পদার্থবিজ্ঞানের অমীমাংসিত সমস্যা

পদার্থবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন খুঁজে ফিরছেন সব কিছুর তত্ত্ব। ইংরেজিতে যাকে বলে, থিওরি অব এভরিথিং। সেই সবকিছুর তত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা। সেসব সমস্যার সবিস্তার বিবরণ, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থা, স্ট্যান্ডার্ড মডেল ইত্যাদি নিয়ে জানুন...

সবে হাইস্কুল পাস করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। বয়স মাত্র ১৬। যাকে বলে সুইট সিক্সটিন! কিন্তু ম্যাক্সের সময়টা তেমন সুইট কাটছিল না। স্রেফ একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভেতর। সেটাকে দুশ্চিন্তা বলাই ভালো। শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু সেখানে কী নিয়ে পড়ালেখা করবেন, তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় আছেন। একবার ভাবলেন, সংগীতই বেছে নেবেন। পিয়ানোতে হাতটা বেশ পাকা। গানেও কম যান না। সেই বয়সে কিছুটা নামডাকও হয়েছে। কিন্তু ক্যারিয়ার হিসেবে সেটা বেছে নিলে কেমন হবে?

এক অধ্যাপককে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন কিশোর প্ল্যাঙ্ক। শুনেই খেপে গেলেন অধ্যাপক। কর্কশভাবে উত্তর দিলেন, ‘এ কথা যদি জিজ্ঞেস করতে হয়, তাহলে সংগীত নিয়ে পড়ালেখা না করাই ভালো। অন্য কিছু খুঁজে নাও গিয়ে।’

আবারও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলেন প্ল্যাঙ্ক। উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন বাবা উইলহেম প্ল্যাঙ্ক। ১৮৭৪ সালের শেষ দিকে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিলেন অধ্যাপক ফিলিপ ভন জলির সঙ্গে। জার্মানির মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা পদার্থবিদ তিনি। কিন্তু অবাক কাণ্ড! নিজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও প্ল্যাঙ্ককে পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে নিরুৎসাহিত করলেন জলি। তাঁর যুক্তি, পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সবকিছু আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। এখন যেটুকু বাকি আছে, তা অগুরুত্বপূর্ণ। তাই পদার্থবিজ্ঞানের ক্যারিয়ার মানে ভবিষ্যৎ নির্ঘাত অন্ধকার। প্ল্যাঙ্ককে তিনি পদার্থবিদ্যায় নয়, গণিতে পড়ার পরামর্শ দেন।

পদার্থবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ মন্তব্যের কারণে ফিলিপ ভন জলিকে ইতিহাস ক্ষমা করেনি। তবে শুধু জলিকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। একই ভুল করেছেন সেকালের নামকরা আরও অনেক পদার্থবিদ। যেমন নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী আলবার্ট এ মাইকেলসন। সহকর্মী এডওয়ার্ড মর্লির সঙ্গে ১৮৮৭ সালে একটা পরীক্ষা করেন তিনি। সেটি মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষা নামে বিখ্যাত। এর মাধ্যমে সেকালের প্রচলিত অলীক, অবাস্তব ইথারতত্ত্ব বাতিল করেন তাঁরা। বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব গড়ে তোলার পেছনে এটিই ইন্ধন জোগায় আইনস্টাইনকে।

বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কেবল উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরাই যে এ রকম ভেবেছেন, তা নয়; অন্য সময়ের পদার্থবিজ্ঞানীদেরও একই ধারণা ছিল। যুগে যুগে পদার্থবিদেরা ভেবেছেন, তাঁদের হাতে পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু আবিষ্কার হয়ে যাবে।
কোয়ান্টাম–গুরু ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রায়ারসন ফিজিক্যাল ল্যাবে ১৮৯৪ সালে বক্তব্য দেন মাইকেলসন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোনো আবিষ্কার করা অসম্ভব। তাঁর মন্তব্য, ‘ভৌত পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সূত্র ও তথ্যের সব আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।...তাই ভবিষ্যৎ আবিষ্কারগুলোকে অবশ্যই দশমিকের পর অন্তত ছয় ঘর পর্যন্ত নির্ভুল করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’

শুধু মাইকেলসনই নন, কিছুদিন পর ব্রিটিশ পদার্থবিদ লর্ড কেলভিনের (আসল নাম উইলিয়াম টমসন) কণ্ঠেও শোনা গেল একই প্রতিধ্বনি। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের এক সভা বসে ১৯০০ সালে। সেখানে তিনি বলেন, ‘পদার্থবিদ্যায় নতুন কিছু আর আবিষ্কারের বাকি নেই। শুধু পরিমাপ যতটা সম্ভব নিখুঁত করার কাজই এখন বাকি।’

বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কেবল উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরাই যে এ রকম ভেবেছেন, তা নয়; অন্য সময়ের পদার্থবিজ্ঞানীদেরও একই ধারণা ছিল। যুগে যুগে পদার্থবিদেরা ভেবেছেন, তাঁদের হাতে পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু আবিষ্কার হয়ে যাবে। অজানাকে জানার ক্ষেত্রে তাঁরাই হবেন শেষ প্রজন্ম—এমন এক আত্মতুষ্টিতে ভুগেছেন। কিন্তু যখনই বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ রকম ধারণা প্রবল হয়েছে, তখনই জন্ম হয়েছে কোনো না কোনো নতুন বিপ্লবের। আগের পদার্থবিজ্ঞানের খোলনলচে ভেঙেচুরে তার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েছে নতুন বিজ্ঞান। মজার বিষয় হচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান বিপ্লবীরাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে তাঁরা চূড়ান্ত আবিষ্কারের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন। সেই চূড়ান্ত আবিষ্কারকে অনেকে বলেন থিওরি অব এভরিথিং। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই তত্ত্ব দিয়ে আমাদের এযাবৎকালের সব আবিষ্কার এক সুতায় গাঁথা যাবে নিখুঁতভাবে।

পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম বিপ্লবকে বলা যায় কোপার্নিকান বিপ্লব, যার শুরুটা হয়েছিল ষোলো শতকের প্রথম দিকে। সেই বৈজ্ঞানিক আন্দোলন হটিয়ে দিয়েছিল স্থান, কাল, গতি ও বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব–সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলিয়ান তত্ত্বগুলোকে। বলতে গেলে, অ্যারিস্টটলের ভুল তত্ত্বগুলো গোটা ইউরোপ অন্ধ করে রেখেছিল টানা দুই হাজার বছর। ইতিহাসে সেটাই অন্ধকার যুগ। তবে সেটা শুধু ইউরোপের জন্যই প্রযোজ্য; চীন, ভারত বা আরবীয় সভ্যতার জন্য নয়। কারণ, এসব অঞ্চলে তখন জ্ঞানের চর্চা চলছিল বহাল তবিয়তে।

যা হোক, কোপার্নিকাসের ধারাবাহিকতায় অচিরেই দেখা দিল আরেকটি বিপ্লব। এবার তার নেতৃত্ব দিলেন আইজ্যাক নিউটন। ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রিন্সিপিয়া-তে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বের প্রস্তাব দেন তিনি। এতে পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার অনেক রহস্য উন্মোচিত হলো। পদার্থবিজ্ঞানে সর্বশেষ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল প্রায় এক শ বছর আগে। সেই ১৯০০ সালের সূচনালগ্নে। এবারের নায়ক দুজন। তাঁদের একজনের কথা শুরুতেই বলেছি। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। যে প্ল্যাঙ্ককে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে নিষেধ করেছিলেন ভন জলি, তাঁর হাতেই ধসে পড়ে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান। তার জায়গায় জন্ম নিল নতুন এক বিপ্লব, নতুন পদার্থবিজ্ঞান—কোয়ান্টাম ফিজিকস। তিনি কৃষ্ণবস্তুর তাপ বিকিরণ বর্ণালির একটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যা প্ল্যাঙ্কের সূত্র নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে প্ল্যাঙ্ক দেখান, শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং কোয়ান্টা আকারে নির্গত হয়। অর্থাৎ কণার মতো গুচ্ছাকারে, যাকে বলা হয় শক্তির প্যাকেট।

এ সময়ের বিপ্লবের আরেক নায়ক আলবার্ট আইনস্টাইন। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব গড়ে তুলতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্ল্যাঙ্কের তত্ত্বটি আসলে সেকালের বিজ্ঞানীদের কাছে হাততালি কুড়িয়েছিল ব্যাপক, কিন্তু কেউই সেটা গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। বরং একধরনের গাণিতিক কারসাজি ভেবে সন্তুষ্ট ছিলেন তাঁরা। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্রথম তত্ত্বটা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। সেকালের অমীমাংসিত রহস্য ফটো–ইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করতে কাজে লাগালেন সেটা।

মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও লেখক লি স্মোলিন তাঁর নামকরা দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিকস বইয়ে লিখেছেন, বর্তমান বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার মূলে রয়েছে পাঁচটি সমস্যা। এর প্রতিটি জটিলতার দিক দিয়ে কুখ্যাত।
লি স্মোলিনের দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিকস-এর প্রচ্ছদ

কোয়ান্টাম তত্ত্বের হালে পানি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও প্রায় দুই দশক। পরমাণুর অতি ক্ষুদ্র জগৎ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নীলস বোর হাত পাতলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাছে। এরপর ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙ্গারসহ একে একে বোর বাহিনীর অনেকে আশ্রয় নিলেন প্ল্যাঙ্কের আবিষ্কৃত তত্ত্বের ছায়াতলে। এভাবে কোয়ান্টাম–বিপ্লবীরা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করতে লাগলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম মেকানিকসের কাজকারবার পরমাণুর অতি ক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে। প্রকৃতির তিনটি মৌলিক বল শক্তিশালী পারমাণবিক বল, দুর্বল পারমাণবিক বল এবং বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল এ তত্ত্বের আলোচ্য বিষয়। কিন্তু এর সঙ্গে কোনোভাবে মহাকর্ষ বলকে একীভূত করা যায়নি। আজকের ইলেকট্রনিকস তথা কম্পিউটার ও মুঠোফোনের মূলে রয়েছে এই তত্ত্ব। তাই তত্ত্বটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বিজ্ঞানীরা বলেন, কোয়ান্টামের এই বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি। এখনো অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তার কারণ বিশ শতকের এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অসম্পূর্ণতা।

মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও লেখক লি স্মোলিন তাঁর নামকরা দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিকস বইয়ে লিখেছেন, বর্তমান বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার মূলে রয়েছে পাঁচটি সমস্যা। এর প্রতিটি জটিলতার দিক দিয়ে কুখ্যাত। এখন পর্যন্ত সেগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এখন কোনো বিজ্ঞানী যদি নতুন কোনো বিজ্ঞান বা তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, তাহলে সে তত্ত্বকে অবশ্যই এই পাঁচ মৌলিক সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য থাকতে হবে। তবেই সেটা বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কী সেই সমস্যাগুলো? চলুন, সেটাই সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।

২.

বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম তত্ত্বে তাঁর অবদানের কথা আগে বলেছি। তবে তাঁর সেরা কাজ হলো আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কার। বিশেষ করে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এখন পর্যন্ত এ তত্ত্বকে বলা হয় স্থান, কাল, গতি ও মহাকর্ষ–সম্পর্কিত সেরা তত্ত্ব।

আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আগে নিউটনিয়ান তত্ত্বে স্থান ও সময় ছিল স্থির ও পরম। কিন্তু সেই ধারণার কফিনে পেরেক ঠুকে দেন আইনস্টাইন। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে স্থান ও সময় আর নির্দিষ্ট, পরম পটভূমি হিসেবে রইল না। স্থান হয়ে গেল পদার্থের মতো গতিশীল। পরিণতি হিসেবে দেখা গেল, সমগ্র মহাবিশ্ব প্রসারিত বা সংকুচিত হতে পারে। এমনকি সময়েরও শুরু থাকতে পারে (যেমন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ) এবং শেষও থাকতে পারে (যেমন ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর)।

নিউটন প্রকৃতির মৌলিক বল মহাকর্ষ আবিষ্কার ও সঠিকভাবে গণনা করে অসংখ্য প্রাকৃতিক ঘটনার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বলের কারণের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে মহাকর্ষের যৌক্তিক কারণটা পাওয়া গেল। এ তত্ত্ব অনুসারে, ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থান–কাল বাঁকিয়ে দেয়। এমনকি আলোকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। সে কারণে পার্শ্ববর্তী অন্য বস্তুগুলো ভারী বস্তুটির চারপাশে ঘুরতে বাধ্য হয়। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ ঘুরছে ঠিক এ কারণে।

এক শতাব্দী ধরে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একাধিক পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মহাবিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহ্বর, মহাকর্ষ তরঙ্গ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এত সব সাফল্য থাকার পরও এ তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে যে মহাবিস্ফোরণ বা কৃষ্ণগহ্বরের মতো উদ্ভট বস্তু পাওয়া যায়, ঠিক সেখানে এসেই অকার্যকর হয়ে পড়ে তত্ত্বটা। অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণ ও কৃষ্ণগহ্বরের যে পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি পাওয়া যায়, সেখানে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আর কাজ করে না। মোদ্দাকথা, এ তত্ত্বের কাজকারবার বৃহৎ জগৎ নিয়ে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব তার ঠিক উল্টো। পরম বিন্দুতে যখন আপেক্ষিকতা কাজ করে না, তখন প্রয়োজন পড়ে ক্ষুদ্র জগতের কোয়ান্টাম তত্ত্বের।

বিশ শতকের এ দুটি আবিষ্কার—কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বলা হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে এসে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুটো তত্ত্ব একই সঙ্গে সঠিক হতে পারে না। কাজেই নতুন এমন কোনো তত্ত্ব দরকার, যেখানে এ দুটি তত্ত্বকে এক সুতায় গাঁথা যাবে। দুটোকে একত্র করে পাওয়া যাবে প্রকৃতির পরিপূর্ণ একটা তত্ত্ব। একটা সার্বিক তত্ত্ব, যাকে বলে থিওরি অব এভরিথিং। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা তেমন কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারেননি। একেই বলা হয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রধানতম অমীমাংসিত সমস্যা। এর আরেক নাম কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ সমস্যা।

৩.

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান দুই তত্ত্বের এই একীভূত করার সমস্যা ছাড়াও আরও একধরনের সমস্যা রয়েছে। মোটাদাগে একে বলা যায় অসীমের সমস্যা। সেটা কোয়ান্টাম ও আপেক্ষিকতা দুটো তত্ত্বের ক্ষেত্রের জন্যই সত্য। প্রকৃতিতে এখনো পরিমাপযোগ্য কোনো মাপকাঠি নেই, যা দিয়ে কোনো অসীম মান মাপা সম্ভব। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের হিসাব–নিকাশে আমরা এমন কিছু ভৌত ভবিষ্যদ্বাণীর মুখোমুখি হই, যা অসীম মান প্রকাশ করে। সেগুলো আসলে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে এদের অর্থহীন বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

সাধারণ আপেক্ষিকতায় অসীমসংক্রান্ত সমস্যার কারণ হলো, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে বস্তুর ঘনত্ব ও মহাকর্ষ ক্ষেত্রের শক্তি হুট করে অসীম হয়ে যায়। আবার মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্তের সেই পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটির ক্ষেত্রে ঘটে একই ঘটনা। পরম বিন্দুও অসীম ভর ও অসীম ঘনত্বের। এখানে সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণ অকার্যকর। বিষয়টিকে অনেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে তখন সময় থেমে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আসলে অসম্পূর্ণ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এই অসম্পূর্ণতার কারণ এ তত্ত্বে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রভাব অবহেলা করা হয়েছে।

অসীম সমস্যা থেকে রেহাই পায়নি কোয়ান্টাম মেকানিকসও। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মতো কোনো ক্ষেত্র বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করতে গেলে অসীমের দেখা পাওয়া যায়। সমস্যা হলো, স্থানের প্রতিটি বিন্দুতে বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বিভিন্ন মান আছে। তার মানে সেখানে অসীমসংখ্যক চলকও রয়েছে (সেটা সসীম আয়তনের মধ্যে হলেও বিন্দুর সংখ্যা অসীম। কাজেই চলকের সংখ্যাও অসীম।) কোয়ান্টাম তত্ত্বে প্রতিটি কোয়ান্টাম চলকের মানে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য ফ্লাকচুয়েশন বা হ্রাসবৃদ্ধি থাকে। এমন অনিয়ন্ত্রণযোগ্য ফ্লাকচুয়েশনের ক্ষেত্রে অসীমসংখ্যক চলক এমন কোনো সমীকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা কোনো অসীম সংখ্যার ভবিষ্যদ্বাণী করে। কাজেই কোন ঘটনা কখন ঘটবে বা কোন বলের শক্তিমত্তা কেমন, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

এ রকম ক্ষেত্রে এসে পদার্থবিদেরা হতাশ হতে বাধ্য। অনেকে আশা করেন, মহাকর্ষ আমলে নেওয়া হলে এই ফ্লাকচুয়েশনকে হয়তো পোষ মানানো যাবে। ফ্লাকচুয়েশনগুলো তখন হয়তো কোনো সসীম বা বোধগম্য মানে আমাদের সামনে হাজির হবে। অসীম সংখ্যাগুলো যদি একীভূত তত্ত্বের অভাবের চিহ্নের প্রমাণ হয়, তাহলে একীভূত তত্ত্বে কোনো অসীম থাকার কথা নয়। তাকে বলা যাবে সসীম তত্ত্ব। অর্থাৎ সেটা এমন তত্ত্ব হবে, যা আমাদের প্রতিটি প্রশ্নের বোধগম্য ও সসীম মানে জবাব দিতে পারবে।

দুটোর যেকোনো একটা যত নিখুঁতভাবে মাপা হবে, অন্যটার পরিমাপে অনিশ্চয়তা দেখা যাবে তত বেশি। কাজেই এ তত্ত্ব থেকে শুধু সম্ভাবনা পাওয়া যায়। যেমন ধরা যাক, একটা কণাকে (ইলেকট্রন) পরিমাপের আগপর্যন্ত সেটা যেকোনো জায়গাতে থাকতে পারে। কিংবা বলা যায়, যেকোনো অবস্থাতেই থাকা সম্ভব।

বিজ্ঞানের বেশ বিস্তৃত একটা জগৎকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম মেকানিকস চরমভাবে সফল। এর আওতায় রয়েছে বিকিরণ থেকে ট্রানজিস্টরের ধর্ম, মৌলিক কণার পদার্থবিজ্ঞান থেকে এনজাইমসহ অন্যান্য বড় অণুর কার্যকারণ। গত শতকে এ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী একের পর এক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও তত্ত্বটি নিয়ে আপত্তি আর সংশয় কাটেনি পদার্থবিদদের। এককালে স্বয়ং আইনস্টাইনও কোয়ান্টাম তত্ত্বের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ, এ থেকে বাস্তবতা বা প্রকৃতির যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এক অর্থে উদ্ভট। কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে এমন কিছু ধারণাগত প্যারাডক্সের জন্ম হয়েছে, যার মীমাংসা প্রায় এক শ বছরে হয়নি।

এ তত্ত্বমতে, একটা ইলেকট্রন একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ। আলোও তা–ই। আবার অতিপারমাণবিক কণাগুলোর আচরণের পরিসংখ্যানগত ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায় এ তত্ত্ব থেকে। অর্থাৎ কোনো ইলেকট্রনের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। বরং কোথায় পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, শুধু সেটুকু বলা যায়। এ ব্যাপারে আমাদের সামর্থ্য সীমিত করে রেখেছে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এ নীতি অনুসারে, কোনো কণার অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়। দুটোর যেকোনো একটা যত নিখুঁতভাবে মাপা হবে, অন্যটার পরিমাপে অনিশ্চয়তা দেখা যাবে তত বেশি। কাজেই এ তত্ত্ব থেকে শুধু সম্ভাবনা পাওয়া যায়। যেমন ধরা যাক, একটা কণাকে (ইলেকট্রন) পরিমাপের আগপর্যন্ত সেটা যেকোনো জায়গাতে থাকতে পারে। কিংবা বলা যায়, যেকোনো অবস্থাতেই থাকা সম্ভব। আমাদের পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ আসলে ওই কণার অবস্থা নির্ধারিত হয়। কিন্তু আমাদের বাস্তব জগৎ আসলে এ রকম উদ্ভট নয়। সেটা হলে বাস্তব জগৎও পরিণত হতো ভুতুড়ে কোনো জগতে। তখন শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো সবকিছু একই সঙ্গে দ্বৈত অবস্থায় থাকত—একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে বাস্তবতার পুরো চিত্র পাওয়া যায় না। কাজেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাপক সাফল্য সত্ত্বেও প্রকৃতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের কাছে এখনো গোপন রয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের জানা জরুরি।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে বর্তমানে এটাই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। একে বলা হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তিগত সমস্যা। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যা সমাধান করে এমন কিছুতে উপনীত হতে চান, যার মাধ্যমে তত্ত্বটার ভিত্তি তাঁদের কাছে বোধগম্য হবে। নয়তো এমন কোনো নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে চান, যা উদ্ভট বা ভুতুড়ে নয়, অর্থবহ।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তিগত সমস্যা মীমাংসার উপায় হতে পারে বেশ কয়েকটি। তার মধ্যে একটি হলো তত্ত্বটির জন্য বোধগম্য কোনো ভাষার জোগান দেওয়া, যার মাধ্যমে তত্ত্বটির সব ধাঁধার সমাধান মিলবে। কিংবা নতুন কোনো তত্ত্বের খোঁজ করা, যেটা সমীকরণগুলোকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। সেটা আমাদের বাস্তব জগতের চিত্রের সঙ্গে মিলে যাবে। অথবা এমন নতুন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করা, যার মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিকসের চেয়ে প্রকৃতিকে গভীর ও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যাবে।

ওপরের তিনটি উপায় নিয়ে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এখন কাজ করছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। কারণ, অনেকে সমস্যাটিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এটা সত্যিই বড় একটা সমস্যা। স্বাভাবিকভাবেই এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি বেশ ধীর। এমনকি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পরও এ সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে আজও।

৪.

তৃতীয় সমস্যা হলো, প্রকৃতির মৌলিক বল ও কণাগুলোকে একীভূত করার সমস্যা। অর্থাৎ আমাদের জানা সব মৌলিক কণা এবং মৌলিক বলকে একত্র করে কোনো একক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে এর সঙ্গে আগে আলোচিত প্রথম সমস্যাটির মিল আছে। কারণ, প্রকৃতির মৌলিক বল এবং মৌলিক কণাকে একীভূত করা মানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে একীভূত করা। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে তা আলাদাও বটে। কারণ, এখানে তত্ত্ব নয়, মৌলিক বল ও কণাদের একীভূত করার কথা বলা হচ্ছে।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক তিনটি মৌলিক বলকে—বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় বল, শক্তিশালী পারমাণবিক বল ও দুর্বল পারমাণবিক বল। অন্যদিকে একমাত্র মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যা মেলে আপেক্ষিকতা তত্ত্বে। আবার প্রকৃতির সব কটি মৌলিক কণার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বে।

সমস্যাটা শুরুতে বেশ সহজ বলে মনে হয়েছিল। বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকীয় বলের সঙ্গে মহাকর্ষকে একীভূত করার প্রথম প্রস্তাব উঠেছিল ১৯১৪ সালের দিকে। এর প্রায় এক দশক পর আইনস্টাইনও এর সমাধানে নেমেছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর সেই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হন। আইনস্টাইন ছাড়াও একই চেষ্টা করেছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকপালেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙ্গারসহ আরও অনেকে। কিন্তু কেউই সফল হননি।

যদি কোয়ান্টাম মেকানিকসের কথা ভুলে যাওয়া সম্ভব হতো, তাহলে একীভূত সমাধানটা হাতের নাগালে পাওয়া অনেক সহজ হতো। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস আমলে নিলে সমস্যা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। মহাকর্ষ অন্যতম প্রাকৃতিক মৌলিক বল। কাজেই প্রথমে আমাদের কোয়ান্টাম মহাকর্ষসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে। সে কথা প্রথম সমস্যায় আলোচনা করেছি।

গত ১০০ বছরে মহাবিশ্বের ভৌত বর্ণনা অনেকটা সহজ-সরল হয়েছে। কণার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে মহাবিশ্ব মাত্র দুই ধরনের কণা দিয়ে তৈরি। সেগুলো হলো কোয়ার্ক আর লেপটন। প্রোটন, নিউট্রনসহ আরও কিছু কণার গাঠনিক উপাদান এই কোয়ার্ক। অন্যদিকে মোটাদাগে বলা যায়, যেসব কণা কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত নয়, তারাই লেপটন। যেমন ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো। আমাদের চেনা জগৎকে ছয় ধরনের কোয়ার্ক ও ছয় ধরনের লেপটন কণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে। তারা চার ধরনের বল (মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় এবং শক্তিশালী ও দুর্বল পারমাণবিক বল) দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়।

মোদ্দাকথা, ১২টি কণা এবং ৪টি বল দিয়ে আমাদের চেনাজানা মহাবিশ্বের সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়। এসব কণা ও বলের মৌলিক পদার্থবিদ্যাও আমাদের বোধগম্য। ৪টি বলের মধ্যে ৩টি বল ও ১২টি কণাকে এখন পর্যন্ত একীভূত করা সম্ভব হয়েছে। এটা করা হয় কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম মহাকর্ষ। একে এখনো এই মডেলে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কাজেই এখন এমন কোনো তত্ত্ব দরকার, যেখানে প্রকৃতির চারটি বল ও সব কটি কণা একীভূত করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের জানা সব জ্ঞান এক ছাতার তলে আনতে পারবে। আর তার মাধ্যমে পাওয়া যাবে প্রকৃতির পরিপূর্ণ একটা তত্ত্ব। সেই তত্ত্বের গালভরা নাম থিওরি অব এভরিথিং, যার কথা আগে বলেছি।

প্রতিবার প্রোগ্রাম রান করার সময় কোনো চিন্তাভাবনা না করে নির্দিষ্ট ধ্রুবকের ডায়াল টিপলেই হলো, কেল্লা ফতে! পদার্থবিদদের কাছে এটাই বিব্রতকর। কারণ, তাঁদের কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটাকে বলা হয় পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বড় সমস্যা।

৫.

চতুর্থ সমস্যা খোদ স্ট্যান্ডার্ড মডেল নিয়ে। আগে বলেছি, আমাদের জানা ৩টি বল ও ১২টি মৌলিক কণাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এখন পর্যন্ত এ তত্ত্বই সেরা। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে অসীমসংক্রান্ত ঝামেলা নেই। এর ফল সসীম সংখ্যায় পাওয়া যায়। এ তত্ত্ব থেকে পাওয়া অনেক ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এক অর্থে এই তত্ত্বকে সফল বলা চলে।

কিন্তু এত সফলতার পরও এর বড় কিছু ত্রুটি রয়েছে। এ তত্ত্বে ধ্রুবকের দীর্ঘ একটি তালিকা রয়েছে। তত্ত্বটির কোনো সূত্র উল্লেখ করার সময় আমাদের অবশ্যই এসব ধ্রুবকের মান নির্দিষ্ট করতে হয়। এসব ধ্রুবক কণাগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করে দেয়। তাদের মধ্যে কিছু ধ্রুবক বলে কোয়ার্ক ও লেপটন কণার ভর কত হবে, কিছু ধ্রুবক বলে বলগুলোর শক্তি কত হবে। এ রকম ২০টি ধ্রুবক নিয়ে গড়ে উঠেছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মান নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু তাদের মান ঠিক এ রকম কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে যদি একটা ক্যালকুলেটর বলে ভাবা হয়, তাহলে দেখা যাবে পাই বা অন্যান্য ধ্রুবকের মতো ক্যালকুলেটরের ডায়ালে সেগুলো আগেই সেট করা আছে। প্রতিবার প্রোগ্রাম রান করার সময় কোনো চিন্তাভাবনা না করে নির্দিষ্ট ধ্রুবকের ডায়াল টিপলেই হলো, কেল্লা ফতে! পদার্থবিদদের কাছে এটাই বিব্রতকর। কারণ, তাঁদের কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটাকে বলা হয় পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বড় সমস্যা। কাজেই কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ধ্রুবকগুলো কীভাবে নির্দিষ্ট হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করা দরকার। বিজ্ঞানীরা আশা করেন, ভবিষ্যতে একীভূত কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব হলে এর উত্তর জানা যাবে।

৬.

পঞ্চম সমস্যার জন্ম ১৯৩০-এর দশকে। সেটা প্রথম টের পেয়েছিলেন সুইস জ্যোতির্বিদ ফ্রিৎজ জুইকি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকে কোমা ক্লাস্টার গ্যালাক্সি নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছা ছিল, ৩২ কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোমা ক্লাস্টারে থাকা গ্যালাক্সিগুলোর গতিবেগ মেপে তাদের ভর নির্ণয় করা। সেটি করতে গিয়ে অদ্ভুত এক ব্যাপার খেয়াল করলেন জুইকি। দেখা গেল, গ্যালাক্সিতে থাকা নক্ষত্রগুলো যে গতিতে চললে গ্যালাক্সির চারপাশে স্থিতিশীলভাবে ঘুরতে পারবে, তার তুলনায় তাদের গতি অনেক গুণ বেশি। এই বেগে চললে আসলে গ্যালাক্সি থেকে নক্ষত্রগুলোর ছিটকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। এই গতিবেগ তখনই সম্ভব হতে পারে, যদি গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষীয় টান অনেক গুণ বেশি হয়, মানে গ্যালাক্সিগুলোর ভর অনেক অনেক বেশি হয়। কিন্তু গণনায় যে ভর পাওয়া গেল, তা প্রায় ৪০০ ভাগ কম। তাহলে বাকি ভরগুলো গেল কোথায়? এর বছরখানেক আগেও ঠিক একই ফল পেয়েছিলেন ডাচ বিজ্ঞানী জ্যান ওর্ট। তবে ওর্ট বুঝতে না পারলেও এখানে গভীর অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগালেন জুইকি। তিনি বুঝতে পারলেন, এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, যদি গ্যালাক্সিগুলোতে দৃশ্যমান ভরের চেয়ে আরও ৪০০ গুণ ভর অদৃশ্য থাকে। সেই অজানা-অদৃশ্য বস্তুদের তিনি নাম দিলেন ডার্ক ম্যাটার।

বিদেশি বলেই হয়তো মার্কিন বিজ্ঞানীরা জুইকির কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। এমনকি বৈপ্লবিক এ আবিষ্কারের কারণে হাসির খোরাক হলেন। এরপর ডার্ক ম্যাটারের কথা সরকারি দপ্তরের মতো লাল ফিতায় ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে রইল বহুকাল।

ত্রিশের দশক থেকে এ পর্যন্ত অজানা-অদৃশ্য এসব বস্তু ও শক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। তাতে আরও গভীর হয়েছে রহস্য। বেড়েছে আমাদের অজানার বোধ। কারণ, খুঁজে পাওয়া যায়নি ওই রহস্যময় বস্তু ও শক্তিগুলো।
আলবার্ট আইনস্টাইন

১৯৭০-এর দশকে বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এল কজন বিজ্ঞানীর গবেষণার কারণে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভেরা রুবিন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁদের গবেষণায় ডার্ক ম্যাটার রহস্য সমাধানের বদলে আরও ঘনীভূত হলো। অনেকবার চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেছে, মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ বস্তু আমরা দেখতে পাই, বাকি ৯৬ শতাংশ আমাদের কাছে অধরা। সেগুলো হলো ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। বাংলায় যাদের বলা হয় গুপ্তবস্তু আর গুপ্তশক্তি।

ত্রিশের দশক থেকে এ পর্যন্ত অজানা-অদৃশ্য এসব বস্তু ও শক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। তাতে আরও গভীর হয়েছে রহস্য। বেড়েছে আমাদের অজানার বোধ। কারণ, খুঁজে পাওয়া যায়নি ওই রহস্যময় বস্তু ও শক্তিগুলো। তাই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি এখন বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। অবশ্য এর প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে এখন অনেকটাই জানেন বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা হচ্ছে, অধরা এই বস্তু না থাকলে নক্ষত্র, ছায়াপথ গঠিত হতে পারত না। তা না হলে এই সৌরজগৎ, আমাদের প্রিয় পৃথিবী এবং আমাদের নিজেদের কোনো অস্তিত্ব থাকত না। তাই অদৃশ্য বলে ডার্ক ম্যাটারকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এসব কারণে অনেক দিন ধরে ডার্ক ম্যাটারের হদিস জানতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা।

কাজেই পঞ্চম সমস্যাটি হলো, গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তিকে ব্যাখ্যা করা। তাদের অস্তিত্ব যদি সত্যিই থাকে, তাহলে আমাদের নির্ধারণ করতে হবে, কেন এবং কীভাবে মহাকর্ষ বড় পরিসরে দুর্বল হয়ে যায়।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এই পাঁচ সমস্যাকে বলা যায় আমাদের বর্তমান জ্ঞানের সীমানা। অনেক পদার্থবিদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই সমস্যাগুলো। আগেই বলেছি, এখন যদি কেউ দাবি করেন যে তিনি নতুন একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, তাহলে তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বটি এ পাঁচ সমস্যার সমাধান করতে পারতে হবে। তাহলেই সেটা সঠিক তত্ত্ব হিসেবে ছাড়পত্র পাবে। কাজেই কিছুদিন পরপর যাঁরা নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন বলে সাংবাদিকদের ডেকে সংবাদ সম্মেলন করেন, ঘোষণা দেওয়ার আগে তাঁদের একটু ভেবে দেখতে হবে, তাঁর তত্ত্ব এসব সমস্যা সমাধান করতে পারছে কি না। পারলে তো কথাই নেই! সবকিছুর তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য শুধু নোবেল পুরস্কারই নয়, মহাবিশ্বের বিপুল রহস্যের সমাধানও অপেক্ষা করে আছে সামনে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: দ্য ট্রাবল উইথ ফিজিকস, লি স্মোলিন; উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন