আইনস্টাইন, মহাকর্ষ তরঙ্গ ও লাইগো - ২

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র। জুলাই, ১৯৩৬ সাল।

নিজের ডেস্কে বসে আছেন আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আলবার্ট আইনস্টাইন। ডেস্কের উল্টো পাশে বসেছেন লিওপোল্ড ইনফেল্ড। আইনস্টাইনের সহকারী। জাতে পোলিশ। টেবিলের ওপর রাজ্যের কাগজপত্রের স্তূপ। সে কারণে তার চেহারা আংশিক নজরে পড়ছে। স্তূপের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধে৵।

কী ভেবে যেন ১০ মিনিট ধরে একনাগাড়ে আইনস্টাইনের কাছে হাওয়ার্ড পার্সি রবার্টসনের স্তুতি গাইছেন ইনফেল্ড। সম্প্রতি দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে ক্যালটেক থেকে প্রিন্সটনে ফিরেছেন তিনি। সেখানে রবার্টসনের সঙ্গে তাঁর খাতির বেশ গাঢ় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

এই তো কদিন আগে দুজন লনে একসঙ্গে হাঁটছিলেন। নিজের অফিসের জানালা দিয়ে সে দৃশ্য দেখেছেন আইনস্টাইন। জুলাইয়ে রোদে তাঁদের আলোচনাটা বেশ প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল। রবার্টসন কিছুক্ষণ বিরতিতে পাইপ টানছিলেন, হাতে ধরা ব্রিফকেস দোলাচ্ছিলেন। একসময় প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির নিকানো ড্রাইভওয়ে ছেড়ে রবার্টসনকে চলে যেতেও দেখেন আইনস্টাইন।

এই হাওয়ার্ড পার্সি রবার্টসনকে খুব ভালোমতোই চেনেন আইনস্টাইন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী প্রফেসর তিনি। গত বছর আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ব্যবহার করে মহাবিশ্বের বস্তু সম্পর্কে কিছু বিশ্বাসযোগ্য অনুমান করেন রবার্টসন। এ থেকে একটা মহাজাগতিক সমাধানও বের করে আনেন। ১৯২৯ সালে জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবলের আবিষ্কৃত প্রসারণশীল মহাবিশ্বকে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল তাঁর এই সমাধানের মাধ্যমে।

ডেস্কের কাগজপত্রের স্তূপের কারণে উল্টো পাশে বসা আইনস্টাইনের মুখ মাঝেমধে৵ হারিয়ে ফেলছিলেন ইনফেল্ড। বসের মনোভাব বুঝতে তাঁকে কিছুক্ষণ পরপর একবার বাঁয়ে, একবার ডানে ঝুঁকতে হচ্ছিল। বেশ কিছুদিন আগে নিজের সাবেক সহকারী নাথান রোজেনের সঙ্গে মহাকর্ষ তরঙ্গ বিষয়ে একটা পেপার লিখেছেন আইনস্টাইন। ইনফেল্ড বললেন, ওই পেপারটার কথা রবার্টসন জানেন। রবার্টসন নাকি পেপারটাতে একটা ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু সে কথাটা বসকে বলা ঠিক হবে কি না, তা একবার ভাবলেন তিনি। কারণ, রাশভারী আইনস্টাইন বিষয়টা কীভাবে নেবেন বোঝা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কথাটা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাতে একটু নার্ভাস হয়ে পড়লেন ইনফেল্ড। তবে তাঁর আসলে দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। কারণ, কথাটা শুনে আইনস্টাইন বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, কয়েক দিন আগে ওই ত্রুটিটা আমার চোখেও পড়েছে।’

আরও পড়ুন
বাস্তবতা হলো, আইনস্টাইন দেখলেন, মহাকর্ষ দুর্বল হলেই কেবল তার তত্ত্বে মহাকর্ষ তরঙ্গের দেখা মেলে। কিন্তু মহাকর্ষ শক্তিশালী হলে, সে তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বিষয়টা একসময় তার কাছে মরীচিকার মতো মনে হয়েছিল

আরও কিছু কথার পর আইনস্টাইনের অফিসকক্ষ ছেড়ে চলে গেলেন ইনফেল্ড। তিনি বেরিয়ে যেতেই ডেস্কে একগাদা কাগজের স্তূপের দিকে কিছুক্ষণ অনুসন্ধানী চোখে তাকালেন আইনস্টাইন। এই স্তূপের ভেতরেই মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে নাথানের সঙ্গে লেখা সেই পাণ্ডুলিপিটা থাকার কথা। সেটার খোঁজে হাত চালালেন তিনি। না, হারায়নি। স্তূপ থেকে বের করে আনলেন পেপারটা।

সেটা আবারও আগাগোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন আপেক্ষিকতার জনক। মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে কাজ শুরুর আগেই বিষয়টা বেশ জটিল বলে মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। কিন্তু বিষয়টা যে এত জটিল হবে, তা ভাবতেও পারেননি তিনি। ১৯১৬ সালে নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রকাশ করে বেশ হইচই ফেলে দেন তিনি। তারই গালভারী নাম আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। এটা প্রকাশের কয়েক মাস পর স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, স্থান-কালেও আলোড়ন তোলা সম্ভব। সেটা করতে পারলে, এমন ঢেউয়ের সৃষ্টি হবে, যা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে আলোর বেগে। এটাই মহাকর্ষ তরঙ্গ। বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ভেতর যে রকম তরঙ্গ ঢেউ খেলে যায়, তার সঙ্গে এই মহাকর্ষ তরঙ্গের বেশ মিল আছে। ১৮৬২ সালে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্রের এই ঢেউকে আলো হিসেবে শনাক্ত করেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।

তবে নিজের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী বের করে আনা অসম্ভব মনে হলো আইনস্টাইনের কাছে। যেকোনো শক্তির বিন্যাসে মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে ব্যাখ্যা করতে নিউটনের সমীকরণ হটিয়ে দেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, নিউটনের একটা মাত্র সমীকরণের বিপরীতে তিনি আমদানি করেন একটা নয়, দশটা সমীকরণ। তবে অনেক খেটেখুটে কেটেছেঁটে দশটা সমীকরণ থেকে কমিয়ে একটা সমীকরণে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন তিনি। সেটা বেশ বশ মানানোর মতো মনে হলো তার কাছে। কিন্তু এই সমীকরণ থেকে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মতো একটা তরঙ্গ সমীকরণ বেরিয়ে এল। সে কারণে আইনস্টাইনের দৃঢ় বিশ্বাস দাঁড়াল, মহাকর্ষ তরঙ্গ অবশ্যই আছে।

বাস্তবতা হলো, আইনস্টাইন দেখলেন, মহাকর্ষ দুর্বল হলেই কেবল তার তত্ত্বে মহাকর্ষ তরঙ্গের দেখা মেলে। কিন্তু মহাকর্ষ শক্তিশালী হলে, সে তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বিষয়টা একসময় তার কাছে মরীচিকার মতো মনে হয়েছিল। তত্ত্বটার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো। আবার তার তত্ত্বটা এতই জটিল যে তার অর্ন্তজ্ঞানও সেখানে কাজ করল না। তারপরও মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব যে সত্যিই আছে, সেটা প্রমাণের ইচ্ছা দুই দশক ধরে বুকের মধ্যে পুষে রেখেছেন আইনস্টাইন।

২৩ জুলাই ফিজিক্যাল রিভিউর সম্পাদকের কাছ থেকে তাঁর লেখা পেপারটা ফেরত এল। সঙ্গে সম্পাদক জন ট্যাটের লেখা একটা চিঠি। ওটার বক্তব্য পরিষ্কার। তাতে বলা হয়েছে, আইনস্টাইন ও নাথানের লেখা পেপারটা এক রেফারির কাছে পাঠানো হয়েছিল।

জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর নিজের জন্মভূমি জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। পালিয়ে আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর যোগ দেন দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রিন্সটন ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে। এখানে আসার পর সেই পুরোনো চিন্তাটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাই আবারও মহাকর্ষ তরঙ্গ আছে কি নেই, তা নিয়ে গাণিতিক হিসাব করার চিন্তা করেন আইনস্টাইন।

যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রথম ছাত্র নাথান রোজেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই এ–সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন। একসময় একটা সমীকরণে মহাকর্ষ তরঙ্গের সমাধানের দেখা পান তিনি। সেটা বড় একটা সাফল্য হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাতে একটা সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুর দেখা মেলে। আর পরম বিন্দু এমন একটা জায়গা, যেখানে সে তরঙ্গের ব্যাখ্যা অসীমের দিকে উড়ে চলে যায়। তাতে আর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। কাজেই আইনস্টাইন একপ্রকার ধরেই নিয়েছেন, তিনি ও নাথান মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রমাণের যে চেষ্টা করেছেন, তার মাধ্যমে আসলে শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে এ তরঙ্গের কোনো অস্তিত্বই নেই!

এতে হতাশ হননি আইনস্টাইন। এই গাণিতিক ফলাফলটাই সাদরে গ্রহণ করেছেন তিনি। অন্যান্য সব ক্ষেত্র, যেমন বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্র, বাতাস, পানি ইত্যাদি তরঙ্গের মাধ্যমে আলোড়িত হয়। কিন্তু মহাকর্ষ ক্ষেত্র ওভাবে আলোড়িত হতে পারে না বলে ধরে নেন তিনি। এরপর জার্মানিতে তার বন্ধু কোয়ান্টাম বিপ্লবের অগ্রদূতদের অন্যতম ম্যাক্স বর্নকে চিঠিতে লেখেন, ‘তরুণ এক সহযোগীর সঙ্গে একটা লক্ষণীয় ফলাফলে পৌঁছেছি। সেটা হলো, মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব নেই।’ কিছুদিন পর নাথান রোজেনকে নিয়ে একটা পেপার লিখে ফেললেন। শিরোনাম: ডু গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস এক্সিস্ট? (মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব কি আছে?) মার্কিন জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ-এ ১৯৩৬ সালের মে মাসে পাঠিয়ে দিলেন সেটা। ঝামেলা দূর হয়েছে ভেবে কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন আইনস্টাইন।

কিন্তু দুই মাস পর, ভীষণ অবাক হন তিনি। ২৩ জুলাই ফিজিক্যাল রিভিউর সম্পাদকের কাছ থেকে তাঁর লেখা পেপারটা ফেরত এল। সঙ্গে সম্পাদক জন ট্যাটের লেখা একটা চিঠি। ওটার বক্তব্য পরিষ্কার। তাতে বলা হয়েছে, আইনস্টাইন ও নাথানের লেখা পেপারটা এক রেফারির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তিনি পেপারটি পরীক্ষা করে তাতে গাণিতিক হিসাবে একটা ভুল খুঁজে পেয়েছেন।

সেকালে ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালের রেফারি হতেন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী, গবেষকেরা। কিন্তু তাঁদের নাম কখনো প্রকাশ করা হতো না। সে রকম এক অজ্ঞাতনামা রেফরি দাবি করেছেন, আইনস্টাইন ও নাথান যে সমস্যাসংকুল অসীমকে মহাকর্ষ তরঙ্গ না থাকার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেই অসীম আসলে তাদের গাণিতিক ভুলের কারণে দেখা দিয়েছে। সেটা সহজেই দূর করা সম্ভব। জন ট্যাট আরও লিখেছেন, রেফারির মন্তব্য ও সমালোচনার প্রতি আইনস্টাইন সাড়া দিলে তিনি খুশি হবেন।

এককালে জার্মানির কোনো জার্নালে আইনস্টাইন যা–ই পাঠাতেন, তা-ই কোনো প্রশ্ন না তুলে ছাপা হয়ে যেত। তেমনই একটা জার্নাল ছিল অ্যানালেন ডার ফিজিক। একসময় যার সম্পাদক ছিলেন কোয়ান্টম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

হ্যাঁ, তা বেশ ভালো সাড়া দিলেন আইনস্টাইন। অজ্ঞাতনামা রেফারির কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। মনে মনে ভীষণ রেগে গেলেন। তত দিনে প্রিন্সটন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক একাডেমিক পোস্টে চলে গেছেন নাথান রোজেন। তাই নিজের শিক্ষকের রাগ-ক্ষোভ থেকে রেহাই পেলেন তিনি।

এককালে জার্মানির কোনো জার্নালে আইনস্টাইন যা–ই পাঠাতেন, তা-ই কোনো প্রশ্ন না তুলে ছাপা হয়ে যেত। তেমনই একটা জার্নাল ছিল অ্যানালেন ডার ফিজিক। একসময় যার সম্পাদক ছিলেন কোয়ান্টম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। ১৯০৫ সালে এই বিখ্যাত জার্নালে পাঁচটি পেপার লিখে গোটা পদার্থবিজ্ঞান জগৎকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তিনি যদি হিসেবে কোনো ভুলও করে থাকেন, তাহলে ওই ভুলটা চিহ্নিত করে একটা ফলোআপ পেপার কেউ না কেউ প্রকাশ করত। এভাবেই বিজ্ঞান চর্চা করা হতো জার্মানিতে। এ নিয়মে অভ্যস্ত ছিলেন আইনস্টাইন। তাই ফিজিক্যাল রিভিউর মতো একটা মার্কিন জার্নাল আইনস্টাইনের লেখা পেপার বাতিল করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। সম্পাদককে একটা কড়া চিঠি লেখা দরকার বলে মনে করলেন আইনস্টাইন। কাগজ–কলম টেনে নিয়ে জন ট্যাটকে চিঠি লিখতে বসলেন। হুল বিঁধানো সে চিঠির ভাষ্য:

নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন আইনস্টাইন। ফিজিক্যাল রিভিউর পিয়ার রিভিউয়ের ঝামেলায় বিরক্ত হয়ে আগের পরিচিত ছোট্ট এক প্রকাশনীতে পেপারটা পাঠানোর কথা ভাবলেন। সেটি জার্নাল অব ফ্রাংকলিন ইনস্টিটিউট। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, রবার্টসনের সঙ্গে ইনফেল্ডের সাম্প্রতিক আলাপের প্রসঙ্গটা শুনেছিলেন তিনি। সেটা আমলেও নিলেন। ইনফেল্ডের মুখে রবার্টসনের সন্দেহের কথা শুনে কী ভেবে পেপারটা আরেকবার যাচাই করার কথা ভাবলেন আইনস্টাইন। সেটা না করলে ভুলটা সংশোধনের কোনো সুযোগই পেতেন না।

তার সমীকরণের মূল বিষয় ছিল, মহাকর্ষক্ষেত্র সর্বজনীন বা কো–ভেরিয়েন্ট। মহাবিশ্বের প্রত্যেকেই অবশ্যই একই পদার্থবিজ্ঞান দেখবে। কারও সুবিধাজনক অবস্থানের ওপর এটি নির্ভর করা উচিত নয়। তাত্ত্বিকভাবে একে বলা হয় কো-অর্ডিনেট সিস্টেম। এর আরেকটা দিক হলো, একটা কো-অর্ডিনেট সিস্টেমে যদি কোনো গণনা কঠিন বা অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়, আর আরেকটা কো-অর্ডিনেট সিস্টেমে যদি গণনা করা সহজ হয়, তাহলে প্রয়োজনে সহজটা বেছে নেওয়া যাবে। ইনফেল্ডের মাধ্যমে আইনস্টাইনকে ঠিক এই বার্তাটাই দিতে চেয়েছিলেন রবার্টসন। ঠিক এ কাজটা করাই বাকি ছিল আইনস্টাইনের।

কাকতালীয় ব্যাপার হলো, এর আগে একই পন্থা অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালের অজ্ঞাতনামা সেই রেফারিও। কিন্তু তখন আসলে রাগে-ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তাই বিষয়টা তার নজরে পড়েনি। কিন্তু ইনফেল্ডের মুখে রবার্টসনের কথা শুনে নিজের ভুলটা চোখে পড়ল আইনস্টাইনের। এবার রাগ বা ক্ষোভের বদলে খুশি হয়ে উঠলেন তিনি।

আরও পড়ুন
সংশোধিত পেপারটা নিয়ে তাঁর দীর্ঘকালীন সেক্রেটারি হেলেন ডুকাসের কাছে গেলেন। জার্মানি থেকে আইনস্টাইনের সঙ্গে চলে এসেছে এই মেয়েটি। তাকে টাইপরাইটারে নতুন করে পেপারটা লিখতে দিয়ে নিজের অফিস রুমে ফিরে গেলেন আইনস্টাইন।

নিজের অফিসে বসে ঘণ্টাখানেক নিজের লেখা পেপারে বুঁদ হয়ে রইলেন আইনস্টাইন। পেপারটার মার্জিনে খসখস করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে লাগলেন। একসময় কাজ শেষ হলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাঁপ ছাড়লেন তিনি। তারপর আবারও গভীর চিন্তায় মজে গেলেন। নতুন হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। তাহলে তার আগের ধারণাটাই সঠিক। পেপারটায় আগে লেখা শিরোনামটা কলমের খোঁচার একটানে কেটে দিলেন আইনস্টাইন। এখন একটা নতুন শিরোনাম দরকার। খুব বেশি ভাবতে হলো না। তিনি নতুন শিরোনাম লিখতে লাগলেন, ‘ডু গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস এক্সিস্ট?’ ‘মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব কি আছে?’

মহাকর্ষ তরঙ্গ বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তে আসার পেছনে তার দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রার কথাটা মনে পড়ল তাঁর। ১৯১৬ সালে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে থাকার সময় তিনি একবার মনে মনে অনেকটাই নিশ্চিত হন যে মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এরপরের দুই দশক পর্যন্ত বিষয়টা সম্পর্কে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। এটাই তাঁর মনের ভেতর কাঁটার মতো খচখচ করেছে অনেক দিন। ১৯৩৬ সালে একগাদা গাণিতিক হিসাব-নিকাশের পর তিনি এবং নাথান রোজেন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বসলেন যে মহাকর্ষ তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর এখন শেষ পর্যন্ত তিনি একেবারে নিশ্চিত হতে পেরেছেন, এটা থাকতেই হবে। ১৯১৮ সালে তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন, দুটি নক্ষত্র যদি পরস্পরকে সর্পিলভাবে পাক খেতে খেতে একত্র হয়ে সংঘর্ষের মুখে পড়ে তবেই এ রকম মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হতে পারে। তবে সেটা এতই দুর্বল হবে যে তা বাস্তবে শনাক্ত করা অসম্ভব।

সংশোধিত পেপারটা নিয়ে তাঁর দীর্ঘকালীন সেক্রেটারি হেলেন ডুকাসের কাছে গেলেন। জার্মানি থেকে আইনস্টাইনের সঙ্গে চলে এসেছে এই মেয়েটি। তাকে টাইপরাইটারে নতুন করে পেপারটা লিখতে দিয়ে নিজের অফিস রুমে ফিরে গেলেন আইনস্টাইন। এবার জার্নাল অব ফ্রাংকলিন ইনস্টিটিউট-এর সম্পাদকের কাছে একটা কভার লেটার লিখতে শুরু করলেন। সেদিন বিকেলে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেটা হেলেনকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।

প্রিন্সটনের ওন্ডেন লেন ধরে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথে একটা বুলডোজার পাশ কাটালেন। চারদিকে বিকেলের মরা রোদ। মার্সেল স্ট্রিটের ১১২ নম্বরে নিজের বাসভবনের দিকে এগোলেন আইনস্টাইন। ডান দিকে মোড় নিলেন এবার। এমন সময় একটু দূরে মার্কোয়ার্ড পার্কে একটা ছায়ামূর্তি চোখে পড়ল। ছায়ামূর্তিটা রাস্তা পার থেকে স্প্রিংডেল রোডে অদৃশ্য হয়ে গেল। মুখে ধূমায়িত পাইপ দেখে ঠিকই চিনতে পারলেন আইনস্টাইন। অধ্যাপক হাওয়ার্ড রবার্টসন। বিদ্যুৎ–চমকের মতো একটি চিন্তা খেলে গেল আইনস্টাইনের মাথায়। ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালের অজ্ঞাতনামা সেই রেফারি আর এই লোকটার পরামর্শ অদ্ভুত রকমভাবে একই। ব্যাপারটা কি কাকতালীয়! নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে!

অবশ্য চিন্তাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ঘটনা যা–ই হোক, কীভাবে বা কোনো কারণে সেটা সংশোধন করতে হলো, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রোজেনের সঙ্গে লেখা পেপারটা শেষ পর্যন্ত সংশোধন করতে পেরেছেন তিনি। এখন আইনস্টাইন শত ভাগ নিশ্চিত, মহাকর্ষ তরঙ্গ অবশ্যই থাকতে হবে।

চলবে...

সূত্র:

১. ব্রায়ান ক্লেগ, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ: হাউ আইনস্টাইন’স স্পেসটাইম রিপলস রিভিল দ্য সিক্রেট অব দ্য ইউনিভার্স, আইকন বুকস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২০১৮

২. ক্লিফোর্ড এম. উইল এবং নিকোলাস ইউনেস, ইজ আইনস্টাইন স্টিল রাইট, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, যুক্তরাজ্য, ২০২০

৩. জেড জেড. বাকওয়াল্ড (সম্পাদনা), আইনস্টাইন ওয়াজ রাইট: দ্য সায়েন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি অব গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, যুক্তরাষ্ট্র, ২০২০

৪. হ্যারি কলিন্স, গ্র্যাভিটি’স কিস: দ্য ডিটেকশন অব গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস, এমআইটি প্রেস, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৭

৫. মিচিও কাকু, প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস, পেঙ্গুইন, যুক্তরাজ্য, ২০০৬

৬. উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত