নিউক্লিয়ার বলের কাহন (পর্ব ২)

প্রোটন আবিষ্কারের পর ঝামেলা যেন আরও বেড়ে গেল। পরমাণুর ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা সমান হওয়ার কথা। কিন্তু সংখ্যা তো মিলছে না! তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আরশাদ মোমেনের সঙ্গে চলুন, পরমাণুর গহিনের এ সমস্যার সমাধানের কথা জেনে আসি...

প্রোটন আবিষ্কারের পর নিউক্লিয়াসের সমস্যার সমাধান তো হলোই না; বরং তাত্ত্বিক ঝামেলা আরও বেড়ে গেল। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করা যাক। আমরা আগেই টের পেয়েছি যে ইলেকট্রনের ভর অনেক কম। তাই পরমাণুর ভর মূলত তার নিউক্লিয়াস থেকেই আসে। কেমিস্টদের করা ঊনবিংশ শতাব্দীর গবেষণার কল্যাণে আমরা পরমাণুর ভর বেশ ভালোভাবেই নির্ণয় করতে জানি। তাহলে কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কতগুলো প্রোটন আছে, তা আমরা বের করতে পারব।

যেমন কার্বন পরমাণুর ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের প্রায় ১২ গুণ। তাহলে নিউক্লিয়াস শুধু প্রোটন দিয়ে তৈরি, এ ধারণার বশবর্তী হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব যে কার্বনের নিউক্লিয়াসে ১২টি প্রোটন আছে। কিন্তু এতে যে নতুন সমস্যা তৈরি হলো, সেটা হলো নিউক্লিয়াসের চার্জ হয়ে দাঁড়ায় প্রোটনের ১২ গুণ, যেটা হওয়ার কথা ৬ গুণ। কারণ, কার্বনে ছয়টি ইলেকট্রন আছে, তাই তার নিউক্লিয়াসকেও সমান কিন্তু বিপরীতধর্মী চার্জ বহন করতে হবে। এ সমস্যার একটা সমাধান রাদারফোর্ডরা প্রস্তাব করলেন, নিউক্লিয়াসে প্রোটনের পাশাপাশি সমানসংখ্যক ইলেকট্রনও রয়েছে, যাতে প্রথমত, অতিরিক্ত চার্জগুলোকে প্রশমিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রনের সঙ্গে প্রোটনের আকর্ষণী বল প্রোটনগুলোর মধ্যের বিকর্ষণী বলের বিপরীত কাজ করবে।

আরও পড়ুন
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রারম্ভে ডি ব্রগলি প্রতিটি মৌলিক কণার সঙ্গে একটি তরঙ্গ সম্পৃক্ততার কথা বলেছিলেন। এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান সেই কণার ভরবেগের বিপরীতের আনুপাতিক।
নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড

কিন্তু এখানেই সব সমস্যার সমাধান হলো না; বরং ঝামেলাটা অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হলো। বিজ্ঞানীরা একই মৌলের যে বিভিন্ন আইসোটোপ আছে এবং তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিউক্লিয়াস আছে, সেই ধারণার সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিচিত ছিলেন। আইসোটোপগুলোর ভর ভিন্ন কিন্তু মৌল হিসেবে সেগুলো একই! ফলাফলে এই মডেলে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যার এই ভিন্নতা পদার্থবিজ্ঞানে একটা হযবরল অবস্থা তৈরি করল। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটনের পাশাপাশি নিউট্রন নামের নতুন একটি ‘মৌলিক’ কণার ধারণা দিলেন, যার ভর প্রোটনের প্রায় সমান, কিন্তু তা চার্জবিহীন। এই ধারণা আরেকটু প্রতিষ্ঠা পেল, যখন পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকল। এই বলবিদ্যার আলোকে নিউক্লিয়াসে ইলেকট্রনের আবদ্ধ থাকার কোনো অবকাশই রইল না।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রারম্ভে ডি ব্রগলি প্রতিটি মৌলিক কণার সঙ্গে একটি তরঙ্গ সম্পৃক্ততার কথা বলেছিলেন। এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান সেই কণার ভরবেগের বিপরীতের আনুপাতিক। তাহলে ইলেকট্রনের মতো হালকা কণার ভরবেগ কম আর তার ফলাফলে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মানও অনেক বেশি। এ কারণে ইলেকট্রন, যার ভর কিনা প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের তুলনায় প্রায় দুই হাজার গুণ কম, সেটা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের দুই হাজার গুণ ব্যাসার্ধ নিয়ে ছড়িয়ে থাকবে। সেটা আর তখন নিউক্লিয়াসে আবদ্ধ থাকবে না।

আরও পড়ুন
কোনো সন্দেহ রইল না যে এই বলের মানকে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের তুলনায় অনেক গুণ বেশি হতে হবে। কিন্তু এই রকম বলের উপস্থিতির সপক্ষে প্রমাণ কী?

এ ক্ষেত্রে নিউক্লীয় ভরের ও চার্জের ধাঁধা সমাধান করার জন্য নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন নামের চার্জবিহীন একটি নতুন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল। যা–ই হোক, এই কণার উপস্থিতি জেমস চ্যাডউইক বুদ্ধিদীপ্ত একটি পরীক্ষা ডিজাইন করে প্রমাণ করলেন। এ কাজের জন্য নোবেল পুরস্কারও জিতলেন।

এখন নিউক্লিয়াসের মধ্যে ইলেকট্রনের উপস্থিতি খারিজ হয়ে যাওয়াতে নিউক্লিয়াসে প্রোটনগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে রাখার জন্য আকর্ষণী নিউক্লীয় বলের ধারণা অবতারণা করতে হলো। এখানে কোনো সন্দেহ রইল না যে এই বলের মানকে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের তুলনায় অনেক গুণ বেশি হতে হবে। কিন্তু এই রকম বলের উপস্থিতির সপক্ষে প্রমাণ কী? এটা বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ফোটনকণা কীভাবে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের উদ্ভব ঘটায়।

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত