বিশেষ আপেক্ষিকতা ও কার্যকারণ সম্পর্ক

আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কিছুই ছুটতে পারে না। ও রকম হলে ধনুক থেকে তির ছোড়ার আগেই সেটি লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। কীভাবে? বিশেষ আপেক্ষিকতার সঙ্গে কারণ ও ফলাফলের সম্পর্ক...

বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দুটি স্বীকার্যের ওপর গঠিত। এক, পদার্থবিদ্যার নীতিমালা সব জড় রেফারেন্স কাঠামোতে (Inertial reference frame) একইভাবে কাজ করবে; দুই, শূন্যতায় সব জড় কাঠামোয় আলোর গতি বা দ্রুতি ধ্রুব হবে। জড় কাঠামো হলো এমন একটি কাঠামো, যার ত্বরণের মান শূন্য। এই দুটি স্বীকার্যের একটি ফলাফল হলো, আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হতো, সেটি মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক (Causality) রক্ষা করত না।

কার্যকারণ সম্পর্কটা কী? সেটা হলো, কোনো একটি ফলাফল (Result) পেতে হলে তার একটি উৎসগত কারণ (Cause) থাকতে হবে। তির লক্ষ্যে বিদ্ধ হতে হলে (ফলাফল) সেটিকে ধনুক থেকে ছুড়তে হবে (উৎসগত কারণ)।

এই লেখায় দেখানোর চেষ্টা করব, আলোর গতির চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করলে আর সেই ভ্রমণের পথটি অনুসরণ করতে পারলে এমন একটি রেফারেন্স কাঠামো পাওয়া সম্ভব, যে কাঠামোয় ফলাফলটি কারণের আগেই সংঘটিত হবে; অর্থাৎ তিরটিকে ধনুক থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগেই সেটি লক্ষ্যে পৌঁছাবে। অর্থাৎ এতে কার্যকারণ সম্পর্ক রক্ষিত হবে না। আমরা মনে করি, মহাবিশ্বে পদার্থবিদ্যার নীতিমালার প্রয়োগ কার্যকারণ সম্পর্ক রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই আলোর গতির চেয়ে দ্রুত বেগে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব নয়।

চিত্র ১: স্থান-কালে একটি গাছ, একটি মহাকাশযান ও আলোর বিশ্বরেখা (World) দেখানো হয়েছে

এখানে বলে রাখি, আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতি সম্ভব—যেমন আমাদের গ্যালাক্সি বহুদূরের গ্যালাক্সির তুলনায় আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমণ করছে। কিন্তু সেই দূরের গ্যালাক্সিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সেটির সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছি না। ওপরের উদাহরণে তিরটি আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু সে ক্ষেত্রে সেই তিরটিকে আমরা দেখতে পাব না। তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাদের কাছে আসবে না। তবে তার ভ্রমণপথটি যদি আমরা দেখতে পাই, তাহলে কার্যকারণ সম্পর্ক রক্ষিত হবে না।

আরও পড়ুন
গাছটির দুই দিকে দুটি আলোর সংকেত প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের বিশ্বরেখা x ও t—উভয় রেখা থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে ডান আর বাঁ দিকে ভ্রমণ করবে। আবার একটি মহাকাশযান আলোর গতির অর্ধেক গতিতে (c/2) গাছের অবস্থান থেকে শুরু করে ডান দিকে সরছে।

এটি প্রমাণ করার জন্য আমরা মিনকোভস্কি ডায়াগ্রামের সাহায্য নেব। ১ নম্বর চিত্রে আমরা স্থান (দেশ) ও সময়ে একটি গাছ ও একটি মহাকাশযানের গতিরেখা দেখাচ্ছি। এখানে x অক্ষ হলো স্থান এবং y অক্ষ হলো সময়। গাছটি স্থবির, তার জায়গা পরিবর্তন করছে না; কাজেই স্থান বা দেশের x অক্ষরেখায় সে ভ্রমণ করছে না। কিন্তু যেহেতু গাছটি সময়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে, তাই সেটি y বা t অক্ষরেখায় ওপরের দিকে উঠছে। অর্থাৎ গাছটি ১ সেকেন্ড পরে t অক্ষরেখায় (০, ০) স্থানাঙ্কের একটু ওপরে থাকবে, ২ সেকেন্ড পর আরেকটু ওপরে ইত্যাদি। দেশ বা স্থান ও কালে গাছের এই ভ্রমণরেখাটিকে গাছের বিশ্বরেখা (World line) বলা হবে।

গাছটির দুই দিকে দুটি আলোর সংকেত প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের বিশ্বরেখা x ও t—উভয় রেখা থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে ডান আর বাঁ দিকে ভ্রমণ করবে। আবার একটি মহাকাশযান আলোর গতির অর্ধেক গতিতে (c/2) গাছের অবস্থান থেকে শুরু করে ডান দিকে সরছে। সেটির বিশ্বরেখা t অক্ষ এবং আলোর বিশ্বরেখার মাঝামাঝি একটা অবস্থানে হবে। মহাকাশযানের বিশ্বরেখাটিকে যানটির সময়রেখা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কারণ, মহাকাশযানটির ফ্রেমে ওই রেখাটিতে যানটির স্থান পরিবর্তন হবে না।

চিত্র ২: গাছের রেফারেন্স কাঠামোয় মহাকাশযানটির অবস্থান গাছ এবং ডান দিকের আলোর বিশ্বরেখার ঠিক মধ্যে থাকবে

২ নম্বর চিত্রটি ১ নম্বরেরই অনুরূপ। এখানে আমরা t অক্ষরেখার বদলে ct ব্যবহার করছি, অর্থাৎ সময়কে আলোর গতি c দিয়ে গুণ করেছি, যাতে ct-এর একক আর x-­এর একক একই হয়, অর্থাৎ দুটিই দূরত্বের একক হয়। ফলে আলোর বিশ্বরেখার নতি বা ঢাল x ও y উভয় অক্ষের সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করবে।

২ নম্বর চিত্রে আমরা আরও দেখতে পাচ্ছি, গাছের রেফারেন্স কাঠামোয় মহাকাশযানটির গতি আলোর গতির অর্ধেক বা c/2 থাকায় মহাকাশযানটির বিশ্বরেখা সব সময় গাছ ও আলোর বিশ্বরেখার ঠিক মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ |AB| = |BC| এবং |DE| = |EF|।

আরও পড়ুন

এবার আমরা গাছ, মহাকাশযান ও আলোর বিশ্বরেখাকে মহাকাশযানের রেফারেন্স কাঠামোয় আঁকব। এই কাঠামোয় মহাকাশযানটি স্থির থাকবে, অর্থাৎ সেটির বিশ্বরেখা ct′ অক্ষ বরাবর হবে। লক্ষণীয়, এই অক্ষটি মহাকাশযানের সময় অনুযায়ী, সে জন্য ct নয়, বরং ct′। স্থির মহাকাশযানের তুলনায় গাছটি c/2 গতিবেগে বাঁ দিকে সরবে। আপেক্ষিকতার স্বীকার্য অনুযায়ী আলোর বেগের কোনো পরিবর্তন হবে না, সেটি আগের মতোই ৪৫ ডিগ্রি নতিতে ভ্রমণ করবে। কিন্তু এখানে যেটি দেখার বিষয়, সেটা হলো মহাকাশযানের বিশ্বরেখার সঙ্গে ডান দিকের আলোর বিশ্বরেখার দূরত্ব গাছটি থেকে যানটির দূরত্বের দ্বিগুণ। অর্থাৎ |B′C′| = 2|A′B′| এবং |E′F′| = 2|D′E′|। কিন্তু ২ নম্বর চিত্রে আমরা দেখেছি যে গাছের ফ্রেমে গাছ থেকে যানটির দূরত্ব যান থেকে আলোর দূরত্বের সমান। শুধু তা–ই নয়, ২ নম্বর চিত্রে ডান আর বাঁ দিকে ভ্রমণরত আলোর রেখা গাছটি থেকে সমান দূরত্ব রেখে সরে, অন্যদিকে ৩ নম্বর চিত্রে, ডান দিকের আলোর বিশ্বরেখা থেকে গাছটির রেখার দূরত্ব বাঁ দিকের আলোর বিশ্বরেখা থেকে দূরত্বের তিন গুণ। অর্থাৎ |H′I′| = 3|G′H′|। বোঝাই যাচ্ছে মহাকাশযানের ফ্রেমে, গাছের ফ্রেমের তুলনায়, সময় ও স্থানের পরিমাপ ভিন্ন। তাহলে আমরা এমন কী করতে পারি, যাতে গাছের ফ্রেমের চিত্রটি এবং মহাকাশযানের ফ্রেমের চিত্রটির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়?

