শ্রোডিঙ্গারের মগজধোলাই

কোয়ান্টাম তত্ত্বের তরঙ্গবিদ্যার জনক এরউইন শ্রোডিঙ্গার অস্ট্রিয়া থেকে ডেনমার্কে বেড়াতে এসেছেন। কোয়ান্টাম ফিজিকসের অনিশ্চয়তা তত্ত্বের জনক ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ আগেভাগেই ওখানে এসে জুটেছেন। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন হলো বিজ্ঞানী নিলস বোরের আস্তানা। ওখানে তাঁর নামে ‘বোর ইনস্টিটিউট’ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সবাইকে বোর তাঁর নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। গল্পগুজব, পিং পং খেলা এবং খানাপিনার আমন্ত্রণ। কিন্তু বোরের আসল উদ্দেশ্য শ্রোডিঙ্গারের মগজধোলাই! কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রধান জনক শ্রোডিঙ্গারের মনে কোয়ান্টামবিরোধী ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। সন্দেহের শিকড়টাকে এখনই উপড়ে ফেলতে হবে। শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গতত্ত্ব বোরের হাইড্রোজেন-পরমাণু তত্ত্ব অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। তাতে বোরের একটুও দুঃখ নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অপদস্থ করার চেষ্টা বোর বরদাশত করতে রাজি নন। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল বলে এক কাল্পনিক পরীক্ষার প্যাঁচাল পেড়ে শ্রোডিঙ্গার কোয়ান্টাম তত্ত্বের বারোটা বাজাতে চাচ্ছেন। বোরের দেওয়া কোয়ান্টাম তত্ত্বের ‘কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা’ ভন্ডুল করার এক অভিনব চেষ্টা! আইনস্টাইন তো কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অসম্পূর্ণ ঘোষণা করে বসে আছেন। ঈশ্বর জুয়াড়ি নন, এই প্রকৃতি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঈশ্বর জুয়া খেলতে পারেন না—এই ধারণা থেকে আইনস্টাইনকে সরানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু সময়মতো যুক্তির দাওয়াই দিয়ে হয়তো শ্রোডিঙ্গারকে পথে আনা যাবে।

সে যুগে নিলস বোরকে সবাই ভয় পেত। বোর তর্ক করতে ভালোবাসতেন। পিং পং খেলতে খেলতে বলের সঙ্গে প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে দিতেন যুক্তির জাল। কয়েক দিন ক্রমাগত তর্ক করে বেচারা শ্রোডিঙ্গার অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তবুও নিস্তার নেই! মাথার পাশে বসে বোরের মমতাময়ী বউ শ্রোডিঙ্গারের সেবা-শুশ্রূষা করছে আর বিছানার ওপারে দাঁড়িয়ে বোর যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে শ্রোডিঙ্গারকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন! কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে সেই যে ঝগড়া শুরু হয়েছিল, ৯০ বছর পরে এখনো তা চলছে। ঝগড়াটা কী নিয়ে?

যেকোনো তরঙ্গ সময় এবং স্থানের সঙ্গে ওঠানামা করে। দুই ধরনের তরঙ্গের কথা এত দিন জানা ছিল। যেমন পানি বা শব্দের মতো যান্ত্রিক ঢেউ। মাধ্যমের সাহায্যে এদের কম্পন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর আছে বিদ্যুত্চুুম্বকীয় তরঙ্গ, যার চলাচলের জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। ওরা হলো বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ফিল্ডের কম্পন। এসব তরঙ্গের সমীকরণ এবং তার সমাধান পদার্থবিদদের ভালো করেই জানা ছিল। ১৯২৪ সালে লুই দ্য ব্রগলি এক নতুন তরঙ্গের কথা বলেন। এই তরঙ্গ চলন্ত পদার্থকে জড়িয়ে থাকে। ভরবেগ থেকে এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বের করার একটা উপায়ও তিনি বের করেছিলেন। কিন্তু এই তরঙ্গ আসলে কী, এদের সমীকরণ বা সমাধান কী, তার কোনো কিছুই দ্য ব্রগলির জানা ছিল না। এটা ছিল তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির থিসিস। থিসিসটির মাথামুণ্ডু বোঝা দায়! তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পরীক্ষকদের আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত ওটা আইনস্টাইনের কাছে পাঠানো হয়। ১৯২৯ সালে দ্য ব্রগলিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

১৯২৫ সালে শ্রোডিঙ্গার আবিষ্কার করলেন কোয়ান্টাম তরঙ্গের সমীকরণ। এই সমীকরণটি নিয়ে বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছেন, ‘কোথা থেকে এই সমীকরণটি এল? কোনো কিছু থেকে অঙ্ক কষে একে বের করা সম্ভব নয়। সমীকরণটি এসেছে শ্রোডিঙ্গারের হূদয় থেকে!’ এই সমীকরণে কাল্পনিক (Imaginary) সংখ্যা স্থান করে নিয়েছে। বাস্তব জগতে এমন কোনো সংখ্যা নেই যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে গুণফল -1 হবে। এমন সংখ্যাকে কাল্পনিক সংখ্যা বলে। একে সাধারণত i হিসেবে লেখা হয়, i হলো -1-এর বর্গমূল। একটি বাস্তব সংখ্যার সঙ্গে কাল্পনিক সংখ্যা যোগ করে একটি জটিল (Complex) সংখ্যা তৈরি করা যায়, যেমন 2+i3। শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সমাধানকে তরঙ্গ ফাংশন বলে, এই সমাধানের এক অংশ বাস্তব এবং আরেক অংশ কাল্পনিক।

অঙ্কের ভাষায় Y হলো কমপ্লেক্স ফাংশন। এমন কমপ্লেক্স ফাংশন বাস্তব জগতে কি কাজে লাগবে? এর মানেই বা কী? উত্তরটা সমীকরণের জনক শ্রোডিঙ্গারের জানা ছিল না! পরের বছর ম্যাক্স বর্ন ওয়েভ ফাংশন থেকে বাস্তব জগতের খবর জানার কৌশল বলে দেন। একটি কমপ্লেক্স সংখ্যা, যেমন 2+i3-কে 2 - i3 দিয়ে গুণ করলে ১০ পাওয়া যাবে। এখানে ২-র৩-কে কমপ্লেক্স কঞ্জুগেট বলে। ইচ্ছে করলে সহজ ভাষায় এই গুণফলকে বর্গ বলে ডাকা যেতে পারে। ম্যাক্স বর্ন বললেন যে তরঙ্গ ফাংশনের বর্গ বস্তুর অস্তিত্বের সম্ভাবনার তরঙ্গ। এই ব্যাখ্যার জন্য বর্ন ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৪ সালে শ্রোডিঙ্গার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে শ্রোডিঙ্গার শোনালেন তাঁর কাল্পনিক বিড়ালের গল্প।

শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ এবং তরঙ্গ ফাংশনের ব্যাখ্যা নিয়ে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের দ্বিমত নেই। ঝগড়াটা লাগে তার পরে! বিড়ালের গল্পটা বলার আগে কোয়ান্টামবিরোধী আইনস্টাইনের সঙ্গে শ্রোডিঙ্গার পরামর্শ করেছিলেন। তাই তো মগজ ধোলাই করে শ্রোডিঙ্গারকে নিজের দলে তড়িঘড়ি করে টেনে আনতে চান বোর। অস্তিত্বের ঢেউ থেকে অস্তিত্ব, সম্ভাবনার ঢেউ থেকে বাস্তবতা কেমন করে উদয় হয়, ঝগড়াটা তাই নিয়ে। আইনস্টাইন, বোর, শ্রোডিঙ্গার, হাইজেনবার্গ গত হয়েছেন। ঝগড়াটা এখনো চলছে। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে যে বিজ্ঞানীরা প্রতিদিন গবেষণা করেন, তাঁরা এসব ঝগড়ায় তেমন অংশ গ্রহণ করেন না। সময় কোথায়? শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সমাধান করে ওয়েভ ফাংশন পাওয়া যাবে এবং তাকে নিংড়ে সব খবর জুটবে। তরঙ্গ ফাংশনের এক অংশ কাল্পনিক।

তাতে কী? পদার্থবিদ্যার মতো ঘোর বস্তুবাদী বিষয়ে কাল্পনিক চরিত্রের আগমন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আইনস্টাইনের মতো পাগল হয়ে লাভ নেই। তাই কোয়ান্টাম বিষয়ে গবেষণারত ছাত্রদের প্রতি অধ্যাপকদের উপদেশ, ‘প্রশ্ন না করে অঙ্ক করো।’ এ আমলে বোরের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার সঙ্গে আরও কয়েকটি ব্যাখ্যা যোগ হয়েছে, যেমন বহুবিশ্ব তত্ত্ব, ইনফরমেশন তত্ত্ব ইত্যাদি। প্রতিটি ব্যাখ্যা যেন পাগলামির প্রতিযোগিতা। কিছুদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে এ নিয়ে এক ভোটাভুটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বোরের কোপেনহেগেন তত্ত্ব সর্বাধিক শতকরা ৪২ ভাগ ভোট পেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকাল কোপেনহেগেন তত্ত্বটিই ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়।

অনেকের কাছে এই ঝগড়া কোয়ান্টাম তত্ত্বের সবচেয়ে মজার ব্যাপার। কল্পনা যেখানে বাস্তব হয়ে ধরা দেয়! বন্ধ ঘরে যেমন একটি কাল্পনিক বিড়াল একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত অবস্থায় থাকে! দরজা খোলার শব্দে মৃত বিড়ালটি যেমন আবার পুনর্জন্ম লাভ করে! যে কেউ ইচ্ছে করলে এই ঝগড়ায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে একটা কথা না বললেই নয়। অঙ্কের ভাষা জানা না থাকলে এই বিতর্কে সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। অঙ্ক বিজ্ঞান নয়, তবুও অঙ্কের সঙ্গে বিজ্ঞানের আছে এক বিচিত্র সম্পর্ক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অঙ্কবিদ ইউজিন উইগনার এ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা এক অলৌকিক দান, যা বোঝার ক্ষমতা এবং যোগ্যতা আমাদের নেই।’ অঙ্কের কল্পনার জগৎ অনেক সময় বাস্তবে এসে ধরা দেয়। প্রকৃতি অঙ্কের ভাষায় কথা বলে। অ্যারিস্টটল একবার রেগে গিয়ে বলেছিলেন, অঙ্ক না শিখে তুমি যদি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে চাও, তবে পরের জন্মে পাখি হয়ে জন্ম নিয়ো।

অঙ্ক ছাড়া মহাবিশ্বের বা কোয়ান্টাম তত্ত্বের গভীরতম সৌন্দর্য চোখে পড়বে না। তবে যেটুকু পড়ে, তাতেই বা লোকসান কী!

লেখক: ইমিরেটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র