গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স সমাধান করে টাইম ট্রাভেল সম্ভব, দাবি পদার্থবিদের

ব্ল্যাকহোলের মতো তীব্র শক্তিসম্পন্ন মহাকর্ষক্ষেত্র তৈরি করতে পারলে, তা স্থান-কালকে এমনভাবে বাঁকাতে পারবে যে বাঁকা অংশ নিজের সঙ্গেই এসে জুড়ে যাবে

সব টাইম ট্রাভেলাররাই জানেন বিষয়টা—অতীতে গেলে কোনো কিছু বদলানো যাবে না। এই নিয়ম মানতে গিয়েই বেঁধে যায় নানা ঝামেলা। যতই ঝামেলা বাঁধুক, সম্ভব হোক না হোক—অতীত বা ভবিষ্যতে যাওয়ার ইচ্ছা মানুষের বহু পুরোনো। কালের আবর্তে এই ইচ্ছা আরও ডালপালা মেলেছে। তবু এখনো সময় ভ্রমণকে কেউই জোর গলায় ‘সম্ভব’ বলবেন না। মোটা দাগে একে অসম্ভব বলেই মনে করা হয়। যেমনটা বললাম, এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু হেঁয়ালি। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি সম্ভবত ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’। যাঁরা সায়েন্স ফিকশন মুভি দেখেন কিংবা কল্পবিজ্ঞান গল্প বা উপন্যাস পড়েন, তাঁরা হয়তো পরিভাষাটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কী এই প্যারাডক্স? এটি কি কোনোভাবেই সমাধান করা সম্ভব নয়?

প্রথমে প্যারাডক্সটা বুঝে নেওয়া যাক। ধরুন, আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গেলেন। পৌঁছালেন আপনার দাদার শৈশবে। স্কুলে পড়া দাদাকে হত্যা করলেন। ফলে দাদাকে মেরে নিজের বাবার জন্মটাই ঠেকিয়ে দিলেন আপনি। তাহলে আপনি এলেন কোথা থেকে?

সময় ভ্রমণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে যে প্যারাডক্স অন্যতম, তা আগেই বলেছি। এসব প্যারাডক্সের আবার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এ ধরনের সমস্যা বা হেঁয়ালি কাজ করে তাপগতিবিদ্যার নিয়ম মেনে। ফলে তাপ ও শক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রিত থাকে।

অর্থাৎ আপনার দাদা তো শৈশবে মারা গেছে, সে সময় তাঁর সন্তান হওয়া তো দূরের কথা, বিয়েই হয়নি। সে ক্ষেত্রে আপনার বাবার জন্ম হবে না, তাই আপনারও কোনো অস্তিত্ব থাকার কথা না। কিন্তু আপনি তো দিব্যি আছেন! না হলে টাইম ট্রাভেল করে অতীতে যেতে পারতেন না। কথা হলো, এটা কীভাবে সম্ভব? এই সমস্যাকে বলা হয় গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স। এই প্যারাডক্স নিয়ে বহু মুভি বানানো হয়েছে, লেখা হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস। প্রায় সবাই একরকম ধরেই নিয়েছেন যে এ প্যারাডক্সের কোনো সমাধান নেই। অথচ সম্প্রতি নতুন এক গবেষণা এই সমস্যা সমাধানে আশার আলো দেখাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির ভ্যান্ডারবিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ও এই গবেষণার পরিচালক লরেঞ্জো গাভাসিনো দাবি করেছেন, গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স সমাধান করে তাত্ত্বিকভাবে টাইম ট্রাভেল সম্ভব। সাধারণ আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা—তিনটি একসঙ্গে ব্যবহার করলে সময় ভ্রমণে যুক্তির স্ববিরোধিতা বা লজিক্যাল কনট্র্যাডিকশন থাকবে না।

আরও পড়ুন

দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় সময়কে আমরা নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে দেখি। যেখানে ঘটনা অতীত থেকে ভবিষ্যতে সরলরেখায় চলে। ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। দেখা যায়, স্থান-কালের ছন্দ আমাদের নিয়মিত অভিজ্ঞতার বিপরীত। 

