ট্রান্সইউরেনিয়াম দেয়াল ভাঙ্গার গল্প - শেষ পর্ব

এনরিকো ফার্মির নামে মহাবিশ্বের সব বস্তুকণার নাম রাখা হয়েছে ফার্মিওন। এককালে মুসোলিনির ইতালিতে তিনি বিখ্যাত ছিলেন ‘দ্য পোপ’ বা ‘পোপ অব ফিজিকস’ নামে। তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে ভুলভাবে নোবেল পেয়ে গেলেন তিনি… তবে কি ভাঙবে না ট্রান্সইউরেনিয়াম-বাধা? যে বাধা স্বয়ং পোপ অব ফিজিকস ভাঙতে পারেননি, তা নিয়েই গবেষণা করছেন এক তরুণ বিজ্ঞানী, এডউইন ম্যাকমিলান… বিজ্ঞানের ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এক আখ্যান…

৩১ জানুয়ারি, ১৯৩৯। ঘড়ির কাঁটা দুপুরের ঘরে পৌঁছাতে তখনো বেশ খানিকটা সময় বাকি। এমন সময়ে সাতাশ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক লুইস আলভারেজকে যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ক্যাম্পাসের উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে আয়েশী ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে দেখা গেল। গন্তব্য, চুল কাটার সেলুন। সেখানে পৌঁছে বেশ আয়োজন করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। নাপিতের কারিশমা শুরু হতেই হাতে তুলে নিলেন সামনে রাখা সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল পত্রিকার সেদিনের সংখ্যা। হঠাৎ একটি বিশেষ আর্টিকেলে চোখ আটকে গেল তাঁর—ফিশন আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছে।

খুঁটিয়ে পড়া শেষে লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আলভারেজ। এক সেকেন্ডও দেরি না করে চুল কাটা অসমাপ্ত রেখেই ছুটলেন বার্কলির বিখ্যাত রেডিয়েশন ল্যাবরেটরির দিকে।

রেডিয়েশন ল্যাবের অবস্থান ক্যাম্পাসের একদম প্রাণকেন্দ্রে। এটি ছিল সে কালের বিশ্বে সর্বাধুনিক পরীক্ষাগারগুলোর অন্যতম। পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটরের মতো অত্যাধুনিক যন্ত্রের উপস্থিতি যেন তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দরজা ঠেলে ল্যাবে ঢুকেই সোজা চলে গেলেন সহকারী ফিল অ্যাবেলসনের কাছে। প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘ফিশন! পরমাণুরাও ভেঙ্গে যেতে পারে!’

মুহূর্তে জমে গেলেন অ্যাবেলসন। কারণ, তিনি নিজেও তখন ইউরেনিয়াম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। জার্মান বিজ্ঞানী অটো হানের মতো ঠিক একই রকম অদ্ভুত ফলাফল তাঁর চোখেও পড়েছিল। হয়তো আরেকটু সময় ও ভাগ্যের সহায়তা পেলে নিজেই সমাধান করে ফেলতেন এই রহস্যের। এখন অবশ্য এসব ভেবে আর লাভ নেই।

অ্যাবেলসনকে শুধু নিউক্লিয়ার ফিশনের কথা জানিয়েই ক্ষান্ত হলেন না আলভারেজ। একে একে প্রায় সবার কাছে তিনি পৌঁছে দিলেন অসামান্য এ আবিষ্কারের খবর। এমনকি ল্যাবের যন্ত্রপাতি থেকে উৎপন্ন ফিশন শক্তির ‘ধাক্কার’ নমুনাও অনেককে ডেকে এনে সরেজমিনে দেখালেন তিনি। এই তালিকায় ছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নেতা রবার্ট ওপেনহাইমারও! আসলে অনেক দিন থেকেই ল্যাবের যন্ত্রপাতি থেকে অদ্ভুত নয়েজ শনাক্ত করছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তাঁরা এসব মোটেও পাত্তা দেননি। যদি দিতেন, তাহলে হয়তো এনরিকো ফার্মির মতো কপাল চাপড়াতে হতো না তাঁদেরও।

১৯৩০-এর দশকে এই লরেন্সের নেতৃত্বেই বার্কলিতে তৈরি করা হয় তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গবেষণা যন্ত্র, কম্প্যাক্ট পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর—সাইক্লোট্রন।

২.

ফিশন আবিষ্কার হাতছাড়া হলেও রেডিয়েশন ল্যাবরেটরির সফলতা কিন্তু ঈর্ষণীয়। এনরিকো ফার্মির প্যানিস্পারনা বয়েজের মতো এখানকার বিজ্ঞানীদের টাকা-পয়সার উৎস নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে হতো না। সরকার ছাড়াও বড় বড় ধনকুবেররা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সবখানেই ছিল অত্যাধুনিক যন্ত্রের ছড়াছড়ি। তবে এসব সুযোগ-সুবিধা নয়, রেডিয়েশন ল্যাবের সফলতার মূলে ছিল লক্ষ্য অর্জনে সমন্বিত কর্মপদ্ধতির প্রয়োগ। এখানকার বিজ্ঞানীরা আলাদাভাবে কোনো সমস্যা নিয়ে কাজ করতেন না। বরং সবাই মিলে একসঙ্গে একটি বিষয়ের নানা দিক ভাগ করে নিয়ে গবেষণা করতেন। কোনো বিশেষ সমস্যা সমাধানে নিজ দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তাঁরা রাত-দিন এক করে কাজে লেগে থাকতেন। এই ব্যতিক্রমী ধারণাটি নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিদ আর্নেস্ট লরেন্সের মস্তিস্কপ্রসূত। তাঁর দেখানো পথেই আধুনিক গবেষণার বাতিঘর হয়ে ওঠে রেডিয়েশন ল্যাবরেটরি।

১৯৩০-এর দশকে এই লরেন্সের নেতৃত্বেই বার্কলিতে তৈরি করা হয় তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গবেষণা যন্ত্র, কম্প্যাক্ট পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর—সাইক্লোট্রন। এতে ব্যবহৃত একটি ফিল্টার থেকেই টেকনিশিয়ামের (মৌলিক পদার্থ ৪৩) খোঁজ পেয়েছিলেন এমিলিও সেগ্রা। নতুন মৌল আবিষ্কারে এই দানবাকৃতি যন্ত্রটির কারিশমা অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এ যন্ত্র ব্যবহার করেই অবশেষে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল প্রথম ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল। আর সেই আবিষ্কারের মূল কারিগর ছিলেন মার্কিন রসায়নবিদ এডউইন ম্যাকমিলান।

আর্নেস্ট লরেন্সের ডিজাইন করা বার্কলির ৬০ ইঞ্চি সাইক্লোট্রন
ছবি: সংগৃহীত

সাইক্লোট্রনের অন্যতম সেরা অপারেটরদের একজন, এডউইন ম্যাকমিলানের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়াতেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি করার পর একরকম নাড়ির টানেই ফিরে এসেছিলেন নিজ অঙ্গরাজ্যে, যোগ দিয়েছিলেন বার্কলির রেডিয়েশন ল্যাবে। ক্ষুরধার মস্তিস্কের সঙ্গে হার না মানা মানসিকতার জন্য অন্য সবার চেয়ে তিনি ছিলেন আলাদা।

ইহুদি বিদ্বেষের দরুন ইতালি থেকে পালিয়ে আসা এই বৈজ্ঞানিক ততদিনে ক্যালিফোর্নিয়ার জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন।

ফিশন আবিষ্কারের খবর শোনার পর ম্যাকমিলান নতুন উদ্যোগে ইউরেনিয়াম নিয়ে গবেষণায় মনোযোগী হন। সাইক্লোট্রন ব্যবহার করে প্রাপ্ত নিউট্রন দিয়ে আঘাত করতে শুরু করেন ইউরেনিয়ামকে। একসময় অদ্ভুত এক ঘটনা তাঁর নজরে আসে। টার্গেট ইউরেনিয়ামের ঠিক পাশেই সম্পূর্ণ অজানা কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পান তিনি। নিশ্চিতভাবেই এটি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের ভাঙা অংশ বা ‘ফিশন ফ্র্যাগমেন্ট’ হতে পারে না। কারণ, এমনটা হলে একে খুঁজে পাওয়া যেত মূল টার্গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে। অজানা বস্তুটির অর্ধায়ু হিসাব করলেন ম্যাকমিলান। মান পাওয়া গেল ২.৩ দিন। ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত অন্য কিছুর সঙ্গে মেলে না এই মান। তাহলে কি এবার সত্যি সত্যি খোঁজ মিলল মৌলিক পদার্থ ৯৩-এর?

বিষয়টি তলিয়ে দেখার জন্য এমিলিও সেগ্রার সাহায্য চাইলেন ম্যাকমিলান। ইহুদি বিদ্বেষের দরুন ইতালি থেকে পালিয়ে আসা এই বৈজ্ঞানিক ততদিনে ক্যালিফোর্নিয়ার জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। সহকর্মীকে সাহায্য করতে সম্মতি জানালেন তিনি। কিন্তু এই কাজের জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিলেন না সেগ্রা। পর্যায় সারণি অনুসারে, মৌলিক পদার্থ ৯৩-এর আচরণ করা উচিত গ্রুপ ৭-এর মৌলদের মতো। কিন্তু অজানা নমুনাটির আচরণ ছিল ল্যান্থেনাইড বা রেয়ার আর্থ মেটাল, মানে দুর্লভ মৃত্তিকা ধাতুদের মতন। এ কারণে সেগ্রা শুরুতেই এর ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন, কষ্ট করে খুব বেশি পরীক্ষানিরিক্ষা না করেই। ম্যাকমিলানকে বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার পরামর্শ দেন তিনি। এমনকি পুরো বিষয়টি নিয়ে ‘আনসাকসেসফুল সার্চ ফর ট্রান্সইউরেনিক এলিমেন্টস’ শিরোনামে একটি পেপারও পাবলিশ করে ফেলেন।

এমিলিও সেগ্রা
ছবি: সংগৃহীত
নতুন মৌল আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হলো ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। এর প্রতিক্রিয়া ছিল অভাবনীয়।

সেগ্রার উপসংহারে কেন যেন আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না এডউইন ম্যাকমিলান। কেন অজানা নমুনাটি অন্যান্য গতানুগতিক ফিশন ফ্র্যাগমেন্টসের মতো ছিটকে দূরে সরে গেল না? আবার, এটি যদি নতুন মৌল না হয়ে ইউরেনিয়ামের কোনো অপরিচিত আইসোটোপ হয়েই থাকে, তাহলে এর আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন কেন? প্রশ্নগুলো ম্যাকমিলানের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাই তিনি নিজেই আবার গবেষণার টেবিলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অজানা নমুনাটি নিয়ে শুরু করলেন নানারকম রাসায়নিক পরীক্ষা। ধরে ধরে একে মিলিয়ে দেখলেন আবিষ্কৃত সবগুলো দুর্লভ মৃত্তিকা মৌলের সঙ্গে। কিন্তু মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। অর্থাৎ, নমুনাটির সম্পূর্ণ নতুন মৌলিক পদার্থ হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়ে গেল।

এর মধ্যেই, ১৯৪০ সালের মে মাসে আবারও বার্কলিতে ফিরে আসেন ফিল অ্যাবেলসন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পরে মাঝখানে কিছুদিনের জন্য ওয়াশিংটন চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেখা হতেই অজানা নমুনাটি নিয়ে তাঁর মতামত, ইংরেজিত যাকে বলে ‘সেকেন্ড অপিনিয়ন’, চাইলেন ম্যাকমিলান। সেগ্রার মতো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্তে আসেননি অ্যাবেলসন। টানা দুই দিন নমুনাটি নিয়ে হরেক রকম রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। তারপর সিদ্ধান্তে এলেন, এটাই সেই পরম কাঙ্ক্ষিত মৌলিক পদার্থ ৯৩।

ফিল অ্যাবেলসন
ছবি: সংগৃহীত

এভাবে ম্যাকমিলান ও অ্যাবেলসনের হাত ধরে সত্যিকার অর্থে ভেঙে গেল পর্যায় সারণির ইউরেনিয়াম-বাধা। খোঁজ মিলল প্রথম ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল নেপচুনিয়ামের।

নতুন মৌল আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হলো ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। এর প্রতিক্রিয়া ছিল অভাবনীয়। প্রিয় পাঠক, ভাবছেন হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল চারদিকে? ফার্মির মতো রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন ম্যাকমিলান ও অ্যাবেলসন? না, এসবের কিছুই হয়নি। কারণ, সেই সময়ে পৃথিবীবাসী প্রতিনিয়ত অবলোকন করছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। ইউরোপের ক্ষুরধার মস্তিস্কগুলো মত্ত ছিল পরস্পরকে ধ্বংস করার সর্বনাশা খেলায়। এসবের মধ্যে নতুন মৌল নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? এমনকি ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল আবিষ্কার করে প্রশংসার পরিবর্তে যেন খানিকটা ভর্ৎসনাই কপালে জুটল দুই বিজ্ঞানীর। বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক তো তাঁদেরকে পাঠানো এক চিঠিতে লিখলেন, ‘নাৎসিরা ব্যবহার করতে পারে, এমন জিনিসপত্র নিয়ে কি কথা বলা দয়া করে বন্ধ করবেন?’

এরপরে আসলে আর কথা চলে না। আপাতত চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নেন দুই বিজ্ঞানী। তবে গবেষণা থেমে থাকেনি। এর পথ ধরেই পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল। বিজ্ঞান এগিয়ে চলে এভাবেই, শত বাধার মধ্যেও।

লেখক: সহকারি ব্যবস্থাপক, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড

সূত্র: সুপারহেভি: মেকিং অ্যান্ড ব্রেকিং দ্য পিরিওডিক টেবিল, কিট চ্যাপম্যান