ট্রান্সইউরেনিয়াম দেয়াল ভাঙ্গার গল্প - পর্ব ২

এনরিকো ফার্মির নামে মহাবিশ্বের সব বস্তুকণার নাম রাখা হয়েছে ফার্মিওন। এককালে মুসোলিনির ইতালিতে তিনি বিখ্যাত ছিলেন ‘দ্য পোপ’ বা ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে। তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন প্যানিস্পারনা বয়েজ। তাঁদের নিয়ে ভুলভাবে নোবেল পেয়ে গেলেন ফার্মি… বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর আখ্যান।

ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল (পর্যায় সারণির ইউরেনিয়ামের পরের অবস্থানগুলোর মৌল) আবিষ্কারের খবরে রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন ফার্মিসহ প্যানিস্পারনা বয়েজের সদস্যরা। তবে সবাই যে একবাক্যে তাঁদের আবিষ্কার মেনে নিয়েছিল, তা নয়। কয়েকজন ঠিকই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জার্মান রসায়নবিদ আইডা নোডাকের নাম। তাঁর মতে, ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস মোটেই বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে আরও ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়নি, বরং সেটি ভেঙ্গে গিয়ে তৈরি করেছে অপেক্ষাকৃত হালকা দুটি মৌলের নিউক্লিয়াসে—যেগুলো অনেক আগে থেকেই অবস্থান করছে আমাদের চেনা-জানা মৌলদের তালিকায়।

বলা বাহুল্য, কেউ তখন নোডাকের কথায় কর্ণপাত করেনি। সবাই তখন ব্যস্ত ফার্মি-বন্দনায়। সুযোগ বুঝে মুসোলিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন পত্রিকাগুলো নতুন মৌল আবিষ্কারের ঘটনাকে সরকারের সফলতা হিসেবে ফলাও করে প্রচার করতে শুরু করে। তারা একে আখ্যা দেয় ‘ফ্যাসিস্ট ভিক্টরিস ইন দ্য ফিল্ড অব কালচার’ হিসেবে। অন্যদিকে দ্বিতীয় সারির সংবাদপত্রগুলো নানা আজগুবি খবর ছাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেমন ফার্মি নাকি ইতালির রানিকে এক বোতল মৌলিক পদার্থ ৯৩ উপহার দিয়েছেন। আদতে তিনি এমনটা কখনো করেননি।

দ্রুতই ফার্মির ধীর গতির নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার আইডিয়া বৈজ্ঞানিক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বড় বড় ল্যাবরেটরিগুলোও ব্যবহার করতে শুরু করে এই পদ্ধতি। এর প্রয়োগে নতুন মৌল আবিষ্কারের মাধ্যমে মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির ফাঁকা স্থানগুলো পূরণে আদা-জল খেয়ে নামেন তাঁরা

নবআবিষ্কৃত মৌল দুটির নামকরণ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বেশ চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ফার্মিকে। প্রাচীন রোমের লিক্টরদের সঙ্গে মিলিয়ে মৌলগুলোর নাম রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ফার্মি অবশ্য সেটি অগ্রাহ্য করেছিলেন। ক্রমানুসারে মৌলগুলোর নাম হিসেবে তিনি পছন্দ করেছিলেন অসোনিয়াম (Ausonium) এবং হেস্পারিয়াম (Hesperium) শব্দ দুটি। প্রথম শব্দটি এসেছে ইতালির গ্রিক নাম অসোনিয়া (Ausonia) থেকে, আর দ্বিতীয়টি এসেছে ইতালির আরেক কাব্যিক নাম হেস্পারিয়া (Hesperia) থেকে।

গবেষণাগারের বাইরে নানা খাতে ঘটনা প্রবাহিত হতে থাকলেও ফার্মির মূল ফোকাস কিন্তু কখনো অন্যদিকে সরে যায়নি। সে জন্যই হয়তো ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের মধ্যেই আরেক দফা অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছিলেন তিনি। অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন, যদি নিউট্রন বিমের যাত্রাপথে বিশেষ কিছু বস্তু—যেমন প্যারাফিন ওয়াক্স—রেখে দেওয়া হয়, তাহলে উল্লেখযোগ্য হারে এদের বেগ কমে যায়। তখন নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার পরীক্ষায় আগের চেয়ে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। অচিরেই ফার্মি বুঝতে পারলেন, প্যারাফিন ওয়াক্সের অণুর মধ্যে থাকা হাইড্রোজেনই এর জন্য দায়ী। এদের সঙ্গে সংঘর্ষেই কমে আসে নিউট্রনদের গতিবেগ। কথিত আছে, রহস্য উদ্ঘাটনের পরে তিনি চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ফ্যান্টাস্টিক! ইনক্রেডিবল! ব্ল্যাক ম্যাজিক!

এভাবে ফার্মির হাত ধরে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর তৈরির মূল সূত্র মানুষের হাতের নাগালে চলে আসে। আধুনিক পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রগুলোতে সাধারণত পানি ব্যবহার করেই নিউট্রনদের গতিবেগ কমানো হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম মডারেশন। কম গতির নিউট্রনদের অপেক্ষাকৃত সহজে শোষণ করতে পারে পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো। ফলে হরেকরকম নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার সম্ভাব্যতা বহুগুণে বেড়ে যায়।

'দ্য পোপ অব ফিজিকস' এনরিকো ফার্মি

দ্রুতই ফার্মির ধীর গতির নিউট্রন দিয়ে নিউক্লিয়াসকে আঘাত করার আইডিয়া বৈজ্ঞানিক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বড় বড় ল্যাবরেটরিগুলোও ব্যবহার করতে শুরু করে এই পদ্ধতি। এর প্রয়োগে নতুন মৌল আবিষ্কারের মাধ্যমে মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির ফাঁকা স্থানগুলো পূরণে আদা-জল খেয়ে নামেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী সামিল হন এই প্রতিযোগিতায়। তবে সে সময় ভাগ্যদেবী হয়তো একটু বেশি প্রসন্ন ছিলেন ইতালীয়দের প্রতি। ১৯৩৭ সালে ফার্মির অন্যতম সহকর্মী এমিলিও সেগ্রা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি থেকে আসা একটি ফিল্টার পরীক্ষা করছিলেন। এর মধ্যেই তিনি হঠাৎ অস্তিত্ব খুঁজে পান পর্যায় সারণির মিসিং বা এতদিন অধরা মৌলিক পদার্থ ৪৩, টেকনিশিয়ামের। উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন বা বিকিরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অজান্তেই তেজস্ক্রিয় মৌলটি তৈরি করে ফেলেছিলেন বার্কলির বিজ্ঞানীরা। অথচ ভাগ্যের সহায়তা না থাকায় তাঁরা এটি নিজেরা শনাক্ত করতে পারেননি। টেকনিশিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব যায় এমিলিও সেগ্রা ও কার্লো পেরিয়ারের ঘরে। প্যানিস্পারনা বয়েজের মুকুটে যুক্ত হয় সাফল্যের আরেকটি পালক।

১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর সকালে ফার্মির ঘুম ভাঙ্গে একটি দুসংবাদ শুনে। আগের রাতে জার্মানিতে বহু ইহুদি পরিবারের ওপরে চরম সহিংসতা চালানো হয়েছে। তাঁদের দোকানপাট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়েছে প্রার্থনালয়গুলো

২.

কথায় আছে, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। প্যানিস্পারনা বয়েজের বেলায় বাক্যটি যেন একদম অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ক্রমেই তাঁদের হাসি-আনন্দমাখা রোমাঞ্চকর দিনগুলো ফুরিয়ে আসে। ইউরোপজুড়ে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। জার্মানির কুখ্যাত একনায়ক এডলফ হিটলারের দেখানো ঘৃণার পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেন ইতালির ফ্যাসিজমের প্রবর্তক মুসোলিনী। অ্যান্টি-সেমিটিজম দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতালিতে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অচিরেই ফার্মি ও তাঁর দলের সদস্যরা বুঝতে পারেন, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

১৯৩৮ সালে এমিলিও সেগ্রা মৌলিক পদার্থ ৪৩ নিয়ে আরও গবেষণা করতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। ঠিক তখনই ঘোষণা আসে, এখন থেকে ইহুদিরা আর ইতালি জাতিসত্ত্বার অংশ হতে পারবে না। সেই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ইহুদিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ব্যাপারে। সেগ্রা নিজে যেমন ইহুদি ছিলেন, তেমনি বিয়েও করেছিলেন নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদি শরণার্থীকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই দম্পতি আর দেশে ফিরে না আসার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বুকে পাথর বেঁধে ক্যালিফোর্নিয়াকে আপন করে নেন তাঁদের নতুন ঠিকানা হিসেবে।

এনরিকো ফার্মি নিজে ইহুদি না হলেও তাঁর স্ত্রী লরা ফার্মি ছিলেন ইহুদি ধর্মালম্বী। স্ত্রী-কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশান্তরী হওয়া ছাড়া ফার্মির সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। অগত্যা পালানোর সম্ভাব্য উপায় খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। সে বছরেরই গোড়ার দিকে একটি বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সে বিখ্যাত ড্যানিশ পদার্থবিদ নীলস বোর তাঁকে একপাশে ডেকে নিয়ে জানিয়েছিলেন, মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে ফার্মির নাম। যদি সত্যি এমনটা হয়, তাহলে হাতে আসা টাকা-কড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন জীবন শুরু করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। চট করে মনে মনে ফার্মি হিসেব কষে দেখলেন, সে বছর তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা প্রায় নব্বই শতাংশ!

১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর সকালে ফার্মির ঘুম ভাঙ্গে একটি দুসংবাদ শুনে। আগের রাতে জার্মানিতে বহু ইহুদি পরিবারের ওপরে চরম সহিংসতা চালানো হয়েছে। তাঁদের দোকানপাট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়েছে প্রার্থনালয়গুলো। আহত-নিহত হয়েছেন অনেকে। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনাটি পরিচিত ‘দ্য নাইট অব ব্রোকেন গ্লাস’ নামে।

খবর শোনার কিছুক্ষণ পর আবার বেজে ওঠে ফার্মির বাসার টেলিফোন। না, এবারে কোনো দুঃসংবাদ নয়। জানানো হলো, সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ স্টকহোম (হোম অব দ্য নোবেল কমিটি) থেকে তাঁকে একটি ফোনকল করা হতে পারে। টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রেখে ফার্মি স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে বের হলেন। নিজেই দোকানে গিয়ে পছন্দ করে কিনলেন এক জোড়া দামি ঘড়ি। তারপর স্ত্রীর হাতে হাত রেখে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ালেন শহরময়। এ যেন ছিল প্রিয় মাতৃভূমিকে নিভৃতে বিদায় জানানোর আয়োজন।

ফার্মি দম্পতি—এনরিকো ও লরা ফার্মি
জাহাজে উঠেই ফার্মি শুনতে পান তাঁর বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। তিনি এবং প্যানিস্পারনা বয়েজের সদস্যরা মোটেও কোনো নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করতে পারেননি!

সেদিন সন্ধ্যায় ফার্মি দম্পতি রেডিওতে একের পর এক দুঃসংবাদ শুনতে পাচ্ছিলেন। পুরো ইতালিজুড়ে জারি করা হয়েছে ইহুদি বিদ্বেষমূলক সব আইন। রহিত করা হয়েছে তাঁদের মৌলিক নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও স্বাধীনতা। জব্দ করা হয়েছে পাসপোর্ট। স্কুলের ত্রি-সীমানায় পা রাখতে বারণ করা হয়েছে ইহুদি শিশুদের। প্রতিটি খবরই বারবার হৃদয় ভেঙ্গে দিচ্ছিল ফার্মি দম্পতির। ঠিক এমন সময়ে আবারও বাজল টেলিফোন। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হলো এনরিকো ফার্মির পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাপ্তির খবর। নিউট্রন ব্যবহার করে নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার এবং ধীর গতির নিউট্রন দিয়ে হরেকরকম নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়েছে এই সম্মাননা। এক মুহূর্তও দেরি না করে ফার্মি পুরস্কার গ্রহণে সম্মতি জানান। রাজি হন সপরিবারে সুইডেন গিয়ে মেডেল গ্রহণের। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী লেকচারারের চাকরির প্রস্তাবও লুফে নেন তিনি। দ্রুতই ঘর ছেড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশে সপরিবারে বেরিয়ে পড়েন ফার্মি। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। সেটা ১৯৩৮ সালের কথা। তারপর ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিরাপদে পেরিয়ে আসেন ইউরোপের গন্ডি। উঠে পড়েন পরবর্তী নিউইয়র্কগামী জাহাজে।

জাহাজে উঠেই ফার্মি শুনতে পান তাঁর বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। তিনি এবং প্যানিস্পারনা বয়েজের সদস্যরা মোটেও কোনো নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করতে পারেননি! সেই সঙ্গে তাঁরা হাতছাড়া করেছেন শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিজেদের করে নেওয়ার সুযোগ!

আরও পড়ুন

৩.

বিগত বছরগুলোতে নোবেল কমিটি বেশ কিছু প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে তারা লবোটমির আবিষ্কারক পর্তুগিজ বৈজ্ঞানিক ইগাস মোনিজকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। অথচ অকার্যকর ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই এই চিকিৎসা পদ্ধতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আবার ১৯২৬ সালে ড্যানিশ বৈজ্ঞানিক জোহানেস ফিবিগারকে নোবেল দেয়া হয়েছিল। যিনি ভাবতেন, ইঁদুরের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী একধরনের বিশেষ কৃমি। পরে এটি ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৩৮ সালে এনরিকো ফার্মির নোবেল প্রাপ্তির ঘটনাটিও অনেকটা একই রকম। তিনি মোটেও ট্রান্স-ইউরেনিয়াম মৌল খুঁজে পাননি। এক্সপেরিমেন্ট থেকে প্রাপ্ত অজানা বস্তুগুলোকে খুব সূক্ষ্মভাবে যাচাই করলে তিনি দেখতে পেতেন, এগুলো আসলে বোরন ও ক্রিপ্টন। অচেনা কিছু নয়। ফার্মির দিক থেকে পুরো ব্যাপারটাই অনিচ্ছাকৃত ভুল। তবে মজার বিষয় হলো, সেই সময়ে ভুলটুকু ধরা পড়লে এক ফোঁটাও হতাশ হতেন না তিনি। বরং হয়তো খুশিতে নাচ জুড়ে দিতেন। কারণ, নতুন মৌল আবিষ্কারের চেয়েও বিস্ময়কর এক কাজ তাঁরা করে ফেলেছেন, বিস্ফোরিত করেছেন পরমাণুকে!

শেষ পর্যন্ত এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব যায় জার্মান বৈজ্ঞানিকদের ঘরে। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে বার্লিনের কাইজার উইলহেলম ইন্সটিটিউট ফর কেমেস্ট্রিতে ফার্মির দেখানো পথ ধরেই ধীর গতির নিউট্রন ও ইউরেনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন রসায়নবিদ অটো হান এবং তার সহকারি ফ্রিটজ স্ট্রসম্যান। সবকিছু একই রকমভাবে করার পরেও কেন যেন বারবার অদ্ভুত ফলাফল হাতে পাচ্ছিলেন তাঁরা। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, কোনোভাবেই মৌলিক পদার্থ ৯৩-এর দেখা মিলছিল না। বরং বারবার আবির্ভূত হচ্ছিল বেরিয়াম পরমাণু!

অটো হান, লিজ মাইটনার ও ফ্রিটজ স্ট্রসম্যান

হন্যে হয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন অটো হান। অন্য অনেক সহকর্মীর মতন তিনি কিন্তু মোটেই নাৎসিবাদের সমর্থক ছিলেন না। মাত্র কয়েক মাস আগেই সাবেক ইহুদি ল্যাব পার্টনার লিজ মাইটনারকে জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন তিনি। এমনকি তাঁকে দিয়েছিলেন নিজের মায়ের হীরের আংটি, যেন দরকার পড়লে সীমান্ত রক্ষীদের ঘুষ দিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইউরেনিয়াম পরীক্ষায় প্রাপ্ত অদ্ভুত ফলাফলের ব্যাখ্যা অনুসন্ধানে এই মাইটনারেরই শরণাপন্ন হলেন হান। সেই সময়ে মাইটনার অবস্থান করছিলেন সুইডেনে, ভাগ্নে পদার্থবিদ অটো ফ্রিশের আশ্রয়ে। ফ্রিশ নিজেও ছিলেন দেশান্তরী। তাঁর বাবাকে নাৎসিরা আটকে রেখেছিল কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর একটিতে। অটো হানের চিঠি পেয়ে দুই ভাগ্য বিড়ম্বিত বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দুর্দশা একপাশে সরিয়ে রেখে নেমে পড়লেন সমস্যা সমাধানে।

১৯৩০-এর দশকে নিউক্লিয়াসকে মোটেই ভঙ্গুর কিছু হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। বরং এদের তুলনা করা হতো উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট তরল পদার্থের ফোঁটার সঙ্গে। বাইরে থেকে নিউট্রন এসে যুক্ত হলে এই ফোঁটাসদৃশ নিউক্লিয়াসদের কাঁপতে শুরু করার কথা। মাইটনারের মতে, বাড়তি শক্তির উপস্থিতিতে এরা অনেকটা ডাম্বেল আকার ধারণ করবে। একসময়ে সেখানে ক্রিয়াশীল আকর্ষণধর্মী শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল এবং বিকর্ষণধর্মী তড়িৎ বল পরস্পরকে নাকচ করে দেবে। ফলে মূল নিউক্লিয়াসের অংশগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হবে অপেক্ষাকৃত ছোট আলাদা দুটি নিউক্লিয়াসে। এভাবেই ফার্মি ও হানের পরীক্ষায় বারবার আবির্ভূত হচ্ছিল বেরিয়াম ও ক্রিপটনের মতো দূরবর্তী (অর্থাৎ পর্যায় সারণিতে ইউরেনিয়ামের তুলনায় দূরের) মৌলিক পদার্থগুলো। নিচের ছবিটি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন। বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন।

প্রিয় পাঠক, জার্মান রসায়নবিদ আইডা নোডাকের কথা মনে আছে? যিনি শুরু থেকেই ফার্মির নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিলেন? দেখা গেল, তাঁর অনুমানই শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হলো। যাহোক, মাইটনার চিঠি লিখে হানকে তাঁদের থিওরির কথা জানিয়ে দিলেন। গোটা প্রক্রিয়াটির নামকরণ করা হলো নিউক্লিয়ার ফিশন। নিউট্রনের পর এটাই ছিল সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার। খুব কাছে এসেও একে স্পর্শ করতে পারলেন না ফার্মি।

যেভাবে সংঘটিত হয় ফিশন
আরও পড়ুন

হান ও মাইটনারের গবেষণার দরুন রাতারাতি ফার্মির মৌলিক পদার্থ ৯৩ ও ৯৪ হারিয়ে গেলেও সম্পূর্ণ নতুন এক যুগে প্রবেশ করে পৃথিবী। যেখানে প্রথমবারের মতো পরমাণুর অন্তর্নিহিত শক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়।

একটি পরমাণুতে ফিশন সংঘটিত হলে অবমুক্ত হয় সামান্য পরিমাণ শক্তি। তবে অনেকগুলো পরমাণুতে যদি একসঙ্গে ফিশন ঘটে বা একের পর এক পরমাণুতে ধারাবাহিকভাবে ফিশন ঘটানো যায়, তাহলে পাওয়া যায় অচিন্তনীয় শক্তি। এই শক্তি ব্যবহার করে সহজেই আলোকিত করা যেতে পারে গোটা শহর। আবার চাইলে নিমিষেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায় বিশাল কোনো জনপদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ধ্বংসাত্মক কাজেই মনোযোগী হলেন বিজ্ঞানীরা। ফলে শুরু হলো ভয়ংকর মারণাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতা।

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র: সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবল, কিট চ্যাপম্যান