পরমাণু কি স্পর্শ করা যায়

ছবি: গেটি ইমেজ

প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক ডেমোক্রিটাস মনে করতেন, আমাদের চারপাশে যেসব জিনিস ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ভাঙা সম্ভব। পদার্থের অতিক্ষুদ্র এসব কণিকার নাম দেন অ্যাটম (Atom)। গ্রিক এ শব্দের আক্ষরিক অর্থ অবিভাজ্য। খ্রীষ্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে ডেমোক্রিটাস এ তত্ত্ব দেন। তার কিছুকাল আগে শুরু হয়েছে দর্শন থেকে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব নির্মাণের চেষ্টা। তখন ঠিক পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে তত্ত্ব আবিষ্কারের চল ছিল না। বরং দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তিতর্কের জাল ছেঁকে দার্শনিকেরা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন।

ডেমোক্রিটাসের চিন্তায় ছিল, পদার্থকে ভেঙে অসীম পর্যন্ত ছোট করা সম্ভব নয়। একটি পর্যায়ে এসে আর ভাঙার সুযোগ থাকে না। তাঁর এই অভিবাজ্য পদার্থের কণাগুলো সুষম, শক্ত এবং এদেরকে সংকুচিতও করা যায় না। এখন আমরা জানি, পরমাণু পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণিকা নয়। এর ভেতরেও আছে নানা কারসাজি। কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে, সেই আড়াই হাজার বছর আগের একজন মানুষ শুধু যুক্তিতর্ক দিয়ে এমন একটি উপসংহার টেনে ছিলেন! বর্তমানে পরমাণুর ধারণা অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেলেও পরমাণু শব্দটি একেবারে মুছে যায়নি। পরমাণুকে ভেঙে আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের কথা বলতে পারি। কিংবা আরেকটু গভীরে গিয়ে কোয়ার্কের কথাও বলা যায়। কিন্তু তখন পদার্থের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পদার্থের বৈশিষ্ট্য অটুট রাখতে হলে পরমাণুতে এসে আমাদেরকে থামতে হয়।

তাই আমরা যখন পদার্থকে স্পর্শের কথা বলি, তখন পরমাণুকে সামনে রাখতেই হয়। পরমাণুকে স্পর্শ করা যায় কি না, এ প্রশ্ন শুনতে খুব একটা জটিল মনে হয় না। তবে উত্তরটা একটু জটিল।

আচ্ছা বলুন তো, স্পর্শ বলতে আপনি কী বোঝেন? যে কোনো দুটি বস্তুর বাইরের পৃষ্ঠ একে অন্যের সঙ্গে লেগে যাওয়া, তাই তো? এমনভাবে লেগে যেতে হতে হবে যেন এর মধ্যে কোনো ফাকা জায়গা না থাকে। এ শর্ত পূরণ করলে আমরা বলতে পারি, বস্তু দুটি একে অন্যকে স্পর্শ করেছে।

আরও পড়ুন

সমস্যা হলো, পদার্থের পরমাণুর ক্ষেত্রে স্পর্শের এই সংজ্ঞাটা তেমন কাজে আসে না। স্পর্শ হতে হলে তো পৃষ্ঠ থাকতে হবে। আক্ষরিক অর্থে পরমাণুর কোনো পৃষ্ঠ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার বাইর্ড এমনটাই বলছেন। তিনি একা নন, গোটা পদার্থবিজ্ঞানই এ কথা বলে। পরমাণুর নির্দিষ্ট কোনো বাইরের পৃষ্ঠ নেই।

ডেমোক্রিটাস পরমাণুকে যে শক্ত কঠিন কণা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, আদতে পরমাণু সেরকম কিছু নয়। এটা মূলত হরেকরকম মৌলিক কণার দিয়ে তৈরি। যেগুলো আবার আলাদা আলাদা নিয়মে একে অন্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। পরমাণুর ভরের প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ জমা থাকে নিউক্লিয়াসে। কিন্তু জায়গা দখলের বেলায় নিউক্লিয়াসের আবার ভীষণ অনাগ্রহ। গোটা পরমাণুর প্রায় ১০ হাজার ভাগের একভাগ জায়গায় চেপেচুপে থাকে নিউক্লিয়াস।

একটি পরমাণুর ইলেকট্রনের কক্ষপথ আরেকটির পরমাণুর ইলেকট্রন কক্ষপথের সঙ্গে যখন মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, তখন তার ভৌত বা রাসায়নিক প্রভাব দুটি পরমাণুর ওপরেই পড়ে।
আরও পড়ুন

আরেকটু গভীরে তাকালে দেখা যাবে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে গাদাগাদি করে বসে আছে প্রোটন আর নিউট্রন। এরা আবার কোয়ার্ক এবং গ্লুওন কণা দিয়ে তৈরি। প্রতিটা মৌলের ভেতরে প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার পার্থক্য থাকে। কিংবা বলা যায়, পার্থক্য থাকে বলেই মৌলগুলো আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের হয়। যেমন সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেনের ভেতরে থাকে একটা প্রোটন, কিন্তু কোনো নিউট্রন থাকে না। আবার ইউরেনিয়ামের মধ্যে থাকে ৯২টি প্রোটন, ১৪৬টি নিউট্রন। সাধারণত নিরপেক্ষ (চার্জ নিরপেক্ষ) একটি পরমাণুতে প্রোটনের সমানসংখ্যক ইলেকট্রন থাকে। এই ইলেকট্রনের মোট ভর পরমাণুর মাত্র ০.১ শতাংশ। কিন্তু কতখানি জায়গা দখল করে জানেন? একটি পরমাণুর ১০ হাজার ভাগের প্রায় ৯,৯৯৯ ভাগ জায়গায় এদের বিচরণ। ইলেকট্রনকে কণা বলার সুযোগ নেই। এটি একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গের মত আচরণ করে। তাই পরমাণুর চারপাশে ইলেকট্রন থাকে, এ কথা বলার চেয়ে বরং ইলেকট্রনের মেঘ থাকে বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। মজার ব্যাপার হলো, ইলেকট্রনের মেঘ কোনো কঠিন বায়বীয় বস্তু নয়। এটি শূন্যস্থান আর শক্ত মিশ্রনে তৈরি এক অদ্ভুত স্থান। এই ইলেকট্রনের মেঘ পরমাণুকে স্পর্শ করার ধারণা বেশ জটিল করে তোলে। ইলেকট্রনের এই মেঘকে আমরা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মত ভৌত বা রাসায়নিক প্রভাব তৈরির বিন্দু হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।

অধ্যাপক বেয়ার্ড বলেন, ‘একটি পরমাণুর ইলেকট্রনের কক্ষপথ আরেকটির পরমাণুর ইলেকট্রন কক্ষপথের সঙ্গে যখন মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, তখন তার ভৌত বা রাসায়নিক প্রভাব দুটি পরমাণুর ওপরেই পড়ে। পারমাণবিক স্তরে এটাকে স্পর্শের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা বলা যায়।

এই স্পর্শ হতে পারে তড়িৎচুম্বকীয় বল, মহাকর্ষ বলসহ বিভিন্ন বল ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ফলাফল। তরল ও কঠিন পদার্থে পরমাণুরা একে অন্যের স্পর্শে এসে রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। গ্যাসীয় কণারা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেয়ে বরং ধাক্কাধাক্কি করতে বেশি পছন্দ করে।

আরও পড়ুন

যাহোক, আমরা যখন একটি চেয়ার বা দেয়াল স্পর্শ করি, তখন মূলত আমাদের হাতের পরমাণুগুলোর ইলেকট্রন মেঘ এবং চেয়ারের পরমাণুগুলোর ইলেকট্রন মেঘের মধ্যে একধরনের মিথস্ক্রিয়া শুরু হয়। ফলে বস্তুটির উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। একে বাস্তব জীবনের মানদণ্ডে স্পর্শ বলা যায়। কিন্তু পরমাণু কি তাহলে স্পর্শ করা গেল? সম্ভবত না। কারণ, পারমাণবিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পর্শ আর আমাদের স্পর্শ সম্পর্কিত ধারণা পুরোপুরি মেলে না।

তবে পরমাণুকে ছুতে না পারলেও আমি আপনি পরমাণু দিয়েই তৈরি। এদের পারস্পরিক বিক্রিয়াই (নাকি স্পর্শ) আমাদের চারপাশের বস্তুজগৎ তৈরি করে। রাসায়নিক বিক্রিয়া, তাপ, কম্পন, শব্দতরঙ্গ—সবকিছুর পেছনেই রয়েছে পরমাণুগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য। আমাদের পরিচিত বস্তুজগতের মূল ভিত্তি পরমাণুর এই অদৃশ্য স্পর্শই। 

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: লাইভ সায়েন্স