বর্ণালির সবচেয়ে পুরোনো রহস্য

আলোর চিরকুটে লেখা থাকে সবকিছু। কোত্থেকে এসেছে, কী দিয়ে গঠিত—এসব বিজ্ঞানীরা বের করে ফেলতে পারেন। কিন্তু তারাদের ফাঁকে ফাঁকে, আন্তনাক্ষত্রিক মহাশূন্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে অদ্ভুত এক আলোক বর্ণালি। কিছুটা ছড়ানো এই বর্ণালিকে বিজ্ঞানীরা ইংরেজিতে বলেন ডিফিউজ ইন্টারস্টেলার ব্যান্ড। রহস্যময় এ বর্ণালির জন্য কোন অণু বা পরমাণু দায়ী, কীভাবে এটা হচ্ছে—এ রকম বহু প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। স্পেকট্রোস্কপির সবচেয়ে পুরোনো এ সমস্যার সমাধান নিয়ে কী ভাবছেন বিজ্ঞানীরা?

সূর্য থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ওজন ইত্যাদির অণু কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নিচ্ছে

হাজার বছর ধরে মানুষ আকাশ দেখছে। আকাশ দেখার মাধ্যম আলো। এই সেদিন মাত্র মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। হাতে গোনা এ রকম কয়েকটা ঘটনা বাদ দিলে মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা সব আলোর মাধ্যমে। শুধু দেখা আলোতেই নয়, অদেখা আলোতেও আমরা আকাশ দেখি। বেনিআসহকলা বা সাত রঙের আলোর বাইরে অবলোহিত আলো, মাইক্রোওয়েভ, ইউভি, এক্স–রে—সব আলোতেই মহাকাশ দেখা চলে। এসব আলোর নানা বৈশিষ্ট্য থেকে জটিল সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এ আলোর বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে বিগ ব্যাংয়ের কথা জানা গেছে। জানা গেছে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। কোন তারা কত দূরে আছে, তা–ও জানা গেছে এর মাধ্যমে। জানা গেছে, সূর্য কিসের তৈরি। কিন্তু ১০০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না, তারকারাজির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় কোন অণুর কারণে ডিফিউজ ইন্টারস্টেলার ব্যান্ড তৈরি হচ্ছে। বিষয়টা তাই আজও রহস্য হয়েই রয়েছে আমাদের কাছে।

সমস্যাটা কী, সেটা নিয়ে আলোচনার আগে দু–একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব একটু ঝালাই করে নেওয়া যাক। পদার্থবিজ্ঞানের খুব বিখ্যাত তত্ত্বগুলোর একটা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। উনিশ শতকেই পরীক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে রেখেছেন। আর বিশ শতকের একদম শুরুতে (১৯০০ সালে) ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এই প্রকৃতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই গোড়াপত্তন করেছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের।

শুধু দেখতে হবে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সবচেয়ে বেশি বেরোচ্ছে। এখন ওই বস্তুর সামনে যদি কোনো গ্যাস রেখে দেওয়া হয়, তাহলে ওই গ্যাস কোনো কোনো তরঙ্গের আলো শোষণ করে নেবে।

এই তত্ত্বের মূলকথা হলো সব বস্তু থেকে তাপ বিকিরিত হয়। এই বিকিরণের প্রকৃতি নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। তাপমাত্রা বেশি হলে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশি বিকিরিত হয়। আর তাপমাত্রা কম হলে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশি বিকিরিত হয়। যেমন সূর্য অনেক উত্তপ্ত, তাই সূর্য থেকে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আসে। এই আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। আবার একজন মানুষের শরীরের তাপমাত্রা কম, তাই বিকিরিত আলো হলো অবলোহিত রশ্মি, আমরা চোখে দেখি না। বলে রাখা ভালো, আলো বলতে শুধু আমাদের চোখে দেখা আলো বোঝায় না। তড়িৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের পুরো স্পেকট্রাম বা বর্ণালিটাই বোঝায়, যার মধ্যে ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমাদের চোখে সংবেদনশীল বা দৃশ্যমান।

কোনো একটা উত্তপ্ত বস্তু থেকে বিকিরিত আলো দেখে বলে দেওয়া সম্ভব, ওই বস্তুর তাপমাত্রা কত। শুধু দেখতে হবে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সবচেয়ে বেশি বেরোচ্ছে। এখন ওই বস্তুর সামনে যদি কোনো গ্যাস রেখে দেওয়া হয়, তাহলে ওই গ্যাস কোনো কোনো তরঙ্গের আলো শোষণ করে নেবে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, একেক পদার্থ একেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। তাই আলোক উৎস আর পর্যবেক্ষকের মধ্যে কোন গ্যাস বা কোন পদার্থ আছে, তা বিকিরিত আলো দেখেই বলে দেওয়া যায়। এভাবে বলে দেওয়া সম্ভব, আমাদের বায়ুমণ্ডলে কোন কোন পদার্থের অণু আছে।

তাপমাত্রা কম হলে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশি বিকিরিত হয়। যেমন সূর্য অনেক উত্তপ্ত, তাই সূর্য থেকে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আসে

সূর্য থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ওজন ইত্যাদির অণু কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নিচ্ছে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে কোন অণু কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করবে, তা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু অণু নয়, পরমাণুও নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। সঠিকভাবে বললে, যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করলে অণু বা পরমাণুর শক্তিস্তরে পরিবর্তন আসে, উচ্চ শক্তিস্তর থেকে আবার যখন অণু বা পরমাণু নিম্ন শক্তিস্তরে উপনীত হয়, তখন একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিকিরণও করে।

আরও পড়ুন

অণু-পরমাণুর সঙ্গে আলোর মিথস্ক্রিয়া তাই দুই রকম—শোষণ ও বিকিরণ। তড়িৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের পুরো বর্ণালির শোষণ ও বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দেখে বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই অণু-পরমাণু শনাক্ত করছেন। যেমন ১৮৬৮ সালে সূর্যের বিকিরণে অজানা শোষণ লাইন দেখে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে দূরবীক্ষণ তাক করে তাই অজানা কোনো শোষণ লাইন দেখলে বিচলিত হন না। ঘেঁটে দেখেন, কোন অণু বা পরমাণুর কারণে ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শোষণ বা বিকিরণ হতে পারে। অণু-পরমাণুর সঙ্গে আলোর এই মিথস্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণাই স্পেকট্রোস্কপি নামে পরিচিত।

স্পেকট্রোস্কপিতে অজানা অণুর অ্যাবজরপশন বা শোষণ রেখার বিপত্তির শুরু ১৯১৯ সালে। তখন পিএইচডি গবেষক ম্যারি লি হেগার ক্যালিফোর্নিয়ার লিক অবজারভেটরিতে কাজ করছিলেন। তাঁর চেষ্টা ছিল, যুগল নক্ষত্রের (বাইনারি স্টার) স্পেকট্রোস্কপি দেখা। সেখানে তিনি খুঁজছিলেন সোডিয়ামের ডি রেখা। তাঁর আশা ছিল, সোডিয়ামের ডি রেখা স্টেশনারি হবে। স্টেশনারি বলতে কী বোঝায়, একটু ব্যাখ্যা করা দরকার।

বর্ণালি হলো বারকোডের মতো একটা নকশা, যেখানে পাতলা ও কালো কিছু রেখা দেখা যায়।
ছবি: বিজ্ঞানচিন্তা

যুগল নক্ষত্র একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তাই ঘোরার সময় একটা নক্ষত্র যদি পৃথিবীর দিকে আসতে থাকে, অন্য নক্ষত্র পৃথিবী থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আলোক উৎস দূরে সরে যাচ্ছে নাকি কাছে আসছে, এর ওপর নির্ভর করে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়। যা ডপলার ইফেক্ট নামে পরিচিত। এখন ওই যুগল নক্ষত্র থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যদি কোনো শোষণ লাইন বা শোষণ রেখা দেখা যায়, লম্বা সময় ধরে ওই শোষণ রেখা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা সম্ভব তার উৎস কী। যদি শোষণের উৎস ওই নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডল হয়, তাহলে ডপলার ইফেক্টের কারণে শোষণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে পরিবর্তিত হবে। এটা ডপলার শিফট নামে পরিচিত।

কিন্তু শোষণের উৎস যদি ওই নক্ষত্র যুগল না হয়ে সৌরজগৎ এবং ওই নক্ষত্রের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় থাকা কোনো অণু বা পরমাণু হয়, তাহলে শোষণ রেখায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডপলার শিফট হবে না। বোঝা যাবে, নক্ষত্রের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায়, যাকে বলা হয় ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম বা আন্তনাক্ষত্রিক ক্ষেত্রতেই এই অণু-পরমাণুগুলো আছে।

তরঙ্গদৈর্ঘ্য (ন্যানোমিটার), সূর্যের স্পেকট্রামে বিভিন্ন পরমাণুর অ্যাবজরপশন লাইন বা শোষণ রেখা

ম্যারি হেগার সোডিয়ামের স্টেশনারি ডি রেখায় খুঁজতে গিয়ে সম্ভাব্য তিনটি স্টেশনারি রেখা খুঁজে পেলেন অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। এর মধ্যে এমন দুটি রেখা পাওয়া গেল, যেগুলো বিজ্ঞানীদের জানা কোনো অণু বা পরমাণুর শোষণ রেখার সঙ্গে মেলে না। ৫৭৮ ও ৫৭৯.৭ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই শোষণ রেখা ম্যারি ১৯১৯ সালেই দেখেছেন গামা পারসেই নক্ষত্র যুগলে। ম্যারি তাঁর আবিষ্কার প্রকাশ করেন ১৯২২ সালে। ২০১৩ সালে ম্যারির পর্যবেক্ষণের ফটোগ্রাফিক প্লেট ডিজিটাইজ করে এবং নোটবুক ঘেঁটে বেনজামিন ম্যাকল ও এলিজাবেথ গ্রিফিন দেখিয়েছেন, ম্যারি ১৯১৯ সালেই ওই রেখা দুটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

আগেই লেখা হয়েছে, রেখা দুটি ছিল স্টেশনারি বা স্থির। যেহেতু ডপলার শিফট হচ্ছিল না, তার মানে এই রেখা দুটির উৎস আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যম, নক্ষত্রের বায়ুমণ্ডলে নয়।

আন্তনাক্ষত্রিক ফাঁকা জায়গায় পর্যবেক্ষণ করা শোষণ রেখায় শুধু ডিআইবিই নয়, আরও অনেক রেখা পাওয়া গেছে, যেগুলো বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেসব রেখা সাধারণত শার্প, ডিআইবির মতো ব্রড নয়।

এমন দুটি অজানা রেখা নিয়ে কেন এই লেখা? কারণ, এরপর গত ১০০ বছরে এমন অজানা রেখা পাওয়া গেছে পাঁচ শতাধিক। যেগুলো আমাদের পরিচিত কোনো অণু বা পরমাণুর শোষণ রেখার সঙ্গে মেলে না। স্পেকট্রোস্কপিতে এর চেয়ে পুরোনো কোনো সমস্যা এখনো অমীমাংসিত নেই।

এবার এই রেখাগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। এই রেখাগুলো শার্প বা চিকন নয়, কিছুটা ব্রড বা ছড়ানো। এই ছড়ানো প্রকৃতির জন্য বিজ্ঞানীরা রেখাগুলোর নাম দিয়েছেন ডিফিউজ ইন্টারস্টেলার ব্যান্ড বা ডিআইবি।

আরও পড়ুন

সাধারণত কোনো অণু তরল বা কঠিন অবস্থায় থাকলে রেখা ব্রড হয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করা এসব রেখা ততটাও ব্রড নয়। এ জন্য কঠিন বা তরল অণুর সম্ভাবনা প্রায় নাকচ করে দেওয়া যায়। কোনো পরমাণুর সম্ভাবনাও বাতিল করে দেওয়া যায়। কারণ, সব কটি পরমাণুর শোষণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিজ্ঞানীদের জানা।

আন্তনাক্ষত্রিক ফাঁকা জায়গায় পর্যবেক্ষণ করা শোষণ রেখায় শুধু ডিআইবিই নয়, আরও অনেক রেখা পাওয়া গেছে, যেগুলো বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেসব রেখা সাধারণত শার্প, ডিআইবির মতো ব্রড নয়। সেগুলো বিভিন্ন অণুর শোষণ রেখার সঙ্গে মিলে যায়। এখন পর্যন্ত ২৯৮টি ভিন্ন ভিন্ন অণু আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি অণু এমনকি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরেও দেখা গেছে।

এসব আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমের অণুর বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণত এগুলো অল্প কয়েকটি পরমাণু দিয়ে তৈরি। অধিকাংশই তিন-চারটি পরমাণুবিশিষ্ট অণু। ১০-১১ পরমাণুবিশিষ্ট অণুও পর্যবেক্ষণ করা গেছে। অল্পসংখ্যক পরমাণুওয়ালা অণুর সুবিধা হলো, এগুলোর স্পেকট্রোস্কপি বিজ্ঞানীরা মোটামুটি ভালোভাবেই জানেন। তাই এসব রেখা দূরবীক্ষণে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

এইচডি১৭০৭৪০ নক্ষত্র থেকে আসা আলোর মধ্যে ডিআইবি, নীল রঙে

আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমে শনাক্ত হওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অণু হলো C60 এবং C70। এই অণুগুলো ফুলারিন নামে পরিচিত। ফুলারিন এক বিস্ময়কর অণু। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে রসায়নে ফুলারিন বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এই অণুর আকার ফুটবলের মতো। এতগুলো পরমাণু মিলে যে এমন একটা অণু তৈরি হতে পারে, তা অনেকের ধারণাতেই ছিল না। ১৯৮৫ সালে গবেষণাগারে ফুলারিন আবিষ্কার করে স্মলি, ক্রোটো ও কার্ল নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৬ সালেই। তখন দেখা গেল, ফুলারিন প্রকৃতিতে অতটা বিরলও নয়। ইঞ্জিনের জ্বালানি পোড়ানোর পরের একটা বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত এই ফুলারিন। তাই যখনই ফুলারিনের স্পেকট্রোস্কপি জানা গেল, বিজ্ঞানীরা মহাকাশে ফুলারিনের শোষণ রেখা খুঁজতে শুরু করলেন। কিছুটা সময় লাগলেও ফুলারিন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় ২০০৩ সালে স্পিৎজার স্পেস টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণের পর।

স্পেকট্রোস্কপির সবচেয়ে পুরোনো এ সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগই আছে। এডিবলস (EDIBLES) নামের এক প্রজেক্টে চেষ্টা করা হচ্ছে এ সমস্যার কোনো একটা গতি করার।

তবে ফুলারিন পর্যবেক্ষণ হলেও ডিআইবির কোনো গতি হয়নি। ডিআইবিতে প্রথম ব্রেকথ্রু আসে ২০১৫ সালে। সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ব্যাসেলের রসায়ন বিভাগের জে পি মেয়ারের গ্রুপ প্রথম নিশ্চিত করে দেখায়, ডিআইবির দুটি লাইন C60+ এর সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। C60+ হলো একটা ফুলারিন অণু থেকে একটা ইলেকট্রন সরিয়ে নিলে যে আয়ন হয়, তা। ৯৬৩.৩ ও ৯৫৭.৮ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দুটি রেখা ডিআইবিতে আগেই দেখা গেছে। মেয়ারের গ্রুপ নিশ্চিত করে ল্যাবরেটরিতে C60+ এর শোষণ লাইনেও এই দুই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শোষণ দেখান। প্রায় এক শতাব্দী পর ডিআইবির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০০, সমাধান হয়েছে দুটি রেখার।

কথা হচ্ছে, সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? কারণটা লুকিয়ে আছে কার্বনের মধ্যে। কার্বন পরমাণু অন্য কার্বনের সঙ্গে বন্ধন করে বিশাল বিশাল অণু তৈরি করতে পারে, যে জন্য পৃথিবীর প্রাণ কার্বননির্ভর। পাঁচ বা ছয়টা কার্বনের বিশেষ ধরনের একটা রিং তৈরি হয়, যাকে বলে অ্যারোমেটিক রিং বা চক্র। সবচেয়ে কমন চক্র হলো বেনজিন, যেখানে ছয়টা কার্বন থাকে, সঙ্গে থাকে ছয়টা হাইড্রোজেন। মূলত কার্বন আর হাইড্রোজেনই প্রধান উপাদান, এ জন্য এগুলোকে বলে হাইড্রোকার্বন। এর সঙ্গে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস বা সালফার পরমাণু যুক্ত হতে পারে। একাধিক রিং একত্রে যুক্ত হয়ে পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন তৈরি করে। সংক্ষেপে যেগুলোকে বলা হয় পিএএইচ। ধারণা করা হয়, ডিআইবির উৎস পিএএইচ।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি রেখা
ছবি: বিজ্ঞানচিন্তা

পিএএইচগুলোর গঠন খুবই এফিশিয়েন্ট। এ জন্যই হাজার হাজার পরমাণু মিলে প্রোটিনের মতো খুবই জটিল জৈবিক অণু তৈরি হতে পারে। সমস্যা হলো, মাত্র ১০০ পরমাণুর সমন্বয়ে লাখ লাখ ভিন্ন ভিন্ন অণু তৈরি হতে পারে। তাই ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে প্রতিটি অণুর স্পেকট্রোস্কপি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য এত দিনেও এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

স্পেকট্রোস্কপির সবচেয়ে পুরোনো এ সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগই আছে। এডিবলস (EDIBLES) নামের এক প্রজেক্টে চেষ্টা করা হচ্ছে এ সমস্যার কোনো একটা গতি করার। তারা শুধু ডিআইবির সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষ সার্ভে করছে মহাকাশের, তৈরি করছে সম্ভাব্য অণুর তালিকা।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিংয়ের সাফল্য আশাবাদী করছে যে সম্ভাব্য অণুর তালিকা তৈরি করে ল্যাবরেটরিতে সেগুলো বানিয়ে ডিআইবির রেখাগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অণুগুলোর গঠন যেহেতু কোয়ান্টাম সিস্টেম, হয়তো কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে এগুলোর গঠন হিসাব করা যাবে। তাই এমনটা আশা করা অলীক হবে না যে ১০০ বছর এই সমস্যা টিকে থাকলেও আগামী ১০–১৫ বছরে ডিআইবির সমাধান হয়ে যাবে।

লেখক: পিএচডি গবেষক, রসায়ন বিভাগ, ইউনিভর্সিটি অব ওয়াইওমিং

সূত্র: নেচার, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি এ, জার্নাল অব মলিকুলার স্পেকট্রোস্কপি, জার্নাল অব ফিজিকস

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন