পদার্থবিদ্যা
নিউক্লিয়ার বলের কাহন - ১
গুগল সার্চ, পাঠ্যবই বা জনপ্রিয় ধারার লেখায় পরমাণুর যে আকারটি দেখানো হয়, তা কতটা সঠিক? পরমাণুর ভেতরের কলকব্জা, এর আকার, রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়াস শনাক্ত করার সেই বিখ্যাত পরীক্ষা এবং এর মাধ্যমে নিউক্লিয়ার বলের সূত্রপাত—তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আরশাদ মোমেনের সঙ্গে চলুন, পরমাণুর গহিনে যাত্রা করা যাক।
আমরা বরাবরই শুনে এসেছি, মহাবিশ্বে মৌলিক বলের সংখ্যা চারটি। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় আর দুই ধরনের নিউক্লীয় বল, যাদের আমরা সবল আর দুর্বল নাম দিয়ে দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করি। প্রথম দুটি বলের সঙ্গে আমরা ঐতিহাসিকভাবেই পরিচিত, বিশেষত নিউটন আর ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের কল্যাণে।
অন্যদিকে বাকি দুটি বলের উপস্থিতি বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে পরমাণুর গঠন জানতে হয়েছিল। রসায়নবিদেরা পরমাণুর ধারণা নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেও এর গঠনের সপক্ষে পরীক্ষা–নিরীক্ষা থেকে পাওয়া কোনো মোক্ষম তথ্য দিতে পারছিলেন না। এর জন্য আমাদের সবার আগে ইলেকট্রন যে একটি চার্জবিশিষ্ট মৌলিক কণা, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। এটি ছিল পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞানী টমসনের সাফল্য। এই কণা যেসব মৌলের ভেতর আছে, তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁকে বেশ বুদ্ধি খাটাতে হয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, ইলেকট্রনের রশ্মি (যা ক্যাথোড রে বা রশ্মি হিসেবে আগেই পরিচিত ছিল) বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছিলেন, কিন্তু তাঁরা একে এক্স-রে বা আলোর মতো নতুন কিছু বলে চিন্তা করতে আগ্রহী ছিলেন। টমসন এই রশ্মির ওপর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব খাটিয়ে দেখালেন, এতে ভরবিশিষ্ট কণা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর পাওয়া ডেটার বিশেষত্ব ছিল, এই কণার চার্জ ও ভরের অনুপাত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং এর মান কোন উৎস থেকে এই ক্যাথোড রশ্মি বেরোচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে না। এভাবে টমসন সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, এই কণা সব মৌলের মধ্যেই আছে। অতএব এটি একটি মৌলিক কণা।
এখানে যে জিনিসটা আমাদের লক্ষ করা উচিত, তা হলো এখানে টমসন কোনো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করেননি; বরং সেই সময়ে যা জানা ছিল, তারই বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার তিনি করেছিলেন। এ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ভালো বিজ্ঞান করার জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি আমাদের সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। শুধু তথ্যের সমাহার করলেই বিজ্ঞান হয় না, তথ্যের মধ্যে যোগসূত্র বের করার দায়িত্বও বিজ্ঞানীদের ঘাড়ে বর্তায়। এটাই বিজ্ঞানের মূল কাজ।
যা-ই হোক, এই গল্পের এটা সবে শুরু। পরমাণুর গঠন বুঝতে পারা তখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়াল। আর পরমাণু যে অবিভাজ্য, এই ধারণার মৃত্যু ঘটল। আমাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতা বলে, পরমাণু সামষ্টিকভাবে চার্জশূন্য, তাই ইলেকট্রন ছাড়াও পরমাণুর মধ্যে বিপরীত চার্জবিশিষ্ট ‘কিছু’ একটা থাকা প্রয়োজন। সেটা কী, তা বের করার উদ্দেশ্য নিয়ে রাদারফোর্ড (তাঁর ব্যাপারে আগেও এখানে লিখেছি) আলফা কণা—যা রেডিয়ামের মতো ভারী তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে বের হয়, সোনার পাতলা পাতের দিকে তাক করলেন। টমসনের ধারণা ছিল, পরমাণু বোধ হয় আস্ত একটা বেলের মতো (বাইরের খোসা বাদে)। ইলেকট্রনগুলো বেলের বীজের মতো ভেতরে ছড়ানো–ছিটানো আছে। এখানে বলে রাখা ভালো, রাদারফোর্ড নিজে বসে বসে পরীক্ষাটি করেননি; বরং তাঁর জুনিয়র সহকর্মী গাইগার ও মার্সডেন পরীক্ষাটি করেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার আইডিয়া ও মূল ডিজাইন রাদারফোর্ডেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে কার কৃতিত্ব কতটুকু, তা বিচারে না গিয়ে তাঁদের ফলাফলে কী জানা গেল, সেটাই মুখ্য। তা হলো পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি; যার মধ্যে পরমাণুর ভরের ৯৫ শতাংশের বেশি এবং ধনাত্মক চার্জের সবটাই অবস্থান করে। কিন্তু এর পাশাপাশি যে উপলব্ধি বিজ্ঞানীদের হলো—নিউক্লিয়াসের আকার অত্যন্ত ক্ষুদ্র, পরমাণুর তুলনায় প্রায় ১০ লাখ ভাগ ছোট! আমাদের আঁকা বেশির ভাগ চিত্রই নিউক্লিয়াসে আকারের ওপর যে সুবিচার করে না, তা গুগলে ‘অ্যাটম পিকচার’ (Atom picture) লিখে সার্চ দিলেই প্রতীয়মান হয়। আমার করা সার্চে যে ছবিটা সবার আগে উঠে এল, তা এখানে যোগ করলাম।
শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ করে আঁকা এই ছবিতে মোটাদাগে আকারগত দুটি ধারণা ঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। ১. ইলেকট্রনকে গোলকের মতো করে দেখানো হয়েছে, যার একটা আকার রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে ইলেকট্রনের কোনো আকার-আয়তন ধরা পড়েনি। ইলেকট্রনকে বিন্দুসম দেখানোই যথাযথ হতো। ২. নিউক্লিয়াসের আকারও ইলেকট্রনের তুলনাগতভাবে অত্যন্ত বড় দেখানো হয়েছে।
এদের অনুপাত শুধু ১০ লাখ ভাগ বললে বোধ হয় আমরা ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারব না। তাই একটি তুলনা দিই। যদি নিউক্লিয়াসের ব্যাস হয় ১ সেন্টিমিটার (একটি মোটরদানার সমান), তাহলে পরমাণুর ব্যাস হবে ১০৪ মিটার বা ১০ কিলোমিটার! অথচ এত ক্ষুদ্র জায়গার মধ্যেই পরমাণুর সব ভর রয়েছে। তার মানে আমরা সাদা চোখে যে পদার্থ দেখি, তার বেশির ভাগই ফাঁকা। আর যদি আমরা এই নিউক্লিয়াসকে ‘দেখতে’ চাই, তাহলে ১০ কিলোমিটার দূরত্ব থেকে ১ সেন্টিমিটার আকারের কোনো বস্তুকে আলো বা আলোসদৃশ কিছু দিয়ে আঘাত করতে হবে। একজন অলিম্পিক শুটিংয়ে পদকজয়ীর পক্ষেও এটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ হবে।
রাদারফোর্ডের গবেষণা দল যে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করতে পেরেছিল, সেটা একটা সৌভাগ্য বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ, তারা পরমাণুর ভেতরটা দেখার জন্য সে সময় সর্বোচ্চ পাওয়া কণা, তথা আলফা কণার রশ্মি ব্যবহার করেছিল। কী চিন্তাধারা থেকে রাদারফোর্ড এই পরীক্ষা করার চিন্তা করেছিলেন, তা এত দিন পর আমাদের সঠিকভাবে হলফ করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি বিজ্ঞানীদের স্বভাবজাত কৌতূহল থেকেই এই কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পদার্থবিজ্ঞানে রিডাকশনিজম (Reductionism) বলে একটা ধারা চালু আছে। গালভরা একটা নাম হলেও ব্যাপারটা অনেকটা সোজা। এর মোদ্দাকথা হলো, কোনো মেশিন বা যন্ত্র কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে হলে এই ধারায় আমাদের করণীয় হবে প্রথমে মেশিনের পার্টস বা বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করা এবং তারপর প্রতিটি অংশ কীভাবে কাজ করে, তা জানা। সর্বশেষ বিভিন্ন অংশের মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে, তা বের করা। এই চিন্তাধারায় আমরা বরাবরই অনেকটা কার্টুনের গদাধারী গুহামানবের মতো কাজ করি, অর্থাৎ নতুন কিছু সামনে এলেই আমরা হাতে থাকা সবচেয়ে ভারী গদা দিয়ে আঘাত করে ভেতরে কী আছে, তা জানতে চেষ্টা করি।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে রাদারফোর্ডের অনুসৃত পদ্ধতিটি এই রিডাকশনিজমেরই প্রতিফলন। আর তাঁর গবেষণা দল ওই সময়ের সবচেয়ে ভারী গদাই ব্যবহার করেছিল।
নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পর স্বভাবতই পরবর্তী প্রশ্ন দাঁড়াল, ‘নিউক্লিয়াস আবার কী দিয়ে তৈরি?’ এটার উত্তর পেতে অবশ্য বিজ্ঞানীরা বেশি কষ্ট করেননি। সবচেয়ে হালকা পরমাণুর নিউক্লিয়াস যা, সেটাকেও একটি মৌলিক কণার আসনে বসিয়ে দিলেন, নাম দেওয়া হলো প্রোটন। স্বভাবতই এই প্রোটন দিয়ে সব নিউক্লিয়াস তৈরি, এ ধারণাই সামনে আসা শুরু হলো।
সমস্যা হলো, প্রোটনের তো বৈদ্যুতিক চার্জ রয়ে গেছে—সবার চার্জও একই, তাদের মধ্যে বিকর্ষণ বল বিদ্যমান। নিউক্লিয়াসের মধ্যে সব প্রোটন একসঙ্গে থাকে কী করে? তার মানে নিশ্চয়ই আরও শক্তিশালী কোনো আকর্ষণ বল নিউক্লিয়াসের মধ্যে রয়েছে, যা এর পেছনে দায়ী। মোটাদাগে, এভাবেই নিউক্লিয়ার বল আমাদের চিন্তাধারার মঞ্চে অনুপ্রবেশ করল। কিন্তু এই নাটকের মধ্যে আরও চড়াই–উতরাই সামনে রয়েছে। আমরা তার অপেক্ষায় থাকি, ঠিক আছে?