণাদের একটা সহজাত ধর্ম। বস্তু বা পদার্থের গাঠনিক একক কোয়ার্ক ও লেপটনের স্পিন থাকে। এদের স্পিন ১/২। এর মানে হলো, এই কণাদের ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরানোর পর তাদের আচরণ আর আগের মতো একই থাকে না। তবে ৭২০ ডিগ্রি ঘোরানোর পর আবারও একই আচরণ করে কণাগুলো। অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তিনটি বলের জন্য বলবাহী কণাদের স্পিন ১। মানে, এসব কণা ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরালে তা একইরকম আচরণ করে। সেই হিসেবে গ্র্যাভিটনের স্পিন ২ হওয়া উচিত বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ যে কণার স্পিন ২, তারাই কেবল সব বস্তু বা পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে।  স্পিন ২-ধারী কণাদের ১৮০ ডিগ্রি ঘোরালেও তারা একই আচরণ করে।

অবশ্য কণাপদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পদার্থবিজ্ঞানীরা গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা বিনিময়ের প্রেক্ষিতে মহাকর্ষ বলের বর্ণনা করলেও, বাস্তবে এমন কিছু নাও থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ পদার্থবিদ মনে করেন, মহাকর্ষ কোয়ান্টাইজডও হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, অন্য বলগুলোকে যে গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করে কোয়ান্টাইজড হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে মহাকর্ষের ক্ষেত্রে এখন একমাত্র আশা স্ট্রিং তত্ত্ব। এ তত্ত্বে মৌলিক কণাকে বিন্দুসম নয়, বরং ভর-শক্তির স্ট্রিং বা তারের ভিন্ন ভিন্ন কম্পন হিসেবে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করা হয়।

স্ট্রিং থিওরির গাণিতিক হিসেব-নিকেষ খুব জটিল

স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা বলেন, ইলেকট্রনকে বিন্দু কণা হিসেবে দেখা গেলেও এটি আসলে স্ট্রিংয়ের কম্পন। আমাদের যদি কোনো সুপারমাইক্রোস্কোপ থাকত, তাহলে সেটা দিয়ে ইলেকট্রনের দিকে উঁকি দিলে দেখা যেত ইলেকট্রন বিন্দুসম কণা নয়, বরং অতিক্ষুদ্র কম্পমান স্ট্রিং বা তার। অন্য কণাদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন কম্পমান স্ট্রিংয়ের দাবি করেন স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা।

মহাকর্ষের জন্যও আশার বাণী রয়েছে স্ট্রিং তত্ত্বে। এখানে এমন এক স্ট্রিংয়ের দেখা মেলে, যার চরিত্র গ্র্যাভিটনের মতো। কিন্তু সমস্যা হলো, স্ট্রিং থিওরি নিজেই এক রহস্য। এ তত্ত্বের এখনও গভীর কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, স্ট্রিংয়ের আকার পরমাণুর চেয়েও অনেক অনেক ক্ষুদ্র। শুধু তাই নয়, এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, এখানে স্থান-কালের মাত্রার সংখ্যা আমাদের পরিচিত চারটি নয়, বরং ১০টি (আমাদের পরিচিত মাত্রা চারটি। এদের মধ্যে স্থানের তিনটি ও কালের একটি মাত্রা)। তাই স্ট্রিংগুলো কাজ করে কেবল স্থান-কালের ১০ মাত্রায়। ফলে স্ট্রিং থিওরির গাণিতিক হিসেব-নিকেষ খুব জটিল। এসব কারণে এ তত্ত্ব থেকে এখনও পর্যবেক্ষণযোগ্য কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়নি। আবার এ তত্ত্বকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য যে বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে, তাও আমাদের সক্ষমতার বাইরে। বিশেষ করে এক্সপেরিমেন্টালিস্ট বা পরীক্ষণবিদ পদার্থবিদেরা একে স্রেফ উড়িয়ে দিতে চান। তাঁদের এককথা, পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী না করলে পারলে কোনো কিছুর আসলে হাইপোথিসিসও হওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই স্ট্রিং থিওরি আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নাকি স্রেফ একটা হাইপোথিসিস বা অতিকল্পনা, তা নিয়েও সন্দিহান বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর দুটি ডিটেক্টরে প্রথমবারের মতো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বহুকাল আগে বহু দূরে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষে সেই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল।

২.

