কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, মহাবিশ্বের সব কিছু গঠনের মূলে আছে কোয়ান্টাম ফিল্ড। এটা কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির একটি মৌলিক ধারণা। এতে বলা হয়, পদার্থের অণু-পরমাণু, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপপারমাণবিক মৌলিক কণা—সবই কোয়ান্টাম ফিল্ডের অবদান। এমনকি আমরা নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির মাঝে যে ফাঁকা মহাশূন্য দেখি, সেখানে প্রতিটা বিন্দুতেও রয়েছে এর অস্তিত্ব।
প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট নিয়মে কাঁপছে কোয়ান্টাম ফিল্ড। সেই কম্পনের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তিত হচ্ছে স্থান-কালের চাদর। কম্পনে ব্যাঘাত ঘটলে নতুন কণার জন্ম হয়। অনেকটা তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটলে যেমন ফোটন নির্গত হয়, সেরকম।
কম্পমান এই কোয়ান্টাম ফিল্ডের কম্পন বা ফ্ল্যাকচুয়েশনের কারণে তৈরি হয় ‘শূন্যস্থানের শক্তি’ বা ‘ভ্যাকুয়াম এনার্জি’। যত দূর চোখ যায়, মহাবিশ্বের সবখানেই এই শক্তি ছড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি কোনোভাবে ভ্যাকুয়াম এনার্জি সংগ্রহ করে কাজে লাগাতে পারি?
কোয়ান্টাম ফিল্ডের মতো ভ্যাকুয়াম এনার্জিও কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির একটি মৌলিক ধারণা। এটা জিরো পয়েন্ট এনার্জির সঙ্গে সম্পর্কিত। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী, একটি সিস্টেমে সর্বনিম্ন এনার্জি কত হতে পারে, সেই পরিমাণকে জিরো পয়েন্ট এনার্জি বলে। ১৯১৩ সালে সর্বপ্রথম জিরো পয়েন্ট এনার্জির ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন আলবার্ট আইনস্টাইন ও জার্মান-মার্কিন পদার্থবিদ অটো স্টার্ন। তাঁরা বলেন, একদম নিখুঁত ভ্যাকুয়ামের মধ্যেও কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের কম্পনের কারণে কিছু এনার্জি থাকে। এটা ওই সিস্টেমের সর্বনিম্ন শক্তি বা জিরো পয়েন্ট এনার্জি।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ১৯১৬ সালে ভ্যাকুয়াম এনার্জির ধারণা দেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ালথার এইচ নার্নস্ট। তবে এর পূর্ণতা আসে ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক ক্যাসিমির এবং ড্রিক পোল্ডারের হাত ধরে, ১৯৪৮ সালে। তাত্ত্বিক পরীক্ষণের মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করেন দুই বিজ্ঞানী। আর কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিকস (QED) তত্ত্বের মাধ্যমে ভ্যাকুয়াম এনার্জির ব্যাখ্যা দেন ব্রিটিশ গণিতবিদ পল ডিরাক।
গণিতের কিছু কৌশল আছে। খটোমটো নাম—যেমন রেগুলাইজেশন বা রি-নরমালাইজেশন প্রক্রিয়া। এগুলো ব্যবহার করে দুটি অসীম সংখ্যার মধ্যে বিয়োগ করা যায়।
ভ্যাকুয়াম এনার্জির প্রাবল্য হিসেব করা যায় খুব সহজেই। আগে যেমন বলেছি, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি অনুযায়ী, প্রতিটি কোয়ান্টাম ফিল্ডে সব সময় কিছু না কিছু কম্পন বা ফ্লাকচুয়েশন থাকে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি তত্ত্বের নাম অনিশ্চয়তা নীতি। এই নীতি বলে, কোনো কণার অবস্থান এবং গতি (আসলে বলা উচিৎ, ভরবেগ) একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ফলে, শূন্য শক্তি অবস্থায়ও কিছু না কিছু কম্পন থাকে। কথাটা এভাবেও বলা যেতে পারে, কোনো কণা একদম স্থির হয়ে যেতে পারে না—কারণ, সে ক্ষেত্রে তার অবস্থান ও ভরবেগ, দুটোই নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা যাওয়ার কথা। প্রকৃতি এটা হতে দেয় না।
যাহোক, বিচ্ছিন্নভাবে কোয়ান্টাম ফিল্ড কতটা কাঁপছে, তা জানার জন্য যখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করা হয়, তখন ফলাফল আসে অসীম। অর্থাৎ, গণিত বলে, অসীম পরিমাণ শক্তি দিয়ে ভরে আছে স্থান-কালের প্রতিটি বিন্দু। এই ক্ষেত্রগুলোতে কী পরিমাণ কম্পন থাকতে পারে, তার কোনো সীমা নেই। ছোট ছোট কম্পন, মাঝারি কম্পন এবং বড় কম্পন—সব একই সঙ্গে প্রতিটি কোয়ান্টাম ফিল্ডে ঘটছে। ফলে এখানকার শক্তিরও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
এখানে একটা প্রশ্ন আবার সামনে আসে। অসীম শক্তি সমৃদ্ধ এসব ফিল্ডে কণা তৈরির জন্য অতিরিক্ত শক্তি থাকে কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমরা ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক ক্যাসিমিরের কাছে যাব। তাঁর উদ্ভাবিত একটি বুদ্ধিদীপ্ত পরীক্ষণের মাধ্যমে উত্তর খুঁজব এর।
যদি দুটি ধাতব পাতকে একসঙ্গে খুব শক্ত করে জোড়া লাগিয়ে ধরে রাখেন, তাহলে এদের মধ্যকার কোয়ান্টাম ফিল্ড একই বৈশিষ্ট্য দেখায়। এসব কোয়ান্টাম ফিল্ডের যে কম্পন হয়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাত দুটির মধ্যে নিখুঁতভাবে খাপ খেতে হবে। ঠিক যেমন গিটারের তারের দৈর্ঘ্য বরাবর এর কম্পনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য খাপ খায়। এখানে একটু বলে দিই, প্রতিটি তরঙ্গ বা ঢেউয়ের চূড়া যেমন থাকে, তেমনি খাদও থাকে। একটা চূড়া থেকে আরেকটা চূড়ার দূরত্ব হলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য। আর কোয়ান্টাম ফিল্ডে প্রতিটি কম্পনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট।
এখানে তাহলে কী ঘটছে? কোয়ান্টাম ঘটনার ক্ষেত্রে, পাত দুটির মধ্যে এখনও অসীম সংখ্যক কম্পন আছে। কিন্তু সেটা পাত দুটির বাইরের জগতে যে পরিমাণ অসীম কম্পন আছে, তার তুলনায় খুব বেশি নয়। মানে, অসীমের মধ্যেই কম-বেশি!
গণিতের কিছু কৌশল আছে। খটোমটো নাম—যেমন রিনরমালাইজেশন প্রক্রিয়া। এগুলো ব্যবহার করে দুটি অসীম সংখ্যার মধ্যে বিয়োগ করা যায়। কীভাবে করা যায়, সেটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। সহজ ও সমতুল্য একটা উদাহরণ দিই। যাঁরা ইন্টিগ্রেশন বা সমাকলন করেছেন, তাঁরা সহজেই বুঝবেন। অসীম সংখ্যক জিনিস যোগ করার বদলে এ ক্ষেত্রে একটা সীমা ধরে নেওয়া হয়। এভাবে অসীমকে সসীম সীমায় নিয়ে এসে হিসাব করা হয়। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে প্রায় একইভাবে রিনরমালাইজেশন প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে অসীম মানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অর্থাৎ সসীমের মধ্যে এনে হিসাব করা যায়। এবং এগুলো যে সঠিক, তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতও করা যায়। একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, ইলেকট্রনের ভর ও চার্জ। রিনরমালাইজেশন প্রক্রিয়ায় এদের সম্ভাব্য মান বের করা যায় খাতা-কলমে; অর্থাৎ তাত্ত্বিকভাবে। আবার আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যায়, খাতা-কলমে বের করা মানের সঙ্গে ঠিক মিলে গেছে। এভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, এসব কৌশল কাজ করে। আর, যা বলছিলাম, এভাবে দুটি অসীম সংখ্যার বিয়োগফল হিসেবে একটি সসীম সংখ্যা পাওয়া যায়।
এর মানে, পাত দুটির ভেতরের চেয়ে বাইরের জগতে কম্পনের পরিমাণ বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, বাইরের কোয়ান্টাম ফিল্ড পাত দুটিকে চাপ দেয় একসঙ্গে থাকার জন্য। একেই বলা হয় ক্যাসিমির ইফেক্ট। আমরা এই প্রভাব পরিমাপ করতে পারি এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড যে আসলেই বাস্তব, তা নিশ্চিত করতে পারি।
৯০-এর দশকের শেষের দিকে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি আরও, আরও বাড়ছে। মানে, ত্বরান্বিত হচ্ছে।
এসব তত্ত্ব ও পরীক্ষণ একটি চমৎকার পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিটি উপাদান, মিথস্ক্রিয়া, প্রতিটি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া একটা সময় অসীম পরিমাণে এই ভ্যাকুয়াম এনার্জিতে রূপান্তরিত হয়। শুনতে যত অদ্ভুতই লাগুক না কেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে কয়েক দশকের গবেষণা এটাই বলে।
দুঃখের বিষয় হলো, এই মুহূর্তে ভ্যাকুয়াম এনার্জি সংগ্রহ বা সেটা কাজে লাগানোর মতো কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। কারণটা খুব সহজ। এটা মহাবিশ্বের সর্বনিম্ন শক্তিব্যবস্থা। অর্থাৎ, এখান থেকে শক্তি সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করতে হলে আপনাকে আরও নিম্ন শক্তিব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এটা কার্যত অসম্ভব। অনেকটা লিফটে করে ভবনের সর্বনিম্ন স্তর থেকে যেমন আর নিচে নামার উপায় থাকে না, সেরকম।
ক্যাসিমির ইফেক্টের ক্ষেত্রে, আমাদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে পাত দুটো একত্রিত করতে হয়। যখন পাতগুলো এদের মধ্যকার অসীম ভ্যাকুয়াম এনার্জির কারণে আলাদা হয়, তখন আমরা কেবল আমাদের দেওয়া শক্তিটুকুই ফেরত পাচ্ছি। বাড়তি কোনো শক্তি সেখান থেকে আসছে না।
কল্পবিজ্ঞানের মহাবিশ্বে অনেকসময় দেখা যায়, ভ্যাকুয়াম এনার্জি ব্যবহার করে বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে মহাকাশযানের গতি। বাস্তবে এটা কিন্তু আমাদের বর্তমান পদার্থবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। বিজ্ঞানীরা সব সময়ই স্বীকার করেন, আমরা এখনও মহাবিশ্বের সব কিছু বুঝতে পারি না। বিশেষ করে ভ্যাকুয়াম এনার্জির বিষয়টা একধরনের হেঁয়ালি তৈরি করে রেখেছে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই হেঁয়ালির উৎপত্তি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপপারমাণবিক অঞ্চলে নয়। বরং মহাজাগতিক বৃহত্তর জগতের সঙ্গে এটা বেশি সম্পর্কিত।
৯০-এর দশকের শেষের দিকে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি আরও, আরও বাড়ছে। মানে, ত্বরান্বিত হচ্ছে। এই ত্বরান্বিত প্রসারণের একটি ব্যাখ্যা হলো ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮-৭০ শতাংশই হলো এই ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। মানে, অজানা শক্তি। তবে এই অজানা শক্তির ব্যাপারে কিছুই জানি না আমরা।
তবে আমাদের জানা ব্যাখ্যাও কারিকুরি করতে পারে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের পেছনে। সেই জানা ব্যাখ্যাটা কী? আসলে, সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যাই হলো ভ্যাকুয়াম এনার্জি। আমরা সম্প্রসারণের হার পরিমাপ করতে পারি। সেখান থেকে ভ্যাকুয়াম এনার্জির মোট পরিমাণও অনুমান করা যায়। গাণিতিক হিসেব বলছে, শূন্য মহাকাশে এই শক্তির পরিমাণ প্রতি ঘন মিটারে প্রায় ৬×১০-১০ জুল!
আমরা যদি ভ্যাকুয়াম এনার্জি কাজে লাগাতে চাই, সে ক্ষেত্রে প্রথমে বুঝতে হবে জিনিসটা আসলে কী। আর সে জন্য আমাদের প্রয়োজন নতুন ধরনের পদার্থবিজ্ঞান।
অসীম তো নয়ই, সংখ্যাটা বরং অবিশ্বাস্য রকম ছোট। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহার করে আমরা যখন উপপারমাণবিক পর্যায়ে এটা হিসেব করেছিলাম, তখন সংখ্যাটা অসীম হয়েছিল। তাহলে কেন এই বৈপরীত্যে? কেন আমাদের মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ কোয়ান্টাম পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হতে পারছে না? অথচ আমাদের জ্ঞানের পরিধি বলছে, দুটোই সত্য। কী হচ্ছে আসলে?
এর উত্তরে বলতে হয়, আমাদের কোনো ধারণা নেই। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এটা সবচেয়ে বড় অমিমাংসিত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি।
আমরা যদি ভ্যাকুয়াম এনার্জি কাজে লাগাতে চাই, সে ক্ষেত্রে প্রথমে বুঝতে হবে জিনিসটা আসলে কী। আর সে জন্য আমাদের প্রয়োজন নতুন ধরনের পদার্থবিজ্ঞান। যেখানে মিলেমিশে একাকার হবে কোয়ান্টাম মেকানিকস ও আপেক্ষিকতার বেড়াজাল। মহাবিশ্বের বিশাল জগৎ আর অতিক্ষুদ্র পরমাণুর জগতের হিসেব করা যাবে একই সূত্র দিয়ে। বিজ্ঞানীরা এমন এক সূত্রের সন্ধান করছেন বহুদিন ধরে। থিওরি অব এভরিং নামে সেই সোনার হরিণ কবে নাগাদ মানুষের আয়ত্ত্বে আসবে তা আমাদের জানা নেই। তবে সেই সূত্র ধরে একদিন মহাবিশ্বের এ রকম আরও অনেক রহস্যের ধূম্রজাল ছিন্ন হবে, এমন আশা করাই যায়।