ইলেকট্রন কি অমর

এআই আর্ট

কণাপদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর জগতে একটা নীতি আছে। চার্জের সংরক্ষণশীলতা নীতি। এ নীতিকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটা খুঁটি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ নীতি আমাদের বলে, ভর ও শক্তির মতো বৈদ্যুতিক চার্জেরও কোনো ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই। মহাবিশ্বের বিপুল মিথস্ক্রিয়ার মাঝে চার্জের মোট পরিমাণ স্থির। কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হবে না। সব সময় একই থাকবে। অর্থাৎ পরিমাণটি ধ্রুব।

অগণিত কণা দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের এই মহাবিশ্ব। এর মধ্যে একটি মৌলিক কণা ইলেকট্রন। এটি একধরনের লেপটন, আরেকটু বড় পরিসরের হিসেবে ফার্মিওন, অর্থাৎ বস্তুকণা। সহজ করে বললে, বস্তুর কণাগুলোকে বলা হয় ফার্মিওন আর বলের কণাগুলোকে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নামে ডাকা হয় বোসন।

এ নীতি আমাদের বলে, ভর ও শক্তির মতো বৈদ্যুতিক চার্জেরও কোনো ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই
আরও পড়ুন

বেশির ভাগ বস্তুকণাই মৌলিক নয়। যেমন প্রোটন। এটি তিনটি কোয়ার্ক নামে আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। তবে ইলেকট্রন মৌলিক কণা। তাই অপরিবর্তনশীলতার নীতি মেনে এটি বিরাজ করে মহাবিশ্বে। তাত্ত্বিকভাবে অবশ্য কোনো কোনো বিজ্ঞানী দাবি করেন, ইলেকট্রন ভেঙে একটি নিউট্রিনো এবং একটি ফোটনে রূপান্তরিত হতে পারে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া এই দাবি স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মৌলিক নীতি, অর্থাৎ চার্জের সংরক্ষণশীলতা লঙ্ঘন করে৷ কারণ, ইলেকট্রন নিজে ঋণাত্মক চার্জবাহী কণা। এর চার্জের পরিমাণ -১। আর ইলেকট্রনের ধ্বংস বা নিউট্রিনোতে রূপান্তর মানে এই চার্জের বিনাশ। কারণ, নিউট্রিনো চার্জ নিরপেক্ষ মৌলিক কণা। আর ফোটনের যে চার্জ নেই, তা তো বলা বাহুল্য। তাই এই নীতি মেনে ইলেকট্রনকে সাবঅ্যাটমিক বা উপ-পারমাণবিক অঞ্চলের চিরস্থায়ী বাসিন্দা, অর্থাৎ মৌলিক কণা বা এলিমেন্টারি পার্টিকেল হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

কণার দীর্ঘায়ু নিয়ে জানতে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন। আগেই বলেছি, হাতে-কলমে করা নানা পরীক্ষায় এখনও স্বতঃস্ফূর্ত ইলেকট্রন ক্ষয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, এসব পরীক্ষানিরীক্ষা আসলে ইলেকট্রনের অমরত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে কিছুদিন আগে পাওয়া যায় আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড-এ ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেল অনুযায়ী, ইতালির বোরেক্সিনো এক্সপেরিমেন্টের বিজ্ঞানীরা জানান, ইলেকট্রনের জীবনকাল ৬.৬ × ১০২৮ বছর বা ৬৬ হাজার ইয়োটা বছর। (১ ইয়োটা মানে, ১-এর পরে ২৪টা শূন্য।) বোরেক্সিনো নামের কণাপদার্থবিজ্ঞানের এ পরীক্ষণে নিম্ন শক্তির নিউট্রনো তাৎক্ষণিক বা রিয়েল টাইমে শনাক্ত করা হয়। বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল এ এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করে।

সেদিক থেকে মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে ইলেকট্রনের জীবনকাল প্রায় ৫ কুইন্টিলিয়ন গুণ বেশি
আরও পড়ুন
শিল্পীর কল্পনায় পরমাণুর ভিতরে ইলেকট্রন
এআই আর্ট
আরও পড়ুন

আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্ম প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে। সেদিক থেকে মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে ইলেকট্রনের জীবনকাল প্রায় ৫ কুইন্টিলিয়ন গুণ বেশি! ১ কুইন্টিলিয়ন মানে ১-এর পরে ১৮টা শূন্য। সংখ্যাটি ঠিক কত বড়, তা আমরা কল্পনা করতে পারি না। তবে ১-এর পরে ৭টি শূন্য থাকলেই কোটির ঘর ছুঁয়ে ফেলা হয় এবং প্রতিবার ডানে শূন্য বসালে ১০ গুণ করে বাড়ে—এভাবে ভাবলে হয়তো বিষয়টা খানিকটা অনুভব করা যাবে।

এত বিশাল সময়ের সাপেক্ষে চিন্তা করলে মহাবিশ্বের সবকিছুই বড় ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হবে। মুহূর্তের মধ্যেই যেন কোটি কোটি নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু হচ্ছে। মহাবিশ্ব বদলে যাচ্ছে চিরতরে। সেদিক থেকে আপনি যদি ইলেকট্রনকে অমর বলতে চান, সেটা বোধ হয় দোষের কিছু হবে না।

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়