মেঘনাদ সাহা: ভুলে যাওয়া এক তারার নাম

আজ ৬ অক্টোবর বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জন্মদিন। জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। অথচ মানুষটি আজ অনেকটাই বিস্মৃত। ভুলে যাওয়া সেই তারার কথা পড়ুন তাঁর জন্মদিনে। জেনে নিন বাঙালি এই বিজ্ঞানীর অবদানের কথা...

মেঘনাদ সাহাঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

কথায় বলে, মানুষ পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি সত্য। বিজ্ঞানও প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, বিজ্ঞান বর্ণনামূলক ক্ষেত্র থেকে ক্রমেই আরও নিখুঁত ও ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তত্ত্বের দিকে এগিয়ে যায়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। যেমন নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের কথাই ধরা যাক। বিজ্ঞানের জগৎ প্রায় তিন শতক বহাল তবিয়তে রাজত্ব করার পর একসময় দেখা গেল, তাতে কিছু ফাঁক আছে। প্রাকৃতিক কিছু ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারছে না তত্ত্বটা। কিছু ভবিষ্যদ্বাণী মিলছে না পর্যবেক্ষণের সঙ্গে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে সেই সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসেই আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার করেন আইনস্টাইন। এ তত্ত্বের কারণে আমাদের বিজ্ঞানের জগৎ এখন বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। প্রাকৃতিক ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণীতে যুক্ত হয়েছে নিত্য-নতুন অনেক কিছু। পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সেগুলো মিলেছে খাপে খাপে। তেমনই কিছু ব্যাপার হলো, কৃষ্ণগহ্বর, মহাকর্ষ তরঙ্গ, মহাবিস্ফোরণ।

তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসের এই কালান্তারে কিছু বিজ্ঞানী অগ্রদূত হলেও তাঁদের কথা সবাই মনে রাখেনি। সঠিক মর্যাদাও পাননি তাঁরা। তাঁদের কাজের যথাযোগ্য মূল্যায়নও হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে। এরকম বিজ্ঞানীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তেমনি একজন আমাদের বাংলাদেশের বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণা এককালে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের নতুন পথ দেখিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমের অনেকের কাছে আক্ষরিক অর্থেই অচেনা মানুষ তিনি।

কিন্তু তাদের গ্রামে কোনো হাইস্কুল ছিল না। বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে শিমুলিয়ার একটা স্কুলে ভর্তি হন মেঘনাদ সাহা। বর্ষায় তাঁদের প্রত্যন্ত গ্রামটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। তখন একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম ছিল নৌকা। তাতে চড়ে শিমুলিয়ায় ক্লাস করতে আসতেন মেঘনাদ

মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে। বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন মুদিদোকানী। তাঁর আয়েই সংসার চলত। শুরুতে প্রথম সন্তান জয়নাথ সাহাকে পড়ালেখার জন্য স্কুলে ভর্তি করেন জগন্নাথ সাহা। ভেবেছিলেন, তাতে তাঁর ব্যবসার সুবিধা হবে। আর্থিক উন্নতির জন্য সুবিধাজনক হবে। কিন্তু ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হন জয়নাথ। কাজেই পড়ালেখাকে স্রেফ টাকা-পয়সা নষ্ট বলে সিদ্ধান্ত নেন বাবা জগন্নাথ। ছেলেক হাইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে দোকানের কাজে লাগিয়ে দেন। এ কারণে অন্য ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করার তেমন ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কিন্তু দোকানের কাজে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না মেঘনাদ সাহা।

মেঘনাদ সাহার মেধার পরিচয় পেয়েছিলেন গ্রামের এক স্থানীয় চিকিৎসক। তিনিই জগন্নাথ সাহাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেঘনাদকে স্কুলে ভর্তি করাতে রাজি করান। অচিরেই প্রাইমারি, মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করে নিজের মেধার প্রমাণ রাখেন মেঘনাদ। এরপর তাকে হাইস্কুলে ভর্তি করাতে রাজি হন বাবা জগন্নাথ। কিন্তু তাদের গ্রামে কোনো হাইস্কুল ছিল না। বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে শিমুলিয়ার একটা স্কুলে ভর্তি হন মেঘনাদ সাহা। বর্ষায় তাঁদের প্রত্যন্ত গ্রামটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। তখন একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম ছিল নৌকা। তাতে চড়ে শিমুলিয়ায় ক্লাস করতে আসতেন মেঘনাদ। এখান থেকেই সর্বশেষ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান দখল করেন। সঙ্গে বৃত্তিও পান। মাসিক ৪ টাকা।

এরপর ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। সেটা ১৯০৫ সালের কথা। ইংরেজদের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার কারণে গোটা বাংলা তখন উত্তাল। বাংলাজুড়ে তখন চলছে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী, তথা ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ। একদিন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় গভর্নর। সেদিন সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিক্ষোভ করেন মেঘনাদ সাহা। সেই অপরাধে কলেজিয়েট স্কুল থেকে তাঁকেসহ বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়। এবার ভর্তি হন কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে। সেখানে সুযোগ পান বিনাবেতনে পড়ার।  ১৯০৯ সালে সেখান থেকে পূর্ববাংলার সবগুলো স্কুলের মধ্যে প্রথম স্থান পেয়ে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মেঘনাদ সাহা। জ্যোতির্বিদ্যা ও রসায়নে সর্বোচ্চ নম্বরও পান। এই ফলাফলই নির্ধারণ করে দিয়েছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ।

১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। দুই পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় হন। আর প্রথম হন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তবে দুজনেই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু

এবার ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। মূল বিষয় হিসেবে বেছে নেন তাপগতিবদ্যা ও কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা। চতুর্থ বিষয় হিসেবে নেন জার্মান ভাষা। সেকালে জার্মানি বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক এগিয়ে ছিল। বেশ কিছু বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল প্রকাশিত হতো জার্মান ভাষায়। যেমন ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের সেরা গবেষণাপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছিল জার্মানির অ্যানালেন ডার ফিজিক-এ। সে কারণে জার্মান শিখতে আগ্রহী হন তিনি। পাশাপাশি এই বিষয়ে কোনো গবেষণাগারের প্রয়োজন ছিল না। কাজেই সহজে পাশ করা যাবে বলে ভেবেছিলেন তিনি। তবে পরে তাঁর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। জার্মান ভাষার অন্যদের চেয়ে কিছুটা কম নম্বর পাওয়ার কারণে আইএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান পান। এরপর ১৯১১ সালে গণিত অর্নাস নিয়ে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে শিক্ষক হিসেবে পেলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্বদের। ১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক এবং ১৯১৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। দুই পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় হন। আর প্রথম হন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তবে দুজনেই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

প্রায় বছরখানেক পর রাজারবাগ সায়েন্স কলেজ উদ্বোধন হয়। সেখানে গণিতের প্রভাষক হিসেব যোগ দেন মেঘনাদ ও সত্যেন। তবে দুজনেরই আগ্রহ ছিল পদার্থবিজ্ঞানে। তাই কিছুদিন পর দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছাত্রদের তিনি পড়াতেন তাপগতিবদ্যা।

বেশ কিছু দিন পরে সত্যেন বোসের সঙ্গে যৌথভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবিষয়ক কিছু লেখা জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তিনি। সেটাই একসময় বহির্বিশ্বে তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল। কারণ এর আগ পর্যন্ত আর কেউ এসব লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেনি। সেটাই ছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্ববিষয়ক লেখাগুলোর প্রথম অনুবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান-ব্রিটিশ রেষারেষির কারণে জার্মান বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো ভারতবর্ষে আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে জার্নালগুলো আবারও আসতে শুরু করে। এরকম একটা গবেষণাপত্রই তাঁর জীবন বদলে দেয়।

আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতিঃরসায়নের অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে মেঘনাদ সাহা নামের এক তরুণ বিপ্লবীর ঝুলি থেকে। আর তাঁর সেই আইডিয়ার নাম তাপীয় আয়নায়ন তত্ত্ব।
স্যাম কিয়াম, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক

ফিজিকালিস জেইটশিফট জার্নালের ডিসেম্বর সংখ্যায় সেই গবেষণাপত্রটা ছিল থার্মাল আয়োনাইজেশন বা তাপীয় আয়নায়ন সম্পর্কিত। লেখক জে. এগার্ট। পরমাণুকে উত্তপ্ত করা হলে তার ইলেকট্রনগুলো ছিটকে বাইরে চলে যায়। তখন পড়ে থাকে শুধু নিউক্লিয়াস। সহজ কথায় একেই বলা হয় তাপীয় আয়নায়ন। কিন্তু গবেষণাপত্রটা বেশ ভাসাভাসা বলে মনে হলো মেঘনাদ সাহার কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই গবেষণাটাকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। রসায়ন ও কোয়ান্টাম ফিজিকস সম্পর্কে নিজের জ্ঞান একত্রিত করে তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, ঠিক কোন তাপমাত্রার পরমাণু থেকে ইলেকট্রনগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তাঁর বেশ জানাশোনা ছিল। তিনি বুঝতে পারেন, নক্ষত্র সম্পর্কে দীর্ঘদিনের একটা অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে এই গবেষণা থেকে।

বর্ণালি হলো বারকোডের মতো একটা নকশা, যেখানে পাতলা ও কালো কিছু রেখা দেখা যায়।
বিজ্ঞানচিন্তা

এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘এগার্টের গবেষণাপত্র পড়ে আমার ধারণা হল, এগার্টের সূত্রে আয়নন বিভবের নিখুঁত মান বসিয়ে পরমাণুর একক বা বহুধা আয়নন যে কোন উষ্ণতা ও চাপে গণনা করা জরুরী। এ থেকে আমি আমার তাপীয় আয়নায়ন সূত্র আবিষ্কার করি, যা এখন আমার নামে পরিচিত। ক্রোমোস্ফিয়ার ও নক্ষত্রের সমস্যা আমার জানা ছিল। আমি সেই সূত্র তখন সেখানে প্রয়োগ করি।’

অনেকেই জানেন, প্রতিটি নক্ষত্র বর্ণালি তৈরি করে। নক্ষত্র থেকে আসা কোনো আলোকে একটা প্রিজমের মধ্য দিয়ে নেওয়া হলে বর্ণালি পাওয়া যায়। ইংরেজিতে একে বলা হয় স্পেকট্রাম। বর্ণালি হলো বারকোডের মতো একটা নকশা, যেখানে পাতলা ও কালো কিছু রেখা দেখা যায়। ১৮৫০ সালের দিকে একই ধরনের বর্ণালির ভিত্তিতে নক্ষত্রগুলোর শ্রেণিবিভাগ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। অনেকটা জীববিজ্ঞানে ক্যারোলাস লিনিয়াসের উদ্ভিদ বা প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাসের মতো। তবে নক্ষত্রের এই শ্রেণিবিভাগ দিয়ে কী বোঝায়, তা কেউই জানতেন না। এরকম বিভিন্ন শ্রেণির নক্ষত্র কেন থাকে? তার কোনো জবাব ছিল না বিজ্ঞানী বা জ্যোতির্বিদদের কাছে।

মেঘনাদ সাহা বুঝতে পারলেন, এই প্রশ্নের জবাবের সঙ্গে রসায়নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কম্পাংকের আলো শোষণ করে নক্ষত্রের বর্ণালির গাঢ় রেখাগুলো তৈরি করে। একসময় তিনি দেখতে পান, তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে আসার হারও বেড়ে যায়। তাতে ওই গাঢ় রেখাগুলোর অবস্থান ও সংখ্যার পরিবর্তন হয়। অন্য কথায়, নক্ষত্রের বিভিন্ন তাপমাত্রার কারণে বর্ণালির রেখার প্যাটার্নও আলাদা হবে। কাজেই জ্যোতির্বিদেরা যখন বর্ণালির ভিত্তিতে নক্ষত্রগুলোকে আলাদা গ্রুপে ভাগ করেন, তখন তাঁরা আসলে এগুলোকে ভাগ করেন তাপমাত্রার ভিত্তিতে। এই তাপীয় আয়নায়ন ব্যাখ্যার জন্য একটা সমীকরণও প্রণয়ন করেন মেঘনাদ সাহা। সেটা পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন জ্যোতির্বিদেরা। কারণ এই সমীকরণ ব্যবহার করে এ সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্য নির্ণয় করতে পারলেন তাঁরা। যেমন নক্ষত্রদের সঠিক তাপমাত্রা এবং তাদের ভেতরে কী কী মৌল আছে। এভাবে মেঘনাদ সাহার কারণেই মানবজাতি প্রথমবারের মতো জানতে পারল, নক্ষত্র আসলে কী দিয়ে গঠিত। দেখা গেল, নক্ষত্রের ভেতরটা আসলে হাইড্রোজেনের অগ্নিগোলা।

তবে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সে কালে ভারতে হাতে-কলমে জোতির্বিদ্যা গবেষণার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছিল না। কাজেই নিজের তত্ত্বটা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট নাক্ষত্রিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেননি মেঘনাদ সাহা। ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। যথাযথ স্বীকৃতিও পাননি তিনি। সে কারণে বিজ্ঞানের অন্য শাখায় মনোযোগ দেন। আরও পরে জড়িয়ে পড়েন ভারতের রাজনীতিতেও। তবে রাজনীতিতে এসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বিবাদে জড়ান। তাও বিজ্ঞান ইস্যুতে। বিজ্ঞানকে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন গান্ধী। অন্যদিকে বিজ্ঞানকে দারিদ্র দূর করার শক্তিশালী অস্ত্র মনে করতেন মেঘনাদ সাহা। এর মধ্যেই ১৯৫২ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে সদস্যও নির্বাচিত হন। এ সময় পরমাণু শক্তি থেকে শুরু করে ক্যালেন্ডার সংস্কারের মতো বেশ কিছু উদ্যোগ নেন তিনি। সে অন্য প্রসঙ্গ।

এত কিছু সত্ত্বেও জীবনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন জোতির্বিজ্ঞানে। তাপীয় আয়নায়ন বিষয়ে তাঁর এই তাত্ত্বিক অবদানের আগে জ্যোতির্বিদদের কাজটা ছিল অনেকটা ক্যাটালগ তৈরি করার মতো। পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড যাঁকে তুলনা করেছেন ডাকটিকিট সংগ্রহের সঙ্গে। কিন্তু মেঘনাদ সাহার অবদানের পর সেটা হয়ে উঠল বিশুদ্ধ ও ভবিষ্যদ্বাণী করার উপযোগী বিজ্ঞান। এ প্রসঙ্গে  বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন বলেছেন, ‘সাহার আয়নায়ন তত্ত্ব গ্যালিলিওর দুরবিন ব্যবহার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।’

জনৈক এক পণ্ডিত একবার বলেছিলেন, সমগ্র পশ্চিমা দর্শন প্লেটোর দর্শনের পাদটীকার চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়। সেই একই মাপকাঠিতে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক স্যাম কিয়াম বলেছেন, আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতিঃরসায়নের অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে মেঘনাদ সাহা নামের এক তরুণ বিপ্লবীর ঝুলি থেকে। আর তাঁর সেই আইডিয়ার নাম তাপীয় আয়নায়ন তত্ত্ব। 

সূত্র: সায়েন্স হিস্ট্রি ডট ওআরজি, উইকিপিডিয়া, মেঘনাদ সাহা: জীবন ও সাধনা/ সুর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র