সালতামামি ২০২৩
বছরজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানের আলোচিত ১০
পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বেশ জমজমাট একটি বছর ছিল ২০২৩। জেমস ওয়েবের মতো দুরবিন দিয়ে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা যেমন সুবিশাল মহাবিশ্বের নানা রহস্যের কিনারা করতে চেয়েছেন, তেমনি পৃথিবীতে বসে কণাপদার্থবিদেরা অতিসূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার করে উঁকি দিয়েছেন পরমাণুর গভীরে। অতিক্ষুদ্র সেই জগত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন পরমাণুর কোয়ান্টাম দশার স্বরূপ। এখানেই শেষ নয়। মহাকর্ষ তরঙ্গ, সমন্বিত তত্ত্ব, অ্যান্টিম্যাটারের আচরণসহ আরও নানা বিষয়ে যুগান্তকারী গবেষণা হয়েছে এ বছর।
পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর অনেক বিস্তৃত। ছোট্ট কোনো তালিকায় সেই ছবিটা ধরা কঠিন। এ লেখায় তবু এর একটা আঁচ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, ফিজিকস ওয়ার্ল্ড, লাইভ সায়েন্স, বিজ্ঞানচিন্তাসহ আরও নানা উৎস থেকে নির্বাচিত দশটি গবেষণার কথা এখানে তুলে ধরা হলো। বিজ্ঞানের জগতে কোনো গবেষণার অবদানই কম নয়। তাই এখানে কোনো ক্রম অনুসরণ করা হয়নি।চলুন তবে, ফিরে তাকানো যাক।
জেমস ওয়েবের চমক
মহাকাশে চোখ রাখলে পাওয়া যায় সুদূর অতীতের আলোর সন্ধান। সেই আলোয় লেখা থাকে সুপ্রাচীন মহাবিশ্বের ইতিহাস। জানা যায় অবিশ্বাস্য সব বিষয়। এগুলো একসময় মানুষ কল্পনাও করেনি।
নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপও সুপ্রাচীন মহাবিশ্বকে আরও ভালোভাবে জানতে, আরও অতীতের আলোর খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিল মহাকাশে। এই নভোদুরবিনের লক্ষ্য, মহাবিশ্বের প্রথম আলোর সন্ধান। ইতিমধ্যেই এ নভোদুরবিন মহাবিশ্বের অজানা অতীতের অনেক কিছুর সন্ধান দিয়েছে। এর মাধ্যমে জানা গেছে মহাবিশ্বের প্রাচীনতম কৃষ্ণগহ্বরের কথা (এখন পর্যন্ত)। পাওয়া গেছে অন্যতম প্রাচীন একাধিক গ্যালাক্সির খোঁজ। শুধু কী তাই, বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ৩০ কোটি বছর পর জন্ম নেওয়া গ্যালাক্সির আলোও ধরা পড়েছে এই নভোদুরবিনের ক্যামেরায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সিপুঞ্জের মুগ্ধকর সব ছবি তুলেছে দুরবিনটি।
আইগার (EIGER—Emission-line Galaxies and Intergalactic Gas in the Epoch of Reionization) কোলাবোরেশনের বিজ্ঞানীরা এ নভোদুরবিন ব্যবহার করে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন এ বছর। আদিগ্যালাক্সিগুলো কীভাবে শিশু মহাবিশ্বকে পুনরায় আয়নিত করেছিল, সে সম্পর্কিত প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, বিগব্যাংয়ের ১০০ কোটি বছর পর মহাবিশ্ব আবারও আয়নিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন গ্যাস আয়ন বা চার্জে পরিণত হয়। ফলে হাইড্রোজেন দ্বারা আলো শোষিত হওয়ার বদলে এর মধ্য দিয়ে চলাচল শুরু করে। এই আলোই ধরা পড়েছে জেমস ওয়েবের ক্যামেরায়। এ আলো বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা ধারণা করছেন, আদি গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর কারণেই মহাবিশ্ব আবারও আয়নিত হয়েছিল।
এ ছাড়াও আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ওরিয়ন নেবুলায় সম্প্রতি ৪২টি জোড়া বস্তু শনাক্ত করেছে জেমস ওয়েব। এগুলো পরস্পরকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এগুলো কী? নক্ষত্রও হতে পারে, আবার ভবঘুরে গ্রহও হতে পারে। বলা কঠিন। যেটাই হোক, তা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বর্তমান তত্ত্বগুলো দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। কীভাবে মুক্ত এসব জোড়া বস্তু তৈরি হলো, সেটা বিজ্ঞানীদের কাছে এক বড় প্রশ্ন। আরেকটি নতুন সমস্যার মুখে পড়েছেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা। বহুদূরের গ্যালাক্সিগুলোর আলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্ব যে বেগে প্রসারিত হওয়ার কথা, তারচেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে। এর পেছনে যে ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তিকে দায়ী করা হয়—বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ শক্তি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে প্রসারিত করে চলেছে স্থান-কাল—সেই ডার্ক এনার্জির রহস্য ঘনীভূত হয়েছে আরও। কারণ, আগের চেয়ে অনেক দ্রুতগতির প্রসারণের অর্থ, এর প্রভাব আরও বেশি। সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, জেমস ওয়েব মহাবিশ্বের নানা রহস্যের উত্তর খুঁজে বের করার পাশাপাশি জন্ম দিচ্ছে নতুন অনেক প্রশ্নের। এসব প্রশ্নই বিজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে নেয়। জেমস ওয়েবের প্রভাব তাই ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে বড় ছাপ রাখবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
শক্তিশালী কোয়ান্টাম গিঁট
বছরের শুরুর দিকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদেরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আরও নির্ভরযোগ্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগিয়েছেন তাঁরা। এই ব্যবস্থায় টপোলজি ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়।
টপোলজি গাণিতিকভাবে খুব জটিল জ্যামিতিক বিজ্ঞান। কোনো জ্যামিতিক আকার যতই পরিবর্তিত হোক, মূল অংশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন না হলে একই টপোলজিক্যাল সেটের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য এরকম কিছু বেশ কাজের। বাইনারি ডিজিট বা বিটের মান শূন্য (০) বা একের (১) যেকোনো একটি হতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিটে একই সঙ্গে দুটোই প্রকাশ করা যায়।
এই গবেষণায় কিউবিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়াসি কণা। কোয়াসি কণাকে বলা হয় একধরনের কনসেপ্ট বা ধারণা। কারণ, এ ধরনের কণা তার অতীতের অবস্থা জমিয়ে রাখতে পারে। ফলে একাধিক তথ্যের কিছু না হারিয়েই বিভিন্ন অবস্থা বিশ্লেষণ করা যায় একই সঙ্গে, যেকোনো মুহূর্তে। এর ফলে ত্রুটিমুক্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব।
তারপরের বড় ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরের আগস্টে। বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম ক্রুটি সংশোধনের জটিলতা মোকাবিলায় নতুন ধরনের কোড তৈরি করেছেন। এমনিতে কোয়ান্টাম বিটগুলো দুর্বল ও ত্রুটিপ্রবণ। পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় হারিয়ে ফেলে আগের তথ্য। এসব সমস্যার সমাধান, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, এই কোড ও টপোলজির মাধ্যমে করা সম্ভব। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জগতে এটি একটি মাইলফলক। ভবিষ্যতে হয়তো বড় পরিসরে এর প্রয়োগ দেখা যাবে।
কোয়ান্টাম জাদু
শূন্য থেকে কি শক্তি টেনে আনা সম্ভব? বিজ্ঞানীরা অনেকটা এমন চেষ্টাই করেছিলেন বছরের শুরুর দিকে। না, একেবারে শূন্য থেকে শক্তি তৈরি করেননি। বরং আণবিক দূরত্বে টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে শক্তি স্থানান্তর করেছেন। এ জন্য গবেষকেরা কাজে লাগিয়েছেন কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়ামের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যকে। এই বিশেষ ধরনের শূন্যতা মূলত বুদবুদের মতো কোয়ান্টাম শক্তিতে ভরপুর।
বস্তুর নানা ধরনের অবস্থান্তর হয়। অর্থাৎ অবস্থার পরিবর্তন হয়। যেমন বরফ গলে পরিণত হয় পানিতে। বিজ্ঞানীরা এমন একধরনের পরিবর্তনের খোঁজ পেয়েছেন। বছরের শুরুতেই এ খবর সামনে আসে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা পদার্থে নয়, বরং তথ্যে হয়। দুটি কিউবিট যখন এনট্যাঙ্গেলড থাকে, তখন এগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি করে নিতে পারে। কিন্তু এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায় এদের পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ করতে গেলে ভেঙে যায় এই সংযোগ। বিজ্ঞানীরা দেখতে চাচ্ছিলেন, অনেকগুলো কিউবিট এনট্যাঙ্গেলড অবস্থায় থাকলে এবং সেখানকার কিছু কিউবিট পর্যবেক্ষণ করলে কী ঘটে। তাঁরা দেখলেন, কীভাবে দেখা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এনট্যাঙ্গেলড অবস্থা ভেঙে পড়বে, নাকি বজায় থাকবে। এই বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করেই তাঁরা শক্তি স্থানান্তর করেছেন আণবিক দূরত্বে।
মহাকর্ষ তরঙ্গের গুঞ্জন
দুই বা তার বেশি গ্যালাক্সি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে তাদের কেন্দ্রে থাকা অতিভারী ব্ল্যাকহোলগুলোও পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়। ব্ল্যাকহোলের এ সংঘর্ষ এত ভয়ংকর যে স্থান-কালজুড়ে তৈরি হয় কম্পন। এই কম্পনকে বলা হয় মহাকর্ষ তরঙ্গ। ২০১৫ সালে লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরির (লাইগো) গবেষকেরা প্রথমবারের মতো এ তরঙ্গ শনাক্ত করেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা যেমন কঠিন ছিল, তেমনি সময়ও লাগত অনেক।
এ বছরের জুনে একাধিক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদল এরকম সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গ খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা দেয়। এ জন্য বিজ্ঞানীরা পালসার পর্যবেক্ষণ করেন। পালসার হলো ঘূর্ণমান নিউট্রন নক্ষত্র। ক্রমাগত ঘূর্ণমান এসব নক্ষত্রের চৌম্বক মেরু থেকে নিয়মিত বিরতিতে নির্গত হয় তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ। বিজ্ঞানীরা দেখেন, মহাকর্ষ তরঙ্গের কারণে পালসারের স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটছে। ১৫ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাঁদের মতে, পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মাইলফলক এটি। এর মাধ্যমে পালসারের স্বাভাবিক ছন্দপতন দেখে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হবে এখন থেকে। ফলে, আরও নতুন গবেষণার সুযোগ হবে। জানা যাবে মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু।
অ্যান্টিম্যাটারও মেনে চলে মহাকর্ষ
ইউরোপের সার্ন গবেষণাগারের আলফা (অ্যান্টিহাইড্রোজেন লেজার ফিজিকস অ্যাপারেটাস) কোলাবোরেশনের বিজ্ঞানীরা এ বছর অ্যান্টিম্যাটারের পতন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাতে দেখা গেছে, সাধারণ পদার্থের ওপর মহাকর্ষ যেভাবে কাজ করে, অ্যান্টিম্যাটারের ওপরও সেভাবেই কাজ করে। আলফা-জি (ALPHA-g) পরীক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিহাইড্রোজেন (প্রতিহাইড্রোজেন) পরমাণুর মুক্ত পতন পর্যবেক্ষণ করেন। হাইড্রোজেনের এই প্রতিকণা একটি পজিট্রন (প্রতিইলেকট্রন) ও একটি অ্যান্টিপ্রোটন দিয়ে গঠিত।
গবেষকদল একটি বায়ুশূন্য লম্বা সিলিন্ডারের মধ্যে চৌম্বকীয় ফাঁদের মাধ্যমে এটি ধরে রাখেন।এরপর তা ছেড়ে দেন, যাতে সিলিন্ডারের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে একসময় পরমাণুটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।তাঁরা দেখতে পান, পরমাণুটি যেখানে ধ্বংস হয়েছে, সেটা তার আদি অবস্থান থেকে খানিকটা নিচে।তা ছাড়া, ধ্বংসের চিহ্ন ওপর থেকে নিচের দিকে গেছে।অ্যান্টিহাইড্রোজেনের তাপীয় গতি পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা বুঝতে পারেন, অ্যান্টিম্যাটার মহাকর্ষ সূত্র মেনে চলে।সাধারণ বস্তুর মতোই পড়ে নিচের দিকে।তবে বিজ্ঞানীদের হিসেব বলছে, সাধারণ বস্তুর চেয়ে অ্যান্টিম্যাটারের মহাকর্ষজনিত ত্বরণ প্রায় ২৫ শতাংশ কম।এ হিসেব কতটা সঠিক, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অবশ্য।কারণ, পরিসংখ্যানগতভাবেএখনও ডেটার পরিমাণ অনেক কম।তবে অ্যান্টিম্যাটার সংশ্লিষ্ট এ গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ সন্দেহ নেই।
প্রোটনের গঠন
পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। আর এই নিউক্লিয়াসের দুটি সদস্যের একটি প্রোটন। এ বছর বিজ্ঞানীরা প্রোটনকে দেখতে পেয়েছেন নিউট্রিনো কণার সাহায্যে। না, নিউট্রন নয়, নিউট্রিনো ভিন্ন ধরনের অতিপারমাণবিক কণা। নিউট্রনের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, এর ভর ইলেকট্রনের কাছাকাছি। আর নিউট্রনের ভর প্রোটনের কাছাকাছি। তা ছাড়া নিউট্রিনো মৌলিক কণা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার এবং কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কণাপদার্থবিদ তেজিন কাই ও তাঁর সহকর্মীরা এই পরীক্ষণটি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাবে মাইনআরভিএ (MINERvA) পরীক্ষার মাধ্যমে প্রোটনের আকৃতি উন্মোচিত হয়।
নিউট্রিনো খুব ক্ষুদ্র হওয়ায় প্রায় সব পদার্থের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে পারে কোনোরকম মিথস্ক্রিয়ায় জড়ানো ছাড়াই। গবেষকেরা প্রোটনের স্বরূপ জানতে প্লাস্টিকের অণুতে নিউট্রিনো দিয়ে আঘাত করেন। এর মধ্যে কিছু নিউট্রিনো প্লাস্টিকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রোটনে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। হ্যাঁ, প্রোটন পর্যবেক্ষণের জন্য গবেষক দলটি হাইড্রোজেনকেই বেছে নিয়েছিল। কারণ, একমাত্র হাইড্রোজেনের মধ্যেই একটি মাত্র প্রোটন থাকে। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। নিখুঁত যন্ত্রের পাশাপাশি তাত্ত্বিক অনেক জটিলতা সমাধান করতে হয়েছে গবেষকদের। কার্বন পরমাণু থেকে ধাক্কা খেয়ে ফেরা নিউট্রিনোদের গতি-প্রকৃতি হিসেব করে, প্রচুর ডেটা বিশ্লেষণ করে অবশেষে তাঁরা হাইড্রোজেনের প্রোটন কেমন, তা জানতে সক্ষম হন। এ গবেষণায় কেবল যে প্রোটনের গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কেই জানা গেছে, তাই নয়। বরং নিউট্রিনো কীভাবে অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তাও জানা সম্ভব হয়েছে।
পরমাণুর এক্স-রে ছবি ও বৈশিষ্ট্য শনাক্ত
শুধু প্রোটনের গঠন নয়, পরমাণুর ছবিও তুলেছেন বিজ্ঞানীরা এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয় ও আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরেরির ২০ গবেষক দুটি ভিন্ন পরমাণুর ভেতরে উঁকি দেন এক্স-রের সাহায্যে।
এ জন্য গবেষক দলটি আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত কণাত্বরক যন্ত্র ব্যবহার করে। এই কণাত্বরক যন্ত্রের পরিধি এক মাইলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এতে উচ্চগতিতে চলমান ইলেকট্রনগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে না। এর পরিবর্তে গতিশীল ইলেকট্রনগুলো একটি অস্থির চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় ইলেকট্রনের অতিরিক্ত শক্তি এক্স-রে আকারে বিকিরিত হয়।
নির্দিষ্ট পরমাণু ব্যবহার করে কীভাবে আরও ভালো পদার্থ তৈরি করা যায়, এর মাধ্যমে তা জানা যাবে। প্রোটিন নিয়ে গবেষণার জন্যও আবিষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভবিষ্যতে টিকা তৈরির কাজেও প্রভাব ফেলবে এক্স-রের এই নতুন ব্যবহার।
এ ছাড়াও গবেষক দলটি স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপির সঙ্গে এক্স-রের সমন্বয় করেছেন। সম্মিলিত এই ব্যবস্থাকে তাঁরা বলছেন, সিনক্রোটন এক্সরে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি বা এসএক্স-এসটিএম (SX-STM)। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকেরা সফলভাবে দুটি ভিন্ন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস শনাক্ত করেছেন। এদের একটি লোহার পরমাণু, অন্যটি টারবিয়ামের পরমাণু। টারবিয়াম একটি বিরল ধাতু।
গবেষক দলটির মতে, তাঁদের এই আবিষ্কার নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।যেমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার।আর কৌশলটি আরও আয়ত্তে আনা গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়া আরও নিখুঁত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
সময়ের দ্বি-চিড়
যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক রিকার্ডো স্যাপিয়েঞ্জা ও তাঁর পিএইচডি শিক্ষার্থী রোমিয়ান টিরোল এ বছর সময়ের দ্বি-চিড়ের মাধ্যমে আলোর ব্যতিচার পরীক্ষা করেছেন সফলভাবে। ১৮০১ সালের দিকে ব্রিটিশ পদার্থবিদ টমাস ইয়ং দ্বি-চিড়ের মাধ্যমে আলোর ব্যতিচার ধর্ম প্রমাণ করেন। ইয়ংয়ের এই দ্বি-চিড় পরীক্ষা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম সফল ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব আরও শক্ত ভিত্তি পায়। পরীক্ষাটি করার জন্য ইয়ং (স্থানের মধ্যে) একটি অস্বচ্ছ পদার্থে খুব কাছাকাছি সূক্ষ্ম দুটি ছিদ্র করেন। এরপর সেই ছিদ্র দিয়ে সমদশার আলোকরশ্মি পাঠান। আলোরশ্মি ছিদ্র দিয়ে ভাগ হয়ে পর্দায় পড়লে দেখা যায়, সেখানে উজ্জ্বল ও অন্ধকার অঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে এমনটা ঘটে। আলোর তরঙ্গ দুটি যখন পরস্পর সমদশায় মিলিত হয়, তখন উজ্জ্বল দেখায়। আর বিপরীত দশায় মিলিত হলে অন্ধকার দেখায়।
ইয়ংয়ের সেই পরীক্ষার পর পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই গবেষক চিন্তা করেন, স্থানের বদলে এই পরীক্ষায় সময়ের চিড় ব্যবহার করলে কেমন হয়। সে লক্ষ্যে তাঁরা বিশেষ ধরনের প্রতিফলক তৈরি করেন। যেটা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বন্ধ ও চালু করা যায়। এই যে অল্প সময়ের ব্যবধানে বন্ধ-চালু করার বিষয়টি, একেই বলা হচ্ছে সময়ের দ্বি-চিড়।
গবেষকেরা দেখেন, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিফলনের ফলে ফেরা আলোক তরঙ্গ ভিন্ন কম্পাঙ্কে ব্যতিচার ধর্ম দেখাচ্ছে। অর্থাৎ, স্থানভিত্তিক উজ্জ্বলতা পরিবর্তনের বদলে দেখা যাচ্ছে, কম্পাঙ্কের পরিবর্তন হচ্ছে। তাঁদের এই গবেষণা বিভিন্ন আলোক কম্পিউটিং বা যোগাযোগ ও সিগন্যাল প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে অপটিক্যাল সুইচ হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবেই একে দেখছেন অনেকে।
জীবিত কোষের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহী
জীবন্ত টিস্যুর মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহী বা ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরির উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে এ বছর। সুইডেনের লিঙ্কোপিং ইউনিভার্সিটি, লুন্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গের জেনোফোন স্ট্রাকোসাস, হ্যান বিসম্যানস, ম্যাগনাস বার্গগ্রেন ও তাঁদের সহকর্মীরা এ আবিষ্কার করেন।
প্রাণিকোষ সাধারণত খুব স্পর্শকাতর ও নমনীয় হয়। তাই এর মধ্যে সরাসরি শক্ত বিদ্যুৎ পরিবাহী কিছু প্রবেশ করানো যায় না। তাতে কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা শরীরের মধ্যে ইলেকট্রোড (বিদ্যুৎ পরিবাহী উপাদান) তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের জেল ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করান। জীবিত টিস্যুর মধ্যে জেলের এনজাইমগুলো এন্ডোজেনাস মেটাবোলাইটকে ভেঙে দেয়। ফলে জেলের জৈব মনোমারগুলোর (একক অংশগুলোর) এনজাইমেটিক পলিমারাইজেশন সক্রিয় হয়ে ওঠে। তরল জেল পরিণত হয় নরম, কিন্ত স্থিতিশীল বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থে। জেব্রাফিশ ও জোঁকের দেহকোষে এ পরীক্ষা চালানো হয়। তাতে সফলতাও মেলে।
জীবিত কোষে এ ধরনের বিদ্যুৎ পরিবাহী ব্যবহারে মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রের জটিল ইলেকট্রনিক সিগন্যাল আরও সূক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে।এতে গবেষণাসহ বিভিন্ন স্নায়ুজনিত রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা করা আগের চেয়ে আরও অনেক সহজ ও কার্যকর হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি
পদার্থবিজ্ঞানের দুই ভিত্তি, আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যকার দ্বন্দ বহুদিনের। কোয়ান্টাম তত্ত্ব পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার জগৎকে ব্যাখ্যা করে। অন্যদিকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে ব্যাখ্যা করে মহাকর্ষকে। বৃহৎ পরিসরে এ তত্ত্ব কার্যকর। সমস্যা হলো, তত্ত্ব দুটি পরস্পরকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। ফলে প্রকৃতির অনেক কিছু আজও ব্যাখ্যা করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা এ দুটি তত্ত্ব একীভূত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সফলতা আসেনি।
অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, তত্ত্ব দুটি একীভূত করতে হলে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে সংশোধন বা কোয়ান্টাইজড করতে হবে। এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে দুটি অনুকল্প দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো, স্ট্রিং তত্ত্ব ও লুপ কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব। কিন্তু এখনও পরীক্ষামূলক প্রমাণ না মেলায় সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এগুলো।
নতুন এ গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ইউসিএলের পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোনাথন ওপেনহাইম। তাঁদের মতে, স্থানকালের ধারণা হয়তো ভুল নয়। তাই স্থান-কাল পরিমার্জনের বদলে তাঁরা কোয়ান্টাম তত্ত্ব সংশোধনের দিকে নজর দেন। একে ‘পোস্টকোয়ান্টাম থিওরি অব ক্লাসিক্যাল গ্র্যাভিটি’ বলছেন তাঁরা।
এ গবেষণার ফলাফল এখনই প্রমাণের সুযোগ অবশ্য হয়নি। কমপক্ষে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে সে জন্য। তবে তাঁদের এ প্রচেষ্টা সফল হলে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর সমাধান মিলবে, সে আশা করাই যায়।