চিত্র ৩: মহাকাশযানের রেফারেন্স কাঠামোয় গাছ ও আলোর বিশ্বরেখা দেখানো হয়েছে। এই চিত্রে মহাকাশযানের বিশ্বরেখার সঙ্গে ডান দিকের আলোর বিশ্বরেখার দূরত্ব গাছটির থেকে যানটির দূরত্বের দ্বিগুণ

এবার আমরা আবার ফিরে যাই গাছের রেফারেন্স ফ্রেমে (চিত্র ১ ও ২)। ৪ নম্বর চিত্রে, আমরা ৩ নম্বর চিত্রের শর্তগুলো আরোপ করতে চাই। আমরা এমন একটি স্থানিক রেখা তৈরি করব, যেখানে মহাকাশযান থেকে আলোর দুই দিকে দুটি বিশ্বরেখার দূরত্ব একই হবে। এ রকম একটি রেখা হবে ABC, যেখানে |AB| = |BC|। এর সমান্তরাল আরেকটি রেখা DEF-এ আমরা দেখাচ্ছি, |EF| = 3|DE|। এই রেখাটিকে সমান্তরালভাবে (0, 0) থেকে আঁকলে মহাকাশযানটির স্থানিক অক্ষ x′ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন
এবার আমরা দেখব দেশকালে কেন আলোর গতির চেয়ে দ্রুততর ঘটনার ক্রমান্বয়তা সম্ভব নয়। চিত্র নম্বর ৬-তে আমরা দুটি ঘটনাকে A ও B দিয়ে চিহ্নিত করেছি। এটা হতে পারে A বিন্দু থেকে আমরা একটি তির ছুড়ছি, কিছু সময় পরে সেটা B বিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে।

এবার দেখা যাক A সূচক একটি ঘটনাকে, গাছের ফ্রেমে আর চলন্ত মহাকাশযানের ফ্রেমে, একই সঙ্গে এ ধরনের একটি মিনকোভস্কি ডায়াগ্রামে কীভাবে দেখা যেতে পারে। গাছটির ফ্রেমে A ঘটনাটি ঘটেছে xA স্থানে এবং tA সময়ে। কিন্তু মহাকাশযানের ফ্রেমে A ঘটনাটি ঘটেছে x′A স্থানে এবং t′A সময়ে। tA সময়টি আমরা পেয়েছি x অক্ষের সঙ্গে একটি সমান্তরাল রেখা টেনে ct-এর সঙ্গে ছেদবিন্দুতে। অনুরূপভাবে t′A সময়টি আমরা পেয়েছি x′ অক্ষের সঙ্গে একটি সমান্তরাল রেখা টেনে ct′-এর সঙ্গে ছেদবিন্দুতে। xA স্থানটি আমরা পেয়েছি ct অক্ষের সঙ্গে একটি সমান্তরাল রেখা টেনে x-এর সঙ্গে ছেদবিন্দুতে। অনুরূপভাবে x′A স্থানটি আমরা পেয়েছি ct′ অক্ষের সঙ্গে একটি সমান্তরাল রেখা টেনে x′-এর সঙ্গে ছেদবিন্দুতে। এটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, A ঘটনাটির স্থান–কাল, গাছ আর মহাকাশযানটির জন্য এক হবে না। এখানে এটা বলে রাখি, ct ও ct′-এর স্কেল আর x ও x′-এর স্কেল ভিন্ন হবে, অর্থাৎ ct-এর এক একক আর ct′-এর এক একক সমান হবে না, একই ব্যাপার x ও x′-এর বেলায়।

চিত্র ৪: গাছের ফ্রেমে মহাকাশযানের স্থানিক ফ্রেম x′ অক্ষ দিয়ে প্রদর্শন করা যেতে পারে। সেটির সমান্তরাল রেখাগুলো ব্যবহার করলে মহাকাশযান থেকে ডান ও বাঁয়ের আলোর বিশ্বরেখা সমান দূরত্বে থাকবে

এবার আমরা দেখব দেশকালে কেন আলোর গতির চেয়ে দ্রুততর ঘটনার ক্রমান্বয়তা সম্ভব নয়। চিত্র নম্বর ৬-তে আমরা দুটি ঘটনাকে A ও B দিয়ে চিহ্নিত করেছি। এটা হতে পারে A বিন্দু থেকে আমরা একটি তির ছুড়ছি, কিছু সময় পরে সেটা B বিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে। AB রেখাটির নতি বা ঢাল আলোর বিশ্বরেখার নতি থেকে কম, অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রির কম, অর্থাৎ তিরটির গতি আলোর চেয়ে বেশি।

৬ নম্বর চিত্রে ct′ রেখাটি হলো v = c/2, আলোর গতির অর্ধেকে ভ্রমণরত মহাকাশযানের ফ্রেমে সময়রেখা। সেই মহাকাশযান থেকে যদি সম্মুখদিকে একটি ছোট রোবট মহাকাশযান ছুড়ে দেওয়া হয় v (রোবট) = c/2 গতিতে, তবে আপেক্ষিকতার লরেনটজ রূপান্তর অনুযায়ী গাছের ফ্রেমে সেই রোবটযানের গতি c/2 + c/2 = c হবে না, বরং

হবে:

অর্থাৎ আলোর গতিবেগের শতকরা ৮০ ভাগ হবে।

এই রোবটযানটির দেশকাল ct′′ এবং x′′ অক্ষ দুটি দিয়ে নির্দেশ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
রোবটযানটি থেকে তিরটিকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করাটাকে আগে দেখা যাবে, ধনুক থেকে তিরটিকে ছোড়া পরে দেখা যাবে। ৬ নম্বর চিত্রটিকে ভালো করে দেখলে এটা বোঝা যাবে যে রোবটযানের ফ্রেমে তিরটির সরণ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের উল্টোভাবে দেখা যাবে, চলচ্চিত্রের রিওয়াইন্ড যে রকম হয়। গাছ ও রোবটযান—এই দুটির ফ্রেমই জড় (Inertial), দুটিরই সমান অধিকার।
চিত্র ৫: গাছ ও মহাকাশযানের ফ্রেমে A ঘটনাটির সময় (tA, t′A) ও স্থান (xA, x′A) নির্ধারণ

গাছের ফ্রেমে A ঘটনাটি ঘটছে tA সময়ে। তিরটি ওই সময়ে ধনুক থেকে ছোড়া হয়েছে। এরপরে আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে তিরটি B বিন্দুতে উপনীত হলো। গাছের ফ্রেমে সেটির সময় হলো tB। এটায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রোবটযানটির ফ্রেমে এই দুটি ঘটনাকে দেখা যাবে t′′A এবং t′′B সময়ে। আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিই কীভাবে t′′A এবং t′′B সময় দুটি পাওয়া গেল। A থেকে x′′ অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল একটি রেখা টানলে সেটি ct′′ অক্ষকে ct”A বিন্দুতে ছেদ করবে, আর B থেকে x′′ অক্ষের সঙ্গে একটি সমান্তরাল রেখা টানলে সেটি ct′′B বিন্দুতে ছেদ করবে। দেখা যাচ্ছে, t′′B < t′′A । অর্থাৎ রোবটযানটি থেকে তিরটিকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করাটাকে আগে দেখা যাবে, ধনুক থেকে তিরটিকে ছোড়া পরে দেখা যাবে। ৬ নম্বর চিত্রটিকে ভালো করে দেখলে এটা বোঝা যাবে যে রোবটযানের ফ্রেমে তিরটির সরণ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের উল্টোভাবে দেখা যাবে, চলচ্চিত্রের রিওয়াইন্ড যে রকম হয়। গাছ ও রোবটযান—এই দুটির ফ্রেমই জড় (Inertial), দুটিরই সমান অধিকার। একটিতে কার্যকারণ রক্ষিত হয়েছে, অন্যটিতে হয়নি। রোবট ফ্রেমে ফলাফল উৎসগত কারণের আগেই সংঘটিত হয়েছে। পদার্থবিদ্যার যেসব নীতিমালা আমরা অনুসরণ করি, সেই অনুযায়ী এটা সম্ভব নয়, কাজেই আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে কোনো তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না। (মহাকাশযানের ফ্রেমে A ও B ঘটনাটি একই সময়ে ঘটবে, ৬ নম্বর চিত্রে সেটি দেখানো হয়নি।)

চিত্র ৬: AB রেখার নতি আলোর বিশ্বরেখার নতি থেকে কম, অর্থাৎ সেটির গতি আলোর গতিবেগের চেয়ে বেশি। A উৎস এবং B ফলাফল হলে, রেখাটি কার্যকারণ সম্পর্ক রক্ষা করে না। এর মানে হলো, এমন একটি জড় রেফারেন্স ফ্রেম পাওয়া সম্ভব, যেখানে B ফলাফল A উৎস কারণের আগেই সংঘটিত হবে

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে আরেকটি জনপ্রিয় উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনাটি শেষ করি। ধরা যাক, আলোর চেয়ে দ্রুতগতির কিছু আছে, ধরা যাক সেটির গতি অসীম, অর্থাৎ মুহূর্তেই তথ্য মহাবিশ্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানো যায়। তাহলে কী করে সেটা কার্যকারণ সম্পর্ক উল্টে দেয়, তা দেখা যাক। একটা দ্রুতগামী ট্রেন (আলোর গতির বড় ভগ্নাংশে) একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছে।

আরও পড়ুন
B বিন্দুটি হলো 3 আর 4 নম্বরের বিশ্বরেখার ছেদবিন্দু। তাই 3 নম্বর মুহূর্তে সেই বার্তা 4 নম্বরকে দিল এবং 4 নম্বর থেকে সেই বার্তা প্ল্যাটফর্মের ফ্রেমে কোনো সময়ক্ষেপণ না করেই 1 নম্বরের কাছে পৌঁছাল।
চিত্র ৭: এই চিত্রে 2 থেকে 3 এবং 4 থেকে 1 নম্বর ব্যক্তিকে অসীম গতিতে সংকেত প্রেরণ সম্ভব। এর ফলে 1 নম্বর তার বার্তা প্রেরণের আগেই সেই বার্তাটি পেয়ে যাবে

