একটি হরর মুভি ও থ্রি মাস্কেটিয়ার্স

বিগ ব্যাং মডেলের অন্যতম প্রধান শত্রু ফ্রেড হয়েল। বন্ধু থমাস গোল্ড ও হারমান বন্ডিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি উঠেপড়ে লাগলেন বিগ ব্যাং তত্ত্বের অসারতা প্রমাণে। একটি হরর মুভি বদলে দেয় তাঁদের প্রচেষ্টার ধারা। এই তিন মাস্কেটিয়ারের স্থিতিশীল মহাবিশ্বের তত্ত্বতালাশ ও তার উল্টো ফলাফল...

দীর্ঘ ছয় বছর সারা বিশ্ব তছনছ করে অবশেষে থামল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারিখটা ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এর এক সপ্তাহ পর ব্রিটেনে মুক্তি পেল একটি সিনেমা। সাদা-কালো, হরর মুভি। কিছুটা কমেডি ধাঁচের। নাম ডেড অব নাইট। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে হরর মুভি বানানো নিষিদ্ধ ছিল। তাই অনেক দিন পর ব্রিটেনে এমন কোনো সিনেমা মুক্তি পেল। সে কারণেই কি না কে জানে, সে দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল মুভিটি। যাকে বলে হাউসফুল।

১৯৪৬ সালের এক রাতে সিনেমাটি দেখতে ব্রিটেনের সারে এলাকায় গিল্ডফোর্ড সিনেমা হলে গেলেন তিন বন্ধু। ফ্রেড হয়েল, হারমান বন্ডি ও থমাস গোল্ড। তিনজনই বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের জন্মরহস্য নিয়ে তাঁরা খুব উৎসাহী। বিগ ব্যাং মডেল তিনজনের কেউ মানতে পারছেন না। তাই মহাবিশ্বের নতুন কোনো মডেলের খোঁজ করছিলেন তাঁরা।

ডেড অব নাইট ছবির পোস্টার

ডেড অব নাইট মুভি পাঁচটি ভূতের গল্পের সমাহার। কিন্তু শেষ দৃশ্যে গোটা কাহিনিতে অদ্ভুত একটি মোড় নিতে দেখা গেল। সিনেমার শুরুতে মূল চরিত্রের ঘুম ভেঙে যায়। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভূত হতে থাকে নতুন নতুন চরিত্র। সেই সঙ্গে প্লটও বিকশিত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সব শেষে দেখা গেল, সিনেমাটি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই। শেষ দৃশ্যেও মূল চরিত্রের ঘুম ভেঙে যায়, যেন এতক্ষণ সবই স্বপ্নের মধ্যে ঘটল। এরপর আগের সব ঘটনাই ঘটতে থাকে হুবহু। কাজেই সিনেমাটি এক অর্থে বৃত্তাকার একটি চক্রের মতো, যার কোনো শুরুও নেই, শেষও নেই; অর্থাৎ সিনেমাটি একইভাবে চিরকাল চলতেই থাকবে। কথিত আছে, সিনেমাটি শেষ হতেই গোল্ড বলে বসলেন, ‘মহাবিশ্বও যদি এ রকম হতো, তাহলে কী হবে?’

ডেড অব নাইট দেখার কয়েক মাস পর মহাবিশ্বের নতুন মডেল গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত হন গোল্ড। তাঁর মডেলে মহাবিশ্ব প্রসারণশীল, তবু বিগ ব্যাং মডেলের সঙ্গে সব দিক দিয়ে সাংঘর্ষিক। আগেই বলেছি, বিগ ব্যাং মডেলের সমর্থকেরা এমন এক মহাবিশ্বের অনুমান করতেন, যেটি অতীতে অতি ক্ষুদ্র, ঘন ও উত্তপ্ত ছিল। আর মহাবিশ্বটা সৃষ্টি হয়েছিল কয়েক বিলিয়ন বছর আগে। বিপরীতে গোল্ড, বন্ডি ও হয়েলের প্রস্তাবিত মডেলে মহাবিশ্ব প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় চিরকাল অস্তিত্বমান। ঠিক যেন ডেড অব নাইট মুভির মতো, যার শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই। এই মডেলেও মহাবিশ্বের অংশগুলো আসলে প্রসারিত হয়। কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে অনবরত তৈরি হয় নতুন পদার্থ। কাজেই মহাবিশ্বের ঘনত্ব সব সময় একই থাকে। অবশ্য পদার্থ কীভাবে শূন্য থেকে এমন রহস্যজনকভাবে তৈরি হচ্ছে, তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তাঁরা।

আরও পড়ুন
ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধংদেহী ছিলেন হয়েল। ওই সময়েই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র তিন বছর বয়সে নামতা শেখায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। চার বছর বয়সে ঘড়ি দেখে কীভাবে সময় বলতে হয়, তা কারও সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই আবিষ্কার করেন।

সেকালে যাঁরা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, তাঁদের কাছে শিগগিরই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তত্ত্বটি। একটি অগ্নিগর্ভ বিশৃঙ্খলা শূন্য থেকে হাজির হয়ে ছায়াপথগুলোকে সব দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে—এ ভাবনাই হয়েলের কাছে ভীষণ অযৌক্তিক বলে মনে হতো। তার চেয়ে শূন্য থেকে পদার্থের সৃষ্টি পছন্দ করলেন তিনি। অন্য কথায়, এ তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব কালহীন, চিরন্তন। এর কোনো শেষ নেই, শুরুও নেই। মহাবিশ্ব এভাবেই চিরকাল রয়েছে। এর নাম দেওয়া হলো স্টেডি স্টেট মডেল বা স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেল। অচিরেই বিগ ব্যাং মডেলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে মডেলটি। স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেলের প্রধান মুখপাত্র আর বিগ ব্যাং মডেলের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন ফ্রেড হয়েল।

ফ্রেড হয়েলের জন্ম উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের গিলস্টেড গ্রামে, ১৯১৫ সালের ২৪ জুন। জায়গাটা বিংলে শহরের পাশের একটা গ্রাম (এখন ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার নামে পরিচিত)। তাঁর বাবা বেন হয়েল ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। ওই এলাকায় তখন উলশিল্পের প্রাধান্য। লন্ডনের রয়েল মিউজিক কলেজে সংগীতে পড়ালেখা করেছিলেন মা ম্যাবেল পিকার্ড। সিনেমায় পিয়ানো বাজাতেন। তাঁর বাবাও বেশ ভালো ভায়োলিন বাজাতে পারতেন। মা–বাবার উৎসাহে শৈশবেই সংগীত ও বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁকেন হয়েল। তখন তাঁদের গ্রামে সবে রেডিও এসেছে। খুব বেশি লোকের বাড়িতে রেডিও ছিল না। তাই তাঁদের বাড়িতে রেডিও শুনতে আগ্রহ নিয়ে জড়ো হতেন ২০-৩০ জন।

ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধংদেহী ছিলেন হয়েল। ওই সময়েই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। মাত্র তিন বছর বয়সে নামতা শেখায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। চার বছর বয়সে ঘড়ি দেখে কীভাবে সময় বলতে হয়, তা কারও সাহায্য ছাড়া নিজে নিজেই আবিষ্কার করেন। বিশ্ব সম্পর্কে সবকিছু নিজে নিজেই শিখতে আগ্রহী ছিলেন হয়েল। সে কারণে তিনি স্কুল পালাতেন নিয়মিত। মাঝেমধ্যে দীর্ঘদিন স্কুলেও যেতেন না। আসলে বেশ কিছু কারণে স্কুলের প্রতি একধরনের অনীহা তৈরি হয়েছিল। এ রকম একটি ঘটনা তিনি নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন। একদিন একজন শিক্ষক ক্লাসে বললেন, নির্দিষ্ট একটি ফুলের পাঁচটি পাপড়ি থাকে। শিক্ষককে ভুল প্রমাণ করতে পরদিন হাতে করে একটি ছয় পাপড়িওয়ালা ফুল নিয়ে ক্লাসে হাজির হন হয়েল। অবাধ্য ছাত্রের এ রকম ধৃষ্ট আচরণের জন্য ওই শিক্ষক তাঁর বাঁ কানে বেশ জোরে থাপ্পড় মারেন। কথিত আছে, এর পর থেকে হয়েল বাঁ কানে তেমন শুনতে পেতেন না। সেদিন ভীষণ ক্ষোভে-দুঃখে সবার সামনে স্কুল থেকে বেরিয়ে যান তিনি। সেই স্কুলে কখনো ফেরেননি। সব মিলে কর্তৃপক্ষের প্রতি ছোটবেলা থেকেই তীব্র ঘৃণা জেঁকে বসেছিল তাঁর মনে।

অনেক পরে স্কুলে ফিরতে রাজি হন হয়েল। তাঁকে ইয়র্কশায়ারের বিংলে গ্রামার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি কৌতূহলও শুরু হয়েছিল ছোটবেলাতেই। তাঁর বাবা বেন হয়েল প্রায় নিরক্ষর হলেও ছেলে হয়েলকে সঙ্গে নিয়ে প্রায়ই পাশের শহরে এক বন্ধুর বাসায় যেতেন। ওই বন্ধুর কাছে একটা টেলিস্কোপ ছিল। রাতে সেখানে আকাশে তারা দেখে সকালে বাড়িতে ফিরতেন বাপ-বেটা। কিছুদিন পর তাঁকে টেলিস্কোপ উপহার দেন তাঁর মা-বাবা। এটাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় হয়েলের। ১২ বছর বয়সে হাতে আসে বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের লেখা বই স্টারস অ্যান্ড অ্যাটম। বিংলের পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বইটি এনেছিলেন হয়েল। অক্সফোর্ডে এডিংটনের দেওয়া বিভিন্ন বক্তৃতার সংকলন ছিল বইটি। সেটি পড়ে জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাপক আগ্রহী হয়ে ওঠেন হয়েল। পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর ভিত্তিটা হয়ে ওঠে আরও শক্ত।

বাঁ থেকে থমাস গোল্ড, হারমান বন্ডি ও ফ্রেড হয়েল

১৯৩৩ সালে কেমব্রিজের ইমানুয়েল কলেজে পড়ার জন্য বৃত্তি পান। সেখানে পড়ালেখা করেন গণিত নিয়ে। খুবই ভালো ফল করে জিতে নেন ম্যাথিউ প্রাইজ। ফলিত গণিতে সেরা রেজাল্ট করলে দেওয়া হতো পুরস্কারটা। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে পিএইচডি করার সুযোগ পান কেমব্রিজে। পল ডিরাক, ম্যাক্স বর্নের মতো কোয়ান্টাম তত্ত্বের নায়কদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। ১৯৩৯ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর সেন্ট জন কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন। এ সময় নক্ষত্রের বিবর্তন নিয়ে গবেষণায় মনোযোগ দিতে শুরু করেন। কিন্তু ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় হুট করে হয়েলের নক্ষত্রবিষয়ক গবেষণায় ছেদ পড়ে। হয়েলের ভাষায়, ‘যুদ্ধ আমার সবকিছু বদলে দিল। এটা আমার সেরা সৃজনশীল সময়কে ধ্বংস করে দিয়েছিল।’ প্রথমে চিচেস্টারে অ্যাডমিরাল্টি রাডার গ্রুপে কাজ করতে পাঠানো হয় তাঁকে। এরপর ১৯৪২ সালে সেকশন লিডার হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে পাঠানো হয় সারেতে অ্যাডমিরাল্টি সিগন্যাল এস্টাবলিশমেন্টে। এখানেই থমাস গোল্ড ও হারমান বন্ডির সঙ্গে দেখা। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অচিরেই তিনজনের কিছু মিল চোখে পড়তে শুরু করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনজনের সমান আগ্রহ। তাই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি।

আরও পড়ুন
এরপর ১৯৪৬ সালে কেমব্রিজের এই তিন বিজ্ঞানী হুট করে মহাবিশ্বের নতুন একটি মডেল ঘোষণা করেন। এর পেছনে একটি হরর মুভির সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদেরা। সে কাহিনি তো শুরুতেই বলেছি।

বন্ডি ও গোল্ডের বেড়ে ওঠা অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। এরপর কেমব্রিজে পড়ালেখা করেছেন তাঁরা। অ্যাডমিরাল্টি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় একই বাড়িতে থাকতেন দুজন। প্রতি সপ্তাহে বেশ কয়েক রাত এই দুই বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতেন হয়েল। রাডার নিয়ে গবেষণার ফাঁকে যেটুকু সময় পাওয়া যেত, সে সময় জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতেন। বিশেষ করে হাবলের পর্যবেক্ষণে পাওয়া প্রসারণশীল মহাবিশ্ব এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলত। এসব আলোচনায় আলাদা আলাদা ভূমিকা ছিল তিনজনের। গণিতে মেধাবী ছিলেন হারমান বন্ডি। তাই তাঁদের আলোচনাকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়া এবং তা থেকে বেরিয়ে আসা সমীকরণগুলো নিপুণভাবে ব্যবহারের দায়িত্ব ছিল বন্ডির। থমাস গোল্ডের বৈজ্ঞানিক ব্যাপারে বেশি ঝোঁক ছিল। তাই বন্ডির সমীকরণগুলোর ভৌত ব্যাখ্যা দিতেন তিনি। ওদিকে হয়েল ছিলেন তিনজনের মধ্যে সবার বড়। তাই তাঁদের ভাবনাচিন্তাগুলোর পথ দেখাতেন তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনজন আলাদা ক্যারিয়ার বেছে নেন। হয়েল জ্যোতির্বিদ্যা, বন্ডি গণিত ও গোল্ড নিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে কেমব্রিজেই থাকতেন তিন বিজ্ঞানী। তাই পার্টটাইমে কসমোলজি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন তাঁরা।

১৯৪০ সালের দিকেও আলোচিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব কোনোভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি হয়েলকে। এর পেছনে মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয়ের ত্রুটিই ছিল মুখ্য। এই প্রেক্ষাপটে সহকর্মী থমাস গোল্ড এবং হারমান বন্ডিকে সঙ্গে নিয়ে একটা নতুন বা প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেন ফ্রেড হয়েল। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে বিগ ব্যাং মডেল ছাড়াও আরেকটি তত্ত্ব আলোচিত ছিল। সেটা হলো চিরন্তন স্থিতিশীল মডেল। বন্ডির বাড়িতে নিয়মিত বসে এই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই তত্ত্বের পক্ষ ও বিপক্ষের যুক্তিগুলোর আলোচনা চলত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আলোচনায় স্থির মহাবিশ্বের প্রতিই পক্ষপাত থাকত। তবে হাবলের পর্যবেক্ষণের কারণে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হতেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

এরপর ১৯৪৬ সালে কেমব্রিজের এই তিন বিজ্ঞানী হুট করে মহাবিশ্বের নতুন একটি মডেল ঘোষণা করেন। এর পেছনে একটি হরর মুভির সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদেরা। সে কাহিনি তো শুরুতেই বলেছি। তাঁদের মডেলটা অসাধারণ ছিল। কারণ, সেটা এমন এক মহাবিশ্বের বর্ণনা করে, যা প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু তা চিরন্তন এবং অপরিহার্যভাবে অপরিবর্তনীয়।

নিজেদের প্রস্তাবিত মডেলের সপক্ষে নদীর উদাহরণ টানলেন হয়েল। নদী প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ অংশই অপরিবর্তিত থাকে। এমনকি আমাদের দেহের সঙ্গেও এ মডেলের তুলনা করা যায়। আমাদের দেহে প্রতিদিন কোষ মরে ঝরে পড়ছে, সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে নতুন কোষ। সেগুলোও একসময় মরে ঝরে গেলে জায়গা করে নেয় অন্য নতুন কোষ। এভাবে আমাদের আসলে কয়েক বছরের মধ্যে দেহের সব কোষ বদলে যায়। কিন্তু এরপরও আমরা একই মানুষ থেকে যাই।

বিগ ব্যাং মডেলে মহাবিশ্ব ও স্থিতিশীল মডেলে মহাবিশ্ব

কিন্তু হাবল প্রমাণ করেছেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। এর সঙ্গে তাঁদের মহাবিশ্ব মডেলকে কীভাবে খাপ খাওয়ালেন হয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা? মহাবিশ্বের বিকাশ প্রমাণিত। কারণ, দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্ব ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। যদি প্রসারণ ছাড়া আর কিছু না ঘটত, তাহলে মহাবিশ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেত এবং তার ঘনত্বও কমে যেত। বিগ ব্যাং মডেল ঠিক এই প্রস্তাব করেছিল। তবে থমাস গোল্ড দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথা বললেন। সেটা প্রসারণের কারণে ঘনত্ব কমে যাওয়া ঠেকিয়ে দিল এবং সামগ্রিক কোনো পরিবর্তনও ঘটায় না। তিনি বললেন, মহাবিশ্ব তার প্রসারণের ক্ষতিপূরণ করে নতুন পদার্থের জন্ম দিয়ে, অর্থাৎ পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া ছায়াপথগুলোর মাঝখানে ক্রমে নতুন পদার্থ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মহাবিশ্বের সামগ্রিক ঘনত্ব একই থেকে যাচ্ছে। এ রকম মহাবিশ্বকেও বিকাশমান এবং প্রসারণশীল দেখাবে, কিন্তু তার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। সেটা ধ্রুব এবং চিরন্তন থেকে যাবে। এভাবে এই ত্রয়ী বিজ্ঞানীর প্রস্তাবিত মডেলে দেখা গেল, হাবলের পর্যবেক্ষণ করা লোহিতবিচ্যুতি এবং দূরে সরে যাওয়া গ্যালাক্সির সঙ্গে চিরন্তন মহাবিশ্বের কোনো বিরোধ নেই। তার আগপর্যন্ত মহাবিশ্বের প্রসারণ আর বিগ ব্যাং মডেল যেন সমর্থক হয়ে উঠেছিল।

এ রকম একটা অপরিবর্তিত কিন্তু বিকাশমান মহাবিশ্ব মডেলের নাম হলো স্টেডি স্টেট মডেল বা স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় বন্ডির বাসায় বসে মডেলটি ব্যাখ্যা করলেন থমাস গোল্ড। আইডিয়াটির কথা শুনে একে পাগলাটে থিওরি বললেন হয়েল আর বন্ডি। হয়েল এমন মন্তব্য করলেন যে ডিনারের আগেই মডেলটি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু রাতের খাবারের আগপর্যন্ত সেটা নিয়ে অনেক রকম হিসাব-নিকাশ করে গেলেন তাঁরা। একে একে বেশ কটি ত্রুটি সারিয়ে তুলতে পারলেন এই ত্রয়ী। ক্ষুধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন বিজ্ঞানী বুঝতে পারলেন, গোল্ডের মডেলটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেকগুলো পর্যবেক্ষণের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। সেটা মহাবিশ্বের জন্য বেশ একটা বোধগম্য তত্ত্ব। এর সারসংক্ষেপ হলো, মহাবিশ্ব যদি অসীম হয়, তাহলে এর আকার দ্বিগুণ হতে পারে এবং তা অসীম ও অপরিবর্তিত থাকতে পারে, যতক্ষণ ছায়াপথগুলোর মাঝখানে নতুন নতুন বস্তু তৈরি হবে।

আরও পড়ুন
পরমাণু তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে ক্রিয়েশন ফিল্ড বা সি ফিল্ড নামে নতুন একটি ধারণার জন্ম দেন হয়েল। বলেন, গোটা মহাবিশ্বে এই ক্ষেত্র রয়েছে, যেখান থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরমাণু তৈরি হচ্ছে।

বিশ্ব সৃষ্টিসংক্রান্ত সব চিন্তাভাবনা আগে পরিচালিত হতো একটা কসমোলজিক্যাল নীতির মাধ্যমে। এই নীতি অনুযায়ী, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, তার আশপাশের এলাকাসহ মহাবিশ্বের যেকোনো এলাকা আসলে একই রকম। অন্য কথায়, মহাবিশ্বে আমাদের বাসস্থান বিশেষ কোনো জায়গা নয়। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বেও একই নীতি প্রয়োগ করেছিলেন আইনস্টাইন। তবে থমাস গোল্ড এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে একটা পারফেক্ট কসমোলজিক্যাল নীতি অনুমান করলেন। সে নীতি অনুযায়ী, মহাবিশ্বে আমাদের এলাকা কেবল মহাবিশ্বের অন্য যেকোনো এলাকার মতো নয়, মহাবিশ্বে আমাদের যুগও অন্য যুগের মতোই। অন্য কথায়, আমাদের বাসস্থান-ই শুধু নয়, আমাদের যুগ বা সময়টাও বিশেষ কিছু না। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সব জায়গায় একই রকম ও সব সময় একই রকম। গোল্ড বিশ্বাস করতেন, তাঁর পারফেক্ট কসমোলজিক্যাল নীতি থেকে প্রাকৃতিকভাবেই মহাবিশ্বের স্টেডি স্টেট মডেল বেরিয়ে আসে।

কেমব্রিজের এই ত্রয়ী বিজ্ঞানী গোল্ডের আইডিয়াকে আরও বিকশিত করে ১৯৪৯ সালে দুটি পেপারে প্রকাশ করেন। প্রথমটির লেখক ছিলেন গোল্ড ও বন্ডি। তাতে দার্শনিক ভাষায় স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেলকে ব্যাখ্যা করা হলো। আর দ্বিতীয় পেপারে মডেলটাকে প্রকাশ করা হলো গাণিতিকভাবে, যার লেখক হয়েল। এরপর তিন বিজ্ঞানী একত্রে কাজ করে তাঁদের মডেলটি ছড়িয়ে দিতে লাগলেন।

কিন্তু স্থিতিশীল মহাবিশ্ব মডেল ঘিরে তাৎক্ষণিকভাবে দুটি প্রশ্ন উঠল। প্রথমত, মডেলে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ছায়াপথগুলোর মাঝখানে নতুন পদার্থ তৈরি হয়, ফলে মহাবিশ্ব সার্বিকভাবে অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু এসব পদার্থ কীভাবে তৈরি হয় এবং সেগুলো আসে কোথা থেকে? ফ্রেড হয়েল হিসাব কষে জবাব দিলেন, এর জন্য মহাবিশ্বে খুব বেশি পদার্থ তৈরি হওয়ার দরকার নেই। প্রতি বিলিয়ন বা শতকোটি বছরে এক কিউবিক মিটারে একটা হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি হলেই যথেষ্ট। আর সেটা পৃথিবীবাসীর পক্ষে কখনো শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানালেন তিনি। পরমাণু তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে ক্রিয়েশন ফিল্ড বা সি ফিল্ড নামে নতুন একটি ধারণার জন্ম দেন হয়েল। বলেন, গোটা মহাবিশ্বে এই ক্ষেত্র রয়েছে, যেখান থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরমাণু তৈরি হচ্ছে। তবে এই সি ফিল্ড বা ক্ষেত্রের পেছনের পদার্থবিজ্ঞানটা কী, তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি এই তিন বিজ্ঞানী। আবার পদার্থগুলোকে কোথায় জন্ম নিতে হবে, সেটাই–বা পদার্থগুলো কীভাবে বুঝতে পারে, তারও কোনো উত্তর ছিল না কেমব্রিজের এই বিজ্ঞানীদের কাছে।

মায়ের কোলে ছোট্ট ফ্রেড হয়েল

স্টেডি স্টেট মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সব জায়গায় শিশু ছায়াপথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে বিগ ব্যাং মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, শুধু বিপুল মহাজাগতিক দূরত্বেই শিশু ছায়াপথ দেখা সম্ভব। তবে ১৯৪০-এর শেষ দিকেও আমাদের টেলিস্কোপগুলো যথেষ্ট উন্নত ছিল না। তাই শিশু ছায়াপথ আর পরিণত ছায়াপথের মধ্যে পার্থক্য করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই কোন মডেল যে সঠিক, তা অমীমাংসিত রয়ে যায়। তবে জ্যোতির্বিদদের জন্য মডেল বাছাই করার সুযোগ ছিল। চাইলে যে কেউ পছন্দমতো বিগ ব্যাং অথবা স্টেডি স্টেট মডেল বেছে নিতে পারতেন। তাই দুই দলেই সমর্থক জ্যোতির্বিদ বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞান সমাজও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। যেসব বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং মডেল মেনে নিতে পারছিলেন না, তাঁদের কাছে হয়েল দলের স্টেডি স্টেট থিওরিটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিল। তাঁরা মহাবিশ্বের সমর্থক বনে গেলেন।

তাতে বিগ ব্যাং মডেলের সমর্থকেরাও দমলেন না। দুই পক্ষই তুমুল তর্কবিতর্কে যোগ দিল। এটা কসমোলজির দ্বিতীয় মহাবিতর্ক নামে পরিচিত। এর এক পক্ষে হয়েল, গোল্ড ও বন্ডি; অন্যদিকে গ্যামো, আলফার ও হারমান। সেটা আরেক গল্প।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: Marcus Chown, Afterglow of Creation, Faber & Faber, UK (2010)

Paul Halpern, Flashes of Creation: George Gamow, Fred Hoyle, and the Great Big Bang Debate, Basic Books (2021)

Simon Mitton, Fred Hoyle : A Life in Science, University of Cambridge, 2011

Simon Singh, Big Bang: The Origin of the Universe, HarperCollins Publishers, London, 2005

মিচিও কাকু, ভাষান্তর: আবুল বাসার, প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস, প্রথমা প্রকাশন

আবুল বাসার, মহাজাগতিক প্রথম আলো, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০২২

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত