কোয়ান্টাম তত্ত্বে অতিবেগুনি বিপর্যয় বলতে কী বোঝায়

১৯১১ সালে একেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে আল্ট্রাভায়োলেট ক্যাটাস্ট্রফি বা অতিবেগুনি বিপর্যয় নামে চিহ্নিত করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল আরেনফেস্ট। আবার অনেকে একে র‍্যালে-জিন্স বিপর্যয় নামেও ডাকেন।

উনিশ শতকের শেষ দিকে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ বা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন ব্যাখ্যায় হিমশিম খাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ সমস্যা সমাধানে একটা সূত্র প্রণয়ন করেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম ভিন। ভিনের সূত্রটি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে গেল। কিন্তু দেখা গেল, দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ব্যাখ্যায় সূত্রটি কাজ করছে না। ভুল ফলাফল দিচ্ছে।

ভিনের সূত্রের এই ব্যর্থতায় একটা নতুন কিছু খুঁজে পেতে বেশ হুড়োহুড়ি পড়ে গেল গবেষকদের মধ্যে। শিগগিরই নতুন একগুচ্ছ সূত্র পাওয়া গেল কয়েকজন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে। এ সময় কদিন পরপরই বেশ কিছু বিকল্প সূত্রের প্রস্তাব পাওয়া যেতে লাগল। তবে এসব সাময়িক বিকল্প সূত্রগুলো ভুল বলে প্রমাণিত হতেও বেশি সময় লাগেনি। এর মধ্যে একটা সূত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি ছিল র‍্যালে-জিন্সের সূত্র। ব্রিটিশ পদার্থবিদ লর্ড র‍্যালে এবং স্যার জেমস জিন্স এটি সূত্রবদ্ধ করেন বলেই এমন নাম। এ সূত্র মতে, উত্তপ্ত বস্ত থেকে নিঃসৃত বিকিরণের তীব্রতা সরাসরি তার পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক এবং বিকীর্ণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।

আরও পড়ুন
১৯০০ সালের দিকে চিরায়ত বলবিদ্যার বিপরীতে তিনি নতুন একটি সূত্র প্রণয়ন করেন। তাঁর তত্ত্ব মতে, শক্তি আসলে প্যাকেট বা গুচ্ছ রূপে নিঃসৃত হয়।

অচিরেই গবেষণাগারে সূত্রটি পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শুরু করেন পরীক্ষণবিদেরা। পরীক্ষায় দেখা গেল, এ সূত্রটির কার্যকারিতা ভিনের সূত্রের ঠিক উল্টো। মানে, ভিনের সূত্র ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কার্যকর হলেও তা দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। অন্যদিকে র‍্যালে-জিন্সের সূত্রটি দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কার্যকর ঠিকই, কিন্তু ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তা সঠিক ফল দেয় না। তা ছাড়া এই সূত্র থেকে আরেকটা বিপর্যয়কর অবাস্তব ফলাফল পাওয়া গেল। দেখা গেল, ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে যতই যাওয়া যায়, এ সূত্রানুসারে বিকিরণের তীব্রতা ততই অসীমের দিকে ধাবিত হতে থাকে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কৃষ্ণবস্তু থেকে একটা পর্যায়ে অসীম পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হবে। অথচ তা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই যদি হতো, তাহলে মহাবিশ্ব অনেক আগেই বিশাল এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হতো। কাজেই ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে র‍্যালে-জিন্সের সূত্র আসলে অকার্যকর।

১৯১১ সালে একেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে আল্ট্রাভায়োলেট ক্যাটাস্ট্রফি বা অতিবেগুনি বিপর্যয় নামে চিহ্নিত করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল আরেনফেস্ট। আবার অনেকে একে র‍্যালে-জিন্স বিপর্যয় নামেও ডাকেন। এর ফলে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে ভিনের সূত্র আবারও পরীক্ষা করে দেখার চাপ সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হলো না। এবারও দেখা গেল, ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোতে সূত্রটি বেশ ভালোভাবে কাজ করলেও দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অকেজো।

অবশেষে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত এই বহুল আলোচিত সমস্যাটির সমাধান করেন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। ১৯০০ সালের দিকে চিরায়ত বলবিদ্যার বিপরীতে তিনি নতুন একটি সূত্র প্রণয়ন করেন। তাঁর তত্ত্ব মতে, শক্তি আসলে প্যাকেট বা গুচ্ছ রূপে নিঃসৃত হয়। এ সূত্রই কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূচনা করে। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে শুরু হয় নতুন পথচলা।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

আরও পড়ুন 

আরও জেনে নিন