এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে কী হতো

ঘর্ষণ বলের কারণেই আমরা চলাচল করতে পারি। ধীরে চলতে পারি, থামতে পারি প্রয়োজনে। সম্ভাবনা আছে, এই লেখাটি আপনি স্মার্টফোনে পড়ছেন। ফোনটা যে হাতে ধরে আছেন, সেটাও সম্ভব হয়েছে ঘর্ষণ বলের কারণে। সত্যি কথা বলতে কি, ঘর্ষণ বল ছাড়া দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ কাজই আমরা করতে পারতাম না।

পদার্থ হলে তাতে ঘর্ষণ বল থাকবেই। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ঘর্ষণ বল ছাড়া পৃথিবী কেমন হতো, তা আমরা কল্পনা করতেই পারি। এটা একধরনের মানস পরীক্ষা। কোনো কিছুর গুরুত্ব বুঝতে এরকম পরীক্ষা বা কল্পনা বেশ কার্যকর। এই লেখায় বৈজ্ঞানিক যুক্তির বুননে সেই কাল্পনিক জগতের খানিকটা দেখব। জানার চেষ্টা করব, মাত্র ১ মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে পৃথিবীর আসলে কী অবস্থা হতো। তবে তার আগে ঘর্ষণ বল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা একটু বুঝে নেওয়া যাক।

ঘর্ষণ ক্রিয়া বাড়ানোর জন্য রাস্তা পুরোপুরি মসৃণ করা হয় না। পাথর ও পিচের রাস্তা থাকে অমসৃণ

পৃথিবী বা বস্তুজগতের জন্য ঘর্ষণ বল এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার মূল কারণ হলো, এটা সরাসরি বস্তুর গতিকে প্রভাবিত করে। নির্দিষ্ট দিকে বস্তু চলার সময় ঘর্ষণ বল কাজ করে ঠিক বিপরীত দিকে। এটা আমরা সবচেয়ে সহজে বুঝতে পারি মেঝেতে একটা বল বা গোলক গড়িয়ে দিলে। মেঝের ঘর্ষণ বলের কারণেই বলটা কিছুদূর এগিয়ে থেমে যায়। কারণ, বল যেদিকে এগোচ্ছে, ঘর্ষণ বল তার বিপরীতে কাজ করে। বলটাকে এগোতে বাধা দেয়। শুনে হয়তো মনে হচ্ছে, এই বল আমাদের জন্য ঝামেলা ছাড়া কিছুই তৈরি করে না। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। উদাহরণ হিসেবে হাঁটার কথাই ধরা যাক। আমাদের পা মাটিতে পেছনের দিকে ধাক্কা দেয়। পা যে এই ধাক্কা দিচ্ছে, এটা সম্ভব হচ্ছে মাটির সঙ্গে পায়ের ঘর্ষণ বলের কারণে। বিপরীতে মাটিও পা-কে সামনের দিকে প্রতিক্রিয়া বলে ঠেলে দেয়। আমরা সামনে এগিয়ে যাই।

খেয়াল করলে দেখবেন, শক্ত মাটির চেয়ে চকচকে টাইলসের মেঝেতে হাঁটা কিছুটা অসুবিধাজনক। এর কারণ হলো, শক্ত মাটির চেয়ে চকচকে টাইলসের ঘর্ষণ সক্ষমতা অনেক কম। অন্যভাবে বললে, মাটি অনেকটা রুক্ষ। সে তুলনায় টাইলস বেশ মসৃণ। ফলে এটা কোনো বস্তুকে কম আটকে রাখতে পারে। একটু অসর্তক হলেই জুতো পায়ে পিছলে পড়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা এ ক্ষেত্রে।

একই উদাহরণ যানবাহনের বেলায়ও খাটে। ঘর্ষণ ক্রিয়া বাড়ানোর জন্য রাস্তা পুরোপুরি মসৃণ করা হয় না। পাথর ও পিচের রাস্তা থাকে অমসৃণ। তা ছাড়া এই ঘর্ষণ বল আরও বাড়ানোর জন্য গাড়ির চাকা বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়। ঘর্ষণ বল বাড়ানোর ফলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা বেড়ে যায় বহুগুণে।

যে মুহূর্তে ঘর্ষণ বল অকার্যকর হয়ে পড়বে, ঠিক সে মুহূর্তেই আপনার হাতে ধরে রাখা সব কিছু পড়ে যাবে মাটিতে। অথবা উড়ে যাবে আকাশে

এমন আরও হাজারো সুবিধা আছে ঘর্ষণের। বিপরীতে অসুবিধাও কম নেই। ঘর্ষণের কারণে প্রতিনিয়ত প্রচুর শক্তি অপচয় হয়। ভারী জিনিস ঠেলে নিতে খুব কষ্ট হয় আমাদের। কিন্তু এত সুবিধার বিপরীতে এটুকু অসুবিধা তো মেনে নিতেই হবে। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য আমাদের সেই মানস পরীক্ষায় ফেরা যাক। তাহলেই বুঝতে পারবেন, এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল অকার্যকর হয়ে পড়লে পৃথিবী জুড়ে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়, চরম বিশৃঙ্খলা।

যে মুহূর্তে ঘর্ষণ বল অকার্যকর হয়ে পড়বে, ঠিক সে মুহূর্তেই আপনার হাতে ধরে রাখা সব কিছু পড়ে যাবে মাটিতে। অথবা উড়ে যাবে আকাশে। আপনি নিজে হয়তো পড়ে যাবেন না। কিন্তু হাঁটতে গেলে দেখবেন, আর এগোতে পারছেন না।

যেহেতু ঘর্ষণ বল নেই, তাই গাড়ির ব্রেকও আর কাজ করবে না। সমগতিতে এগিয়ে যেতে থাকবে রাস্তা ধরে। এটাকে বরং ‘ভেসে যাওয়া’ বলাই ভালো। রাস্তার ওপর গাড়ি একরকম ভেসে ভেসে এগোতে থাকবে, মসৃণ বরফের ওপর দিয়ে কোনো কিছু গড়িয়ে দিলে যেমন হয়, সেরকম। কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার আগে গতি কমার কোনো সুযোগ নেই। ফলাফল, মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর নানা জায়গায় শুরু হবে দুর্ঘটনার তাণ্ডব। শুধু গাড়ি নয়, চলমান যেকোনো জিনিসেরই হবে এই পরিণতি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

উড়ন্ত বস্তুদের আরও খারাপ অবস্থা হবে। ঘর্ষণ বল নেই তো বাতাসের বাধাও আর কাজ করবে না। ফলে খেচর প্রাণীরা আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো টুপটাপ ঝরে পড়বে মাটিতে। সাধারণ উড়োযানের ভাগ্যেও ঘটবে একই ঘটনা। এসবই হবে মুহূর্তের মধ্যে। যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ক্ষতিও বাড়বে সমান তালে। মোট কথা, ঘর্ষণ বল ছাড়া আমাদের চিরচেনা পৃথিবী অচেনা হয়ে যাবে মুহূর্তে। অচেনা সেই পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ এখনকার পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে করা গেলেও জীবনযাত্রা হবে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। আমাদের জন্য জীবন হয়ে উঠবে দুঃসহ। আশার কথা হলো, বাস্তবে ঘর্ষণহীন পৃথিবী বা বস্তুজগৎ হয়তো সম্ভব নয়।

প্রতিদিনের জীবনে আমরা ঘর্ষণ বল আলাদাভাবে অনুভব করি না তেমন। বাতাসের মতোই খুব স্বাভাবিক বিষয় এটি আমাদের কাছে। অথচ স্বাভাবিক এই বিষয়টি যে কত প্রয়োজনীয়, তা বোঝা যায় ঘর্ষণহীন জগৎ কল্পনা করলে। ছোট ছোট এই বিষয়গুলো পৃথিবীকে কত সুন্দর করে রেখেছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। নতুনভাবে উপলব্ধি করা যায় আমাদের চিরচেনা এই পৃথিবীর মাহাত্ম্য। এজন্যই ‘না থাকলে কী হতো’—এ ধরনের মানস পরীক্ষাগুলো করে দেখা জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া