প্ল্যাটফর্মে থাকা 1 নম্বর মানুষটি ট্রেনটির সামনের দিকের এক আরোহী 2 নম্বর মানুষটিকে একটি বার্তা দিল। আমাদের ধরে নিতে হবে 1 ও 2 নম্বর মানু্ষটি মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়ানো এবং এই বার্তা প্রদানে কোনো সময়ক্ষেপণ হয়নি। 2 নম্বর মানুষটি মুহূর্তে এই বার্তাটি ট্রেনের পেছনে থাকা এক আরোহী 3 নম্বরকে প্রেরণ করল। 2 নম্বরের কাছে এই বার্তা প্রেরণের জন্য একটা বিশেষ যন্ত্র আছে, যা কিনা অসীম গতিতে সংকেত পাঠাতে পারে। যেহেতু আমরা ধরে নিয়েছি অসীম গতি সম্ভব, সেহেতু ট্রেনের রেফারেন্স ফ্রেমে এই বার্তাটি একই সময়ে 3 নম্বরের কাছে পৌঁছাল। ট্রেনের 3 আর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা 4 নম্বর ব্যক্তিটি প্রায় একই জায়গায় অবস্থিত, তাই 3 থেকে 4-এ বার্তার হাতবদলের জন্য কোনো সময়ই লাগল না। এরপর 4 আবার মুহূর্তে, সেই বিশেষ যন্ত্রের (2 নম্বর ওই ধরনের যন্ত্র ইতিমধ্যে ব্যবহার করেছে) সাহায্য নিয়ে সেই বার্তা 1 নম্বরকে প্রেরণ করল। আমরা এখন দেখাব যে 4 নম্বর থেকে আসা বার্তা 1 নম্বরের কাছে যখন পৌঁছাবে, 1 নম্বর তখনো তার মূল বার্তা 2 নম্বরকে পাঠাতে পারেনি। অর্থাৎ চিঠি পাঠানোর আগেই যেন চিঠির উত্তর চলে আসবে, এ রকম একটা ব্যাপার।

চিত্র ৮: প্ল্যাটফর্মের ফ্রেমে 2 নম্বর থেকে 3 নম্বরে বার্তা অতীতে প্রেরিত হবে

এবার মিনকোভস্কি ডায়াগ্রামে ব্যাপারটা দেখা যাক। A বিন্দুতে 1 এবং 2-এর বিশ্বরেখা মিলিত হয়েছে, সেখানে 1 নম্বরের কাছ থেকে 2 নম্বর চিঠি বা বার্তা পেল। 2 তাৎক্ষণিকভাবে সেই বার্তা B বিন্দুতে 3 নম্বরের কাছে পাঠাল। এখানে লক্ষণীয় যে ট্রেনের ফ্রেমে এটি তাৎক্ষণিক অর্থাৎ শূন্য সময়ে প্রেরিত হলেও প্ল্যাটফর্মের ফ্রেমে B বিন্দুতে বার্তাটি অতীত একটি সময়ে পৌঁছাল, এটিই হলো প্যারাডক্স বা হেত্বাভাস। B বিন্দুটি হলো 3 আর 4 নম্বরের বিশ্বরেখার ছেদবিন্দু। তাই 3 নম্বর মুহূর্তে সেই বার্তা 4 নম্বরকে দিল এবং 4 নম্বর থেকে সেই বার্তা প্ল্যাটফর্মের ফ্রেমে কোনো সময়ক্ষেপণ না করেই 1 নম্বরের কাছে পৌঁছাল। ৮ নম্বর চিত্র থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে সেই বার্তা মূল বার্তা প্রেরণের আগেই 1 নম্বরের কাছে পৌঁছাবে, অর্থাৎ এখানে ফলাফল ও উৎস কারণের মধ্যে সাযুজ্য রক্ষিত হবে না। এই ব্যাপারটিতে কার্যকারণ সম্পর্ক রক্ষিত হয়নি বলে আমরা ধরে নিতে পারি যে অসীম গতিতে কোনো তথ্য বা বস্তু ভ্রমণ করতে পারে না। অর্থাৎ 2 নম্বর বা 4 নম্বর যে যন্ত্র ব্যবহার করেছে, সেটি অসীম গতিতে (বা আলোর গতির থেকে দ্রুতগতিতে) কোনো তথ্য পাঠাতে পারবে না।

* Tatsu Takeuchi-র An Illustrated Guide to Relativity এবং A.P. French-এর Special Relativity—এই বই দুটি এ আলোচনার উপস্থাপনাকে সাহায্য করেছে।

লেখক: অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তা সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন