ভুতুড়ে কণা নিউট্রিনো

যেসব বস্তুকণা দিয়ে মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভট কণাটির নাম নিউট্রিনো। প্রতি মুহূর্তে এগুলো আপনার দেহ কিংবা পৃথিবী ভেদ করে চলে যাচ্ছে, কোনোরকম বাধা ছাড়াই। একটা-দুটো নয়, মাছের পোনার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে। কিন্তু কারও সঙ্গে কোনোরকম মিথস্ক্রিয়া করছে না। ঘন কুয়াশা ভেদ করে একটা বুলেট যেভাবে চলে যায়, পৃথিবীর এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আরেক প্রান্ত দিয়ে নিউট্রিনোর বেরিয়ে আসাকেও তুলনা করা যায় অনেকটা সেরকম। এদের আচার-আচরণ অনেকটাই ভূতের মতো। এ কারণেই নিউট্রিনোকে বলা হয় ভুতুড়ে কণা। ঘোস্ট পার্টিকেল। এ নামটি অবশ্য দিয়েছিলেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির গ্র্যান্ডমাস্টার আইজ্যাক আসিমভ। কেউ কেউ বলেন লাজুক কণা। কারণ, কারো সঙ্গে মিশতে চায় না। অন্তর্মুখী চরিত্র। তাই তো এ কণা আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীদের লেগে গিয়েছিল অনেক দিন। এমনকি এখনও এ কণা সম্পর্কে বলতে গেলে খুব কমই জানা গেছে।

নিউট্রিনো কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি। সেই ১৯৩০ সালে। বিটা ক্ষয়ে আপাত শক্তির হারিয়ে যাওয়া ব্যাখ্যা করতে নিউট্রিনো কণার অস্তিত্বের অনুমান করেন তিনি। পাউলি প্রস্তাব করেন, একটা চার্জ নিরপেক্ষ কণা বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় পরমাণুর বাইরে শক্তি নিয়ে যায়। সেই কণাটিরই পরে নাম দেওয়া হয় নিউট্রিনো। কণাটির নামকরণ করেছিলেন ইতালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি। এ শব্দের অর্থ, ছোট্ট অচার্জিত কণা। বিজ্ঞানী জেমস চ্যাড উইকের আবিষ্কৃত চার্জ নিরপেক্ষ ভারী নিউট্রনের সঙ্গে পার্থক্য করতে এরকম নামকরণ করা হয়।

আরও পড়ুন

নিজের ধারণা নিয়ে একসময় নিজেই সন্দিহান ছিলেন পাউলি। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ২৫ বছর পর পরীক্ষামূলকভাবে কণাটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ১৯৫৬ সালে মার্কিন পদার্থবিদ ফ্রেডরিক রেইন এবং ক্লাইড কোয়ান নিউট্রিনো কণাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। সেগুলোর উৎপত্তি ছিল পারমাণবিক চুল্লিতে।

অন্য কণার সঙ্গে কোনো রকম মিথস্ক্রিয়া না করা বা কম করার অন্যতম কারণ, কণাটি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ। এদের ভরও খুব কম। অতি হালকা কণা। একসময় এদের ভর নেই বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু তা আসলে ঠিক নয়। নিউট্রিনো কণার ভর প্রায় শূন্য, তবে একেবারে শূন্য নয়। তবে তা এত ছোট যে এখনও সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, একটি দাড়িপাল্লার একপাশে যদি একটা ইলেকট্রন রাখা হয়, তাহলে অন্য পাল্লাকে ভারসাম্যে আনতে প্রায় এক লাখ নিউট্রিনো লাগবে। এত অল্প ভরের কারণেই এরা আলোর প্রায় কাছাকাছি গতি চলতে পারে।

নিউট্রিনো কণা তিন ধরনের। ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো এবং টাউ নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর একটা বিশেষ ধর্ম হলো, এদের এক ধরন থেকে আরেকটি ধরনে রূপান্তর করা যায়। অন্যান্য মৌলিক কণার সঙ্গে তুলনা করলে নিউট্রিনো আবিষ্কার সাম্প্রতিক। ইলেকট্রন নিউট্রিনো আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৬ সালে এবং টাউ নিউট্রিনো ২০০০ সালে।

মহাবিশ্বে নিউট্রিনোর সংখ্যা প্রচুর। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, ফোটনের পর মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় এ কণা। পৃথিবীর প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার ভেদ করে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। আমাদের সৌরজগৎ ছাড়াও এসব নিউট্রিনো আসছে মহাবিশ্বের অন্য কোনো জায়গা থেকে। কোনো নিউট্রিনো কণার জন্ম কোথায়, তার ওপর ভিত্তি করে এর শক্তির পরিমাণও ভিন্ন হয়। এই শক্তির পরিমাণ মেপেই বিজ্ঞানীরা ওই নিউট্রিনো কণার উৎপত্তি কোথায়, তা বলতে পারেন। সেভাবেই নিউট্রিনোর উৎস সম্পর্কে জানা গেছে অনেক কিছু। যেমন: এদের কিছু আসছে আপনার পায়ের নিচের মাটির গভীর থেকে। এদের উৎস পাথরের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। কিছুর উৎস আপনার নিজের দেহ। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, আপনার দেহের তেজস্ক্রিয়তার ফলস্বরূপ নিউট্রিনো বেরিয়ে আসছে। হিসেব মতে, আমাদের দেহ থেকেও প্রতি সেকেন্ডে বেশ কয়েক হাজার নিউট্রিনো নিঃসৃত হচ্ছে। আমাদের দেহে এগুলো তৈরি হওয়ার কারণ হাড় ও দাঁতের ভেতরে থাকা পটাশিয়াম মৌলের ক্ষয়।

নিজের ধারণা নিয়ে একসময় নিজেই সন্দিহান ছিলেন পাউলি। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ২৫ বছর পর পরীক্ষামূলকভাবে কণাটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়
কানাডার অন্টারিওর সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরির বাইরের দিক
আপনি যদি পরিণত বয়সী ও স্বাভাবিক আকৃতির মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে এই মুহূর্তে আপনার ভেতর এক লাখ বা তারও বেশি সৌর-নিউট্রিনো কণা রয়েছে। এগুলো এসেছে সূর্যের গভীর থেকে

পৃথিবীতে আসা বেশির ভাগ নিউট্রিনোর উৎস সূর্য। সেখান থেকেও আসছে বিপুল পরিমাণ নিউট্রিনো। সেগুলো দশ মিনিটের কম সময় আগে সূর্যের কেন্দ্রে তৈরি হয়েছে। নক্ষত্রে ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুটি হাইড্রোজেন জোড়া লেগে হিলিয়াম তৈরি হচ্ছে (আমাদের সূর্যেও ফিউশন চলছে)। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে নিউট্রিনো। সূর্য থেকে আসা নিউট্রিনোকে বলা হয় সোলার নিউট্রিনো। বাংলায় সৌর-নিউট্রিনোও বলা চলে। আবার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফিশন প্রক্রিয়ায় পরমাণু বিভাজিত হয়ে ছোট্ট পরমাণুতে পরিণত হচ্ছে। এতেও তৈরি হচ্ছে অগণিত নিউট্রিনো।

আপনি যদি পরিণত বয়সী ও স্বাভাবিক আকৃতির মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে এই মুহূর্তে আপনার ভেতর এক লাখ বা তারও বেশি সৌর-নিউট্রিনো কণা রয়েছে। এগুলো এসেছে সূর্যের গভীর থেকে। সৌর-নিউট্রিনো চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নয়। এরা প্রতি মুহূর্তে প্রায় আলোর কাছাকাছি গতিতে ছুটছে। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, প্রতি সেকেন্ডে আমাদের দেহ ভেদ করে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন সোলার বা সৌর-নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে (এক ট্রিলিয়ন = ১০১২)। কিন্তু আমরা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও তা টের পাচ্ছি না।

নিউট্রিনো কণার কাছে পুরো বিশ্বের প্রায় সবকিছু বাধাহীন। কোনো চেষ্টা ছাড়াই কণাটি দেয়াল, গ্রহ এবং গোটা নক্ষত্র ভেদ করে চলে যেতে পারে। যেমন একটা নিউট্রিনো কণা গড়ে ২৭০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটারের পুরু লোহার দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে, প্রায় কোনো মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই। আগেই বলেছি, আমাদের দেহের ভেতর দিয়েও বিপুল পরিমাণ নিউট্রিনো কণা চলে যাচ্ছে। কিন্তু এদের অতি স্বল্পসংখ্যকই আমাদের জীবদ্দশায় দেহের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। নিউট্রিনোর এই বিশেষ গুণের কারণে এদের শনাক্ত করাও খুবই কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরাও কম সেয়ানা নন। অনেক গবেষণার পর দেখা গেল, বিশেষ ধরনের এক জাল বা ডিটেক্টর দিয়ে নিউট্রিনো শনাক্ত করা সম্ভব। এদের শনাক্ত করার জন্য মাটির কয়েক কিলোমিটার গভীরে বা কোনো পাহাড়ের মাঝখানে বিশালাকৃতির ডিটেক্টর বসানো হয়। নিউট্রিনো শনাক্ত করতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ডিটেক্টর বা নিউট্রিনো টেলিস্কোপ বসিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন কানাডার অন্টারিওর সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরি। মাটির নিচে বসানো বিশাল আকৃতির এই ডিটেক্টরে বল আকৃতির কন্টেইনারে ১ হাজার টন ভারী পানি (ডিউটেরিয়াম) ভরা হয়। এ ছাড়া কন্টেইনারের চারপাশে রাখা হয় ৯ হাজার ৫০০টি ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব।

কানাডার অন্টারিওর সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরির ভেতরের দিক
আরও পড়ুন

কিন্তু এসব আয়োজনের কারণ কী? এর মাধ্যমে নিউট্রিনো কণা কীভাবে ধরা সম্ভব? আসলে নিউট্রিনো কণা ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ইলেকট্রন তৈরি করে। প্রতিটি সংঘর্ষে একটি নিউট্রিনো একটি ডিউটেরিয়ামে (যার মধ্যে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন থাকে) আঘাত করে একটি ইলেকট্রন বের করে দেয়। এই ইলেকট্রন আলোর চেয়েও বেশি গতিতে ডিউটেরিয়ামের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। আর এটি করতে গিয়ে যে ঘটনাটি ঘটে, তাকে বলা হয় চেরেনকভ বিকিরণ। এতে তৈরি হয় আলোর শঙ্কু, যা বিমান থেকে উৎপন্ন সনিক বুম শোনার মতো। ডিটেক্টরে থাকা ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবগুলো আলোক শঙ্কুগুলো এবং তাদের সজ্জা শনাক্ত করতে পারে। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা এই ডিটেক্টরে এ ধরনের কিছু শনাক্ত হলে বোঝা যায় নিউট্রিনোগুলোর উৎস সূর্য। ২০০১ সালে সডবোরি নিউট্রিনো অবজারভেটরিতে তিন ধরনের নিউট্রিনো শনাক্ত করার মাধ্যমে সেটি প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এখান থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, নিউট্রিনোর ভরও আছে।

নিউট্রিনো শনাক্ত করার সবচেয়ে বড় ডিটেক্টরের নাম আইসকিউব। ২০১০ সালে দক্ষিণ মেরুতে এটি স্থাপন করা হয়। এখানে বিজ্ঞানীরা ৫ হাজার ১৬০টি কাচের গোলক মাটির কয়েক কিলোমিটার গভীরে স্থাপন করেছেন। এখানেও আগের মতো এই নীতি প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ কোনো নিউট্রিনো কণা একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করলে আলো নিঃসৃত হয়। ঘটনাটা বিরল হলেও এর মাধ্যমে বোঝা যায় নিউট্রিনোর অস্তিত্ব।

প্রশ্ন আসতে পারে, নিউট্রিনো শনাক্ত করে কী লাভ? মহাবিশ্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের যোগান দেয় নিউট্রিনো। অন্য কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে এ কণা মোটেও আগ্রহী নয়। তাদের এই অনাগ্রহই বিজ্ঞানীদের কাছে বেশি দরকারি। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ এবং অন্যান্য কণারা মহাবিশ্বের অন্য কণাতে শোষিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিউট্রিনো আলাদা। এই কণা মহাবিশ্বের দূরবর্তী এলাকা থেকে অন্য কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করেই পৃথিবীতে অবিকৃত অবস্থায় চলে আসতে পারে।

আইসকিউব অবজারভেটরি, নিউট্রিনো শনাক্ত করার সবচেয়ে বড় ডিটেক্টর
আরও পড়ুন

নিউট্রিনো শনাক্ত করা কঠিন হলেও এর কিছু বাস্তব প্রয়োগও আছে। যেমন নিউট্রিনো শনাক্ত করে বোঝা সম্ভব, কোনো পরমাণু চুল্লিতে কী পরিমাণ প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে এটি বেশ কার্যকরী তদন্তের হাতিয়ার। কারণ এর মাধ্যমে সংস্থাটি বুঝতে পারে, কেউ বা কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে কি না। আবার যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিউট্রিনো ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। নিউট্রিনো দৃঢ় বস্তু ভেদ করে চলে যেতে পারে। তাই এর মাধ্যমে বাধাহীনভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এবং অন্য গ্রহে থাকা রোভার বা দূর মহাকাশের নভোযানে মেসেজ পাঠানো বা যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। এসব চিন্তা করে এখন নিউট্রিনোভিত্তিক মোবাইল ফোন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আবার নিউট্রিনো বিকিরণ থেকে মোবাইল ফোন চার্জ করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।

সূত্র: গোস্ট পার্টিকেল: ইন সার্চ অব দ্য ইলিউসিভ অ্যান্ড মিস্টিরিয়াস নিউট্রিনো / অ্যালান কোডস এবং জেমস রিওরডন

নিউট্রিনো / ফ্রাঙ্ক ক্লোজ

ব্ল্যাক বডিস অ্যান্ড কোয়ান্টাম ক্যাটস / জেনিফার ওইলেট

উইকিপিডিয়া