বুঝতেই পারছেন, মহাকর্ষ এবং অন্য তিনটি বলকে একত্রে ব্যাখ্যা করার মতো কোনো পর্যবেক্ষণযোগ্য তত্ত্ব এখন আমাদের হাতে নেই। কিন্তু তেমন একটা তত্ত্বের স্বপ্ন অনেক দিন ধরেই দেখছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও এরকম একটা তত্ত্ব প্রণয়নে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তাঁর সে চেষ্টা থামেনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন। শুধু আইনস্টাইনই নন, অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী এ তত্ত্ব পেতে গবেষণা করেছেন। এ বিষয়ে লেখাও হয়েছে গাদা গাদা বই। স্টিফেং হকিং নিজেই লিখেছেন বেশ কয়েকটা বই। এর মধ্যে রয়েছে আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, দ্য থিওরি অব এভরিথিং-এর মতো জনপ্রিয় বই।

স্বপ্নের এই তত্ত্বকে অনেকে বলেন কোয়ান্টাম থিওরি অব গ্র্যাভিটি। কেউ-বা বলেন থিওরি অব এভরিথিং। সবকিছুর তত্ত্ব। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বোঝাতে চান, কাঙ্ক্ষিত সেই তত্ত্ব হবে এমন কিছু, যা দিয়ে একই সঙ্গে প্রাকৃতিক চারটি বল এবং আমাদের জানা সবগুলো বস্তুকণার মিথস্ক্রিয়া একত্রে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র পরিসর এবং বৃহৎ পরিসরকে একইসঙ্গে ব্যাখ্যা করবে সেই তত্ত্ব। আরও ভালোভাবে বললে, সেই তত্ত্বটি হবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মেলবন্ধন। কেউ কেউ বলেন, এ দুই তত্ত্বের বিবাহবন্ধন।

যাই হোক, আমাদের ঝুলিতে তেমন কোনো তত্ত্ব না থাকার মানে এই নয় যে গ্র্যাভিটনের অস্তিত্ব নেই। গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা হয়তো আছে, কিন্তু কে জানে, আমাদের বর্তমান জ্ঞান ও সক্ষমতা দিয়ে তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারছি না। তবে এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা কিংবা গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। অনেকেই গ্র্যাভিটন শনাক্ত করার নানা কৌশল নিয়ে কাজ করছেন। এর একটি হলো বৃহস্পতি গ্রহের সমান একটা ডিটেক্টর ব্যবহার করা।

আমরা জানি, কোনো আলোক তরঙ্গ ফোটন কণা দিয়ে গঠিত হয়ে একসঙ্গে ছুটে চলে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী ধারণা করেন, মহাকর্ষ তরঙ্গও হয়তো তেমন কিছুই। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর দুটি ডিটেক্টরে প্রথমবারের মতো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বহুকাল আগে বহু দূরে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষে সেই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মহাকর্ষ তরঙ্গ আসলে স্থান-কালের বুননে বিপুল এক ঢেউ। বিশাল এক আলোড়ন। এর যাত্রাপথে যাকে পায়, তাকেই নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আলোর মধ্যে একত্রে ছুটে চলা তরঙ্গ ও ফোটন কণার মতো মহাকর্ষ তরঙ্গ হয়তো গ্র্যাভিটনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে ছুটে চলে। কিন্তু মুশকিল হলো, তাকে শনাক্ত করা যাবে কীভাবে? হয়তো ভাবছেন, তা কেন?

সেটা বোঝার জন্য আলোর ফোটনের ব্যাপারটা একটু শুনুন। একটা আলোর উৎসকে যথেষ্ট পরিমাণ ম্লান করে প্রতিটি ফোটন কণাকে আলাদা আলাদাভাবে কোনো ডিটেক্টরে শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু একই পদ্ধতিতে মহাকর্ষ কণা বা গ্র্যাভিটন শনাক্ত করা কঠিনই নয়, অসম্ভবও বটে। তার কারণ হলো, আগেই বলেছি মহাকর্ষ তরঙ্গ অতি দুর্বল। আর কোয়ান্টাম তত্ত্বে দুর্বলতা হলো ‘বস্তুর সঙ্গে বিরল মিথস্ক্রিয় হওয়া’র সমার্থক। কাজেই স্রেফ পরমাণু ব্যবহার করে গ্র্যাভিটনকে থামানো কঠিন। তাই ফোটনের মতো করে এদের শনাক্ত করাও কঠিন ও প্রায় অসম্ভব। সেই কারণে মহাকর্ষ কণা আমাদের কাছে এখনও অধরা।

মহাকর্ষ কণা শনাক্ত করা কত কঠিন, সেটা উপলদ্ধি করার জন্য নিউট্রিনো কণার তুলনা টেনে আনা যায়। মহাবিশ্বের অধরা কণাদের তালিকায় নিউট্রিনো অন্যতম। সূর্যের ভেতর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বা পারমাণবিক বিস্ফোরণে বিপুল পরিমাণ নিউট্রিনো কণা তৈরি হচ্ছে সবসময়। সেগুলো স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেহের ভেতর দিয়ে কোটি কোটি নিউট্রিনো কণা হুড়মুড় করে চলে যাচ্ছে। সঠিকভাবে বললে, এর পরিমাণ প্রায় এক ট্রিলিয়ন। কিন্তু আপনি টেরই পাচ্ছেন না। কারণ এরা আপনার দেহের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করছে না। এহেন চরিত্রের কারণে নিউট্রিনো কণা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। বলা যায়, প্রায় অধরা।

মজার ব্যাপার হলো, নিউট্রিনোর চেয়েও এককাঠি সরেস এই গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা। কারণ অন্য কণাদের সঙ্গে নিউট্রিনোর চেয়ে ১০০০ মিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ভাগ কম মিথস্ক্রিয়া করে গ্র্যাভিটন। অবশ্য নিউট্রিনোকে ধরতে বা শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরাও মাথা খাটিয়ে বেশ জবরদস্ত একটা কৌশল বের করেছেন। এর মাধ্যমে কোনো কণার সঙ্গে নিউট্রিনোকে মিথস্ক্রিয়া করতে বাধ্য করা যায়। আসলে বলা উচিত, মিথস্ক্রিয়া করার সম্ভাবনা বাড়ানো হয়। সেটি করা হয় নিউট্রিনোর গতিপথে বিপুল ভর জড়ো করে। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউট্রিনো ডিটেক্টরটি বসানো হয়েছে দক্ষিণ মেরুতে। এর নাম আইসকিউব। এতে রাখা হয়েছে অ্যান্টাকর্টিকার এক ঘন কিলোমিটার জমাট বরফ। আরও আছে অতি সূক্ষ্ণ কিছু যন্ত্রপাতি। ফলে এই অধরা কণাও ধরা দিয়েছে বিজ্ঞানীদের জালে। নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন এ কণার অস্তিত্বের ব্যাপারে।

মহাকর্ষ বল দুর্বল হওয়ায় গ্র্যাভিটন শনাক্ত করতে যে ডিটেক্টর বসাতে হবে, তার ভর হতে হবে অনেক অনেক গুণ বেশি
ছবি: ফ্রিপিক

গ্র্যাভিটনের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের একটা কৌশল খাটানোর কথা ভেবেছেন কিছু বিজ্ঞানী। কিন্তু মুশকিল হলো, মহাকর্ষ বল দুর্বল হওয়ার কারণে গ্র্যাভিটন শনাক্ত করতে যে ডিটেক্টর বসাতে হবে, তার ভর হতে হবে অনেক অনেক গুণ বেশি। সেই সঙ্গে আকৃতিটাও হবে আক্ষরিক অর্থেই দানবাকৃতির। তার আকৃতির কাছে বিশালাকৃতির এই নিউট্রিনো ডিটেক্টরকেও মনে হবে বামন। চোখটা আগেই কপালে তুলবেন না প্লিজ! তার আগে আরেকটু শুনুন।

বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, গ্র্যাভিটন শনাক্ত করতে আমাদের যে ডিটেক্টর দরকার, তার ভর হতে হবে বৃহস্পতি গ্রহের সমান। মানে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহটির সমান। তাহলেই হয়তো কেবল গ্র্যাভিটন শনাক্ত করা সম্ভব। স্মরণ করিয়ে দিই, বৃহস্পতির ভর ১.৮৯৮ × ১০২৭ কেজি। আবার গ্রহটি এতই বড় যে এর ভেতর ১ হাজার ৩০০টি পৃথিবী অনায়াসে ঢুকিয়ে ফেলা যাবে। বুঝুন অবস্থা!

বিজ্ঞানী গ্র্যাভিটন শনাক্ত করার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তাঁদের কারও কারও মতে, গ্র্যাভিটন হয়তো আদৌ কোনো ভৌত অস্তিত্ব নয়, স্রেফ মেটাফিজিকস।

দাঁড়ান, বিস্ময়ের আরও ব্যাপার আছে। বৃহস্পতির সমান ভরের ডিটেক্টর দিয়ে গ্র্যাভিটন শনাক্ত করা হবে হকিং রেডিয়েশন ব্যবহার করে। বিজ্ঞানীদের ভাবনাটা অনেকটা এরকমই। কারণ কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা এই বিকিরণকে শক্তিশালী গ্র্যাভিটন উৎস বলে মনে করা হয়। এই বিকিরণের অন্তত এক শতাংশ এই মহাকর্ষ কণা থাকা উচিত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখানেই আছে সবচেয়ে বড় বিপত্তি। হিসেবে দেখা গেছে, এত বিশাল ডিটেক্টর দিয়ে একটা মাত্র গ্র্যাভিটন শনাক্ত করতেও লেগে যাবে মহাবিশ্বের প্রকৃত বয়সের চেয়েও বেশি সময়। তাহলে এরকম একটা ডিটেক্টর বানিয়ে গ্র্যাভিটন শনাক্ত করা কি আদৌ সম্ভব? আর এত সময় ব্যয় করে গ্র্যাভিটন শনাক্ত করে লাভটাই-বা হবে কোন কচু! নিজেই ভেবে দেখুন।

এসব ভেবে অনেক বিজ্ঞানী গ্র্যাভিটন শনাক্ত করার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তাঁদের কারও কারও মতে, গ্র্যাভিটন হয়তো আদৌ কোনো ভৌত অস্তিত্ব নয়, স্রেফ মেটাফিজিকস। বাংলায় যাকে বলে অধিবিদ্যা। পরীক্ষামূলক বা পর্যবেক্ষণযোগ্য বিজ্ঞান নয়, দর্শনশাস্ত্র নিয়েই যার কাজকারবার। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দর্শনশাস্ত্রের খোলস ছেড়ে যে বিজ্ঞান একদিন পরীক্ষামূলক জ্ঞান হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, তাকেও কী আবার এভাবে মাথা নত করতে হবে!

বিজ্ঞানীরা কি আর এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র! মোটেও নয়। কয়েকজন বিজ্ঞানী তাই গবেষণাগারে হাইপোথেটিক্যালি গ্র্যাভিটনের চালচরিত্র অনুসন্ধানের কথা ভাবছেন। কিন্তু বলা বাহুল্য, সেটি সত্যিকারের গ্র্যাভিটন নয়। তবে এর মাধ্যমে যে কণাটির চরিত্রটা হয়তো আরও ভালোভাবে বোঝার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। আর বিজ্ঞান তো থেমে থাকে না। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো উপায় বা কৌশলের খোঁজ পাবেন বিজ্ঞানীরা। গ্র্যাভিটন বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেদিন তা ধরা পড়বে আমাদের হাতে। ব্যস! তাতেই হয়তো পদার্থবিজ্ঞানীদের বহুদিনের কাঙ্খিত কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি থিওরি বা থিওরি অব এভরিথিং একদিন এসে যাবে হাতের মুঠোয়। কাজেই হাল ছাড়া যাবে না, শুধু একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে—এই যা।

সূত্র: প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস/ মিচিও কাকু

দ্য গড ইকুয়েশন/ মিচিও কাকু

সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন, উইকিপিডিয়া