১৯২৯ সালের অক্টোবর মাস। পঞ্চম সলভে কনফারেন্সের পর ঠিক দুই বছর পেরিয়ে গেছে। ছয় দিনের সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনের পর থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একটু একটু করে মান্যতা পেতে শুরু করেছে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, আরউইন শ্রোডিঙ্গার, পল ডিরাক, পাস্কেল জর্ডান প্রমুখ তরুণ পদার্থবিদের হাত ধরেই এই নতুন তত্ত্বের ক্রমবিকাশ। নিলস বোর ও ম্যাক্স বর্নের মতো প্রবীণ বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা নিয়ে খুব উৎসাহিত। তত্ত্বের নিখুঁত গাণিতিক রূপের সাহায্যে বিভিন্ন পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। পরমাণু তথা কণাপদার্থবিজ্ঞানের এক অজানা জগৎ উন্মোচিত হতে চলেছে গবেষকদের সামনে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গাণিতিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা করেই অনিশ্চয়তা নীতির সন্ধান পেয়েছেন হাইজেনবার্গ। অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও গতিশীল কণাগুলোর বিশেষ কিছু ধর্ম নির্ণয়ের সময় এই অনিশ্চয়তার প্রশ্ন আসে। সমসাময়িক দিকপাল গবেষকেরা সন্তুষ্ট হলেও মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিন্তু তখনো মেনে নিতে পারেননি এই তত্ত্ব। তাঁর মতে, বৈজ্ঞানিক মাপজোখের সুনির্দিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই তত্ত্বের সম্পূর্ণতা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়।
নতুন এই তত্ত্ব নিয়ে রাশি রাশি গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে। এদিকে হাইজেনবার্গ ও ডিরাক বেরিয়েছেন আমেরিকা ট্যুরে। পদার্থবিদ্যার নতুন এই শাখা নিয়েই আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় ধরে লেকচার দিয়েছেন তাঁরা। এখানে এসেই বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছে দুজনের। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ব্রিটিশ-জার্মান অসূয়া নেই। দুই দশক আগেও জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের সত্যতা পরীক্ষামূলক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের তত্ত্বাবধানে। সনাতন পদার্থবিদ্যার নিউটনীয় ধারণাকে চুরমার করে দিয়েছিল এই আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব। কণাপদার্থবিজ্ঞানের জগতে একই রকম বৈপ্লবিক ধারণা নিয়ে এবার হাজির কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। নতুন এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অন্যতম প্রধান কান্ডারি ২৯ বছর বয়সী তরুণ পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ।
দীর্ঘ কয়েক মাস আমেরিকায় কাটিয়ে এশিয়া ট্যুরে এলেন তিনি। জাপান ও সিঙ্গাপুর হয়ে এবার তাঁর গন্তব্য ভারতবর্ষ, তথা বাংলা। বছরখানেক আগে তাঁর শিক্ষক সমারফেল্ডও এসেছিলেন ভারতবর্ষে। ইংরেজশাসিত এই দেশের গবেষকেরাও আধুনিক পদার্থবিদ্যার অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে শুরু করেছেন। প্রবীণ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তো আছেনই, এমনকি বেশ কয়েকজন তরুণ গবেষকের কাজকর্ম নিয়ে উচ্ছ্বসিত ইউরোপের বিজ্ঞানী মহল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ অধ্যাপকের গবেষণার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন। বসুর লেখা গবেষণাপত্রটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে বিখ্যাত জার্নাল সাইটশ্রিফট ফুর ফিজিক-এ প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। তবে ইদানীং গবেষণার শিরোনামে কলকাতা। এই শহরেই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের গবেষণাগারে বিশেষ আলোক বিচ্ছুরণের সন্ধান পেয়েছেন সি ভি রমণ ও তাঁর সহকারী কে এস কৃষ্ণাণ। সম্প্রতি ইউরোপের একাধিক গবেষণাপ্রবন্ধে এই বিচ্ছুরণকে ‘রমণ এফেক্ট’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
৪ অক্টোবর ১৯২৯, জাহাজে কলকাতায় এসে নামলেন হাইজেনবার্গ। ঘটনাচক্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তখন কলকাতায়। সত্যেন্দ্রনাথ, কে এস কৃষ্ণাণ, ডি এম বোস, আর রাও এবং অন্যান্য পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও শিক্ষকেরা সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আকস্মিক আগমনে। ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতেই তড়িঘড়ি একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বোস (ডি এম বোস) খুব সাহায্য করেছিলেন ওয়ার্নারকে। গবেষণার প্রয়োজনে দীর্ঘদিন জার্মানিতে থাকার সুবাদে দেবেন্দ্রমোহন তাঁর পূর্বপরিচিত। কলকাতায় আসার আরেকটি কারণ অবশ্যই ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বছর তিনেক আগে রবীন্দ্রনাথের কথা তিনি প্রথম শুনেছিলেন অধ্যাপক ম্যাক্স বর্নের স্ত্রী হেডভিগের কাছে। গ্যোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাইজেনবার্গের শিক্ষক ছিলেন বর্ন। ভারতীয় কবি তখন জার্মানির বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কবির লেখা ঘরে–বাইরে উপন্যাসটির উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন অধ্যাপক–পত্নী। মা–বাবাকে নিয়ে মিউনিখে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন হাইজেনবার্গ। তাঁর ধার্মিক মা বাড়িতে ফিরেই বলেছিলেন, এই ইন্ডিয়ান পোয়েট দেখতে যেন একেবারে ঈশ্বর যিশুর মতো! নোবেল পুরস্কারজয়ী অপূর্বদর্শন এই মানুষ যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রাচ্যের মনীষী। তিনি নিজেও দেখেছেন জার্মানিতে কবির বক্তৃতা কিংবা অনূদিত কবিতাগুলোকে নিয়ে কী প্রবল উন্মাদনা! রোমান্টিকতার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক আদর্শবাদ। কানায় কানায় ভরে ওঠা বক্তৃতাকক্ষে প্রবেশ করতে না পেরে বাইরে গন্ডগোলের মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটত। কী অনাবিল দক্ষতায় ছান্দিক স্বর ক্ষেপণে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন কবি! সেই থেকে ভারতীয় দর্শনের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে ওয়ার্নারের। মনে হচ্ছিল, একবার মানুষটির সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারলে বেশ হতো। অবশেষে সেই সুযোগ হয়েছে দেবেন্দ্রমোহনের সৌজন্যে। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে অনেক দিনের ঘনিষ্ঠতা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাগনে দেবেন্দ্রমোহনের। কবির প্রিয় পাত্র তিনি। মধ্যাহ্নভোজের পর হাইজেনবার্গকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ দোতলায় একটি ঘরে চমৎকার চায়ের আয়োজন করেছেন। দেবেন্দ্রমোহন কিছুক্ষণ পর উঠে গেলেও রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছিলেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের সঙ্গে। গাছের ফাঁক গলে পড়ন্ত বেলার আলো জানালার শার্সি দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরে। বিজ্ঞান ও দর্শনের বাস্তব সত্য নিয়ে কথা বলছেন এক আগ্রহী জার্মান তরুণ ও প্রবীণ ভারতীয় কবি। মানবনিরপেক্ষ কোনো সৌন্দর্য ও সত্যে বিশ্বাসী নন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, বিজ্ঞানে শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেদের মনের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে।
এই কথা বেশ মনে ধরে হাইজেনবার্গের। তাঁর অনিশ্চয়তা তত্ত্বও তো এই প্রক্রিয়ারই ফসল! উত্তরে তিনি জানান একদম ঠিক কথা। বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত আমরা যে প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের সন্ধান করি, সেটা আসলে মানবসত্তার এক উপলব্ধি।
—হ্যাঁ, এক অনন্ত মানবসত্তা। বৈজ্ঞানিক ধারণায় যে বিশ্বপ্রকৃতির কথা বলা হয়, তার বাস্তবতা আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল। এমন কোনো কিছুই থাকতে পারে না, যা মানবব্যক্তিত্বের অধীন নয়। এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের সত্যও মানবীয় সত্য।
—কী রকম?
—যেমন ইলেকট্রন ও প্রোটন দিয়ে তৈরি জড় পদার্থের কথাই ধরা যাক। এগুলোর মধ্যে অনেকটাই ফাঁকা অঞ্চল থাকে। তার মানে শূন্যস্থান ইলেকট্রন ও প্রোটনকে সংবদ্ধ করে রাখলেও পদার্থকে নিরেট বলে মনে হয়। ঠিক একইভাবে মানবজাতিও স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, তাদের মধ্যে রয়েছে মানবীয় সম্বন্ধের পারস্পরিকতা।
—তাহলে আপনার মতে জগৎ হলো মানবসত্তার এক উপলব্ধি।
—হ্যাঁ, এক অনন্ত সত্তার উপলব্ধি। আমাদের কর্ম ও আবেগের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধি আসে।
—আমরা তো কেবল প্রকৃতির শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপটিই অনুধাবন করতে চাই। বড় আকারের কোনো অস্তিত্বে এই শৃঙ্খলার নির্দেশ ধরা গেলেও অতি ক্ষুদ্র কণাগুলোর মধ্যে সেই শৃঙ্খলা আমাদের বোধে ধরা পড়ে না।
—আসলে অস্তিত্বের গভীরেই রয়েছে এই দ্বৈত পরস্পরবিরোধিতা। এর তুলনা আমি খুঁজে পাই আমাদের মনস্তত্ত্বে। আমাদের সংরক্ত আবেগ ও কামনাগুলো অবাধ্য, অথচ আমাদের চরিত্র এগুলোর বশে এনে একটা সমন্বিত সমগ্রে পরিণত করে।…ভারতীয় দর্শনে নশ্বরতা, আন্তসম্পর্কবন্ধন, আপেক্ষিকতা ইত্যাদি বিষয়ের ভৌত বাস্তবতা নিয়ে আরও অনেক কথা বলেছিলেন কবি। কলকাতার বাইরে এক গ্রামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। নাম শান্তিনিকেতন। গোটা ভারত থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে। সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞানও পড়ানো হয় সেখানে। আন্তর্জাতিক এই শিক্ষাঙ্গনের অন্তরাত্মাটি কিন্তু একেবারে খাঁটি ভারতীয়। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও গান্ধীজির ভূমিকা নিয়েও কথা হয় তাঁদের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই দীর্ঘ কথোপকথন বেশ অর্থবহ মনে হয়েছিল তরুণ পদার্থবিদের।
সন্ধ্যায় সেখান থেকেই সোজা চলে এসেছিলেন শিয়ালদহ স্টেশনে। কলকাতা পৌঁছানোর সংবাদ জানিয়ে মা-বাবাকে একটি চিঠি লিখে লেটারবক্সে ফেললেন তিনি। তারপর উঠে বসলেন দার্জিলিং মেলের ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে। এবার তাঁর গন্তব্য শৈলশহর দার্জিলিং। তখনো দার্জিলিংকে ঠিক শহর বলা চলে না, দেশীয় কয়েকজন রাজা ও জমিদারদের সম্পত্তি থাকলেও ব্রিটিশরা এই পাহাড়ি জনপদকে একটু একটু করে নিজেদের গ্রীষ্মাবাস হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন। টি প্ল্যান্টেশনের পাশাপাশি চার্চ, ক্লাব, স্কুল, কমিউনিটি হল, বুকশপ ইত্যাদি দু–একটা করে গড়ে উঠছে সবই। এমনকি পাহাড়ের ঢালে প্রায় ৪০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে আস্ত এক বোটানিক্যাল গার্ডেন, নাম লয়েডস বোটানিক্যাল গার্ডেন। শহরে পায়ে হাঁটা রাস্তায় খাদের দিকে লোহার রেলিং দেওয়া।
হোটেলে উঠেছেন হাইজেনবার্গ। দার্জিলিংয়ে পৌঁছানোর সংবাদ জানিয়ে বাড়িতে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন তিনি। কোথা থেকে যে রাজ্যের কুয়াশা ও মেঘ এসে জড়ো হয়েছে! ধূসর মেঘের আড়াল পেরিয়ে দৃষ্টি বেশি দূর যায় না। সঙ্গে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। কমে আসছে দিনের আলো। একটু একটু করে আরও জবুথবু হয়ে পড়ছে এই শৈল জনপদ। হোটেলের কেয়ারটেকার ছেলেটি তাঁর জন্য চা নিয়ে এল। স্থানীয় লেপচা ছেলেটি ইংরেজিতে কথা বলা ভালোই রপ্ত করেছে। ও যখন ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, হাইজেনবার্গ জিজ্ঞেস করলেন,
—টাইগার হিল এখান থেকে কত দূর?
—খুব বেশি দূরে নয়। যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে। আপনি যাবেন? তাহলে ঘোড়ার ব্যবস্থা করে রাখি?
—ঘোড়ার দরকার কী? আমি ট্রেক করেই যেতে চাই। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা, বৃষ্টি হলে তো সবই ভেস্তে যাবে!
—ভাগ্য ভালো থাকলেই টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখা যায়। মনে হয়, মেঘ কেটে যাবে। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন, স্যার। রাত দুটো নাগাদ আমি ডেকে দেব। আর্লি ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, নইলে সাড়ে চারটার আগে পিকে পৌঁছানো যাবে না।
ক্ষণিকের কথাবার্তাতেই ছেলেটিকে ভালো লেগে যায় হাইজেনবার্গের। তিনি বলেন, টাইগার হিলে যাওয়ার জন্য একজন গাইডকে বলে রেখো।
—সে আপনি ভাববেন না, স্যার। আজ রাতেই ম্যানেজারবাবুকে বলে রাখব।
বিছানায় রাখা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বসলেন তরুণ অধ্যাপক। মাসখানেক হতে চলল দেশ ছেড়ে বেরিয়েছেন। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। কাগজ–কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসলেন তিনি।
দার্জিলিং
অক্টোবর ৫, ১৯২৯
প্রিয় মা-বাবা,
দুই ঘণ্টা আগেই আমার ভারতে পৌঁছানোর খবর জানিয়ে তোমাদের একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম। আমার ধারণা, হয়তো এক্ষুনি সেটা তোমাদের কাছে পৌঁছাল (ওখানে নিশ্চয় এখন দুপুরবেলা); তোমরা সম্ভবত দেখে অবাক হচ্ছ যে টেলিগ্রামটা কলকাতা থেকে নয়, দার্জিলিং থেকে এসেছে। কিন্তু আমার শেষ চিঠিতে জানিয়েছিলাম, আমি দুই দিন আগে কলকাতায় পৌঁছেছি। ইচ্ছা করেই আগে তোমাদের জানাতে চাইনি; যা–ই হোক, আমি চেয়েছিলাম নির্দিষ্ট দিনের জন্য অপেক্ষা করতে, যেদিন গন্তব্যে পৌঁছে আমার টেলিগ্রাম পাঠানো যাবে।
এই মুহূর্তে আজ দুপুরে আমি হিমালয়ের কোলে এই পাহাড়ি গ্রামে (২২০০ মিটার উচ্চতা) বসে আছি। তোমরা জানলে খুব অবাক হবে, আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে আমার ঘরের জানালা দিয়েই হিমালয়ের বিশাল পর্বতমালা, হিমবাহসহ বিস্তৃত শৈলশিরা দেখা যায়। তবে এই মুহূর্তে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে এবং ঘন কুয়াশায় ১০০ মিটার দূরের কিছুও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। তোমরা হয়তো বুঝতেই পারছ যে আমি কিছুটা অধৈর্য হয়ে আছি; আজ থেকে দিন দুয়েক বাদেই আমাকে নেমে যেতে হবে, কিন্তু যদি এই সময়ের মধ্যে আবহাওয়া পরিষ্কার না হয়, তবে আমার ভারতে আসাই বৃথা হবে। আর তোমরা তো জানোই পাহাড় আমার হৃদয়ের কতটা জুড়ে আছে। আমার কাছে যেকোনো পুরোনো মন্দিরের চেয়ে পাহাড় বেশি আকর্ষণীয়। তবে ভাগ্য আমার সঙ্গে থাকতেও পারে; কারণ, আমি আগেও দেখেছি এই ধরনের ক্ষেত্রে পাহাড় আমাকে খালি হাতে ফেরায় না। তবে এখানকার বৃষ্টি ও কুয়াশাঘেরা প্রকৃতিও মোহময়; গাঙ্গেয় উপকূলের গরম একদমই নেই, বাতাস নিজেই বেশ ঠান্ডা এবং আমার তো প্রায় ‘অ্যাট হোম’ ফিলিংস হচ্ছে। এখানে এত ঠান্ডা যে উলের স্যুট পরেও আমি রীতিমতো কাঁপছি। আবহাওয়া পরিষ্কার হলে প্রত্যেক পর্যটকের মতো আমিও রাত তিনটায় উঠে টাইগার হিলে যাওয়ার চেষ্টা করব। সেখানে যেতে হলে আদতে একটি পাহাড়ে চড়তে হয় এবং সেখান থেকে মাউন্ট এভারেস্ট দেখা যায়। শুনেছি, টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা নাকি এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। হয়তো নামেই বুঝতে পারছ যে এখানকার জঙ্গলে এখনো বাঘ আছে, তবে চলাচলের রাস্তায় খুব একটা আসে না, আর মানুষ দেখলেই নাকি পালিয়ে যায়। অনেকটা আমাদের ওখানকার হরিণের মতো বলতে পারো।
গতকাল কলকাতার পদার্থবিজ্ঞানীদের সঙ্গে চমৎকার সময় কেটেছে, বেশ কৌতূহলোদ্দীপক অভিজ্ঞতা বলতে পারো। বিকেলে আমি ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতিথি ছিলাম। তোমাদের হয়তো মনে আছে, বছর দুয়েক আগে মিউনিখে আমরা ওনার বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম। তিনি এখানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুল যা–ই বলা হোক না কেন, তরুণ ভারতীয়রা সেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি নানা বিষয়ের শিক্ষা গ্রহণ করে। গান্ধীর অধীনে ভারতে যে স্বাধীনতাসংগ্রাম চলছে, সেটার সঙ্গেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। বস্তুগতভাবে অবশ্যই ইংরেজরা ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু শক্তির ওপর কখনো আত্মার জয় হবে কি? ইংরেজ ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে আমি কেবল খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলোরই মুখোমুখি হয়েছি। ইউরোপীয়দের জন্য হোটেল, রেলপথ—সবকিছুর অবস্থা খুব নিম্নমানের এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্পষ্টতই, সব মুনাফা ইংরেজদের পকেটে চলে যাচ্ছে, দেশে থাকছে না কিছুই এবং তাই হয়তো পরিকাঠামোগত উন্নতি করা হয়ে উঠছে না। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবে—ট্রেনযাত্রাকালে এখানকার প্রথম শ্রেণির কামরাগুলোতেও বালিশ ও চাদর সরবরাহ করা হয় না, নিজেকেই সেগুলো বগলদাবা করে নিয়ে আসতে হয়। জার্মানির চতুর্থ শ্রেণির কামরা এখানকার প্রথম শ্রেণির চেয়ে ভালো। তবু সবকিছু আমাদের দেশের চেয়ে ব্যয়বহুল। টাকা কোথায় যায়, তা সহজেই বোঝা যায়। যেকোনো ভদ্র ব্যক্তি এখানকার অর্থনীতিকে কলঙ্কজনক বলে ভাববেন। এখানকার নিম্নশ্রেণির জীবনযাপন আমাদের দৃষ্টিতে মর্মান্তিক; তবু ইংরেজরা উন্নতির কোনো চেষ্টাই করছেন না।
গাইড ছেলেটি একেক করে চেনাতে শুরু করে বিদেশি অতিথিকে। একেবারে সামনে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওর উচ্চারণে ‘কাংচেনজঙ্গা’।
এই দেশের কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি আমাদের কাছে বেশ ভয়ানক এবং অবোধ্য বলে মনে হয়, এবং আমি এমন কিছু জিনিস প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমি ভুলে যেতে চাই। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পাছে খুব ঠান্ডা হয়ে যায়, তাই কেয়ারটেকার ছেলেটি আমার ঘরের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। এ রকম পরিবেশ আমাকে আলপাইনের ট্রেকারস হাটে কাটানো জীবন মনে করিয়ে দেয়। আমার ঘরের বাইরে জঙ্গল ছাড়িয়ে আবছা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যেই খানিকটা পরিষ্কার হয়ে এল এবং পাহাড়জুড়ে গ্রামের টিমটিমে আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। হয়তো রাতের মধ্যেই আকাশ পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
অবশেষে সত্যি টাইগার হিলে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পৌঁছানোর বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশ একটু একটু করে উজ্জ্বল হতে থাকে। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর পুব আকাশে আলোর দীপ্তি দেখা যায়। নীল আকাশের ক্যানভাসে তুষারাবৃত হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি আলোর ছটা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সাদা চকচকে হয়ে ওঠে বরফের শৃঙ্গগুলো। প্রথমে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তারপর একে একে আলো ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শৃঙ্গে। মেঘমুক্ত আকাশে প্রতিটা পাহাড়চূড়া আলাদা করে দেখা যাচ্ছে। গাইড ছেলেটি একেক করে চেনাতে শুরু করে বিদেশি অতিথিকে। একেবারে সামনে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওর উচ্চারণে ‘কাংচেনজঙ্গা’। দূরে মেঘের রেখার পেছনে আবছা শৃঙ্গটি হলো মাউন্ট এভারেস্ট, পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ। পাশাপাশি জেগে থাকা আরও অনেক শৈলচূড়া এবং পাহাড়ি খাঁজে হিমবাহগুলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সূর্য তার সব ঔজ্জ্বল্য নিয়ে হাজির হলো হিমালয়ে। রোদ এসে পড়ল টাইগার হিলেও। একরাশ ভালো লাগা সঙ্গে নিয়ে এবার ফেরার পালা। গাইডকে সঙ্গে নিয়ে বনের রাস্তা ধরেই নামতে শুরু করলেন হাইজেনবার্গ।
হোটেলে ফিরে এলেন তরুণ পদার্থবিদ। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলেন তিনি। আজ আবহাওয়া একদম পরিষ্কার, কোথাও যেন মালিন্যের রেশটুকু নেই। কাগজ–কলম নিয়ে বসলেন চিঠির বাকি অংশ লিখতে।
রোববার সকাল, ৬ অক্টোবর
ভাগ্য ইতিমধ্যেই আমার ওপর সুপ্রসন্ন হয়েছে, আমি যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে বেশিই বলতে পারো। যখন রাত একটা নাগাদ একবার ঘুম থেকে উঠলাম, তখনো চারদিক পুরোপুরি কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল এবং আমি সত্যিই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু রাত দুইটায় কেয়ারটেকার ছেলেটি আমার দরজায় কড়া নাড়ল: আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল, ও জিজ্ঞেস করল আমি চা খেতে চাই কি না? ২টা ৩০ মিনিট, আমরা শীতের পোশাক পরে প্রাতরাশ করে নিলাম। একজন তিব্বতি গাইড আমার সঙ্গে গিয়েছিল। (এখানকার পর্বত অধিবাসীরা মঙ্গোলিয়ান বংশোদ্ভূত এবং হিমালয়ের উত্তর দিক থেকে এসেছে।) আকাশে বেশ কিছু তারা উঠেছিল; বিশেষ করে আমাদের চলার পথে মাথার ওপরে দর্শনীয়ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ছিল কালপুরুষ। প্রথমে পাশের একটি গ্রামের মধ্য দিয়ে খানিকটা উঠে যাওয়া, যেখানে মাত্র কয়েকটি আলো জ্বলছিল, তারপর একটি গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটানা পথচলা। সঙ্গে গাইড থাকায় সুবিধাই হয়েছে, অন্যথায় আমি হারিয়ে যেতে পারতাম। আমরা যখন ওপরের দিকে উঠছিলাম, আকাশ দৃশ্যত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। তারপর ৪টা ৩০ মিনিট নাগাদ আমরা শিখরে পৌঁছেছিলাম। আকাশে মেঘের কয়েকটি পুরু রেখা, তবে বাধাহীনভাবে আকাশের অনেকটা দূরে চোখ যায়। কিন্তু চমৎকার তারকাখচিত আকাশ ছাড়া তখনো সবকিছু অন্ধকার। সূর্যোদয়ের আগের স্বল্প সময়ে আমরা কাঠের আগুনে খানিকটা কফি তৈরি করে ফেলেছিলাম। ওখানে ট্যুরিস্ট বলতে কেবল আমরাই ছিলাম, অন্যরা হয়তো আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারপর যখন ঘড়িতে সময় প্রায় ভোর পাঁচটার কাছাকাছি, পূর্ব দিক আলোকিত হতে শুরু করল। স্বচ্ছ নীল আকাশ থেকে হিমালয়ের তুষারাবৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল আলো; তাদের সাদা ধূসর রং, আমাদের দেশের পর্বতের মতোই এই দৃশ্য আমার কাছে অতিপরিচিত। তখন আমাদের সামনে (অর্থাৎ ৫০-৭০ কিলোমিটার দূরে) সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার দীর্ঘ পরিসর। ধারালো শিরা-উপশিরা ছাড়াও প্রতিটি শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছিল। সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি ৮ হাজার মিটার উঁচু। এত উঁচু বিশালাকার পর্বতগুলো কেবল ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। যাহোক, মাউন্ট এভারেস্ট এখান থেকে অনেক দূরে—আমার মনে হয়, প্রায় ১৫০ কিলোমিটার হবে, সেই রকমই ধূসর দেখাচ্ছিল। তা ছাড়া সব সময় এই পর্বত মেঘের আড়ালে ছিল, যেখান থেকে মাঝেমধ্যে কেবল শৃঙ্গের ঝলক দেখতে পাওয়া যায়। দুটো পর্বতের রেঞ্জের মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার পূর্ব দিকে নিচের চূড়া এবং হিমবাহের একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল প্রসারিত। সম্ভবত উচ্চতার নিরিখে সব কটিই ৬ হাজার মিটারের ওপরে। বিশেষ করে পূর্ব দিকের এই দৃশ্যের ব্রুয়েনস্টাইন থেকে দেখতে পাওয়া ট্যারেন পর্বতমালার সঙ্গে অনেক মিল। (তোমাদের কি এই ব্যাপার এখনো মনে আছে?) সূর্য আমাদের পাহাড়ে পৌঁছানোর অনেক আগে, উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলো জ্বলজ্বল করতে শুরু করে, প্রথমে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও মাউন্ট এভারেস্ট, তারপর একে একে নিচের শিখরগুলো। তবে তোমরা ইতিমধ্যে জানো যে এ ধরনের সূর্যোদয় কেমন দেখায়। আমরা সেখানে অনেকটা সময় ধরে ছিলাম, যতক্ষণ না পাহাড়গুলো পুরোপুরি সাদা হয়ে জ্বলজ্বল করতে শুরু করল এবং রোদের উত্তাপ আমাদের গায়ে এসে লাগল। এই মুহূর্তে আমরা আবারও মেঘ এবং কুয়াশার নিচে বসে আছি। তবে এই পরিবেশ অবশ্যই আমাকে আর বিচলিত করছে না।
আরেকটি নতুন পৃষ্ঠা নিয়ে লেখা শুরু করতে ইচ্ছা করছে না। অতএব তোমরা অনেক উষ্ণ শুভেচ্ছা নিয়ো,
তোমাদের ওয়ার্নার
পরদিন সকালের ট্রেনেই পাহাড় থেকে নেমে এলেন হাইজেনবার্গ। আবার কলকাতা থেকে জাহাজ ধরতে হবে। ফিরতি যাত্রায় ট্রেনে বসে নিজের দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বন্ধু পল ডিরাককে লিখে জানালেন তিনি।
কলকাতা থেকে মাদ্রাজে এলেন হাইজেনবার্গ। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁকে স্বাগত জানাতে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কে এস কৃষ্ণাণ। এই বিদেশি অতিথিকে সঙ্গ দেওয়ার ভার পড়েছে বিজ্ঞান বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র চন্দ্রের ওপর। ছেলেটির পুরো নাম সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর। কয়েক মাস আগেই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন হাইজেনবার্গের শিক্ষক আর্নল্ড সমারফেল্ড। তাঁর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিল চন্দ্র। সমারফেল্ডের কাছেই সে প্রথম শুনেছিল শ্রোঙ্গিগারের ওয়েভ মেকানিকস এবং হাইজেনবার্গ, ডিরাক, পাউলি ও অন্যান্য তরুণের হাতে কণাপদার্থবিজ্ঞান জগতের অগ্রগতির কথা। ফলে এবার হাইজেনবার্গের সাহচর্য ওর কাছে স্বপ্নের মতো। একটি গাড়ি ভাড়া করে সারা দিন ধরে কাঞ্চিপুরম ও মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলো জার্মান পদার্থবিদকে ঘুরিয়ে দেখাল সে। কলেজপড়ুয়া এই ছাত্রের বিজ্ঞানভাবনা শুনে এবং ওর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন হাইজেনবার্গ। ওকে শুনিয়েছিলেন কোপেনহেগেনে বিজ্ঞানী নীলস বোরের ইনস্টিটিউশনের কথা। বোরের বিজ্ঞানদর্শন, শিক্ষাদান ও মহানুভবতায় যে শিক্ষাঙ্গন, তাঁর নিজের কাছেই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এসব কথা শুনে গবেষণার স্বপ্নে যেন আরও বেশি করে বিভোর হয়ে ওঠে চন্দ্রশেখর। সন্ধ্যার পর সমুদ্রসৈকতে বসেও চলল পদার্থবিজ্ঞান আলোচনা। নিজের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রবন্ধটি নিয়েও কথা বলল চন্দ্র। পরদিন বাবাকে চিঠি লিখে জানাল, ‘সোমবার সারাটা দিন তাঁর সঙ্গে কাটালাম, একেবারে জাহাজঘাটায় কলম্বোর উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ার আগপর্যন্ত। আমার গবেষণাপত্রটি নিয়েও কথা বলেছি। মাত্র এক দিনে পদার্থবিজ্ঞানজগতের কত কিছু যে জানলাম!’
মাদ্রাজ থেকে জাহাজে চেপে সোজা কলম্বো। দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাজধানী শহরটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বেশি, আছে অগুনতি মনাস্ট্রি। ভারতে আসার আগে রেঙ্গুনেও নারকেলগাছে ঘেরা একটি প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির দর্শন করেছিলেন হাইজেনবার্গ। মা-বাবাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এই মন্দিরগুলোতে বাইরে জুতা রেখে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয়।’ পায়ে হেঁটে বন্দর–শহরটি ঘুরে দেখলেন তিনি। গেলেন গঙ্গারামাইয়া মন্দির দেখতে। ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরের এই শহরে মানুষেরা কিন্তু ভারী আন্তরিক। দুই দিন অপেক্ষা করার পর অবশেষে সিঙ্গাপুর থেকে হাইজেনবার্গের ঢাউস স্যুটকেসটি এখানে এসে পৌঁছায়। যথাসময়ে হারুনা মারু কলম্বো বন্দর ছেড়ে রওনা হয়। এই জাপানি জাহাজে চেপেই সুয়েজ খাল পেরিয়ে ইউরোপে যাচ্ছেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। এবার সত্যি দেশের টান অনুভব করছেন তরুণ পদার্থবিদ।