৩০ নভেম্বের, ২০১৭। ক্যালেন্ডারের পাতার অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেকখানি আলাদা। সেটি ছিল স্বপ্ন পূরণের সূচনার দিন। ছাপান্ন বছর ধরে লালিত স্বপ্ন। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার এক অখ্যাত গ্রাম রূপপুর হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ। বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার সহায়তায় প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে শুরু হয় দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর ভবনের নির্মাণ কাজ। বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং সক্ষমতার মাইলফলক হয়ে থাকা এই অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছরের ৩০ নভেম্বরকে দেশে পালন করা হচ্ছে নিউক্লিয়ার ডে হিসেবে।
বিশেষ এই দিনটি বছর ঘুরে আবার চলে এসেছে। দিনটিকে স্মরণ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটির নানা খুঁটিনাটি জেনে ফেলা যায়।
একটি ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস ভেঙে গিয়ে দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট নিউক্লিয়াস তৈরি হয় এর নাম ফিশন বিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় আরও উৎপন্ন হয় কয়েকটি নিউট্রন এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ইউরেনিয়ামের ফিশনের কথা। যখন একটি নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আঘাত করা হয়, তখন প্রথমেই সেটি আগত নিউট্রনকে শোষণ করে তৈরি করে একটি যৌগিক নিউক্লিয়াস। তারপর দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। খুব অল্প সময় পরে (১০-১৪ সেকেন্ড পর) যৌগিক নিউক্লিয়াসটি অতিরিক্ত শক্তি গামা রশ্মি হিসেবে বিকিরণ করে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যায়। আবার যৌগিক নিউক্লিয়াসটি ভেঙে অপেক্ষাকৃত কম ভরের দুইটি নিউক্লিয়াস (যাদের একটির ভরসংখ্যা হবে ১৩৭-এর কাছাকাছি এবং অন্যটির হবে ৯৫-এর কাছাকাছি), ২-৩টি নিউট্রন এবং প্রায় ২০৪ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি উৎপন্ন করে। প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় ছয় গুণ বেশি। শক্তির বিচারে যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন হয় ফিশনের মাধ্যমে।
ফিশন বিক্রিয়ার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো চেইন বিক্রিয়া। অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশে একবার ফিশন শুরু হলে সেটি চলতেই থাকে। আগেই বলেছি, প্রতিবার ফিশন সংঘটনের পরে দুটি বা তিনটি করে নতুন নিউট্রন পাওয়া যায়। সেগুলো আশেপাশের অন্য ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা দিয়ে ফিশন ঘটায়। দ্বিতীয় ধাপের ফিশন থেকেও পাওয়া যায় নতুন নিউট্রন এবং বিপুল শক্তি। সেই নিউট্রনগুলোও একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তবে একটি কথা বলে রাখা ভালো। প্রতি ধাপে উৎপন্ন নিউট্রনের সবগুলোই কিন্তু ফিশনে অংশগ্রহণ করে না। এদের সিংহভাগই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অপচয় হয়। তবে যদি রিঅ্যাক্টরকে সঠিকভাবে নকশা করা হয়, তাহলে প্রতিটি ফিশন থেকে কমপক্ষে একটি নিউট্রন পাওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমে আরেকটি ফিশন ঘটবে। এভাবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ফিশন এবং এর মাধ্যমে উৎপাদিত শক্তির পরিমাণ। এর নাম চেইন বিক্রিয়া। ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া বজায় রাখার কাজটি সম্পন্ন করা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ডের মতো কাজ করা রিঅ্যাক্টরে। সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রেখে ফিশন ঘটানো হয়। কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফিশনের মাধ্যমে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপদ!
ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া কিন্তু চাইলেই পাওয়া যায় না। এর জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত জ্বালানি ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপ পাওয়া যায় পৃথিবীতে। ইউরেনিয়াম-২৩৮ এবং ইউরেনিয়াম-২৩৫। প্রথমটির পরিমাণ শতকরা ৯৯.৩ শতাংশ এবং অন্যটির মাত্র ০.৭ শতাংশ। কিন্তু বেশিরভাগ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ফিশন ঘটানো হয় মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর সঙ্গে (কেন ইউরেনিয়াম-২৩৮ ব্যবহার করা হয় না, সে আলোচনা অন্য আরেক দিনের জন্য তোলা রইল)। তাই রিঅ্যাক্টরে ব্যবহারের আগে শতকরা হিসাবে এদের পরিমাণ বাড়ানো হয়। যে প্রক্রিয়ায় এ কাজটি করা হয়, তার নাম এনরিচমেন্ট বা সমৃদ্ধকরণ। প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরগুলোতে ব্যবহারের আগে (যেমনটা আমাদের দেশে ব্যবহার করা হবে) জ্বালানিতে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ প্রায় ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। রিঅ্যাক্টর ভেদে এনরিচমেন্টের পরিমাণে তারতম্য হয়। অন্যদিকে, পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে এনরিচমেন্টের পরিমাণ হতে হয় ৯০ শতাংশেরও বেশি।
জ্বালানি এনরিচমেন্টের পরে এবার কাজ করতে হবে নিউট্রন নিয়ে। ফিশন ঘটানোর মূল কারিগর এই নিউট্রন। মুক্ত নিউট্রনগুলো বিভিন্ন শক্তির হয়। কোনোটা দ্রুত গতির, আবার কোনোটা ধীর গতির। প্রথমগুলোকে বলা হয় ফাস্ট নিউট্রন এবং পরেরটির নাম থার্মাল নিউট্রন। থার্মাল নিউট্রনের সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর ফিশন সংঘটনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু ঝামেলা হলো, প্রতিটি ফিশনের মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়া নিউট্রনগুলোর সবগুলোই ফাস্ট নিউট্রন। যাদের দিয়ে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এ ফিশনের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। তাই রিঅ্যাক্টরে ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া পেতে হলে অবধারিতভাবে আমাদের নিউট্রনগুলোর শক্তি কমিয়ে থার্মাল নিউট্রনে পরিণত করতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করা হয় তার নাম নিউট্রন মডারেশন।
প্রক্রিয়াটি কিন্তু একদমই জটিল নয়। নিউট্রনকে এর কাছাকাছি ভরের অণু বা পরমাণু দিয়ে ধাক্কা দেওয়া হয়। প্রতিটি সংঘর্ষের মাধ্যমে কিছু পরিমাণ শক্তি হারায় নিউট্রন। এক সময় এরা পরিণত হয় থার্মাল নিউট্রনে। যাদের সঙ্গে সংঘর্ষ করানো হয়, তাদের বলা হয় মডারেটর। সবচেয়ে সহজলভ্য মডারেটর হলো পানি। এর বাইরেও ভারী পানি (ডিউটেরিয়াম অক্সাইড, D2O), গ্রাফাইট ইত্যাদি মডারেটর হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তবে প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে ব্যবহার করা হয় সাধারণ পানি। জ্বালানি হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ এনরিচড ইউরেনিয়াম এবং মডারেটর হিসেবে সাধারণ পানির সমন্বয়ের মাধ্যমেই সেখানে অর্জন করা সম্ভব হয় ভারসাম্যপূর্ণ চেইন বিক্রিয়া। এটি পরিচিত ক্রিটিক্যালিটি নামে। তবে চাইলে ভারী পানি বা গ্রাফাইটের সমন্বয়ে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেও ক্রিটিক্যালিটি অর্জন করা সম্ভব। এ পদ্ধতি সাধারণত অন্য ধরনের রিঅ্যাক্টরে ব্যবহার করা হয়। সেগুলোর আলোচনাও আরেকদিন হবে।
দুই
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা যন্ত্রাংশের সম্পর্কেও কিছু বলতে হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল যন্ত্রপাতি দুইটি সার্কিটে বিন্যস্ত থাকে। প্রাইমারি সার্কিট এবং সেকেন্ডারি সার্কিট। শক্তি উৎপাদনের মূল কাজটি করা হয় প্রাইমারি সার্কিটে। তারপর ফিশনের মাধ্যমে রিঅ্যাক্টরের কোরে উৎপন্ন হওয়া তাপশক্তিকে কুলেন্ট ব্যবহার করে নিয়ে যাওয়া হয় স্টিম জেনারেটরে। সেখানে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি সার্কিটের পানির স্পর্শ না করিয়েই তাপের আদান-প্রদানের মাধ্যমে তৈরি করা হয় স্টিম বা বাষ্প। এদের ব্যবহার করে ঘোরানো হয় টারবাইনকে। পরবর্তীতে জেনারেটর এই ঘূর্ণনকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করে বিদ্যুৎ। সহজ করে বললে এটাই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাজের মূলনীতি।
প্রাইমারি সার্কিটের মূল উপকরণগুলো হলো রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল, রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প, প্রেসারাইজার এবং স্টিম জেনারেটর। রিঅ্যাক্টরের কোরের মাঝে থাকা ফুয়েল অ্যাসেম্বলিতে রাখা হয় এনরিচড ইউরেনিয়ামকে। প্রতিটি অ্যাসেম্বলি গঠন করা হয় অনেকগুলো ফুয়েল রড নিয়ে। একেকটি অ্যাসেম্বলিতে এদের সংখ্যা ৩০০টিরও বেশি হতে পারে। আর কোরের ভেতরে অ্যাসেম্বলির মোট সংখ্যা ২০০টিরও বেশি। প্রতিটি ফুয়েল রড তৈরি হয় অনেকগুলো ছোট ছোট ফুয়েল পেলেটের সমন্বয়ে। মূলত এদের মাঝেই রাখা হয় ইউরেনিয়াম। ফুয়েল রডগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের সংকরের তৈরি ফুয়েল ক্ল্যাডিং। এদের অস্তিত্ব থাকার কারণে কোনোভাবেই তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাইরে আসতে পারে না।
যখন ফিশন শুরু হয়, তখন ফুয়েল রডগুলো উত্তপ্ত হতে থাকে। সেই তাপশক্তিকে ক্রমাগত অপসারণ করে নিয়ে যেতে হয় স্টিম জেনারেটরে। যার মাধ্যমে এই কাজটি করা হয়, তার নাম কুলেন্ট। প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে সেই পানিকেই ব্যবহার করা হয় কুলেন্ট হিসেবে। অর্থাৎ, এ ধরনের রিঅ্যাক্টরে পানি একই সঙ্গে মডারেটর এবং কুলেন্ট। যাই হোক। কুলেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পানিকে যে রাস্তায় কোরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, তার নাম কোল্ড লেগ। যখন পানি এখান দিয়ে প্রবেশ করে তখন এর তাপমাত্রা থাকে ২৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।
তারপর এরা ওপরের ছবিতে দেখানো রাস্তা ধরে প্রথমে যায় কোরের নিচের অংশে। সেখান থেকে ফুয়েল রডগুলোর মধ্যকার ফাঁকা স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাপ পরিবহণ করে নিয়ে আসে হট লেগে। কোর থেকে গরম পানি বের হওয়ার রাস্তার নাম হট লেগ। এ সময় পানির তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৩৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।
রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের ওপরের অংশে থাকে কন্ট্রোল রডগুলো। এদের মূল কাজ কোরের মধ্যে থাকা নিউট্রন শোষণ করা। এদের মূল উপাদান বোরন। যদি কোনো কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোরের মধ্যে ফিশনের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই রডগুলো কোরের মধ্যে প্রবেশ করে নিউট্রন শোষণ করা শুরু করে। ফলে পর্যাপ্ত থার্মাল নিউট্রনের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় ফিশন। অর্থাৎ, রিঅ্যাক্টর বন্ধ হয়ে যায়। রিঅ্যাক্টর প্রোটেকশন সিস্টেম নামের একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয় রিঅ্যাক্টরকে। অবস্থা বেগতিক দেখলেই এর কাজ শুরু হয়ে যায়। মেইন কন্ট্রোল রুমে থাকা অপারেটররা চাইলেও একে থামাতে পারে না। অবশ্য থামানোর কোনো দরকারও নেই!
প্রাইমারি সার্কিটের ভেতরে পানির প্রবাহ চালু রাখার মূল কাজটি করে রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প। এটি বেশ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ পানি প্রবাহে সক্ষম এটি। হট লেগ থেকে বের হবার পর উত্তপ্ত পানির গন্তব্য হয় স্টিম জেনারেটরে। সেখানে পৌঁছানোর পর এদের স্টিম জেনারেটরে থাকা অনেকগুলো টিউবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করানো হয়। এতে করে টিউবগুলো গরম হতে থাকে। টিউবের ঠিক অন্য পাশেই থাকে সেকেন্ডারি সার্কিটের পানি। যারা কিনা এই টিউবগুলো থেকে শোষণ করে নেয় এই বিপুল পরিমাণ তাপশক্তি এবং পরিণত হয় স্টিমে। অন্যদিকে, তাপ ছেড়ে দেওয়ার পর প্রাইমারি সার্কিটের কুলেন্ট ফেরত চলে যায় কোল্ড লেগে এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হয়।
তিন
কোল্ড এবং হট লেগে পানির তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৯৫ ডিগ্রি এবং ৩৩০ ডিগ্রির কাছাকাছি। কিন্তু পানির স্ফুটনাংক স্বাভাবিক চাপে মাত্র ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে হিসেবে প্রাইমারি সার্কিটের ভেতরে তো সব বাষ্প হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তো সেখানে তীব্র বেগে পানি প্রবাহিত হতে দেখতে পাই। রহস্যটা কী তাহলে? আসলে সম্পূর্ণ প্রাইমারি সার্কিটকে প্রায় ১৬ মেগাপ্যাসকেল চাপে রাখা হয়। তাই অনেক উচ্চ তাপমাত্রাতেও পানি ফোটা শুরু করে না। এ জন্যই এ ধরনের রিঅ্যাক্টরের নাম দেওয়া হয়েছে প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টর। যে যন্ত্রের সাহায্যে এত উচ্চ চাপ বজায় রাখা হয়, তার নাম প্রেসারাইজার। এটি আসলে একটি বেশ বড় আকারের ট্যাংক। যার অধিকাংশই পানি দিয়ে ভর্তি। ট্যাংকের ওপরের দিকে থাকে বাষ্প। এর একেবারে নিচের দিকে পানির ভেতরে রাখা থাকে একটি হিটার। যদি কোনোভাবে প্রাইমারি সার্কিটের চাপ কমে যায়, তাহলে হিটার চালু করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিকে বাস্পে পরিণত করা হয়। যাদের সম্মিলিত চাপের প্রভাবে প্রাইমারি সার্কিটের প্রেসার আগে অবস্থায় ফিরে যায়। অন্যদিকে, যদি সার্কিটের ভেতরে চাপ বেড়ে যায়,তাহলে ট্যাংকের ওপরে থাকা বিভিন্ন ভালভ এবং স্প্রের মাধ্যমে পানি ছিটানো হয়। যার ফলাফল হিসেবে বাষ্প পানিতে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে সমগ্র সার্কিটের চাপ কমে যায়।
এতক্ষণ আসলে প্রাইমারি সার্কিটের একটি লুপের কথা বর্ণনা করলাম। কোল্ড লেগ থেকে কোর, সেখান থেকে হট লেগ, তারপর স্টিম জেনারেটর হয়ে রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প হয়ে আবার কোল্ড লেগে আসে পানি। প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে এমন লুপের সংখ্যা হয় সাধারণত তিনটি বা চারটি। সবগুলো লুপই একই রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। আর প্রেসারাইজার যুক্ত থাকে চারটি লুপের মধ্যে যে কোনো একটির হট লেগের সাথে। চারটি হট লেগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে চারটি স্টিম জেনারেটর। এদের প্রত্যেকটি চারটি আলাদা রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। রিঅ্যাক্টরে ফিশনের মাধ্যমে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ তাপশক্তিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্যই লুপের সংখ্যা বাড়ানো হয়। নাহয় সিংহভাগ শক্তিই অপচয় হয়ে যেত।
চার
সেকেন্ডারি সার্কিটের আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটি বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করে ফেলা ভালো। প্রাইমারি সার্কিটের পানি সম্পূর্ণ তেজস্ক্রিয়। কোরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হবার কারণে এমনটা হয়। এছাড়াও নিউট্রন মডারেশনের প্রক্রিয়া চলার কারণে অনেক সময়েই পানিতে থাকা অক্সিজেন নিউট্রন শোষণের মাধ্যমে কয়েক ধাপ বিকিরণ শেষে পরিণত হয় নাইট্রোজেন-১৬তে। যা কিনা বিকিরণ করে ক্ষতিকর গামা রশ্মি। কিন্তু এদের নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কারণ এদের দৌড় প্রাইমারি সার্কিট পর্যন্তই। সেকেন্ডারি সার্কিটকে সম্পূর্ণ রূপে আলাদা রাখা হয় প্রাইমারি সার্কিট থেকে। তাই কোনোভাবেই পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি প্রাইমারি সার্কিটকে রাখা হয় দুই স্তর বিশিষ্ট কনটেইনমেন্টের ভেতরে। ভেতরের কনটেইনমেন্ট তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাব্যতা শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে এবং বাইরের কনটেইনমেন্ট রিঅ্যাক্টরকে রক্ষা করে বাহ্যিক প্রভাব থেকে। যেমন: ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বিমান দুর্ঘটনা ইত্যাদি। নিচের ছবিতে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি সার্কিটের ডায়াগ্রাম দেখানো হয়েছে।
সেকেন্ডারি সার্কিটের মূল উপকরণগুলোর সঙ্গে পরিচয় জানা দরকার। এগুলো হলো টারবাইন (লো প্রেসার সিলিন্ডার এবং হাই প্রেসার সিলিন্ডার), ময়েশ্চার সেপারেটর অ্যান্ড রিহিটার, জেনারেটর, কনডেনসার, মেইন কন্ডেনসেট পাম্প, লো প্রেসার হিটার এবং হাই প্রেসার হিটার, ফিড ওয়াটার পাম্প, ডিয়ারেটর ইত্যাদি। সেকেন্ডারি সার্কিটে থাকা সকল উপকরণগুলো থাকে টার্বাইন বিল্ডিংয়ে। বিল্ডিংটি কনটেইনমেন্টের বাইরে অবস্থান করে। সেকেন্ডারি সার্কিট তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত হওয়ার কারণে একে কনটেইনমেন্টের ভিতরে রাখার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ে থাকা স্টিম জেনারেটর থেকে উৎপন্ন স্টিমগুলো পাইপ লাইনের মাধ্যমে এসে প্রবেশ করে টারবাইন বিল্ডিংয়ে। তারপর সোজা চলে যায় টার্বাইনে।
টারবাইনে দুটি প্রধান অংশ থাকে। হাই প্রেসার সিলিন্ডার (HPC) এবং লো প্রেসার সিলিন্ডার (LPC)। হাই প্রেসার সিলিন্ডারের সংখ্যা থাকে একটি। আর লো প্রেসার সিলিন্ডারের সংখ্যা ডিজাইন অনুযায়ী তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণত এদের সংখ্যা হয় চার। প্রথমেই স্টিম জেনারেটর থেকে আসা টাটকা বাষ্প প্রবেশ করে টার্বাইনের হাই প্রেসার সিলিন্ডারে। সেখানে এগুলোকে ব্যবহার করা হয় রোটর ঘোরানোর কাজে। একবার ব্যবহারের পরই কিন্তু বাষ্পের কার্যকারীতা শেষ হয়ে যায় না। একে আবারও ব্যবহার করা যায়। তবে প্রথমবার ব্যবহারের পর এদের গুণগত মান হ্রাস পায়। কারণ ব্যবহারের পর বাষ্পে আদ্রতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় ধাপে ব্যবহারের আগে এদের প্রথমে ময়েশ্চার সেপারেটর অ্যান্ড রিহিটার দিয়ে শুষ্ক করা হয় এবং তাপ দেয়া হয়। যা কিনা স্টিমের কোয়ালিটি উন্নতিতে সাহায্য করে। অতঃপর এদের পাঠানো হয় লো প্রেসার সিলিন্ডারে। সেখানে দ্বিতীয় দফা ব্যবহার শেষে স্টিম আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। এবার শুরু হয় এদের পানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া।
প্রথমেই এদের পাঠানো হয় কনডেন্সারে। প্রতিটি লো প্রেসার সিলিন্ডারের সঙ্গেই একটি করে কনডেনসার থাকে। কনডেনসারে কুলিং টাওয়ার থেকে টিউবের মাধ্যমে ঠান্ডা পানি আসে। সেখানে স্টিমগুলো কুলিং টাওয়ার থেকে আসা টিউবের পানিকে তাপ ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় পানিতে। একটি কথা মনে রাখতে হবে। কনডেনসারে কিন্তু স্টিম এবং কুলিং টাওয়ার থেকে আসা পানির সরাসরি মিশ্রণ হয় না। টিউবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় ঠাণ্ডা পানি। যার সংস্পর্শে এসে স্টিমগুলোও ঠাণ্ডা হয়। কনডেনসারের মাধ্যমে স্টিমগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে পরিণত হয়। তখন এদের নাম বলা হয় কনডেনসেট।
কনডেনসেটকে পুনরায় স্টিম জেনারেটরে পাঠানোর আগে একে নির্দিষ্ট মাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। কারণ স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানির চেয়ে উত্তপ্ত পানির কর্মদক্ষতা বেশি। উত্তপ করার কাজটি করে লো প্রেসার হিটারে এবং হাই প্রেসার হিটার। লো প্রেসার হিটার উত্তপ্ত করার কাজে ব্যবহার করে লো প্রেসার সিলিন্ডার থেকে আসা স্টিমকে। এক্সট্রাকশন লাইনের মাধ্যমে স্টিমকে নিয়ে আসা হয়। একইভাবে হাই প্রেসার হিটার ব্যবহার করে হাই প্রেসার সিলিন্ডার থেকে আসা স্টিমকে। প্রথমে কনডেনসেটকে কয়েকটি ধাপে লো প্রেসার হিটার ব্যবহার করে উত্তপ্ত করা হয়। তারপর এতে থাকা ময়েশ্চার দূর করে ফিড ওয়াটার পাম্প ব্যবহার করে পাঠানো হয় হাই প্রেসার হিটারে। সেখানেই কনডেনসেটকে উত্তপ্ত করে কাংখিত তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরই পাঠিয়ে দেয়া হয় স্টিম জেনারেটরে। প্রাইমারি সার্কিটের তাপ পরিবহণ করে নিয়ে আসার জন্য। এরপর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
টার্বাইনের দুই ধরনের সিলিন্ডারগুলোই একটি কমন শ্যাফটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। স্টিম ব্যবহার করে হাই প্রেসার সিলিন্ডার ব্লেড এবং লো প্রেসার সিলিন্ডার ব্লেডগুলো সেই শ্যাফটকে ঘোরায়। এটি আবার যুক্ত থাকে জেনারেটরের সাথে। যা কিনা শ্যাফটের যান্ত্রিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপন্ন করে বিদ্যুৎ।
সবার শেষে কুলিং টাওয়ার নিয়ে একটু ধারণা দেওয়া যাক। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে যাদের ধারণা কম তারা কুলিং টাওয়ারগুলোকেই মনে করে রিঅ্যাক্টর। আসলে এখান থেকে বের হওয়া সাদা ধোঁয়া দেখে বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে কুলিং টাওয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশ মাত্র। এদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশও বলা যাবে না। কারণ অনেক দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কুলিং টাওয়ার থাকে না । সেগুলোতে ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে কুলিংয়ের কাজটি করা হয়।
স্টিমের ছেড়ে দেওয়া তাপশক্তি বহন করে নিয়ে আসা পানিকে ঠাণ্ডা করার পদ্ধতি অনুসারে কুলিং টাওয়ারগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মেকানিক্যাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ার এবং ন্যাচারাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ার। প্রথমটিতে ঠাণ্ডা করার কাজে ব্যবহার করা হয় ফ্যান। আর, পরেরটিতে প্রাকৃতিক বাতাসকেই কাজে লাগানো হয়। ন্যাচারাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ারের নিচের অংশ থেকে ওপরের দিকে বাতাসের প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। আর গরম পানিগুলোকে নোজলের সাহায্যে ওপর থেকে নিচের দিকে স্প্রে করা হয়। এতে করে বাতাস গরম পানি থেকে তাপ শোষণ করে ওপরের খোলা মুখ দিয়ে পরিবেশে চলে যায়। আর পানিগুলো টাওয়ারের নিচে থাকা রিজার্ভারে এসে জমা হয়। সেখান থেকে এগুলোকে আবার পাঠানো হয় কনডেনসারে। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। ঠিক এভাবেই ইউরেনিয়াম থেকে শক্তি আহরণ করে তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ।
লেখক: সহকারী ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি, রূপপুর, পাবনা