সাধারণ আপেক্ষিকতার সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ ‘ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভ’, সংক্ষেপে সিটিসি। মহাকর্ষ স্থান-কালকে বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। ব্ল্যাকহোলের মতো তীব্র শক্তিসম্পন্ন মহাকর্ষক্ষেত্র তৈরি করতে পারলে, তা স্থান-কালকে এমনভাবে বাঁকাতে পারবে যে বাঁকা অংশ নিজের সঙ্গেই এসে জুড়ে যাবে। ফলে তৈরি হবে একধরনের লুপ বা ফাঁস। সহজ কথায়, এই লুপের কারণে ভবিষ্যত থেকে অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হতে পারে, যেখানে সময়ের প্রবাহ স্বাভাবিক লিনিয়ার (সরলরৈখিক) নিয়ম মেনে চলে না।

আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে গেলেন। পৌঁছালেন আপনার দাদার শৈশবে। স্কুলে পড়া দাদাকে হত্যা করলেন। ফলে দাদাকে মেরে নিজের বাবার জন্মটাই ঠেকিয়ে দিলেন আপনি।

বিজ্ঞানী গাভাসিনোর মতে, সাধারণ আপেক্ষিকতা কেবল ভর নয়, সব ধরনের শক্তি এবং ভরবেগও মহাকর্ষের উৎস হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ একটা বস্তু যদি ঘূর্ণমান হয়, তা স্থান-কালকে টেনে নেয়। যদিও এই ব্যাপারটা আমাদের সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রে দেখা যায় না। কিন্তু পুরো মহাবিশ্ব যদি ঘূর্ণমান হতো, তখন স্থান-কাল এত বেঁকে যেত যে সময় (এবং স্থান) একধরনের লুপ বা ফাঁস সৃষ্টি করবে। এ অবস্থায় কোনো মহাকাশযান এই লুপের ভেতরে ভ্রমণ করলে, তা একই স্থানে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সময়ও এক থাকবে। আগেই বলা হয়েছে, আমাদের মহাবিশ্ব এভাবে ঘূর্ণমান নয়। তাই এই লুপের দেখা বাস্তবে মিলবে না।

তবে ব্ল্যাকহোলের মতো ঘূর্ণমান বিশাল বস্তু স্থান-কালে এ ধরনের ফাঁস বা বক্রতা তৈরি করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভ তা প্রমাণ করে। মোট কথা, সময় ভ্রমণের সম্ভাব্য একটা ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে এভাবে।

সময় ভ্রমণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে যে প্যারাডক্স অন্যতম, তা আগেই বলেছি। এসব প্যারাডক্সের আবার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এ ধরনের সমস্যা বা হেঁয়ালি কাজ করে তাপগতিবিদ্যার নিয়ম মেনে। ফলে তাপ ও শক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রিত থাকে।

 গাভাসিনো বলেন, সত্যি বলতে, এনট্রপির বৃদ্ধিজনিত এই নীতিই পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র নিয়ম, যা অতীত ও ভবিষ্যতের পার্থক্য স্পষ্ট করে তোলে। আমরা এখন পর্যন্ত কেবল অতীত মনে রাখতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যত অনুমান করতে পারি না। এর কারণও এনট্রপি।

আরও পড়ুন
এমন পরিবর্তনে সময় ভ্রমণকারীর ওপর ভয়ানক প্রভাব পড়তে পারে। যেমন এনট্রপি কমতে থাকলে স্মৃতি মুছে যাবে। গাভাসিনোর গবেষণা মতে, সময়ের লুপে এনট্রপি কমলে, সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহে পরিবর্তন আসতে পারে, ফলে বয়স কমতে পারে বা অতীতের ঘটনা নতুনভাবে গঠিত হতে পারে।

শুধু কি তাই! এনট্রপি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। বার্ধক্য থেকে স্মৃতির গঠন, এমনকি হাঁটাচলা পর্যন্ত। যেমন হাঁটার সময় ঘর্ষণ প্রক্রিয়া কাজ করে, ফলে এনট্রপি বেড়ে যায়। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কেউ যদি সময়ের লুপে আটকে যায়, কীভাবে ঘটবে এই প্রক্রিয়াগুলো?

এই সমস্যার সমাধান দিচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। গবেষক গাভাসিনোর এ গবেষণা ক্লাসিক্যাল অ্যান্ড কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি জার্নালে প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। সেখানে আকর্ষণীয় একটা সমাধান দিয়েছেন তিনি। দেখিয়েছেন, ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভ বা সময়ের লুপে তাপগতিবিদ্যার আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যায়। এ বিষয়ে ইতালিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কার্লো রোভেল্লির কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পদার্থবিদ গাভাসিনো। ফলে তিনি দেখেন, এমন লুপের মধ্যে কোয়ান্টাম পর্যায়ে কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা এনট্রপি মুছে ফেলতে পারে। এটি আমাদের চিরচেনা ধারণার পুরো বিপরীত।

এমন পরিবর্তনে সময় ভ্রমণকারীর ওপর ভয়ানক প্রভাব পড়তে পারে। যেমন এনট্রপি কমতে থাকলে স্মৃতি মুছে যাবে। গাভাসিনোর গবেষণা মতে, সময়ের লুপে এনট্রপি কমলে, সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহে পরিবর্তন আসতে পারে, ফলে বয়স কমতে পারে বা অতীতের ঘটনা নতুনভাবে গঠিত হতে পারে। গাভাসিনো বলেন, ‘এন্ট্রপির বৃদ্ধিই মৃত্যুর কারণ। এখন আমরা যদি মৃত্যুটাকেই উল্টে দিই, তাহলে কী হবে!’

মানে, আপনি যদি সময় লুপে গিয়ে দাদাকে হত্যা করেন, তাহলে তিনি হয়তো কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসবেন। কারণ, লুপের মধ্যে সময়ের ঘটনাগুলো বদলে যায়, পুরোপুরি উল্টেও যেতে পারে। এভাবে গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের একটা সমাধান আসতে পারে।

বেশির ভাগ পদার্থবিদ ও দার্শনিক মনে করেন, সময় ভ্রমণ সম্ভব হলে প্রকৃতি এমনভাবে কাজ করবে যে প্যারাডক্সের বিষয়টি থাকবেই না। প্যারাডক্স বা স্ববিরোধিতা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য আরেকটি নীতি প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনের ভিত্তিতেই আসে সেলফ-কনসিস্টেনসি প্রিন্সিপল। 

পদার্থবিদ গাভাসিনোর গবেষণাতেই প্রথম দেখা যায়, কোনো অনুমান ছাড়াই এই নীতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়ম থেকে এসেছে। ফলে বলা যায়, কেবল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাধারণ নিয়মেই সময় ভ্রমণের প্যারাডক্স এড়ানো সম্ভব। 

আরও পড়ুন
পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান সীমা-পরিসীমা যাচাই করতে গাভাসিনোর কাজটি সহায়ক হবে। তিনি নিজেই জানান, বিষয়টি তাঁর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ এটি আমাদের জানায়, মহাবিশ্বে এনট্রপি ঠিক কীভাবে ভূমিকা রাখছে।

গাভাসিনোর এই গবেষণা সময় ভ্রমণের শক্তিশালী তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছে। তবু বড় এক প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের এই মহাবিশ্বে কি সময়ের লুপ আছে? অস্তিত্ব আছে কি সিটিসির? এ নিয়ে অবশ্য বেশির ভাগ পদার্থবিদ সন্দিহান।

১৯৯২ সালে পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এই ধারণার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করেন। ‘ক্রোনোলজি প্রটেকশন কনজেকচার’ নামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেন তিনি। হকিংয়ের মতে, প্রকৃতি নিজেই সময় ভ্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, যাতে কোনো প্যারাডক্স সৃষ্টি না হয়। তিনি কল্পনা করেন, সময়ের লুপ তৈরি হতে গেলে কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে স্থান-কাল এমনভাবে পরিবর্তিত হবে যে তা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব হবে না। ফলে সময় ভ্রমণ স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব হয়ে ওঠবে। এ হিসেবে, বলা বাহুল্য, গাভাসিনোর ধারণাটি সত্য হওয়া সম্ভব নয়।

তবে পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান সীমা-পরিসীমা যাচাই করতে গাভাসিনোর কাজটি সহায়ক হবে। তিনি নিজেই জানান, বিষয়টি তাঁর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ এটি আমাদের জানায়, মহাবিশ্বে এনট্রপি ঠিক কীভাবে ভূমিকা রাখছে।

তবে মহাবিশ্বে সময়ের এরকম লুপ না থাকলেও এর গাণিতিক মডেল অনেক বাস্তব বিষয় সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে। যেমন প্রকৃত এনট্রপির বিবর্তন এবং উপপারমাণবিক পর্যায়ে এর আচরণ বুঝতে সহায়ক হতে পারে এটি। উপপারমাণবিক সিস্টেম ও এর তাপগতিবিদ্যা সম্পর্কে পাওয়া যেতে পারে নতুন তথ্য। অর্থাৎ সময় ভ্রমণ সত্যি বা এখনই বাস্তব না হলে কী হবে, এ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করছে, সমৃদ্ধ করছে প্রযুক্তি।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

সূত্র:  সায়েন্স অ্যালার্ট ও লাইভ সায়েন্স।

আরও পড়ুন