নিউটন থেকে ম্যাক্সওয়েল: যেভাবে বদলে গেল পদার্থবিজ্ঞান

মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিচিও কাকু বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক হিসেবে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় নাম। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ পাঠকের উপযোগী বেশ কিছু জনপ্রিয় ধারার বই লিখেছেন তিনি। সহজ-সরল উপস্থাপনা ও গল্প বলিয়ের মতো ঢঙের কারণে সেগুলো বিশ্বব্যাপী বহুল পঠিত। তাঁর লেখা তেমনই একটি জনপ্রিয় বই আইনস্টাইন’স কসমস। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এ বই মূলত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক জীবনের বয়ান। সেই সঙ্গে আইনস্টাইনের সেরা আবিষ্কার ও বিশ শতকের বিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ের অনুবাদ প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য। আইনস্টাইনের আগে নিউটনের পদার্থবিজ্ঞান ও ম্যাক্সওয়েলের বিপ্লবের কথা উঠে এসেছে এ লেখায়।

আইজ্যাক নিউটনের পর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিনিয়াস বিজ্ঞানী হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। একবার এক সাংবাদিক তাঁকে নিজের সাফল্যের সূত্র ব্যাখ্যা করতে বলেছিল। মহান এই চিন্তাবিদ এক সেকেন্ড ভেবে উত্তর দিলেন, ‘সাফল্য যদি A হয়, তাহলে আমার সূত্রটি হল A = X+Y+Z। এখানে X হলো কাজ আর Y মানে খেলাধুলা।’

তাহলে Z-এর মানে কী?’ সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন।

‘মুখটা বন্ধ রাখা।’ জবাব দিলেন আইনস্টাইন।

বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য কাজ করেছেন তিনি। অনুসন্ধান করেছেন মহাবিশ্বের অপার রহস্য। কিন্তু পদার্থবিদ, রাজা ও রানি আর জনগণ তাঁর যে গুণগুলো পছন্দ করতেন, সেটা তাঁর মানবতা, উদারতা ও রসিকতা।

পদার্থবিজ্ঞানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই বুড়ো মানুষটিকে প্রিন্সটনের রাস্তায় হাঁটতে দেখলে শিশুরাও ভিড় জমাত। বিনিময়ে তাদের প্রশ্রয় দিতে তাদের দিকে কান পাততেন তিনি। বিশেষ করে পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন আইনস্টাইন। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির দিকে হাঁটতে হাঁটতে এই মহান চিন্তাবিদের সঙ্গ পেত ছেলেটি। একদিন তারা পায়চারি করছিল। হুট করে হো হো হাসিতে ফেটে পড়লেন আইনস্টাইন। ছেলেটিকে তার মা জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে কথা বলছে তারা। জবাবে ছেলেটি বলল, ‘আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করেছি, আজ তিনি বাথরুম করেছেন কি না।’ কথা শুনে আতঙ্কিত হলেন সেই মা। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, ‘আমি খুশিই হয়েছি। কারণ অন্তত কেউ একজন আমাকে এমন একটা প্রশ্ন করেছে, যার উত্তরটা আমি দিতে পারি।’

পদার্থবিদ জেরেমি বার্নস্টেইন একবার বলেছেন, ‘আইনস্টাইনের সাথে যাদের সত্যিকার যোগাযোগ হতো, তারা ফিরে আসত মানুষটির মহত্বের প্রবল অনুভূতি নিয়ে। তাঁর বেলায় যে শব্দগুচ্ছটি বারবার বলা হতো, সেটি তাঁর ‘মানবতা’... তাঁর চরিত্রের সরল, প্রেমময় বৈশিষ্ট্য।’

জেরেমি বার্নস্টেইন
ছবি: সংগৃহীত

ভিক্ষুক, শিশু আর রাজক্ষমতা—সবার প্রতি সমান সদয় ছিলেন আইনস্টাইন। আবার বিজ্ঞানের সম্মানজনক মন্দিরে তাঁর পূর্বসূরীদের কাছেও ছিলেন অকৃপণ। অন্যসব সৃষ্টিশীল ব্যক্তির মতো বিজ্ঞানীরাও তাঁদের প্রতিপক্ষের প্রতি ভয়াবহ ঈর্ষান্বিত হতে পারেন। এমনকি জড়িয়ে পড়েন তুমুল ঝগড়া-বিবাদেও। কিন্তু একজন প্রবর্তকের মতো তিনি যেসব আইডিয়ার জন্ম দিয়েছেন, সেগুলোর উৎস খুঁজে বের করতে পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রপথিকদের কাছে ফিরে গেছেন আইনস্টাইন। এর মধ্যে রয়েছেন আইজ্যাক নিউটন ও জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। এই বিজ্ঞানীদের ছবি তাঁর টেবিল ও দেয়ালে ঝুলতে দেখা যেত। আসলে বিশ শতকের সূচনালগ্নে বিজ্ঞানের দুটি স্তম্ভ গড়ে দিয়েছিল নিউটনের বলবিদ্যা ও মহাকর্ষ এবং ম্যাক্সওয়েলের আলো সম্পর্কিত কাজ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সেকালে ভৌত সব জ্ঞানের মোট সমষ্টির সিংহভাগই মূর্ত ছিল এই দুই পদার্থবিজ্ঞানীর অর্জনের মধ্যে।

গ্রিক দার্শনিক ও খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদরা লিখেছিল, বস্তু নড়াচড়া করে, কারণ তাদেরও মানুষের মতো ইচ্ছা ও আবেগ আছে।

নিউটনের আগে পৃথিবী ও মহাকাশের বস্তুদের গতি প্রায় পুরোপুরি অব্যাখ্যাত ছিল। অনেকে বিশ্বাস করত, আত্মা ও শয়তানের মাধ্যমেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। জাদুবিদ্যা, ডাকিনিবিদ্যা ও কুসংস্কার নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হতো ইউরোপের সবচেয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও। এখন আমরা বিজ্ঞানকে যেভাবে জানি, তখন তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

গ্রিক দার্শনিক ও খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদরা লিখেছিল, বস্তু নড়াচড়া করে, কারণ তাদেরও মানুষের মতো ইচ্ছা ও আবেগ আছে। অ্যারিস্টটলের অনুসারীদের কাছে বস্তুর গতি ক্রমান্বয়ে কমে আসার কারণ, সেগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আবার তারাই লিখেছিল, বস্তু মেঝেতে পড়ে যাওয়ার কারণ, সেগুলো মাটির সঙ্গে একত্রিত হতে আকুল হয়ে পড়ে।

আত্মার এই বিশৃঙ্খল বিশ্বের মধ্যে যে মানুষটি একদা শৃঙ্খলা আনবেন, এক অর্থে তিনি ছিলেন আইনস্টাইনের মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের দিকে দিয়ে পুরোপুরি উল্টো। আইনস্টাইন ছিলেন তাঁর সময়ের উদার মানুষ। আবার গণমাধ্যমকে খুশি করতে তিনি দ্রুত এক লাইনের বাণী দিতে পারতেন। বিপরীতে নিউটন ছিলেন ভয়ংকর অসামাজিক। তাঁর মানসিক বৈকল্যের প্রবণতা ছিল। অন্যের প্রতি ছিল প্রচণ্ড সন্দেহ বাতিক। কোনো কাজ অন্যের আগে করার প্রশ্নে অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তিক্ততা ও দীর্ঘ মেয়াদী দ্বন্দ্বও ছিল তাঁর। নিউটনের বাক সংযমও ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ১৬৮৯-৯০ সালের সেশনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর কথা বলার একটা মাত্র ঘটনার রেকর্ড পাওয়া যায়। ঘটনাটা হলো: একবার তিনি বাতাসের ঝাপটা অনুভব করেন। তখন এক নকীবকে জানালা বন্ধ করতে বলেছিলেন। জীবনীকার রিচার্ড এস ওয়েস্টফলের মতে, নিউটন ছিলেন, ‘নির্যাতিত মানুষ। একজন চরম বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি সবসময় দ্বিধাগ্রস্ত থাকতেন। বিশেষ করে মাঝবয়সে একেবারে ভাঙনের কিনারায় চলে যান তিনি।’

আইজ্যাক নিউটন
ছবি: সংগৃহীত

তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিউটন ও আইনস্টাইন হলেন সত্যিকারের কারিগর। তাঁদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে। দুজনই নিদিষ্ট কোনো বিষয়ে তীব্র মনোযোগে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস কাটাতেন। শারীরিক ক্লান্তিতে নিঃশেষ ও ভেঙে না পড়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকত। আবার মহাবিশ্বের গুপ্ত রহস্যগুলোর সরল চিত্র মনের চোখে দেখার ক্ষমতা ছিল দুজনেরই।

১৬৬৬ সালে নিউটনের বয়স ছিল তেইশ বছর। সে বছর বলের ওপর ভিত্তি করে নতুন এক বলবিদ্যার প্রবর্তন করেন তিনি। এর মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের বিশ্বে এতকাল আছর ফেলা আত্মাদের হটিয়ে দেন নিউটন। প্রস্তাব করেন গতির তিনটি সূত্র। এসব সূত্র অনুযায়ী, বস্তু চলাফেরা করার কারণ কোনো ফোর্স বা বল তাদের ধাক্কা দেয় কিংবা টানে। এই বলগুলো সরল সমীকরণের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে মাপা ও প্রকাশ করা সম্ভব হলো। ফলে, বস্তুর চলাফেরার পেছনে তাদের ইচ্ছা জড়িত থাকে—এরকম কোনো কল্পনার আর দরকার হলো না। তার বদলে নিউটন বস্তুর ওপর ক্রিয়াশীল বলগুলোকে যোগ করার মাধ্যমে পতনশীল পাতা, রকেট, কামানগোলা ও মেঘ থেকে শুরু করে সবকিছুর গতিপথ মাপতে পারলেন। সেটা ছিল নিছক একাডেমিক প্রশ্নের চেয়েও বেশি কিছু। কারণ এটাই তৎকালে শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি গড়তে সহায়তা করেছিল। এভাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শক্তিতে বিশালাকৃতির স্বয়ংক্রিয় যানবাহন ও জাহাজ চালানোর মাধ্যমে তৈরি হলো নতুন সাম্রাজ্য। সেতু, ড্যাম ও আকাশচুম্বী ইমারত নির্মাণ করা হতে লাগল ব্যাপক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। কারণ প্রতিটি ইট বা বিমের চাপ মাপা সম্ভব হলো। নিউটনের বল সম্পর্কিত তত্ত্বের বিজয় এত অসাধারণ ছিল যে নিজের জীবদ্দশায় বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। তাই তাঁর প্রশংসা করে অ্যালেকজান্ডার পোপ লিখতে বাধ্য হন:

Nature and Nature’s laws lay hid in night,

God said, Let Newton be! and all was light.

আলবার্ট আইনস্টাইন
ছবি: সংগৃহীত

নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রস্তাবের মাধ্যমে নিউটন তাঁর বলের তত্ত্বটি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন। এ সম্পর্কে একটা গল্প বলতে পছন্দ করতেন তিনি। গল্পটা হলো: প্লেগ মহামারীর কারণে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বাধ্য হয়ে লিংকনশায়ারের উলসথর্পে নিজের পারিবারিক খামারে ফিরে গেলেন তিনি। একদিন তাদের খামারের গাছ থেকে একটা আপেল মাটিতে পড়ে যেতে দেখেন নিউটন। এরপর নিজেকে সেই ভাগ্য নির্ধারণী প্রশ্নটা করলেন: একটা আপেল যদি নিচে পড়ে, তাহলে চাঁদও কি নিচে পড়ে যায়? পৃথিবীর কোনো আপেলের ওপর যে মহাকর্ষ বল কাজ করে, সেই একই বল কি মহাকাশের বস্তুগুলোর গতিও পরিচালনা করতে পারে? তাঁর চিন্তাটা ছিল প্রচলিত বিশ্বাসের একেবারে বিপরীত। কারণ, গ্রহগুলো স্থির গোলকের ওপর বসানো বলে সে কালে অনুমান করা হতো। সেগুলো নিখুঁত স্বর্গীয় আইন মেনে চলে বলে বিশ্বাস করত সবাই। অন্যদিকে পাপ ও পরিত্রাণের আইনগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হয় মানবজাতির পাপপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো।

আকস্মিক এক অন্তর্দৃষ্টিতে নিউটন বুঝতে পারলেন, পার্থিব এবং স্বর্গীয় বা মহাকাশের—দুই পদার্থবিজ্ঞানকে একটা মাত্র চিত্রে একত্রিত করতে পেরেছেন তিনি। যে বলটি একটা আপেলকে মাটির দিকে টানে, সেই একই বল অবশ্যই বাইরের চাঁদের কাছেও পৌঁছায় এবং তাকে পথ দেখায়। এভাবে তিনি মহাকর্ষের নতুন এক দুরদর্শিতায় এসে পৌঁছান।

একটা পাহাড়চূড়ায় বসে একটা পাথর ছোড়ার কথা কল্পনা করলেন তিনি। বুঝতে পারলেন, পাথরটা দ্রুত থেকে আরও দ্রুত ছুড়ে দেওয়া সম্ভব। এরপর ভাগ্য নির্ধারণী এক প্রশ্ন করলেন। পাথরটা যদি এত জোরে ছোড়া যায়, যাতে সেটা আর ফিরে আসতে পারবে না, তাহলে কী ঘটবে? তিনি বুঝতে পারলেন, কোনো পাথর মহাকর্ষের অধীনে ক্রমাগত নিচের দিকে পড়তে থাকলে সেটা ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানবে না। বরং পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকবে। একপর্যায়ে পাথরটা ওই ব্যক্তির কাছে ফিরে এসে তার মাথার পেছনে আঘাত হানবে। নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে পাথরটার জায়গায় খোদ চাঁদটাকে বসালেন। চাঁদও ক্রমাগত পতিত হচ্ছে বা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই পাথরটার মতো কখনো ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানছে না সেটা। বরং চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একটা বৃত্তাকার কক্ষপথে অনবরত ঘুরছে। সে কালের খিস্ট্রিয় গির্জার ভাবনা মতো চাঁদ কোনো স্বর্গীয় গোলকে স্থির অবস্থায় নেই, বরং সেটা অনবরত একটা পাথর বা আপেলের মতো মুক্তভাবে পড়ছে। আর তা পরিচালিত হচ্ছে মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে। সেটাই ছিল সৌরজগতের গতির প্রথম কোনো ব্যাখ্যা।

নিউটনের মতে, এই বল তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে। নিউটন বিশ্বাস করতেন, সূর্য যদি হুট করে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গে নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে হারিয়ে যাবে গভীর মহাকাশে।

দুই দশক পর, ১৬৮২ সালে, রাতের আকাশ আলোকিত করা এক উজ্জ্বল ধূমকেতু দেখা গেল। সেটা দেখে একই সঙ্গে আতঙ্কিত ও বিস্মিত হলো গোটা লন্ডন। একটা প্রতিফলক দুরবীনের (তাঁর অন্যতম উদ্ভাবন) সাহায্যে বেশ সতর্কভাবে ধূমকেতুটার গতিপথ অনুসরণ করেন নিউটন। তিনি দেখতে পান, ধূমকেতুটা মুক্তভাবে পতিত হচ্ছে এবং তার ওপর মহাকর্ষ বল কাজ করছে ধরে নিলে, তাঁর আবিষ্কৃত সমীকরণের সঙ্গে ধূমকেতুটার গতি বেশ নিখুঁতভাবে মিলে যায়। শৌখিন জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালিসহ তিনি নিখুঁতভাবে অনুমান করলেন, ওই ধুমকেতুটা রাতের আকাশে আবার কবে ফিরে আসবে (এই ধূমকেতুটা পরে হ্যালির ধূমকেতু নামে পরিচিতি পায়)। সেটাই ছিল ধূমকেতুর গতি নিয়ে করা প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী। হ্যালির ধূমকেতু ও চাঁদের গতি গণনা করতে মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করেন নিউটন। সেই একই সূত্র ব্যবহার করে এখন ইউরেনাস ও নেপচুন ছাড়িয়ে মহাকাশ অনুসন্ধানী যানগুলোকে নির্ভুলভাবে পথ দেখায় মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা)।

নিউটনের মতে, এই বল তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে। নিউটন বিশ্বাস করতেন, সূর্য যদি হুট করে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গে নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে হারিয়ে যাবে গভীর মহাকাশে। মহাবিশ্বের সবাই ঠিক সেই মুহূর্তেই জানতে পারবে, সূর্য মাত্রই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কাজেই সব ঘড়ি এমনভাবে সিনক্রোনাইজ করা সম্ভব, যাতে সেগুলো মহাবিশ্বের সব জায়গার সুষমভাবে স্পন্দিত হবে। পৃথিবীর এক সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য আর মঙ্গল ও বৃহস্পতির এক সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য হবে এক সমান। আবার নিউটনের মতে, সময়ের মতো স্থানও পরম। পৃথিবীর মিটার মাপনদণ্ড হবে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাপনদণ্ডের মতো এক সমান। মহাবিশ্বের কোথাও মিটারের মাপনদণ্ডের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হবে না। কাজেই মহাকাশে যেখানেই যাত্রা করা হোক না কেন, সেকেন্ড ও মিটার সব সময় একই থাকবে।

নিউটনের এই ধারণার ভিত্তি ছিল পরম স্থান ও কাল সম্পর্কিত সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। নিউটনের কাছে স্থান ও কাল একটা পরম রেফারেন্স ফ্রেম বা জড়কাঠামো গঠন করে। এই কাঠামোর সাপেক্ষে আমরা সব বস্তুর গতি বিচার করতে পারি। যেমন ট্রেনে ভ্রমণের সময় আমরা বিশ্বাস করি, ট্রেনটা চলছে এবং পৃথিবী স্থির। তবে জানালা দিয়ে বাইরের পেরিয়ে যাওয়া গাছপালা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি, হয়তো ট্রেনটাই স্থির এবং গাছপালাগুলো জানালার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছে। ট্রেনের ভেতরের সব গতিহীন বলে মনে হয়। তাই আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আসলে কে গতিশীল? ট্রেন, নাকি গাছপালা? নিউটনের মতে, এই পরম প্রসঙ্গ কাঠামো বা জড়কাঠামোই উত্তরটি নির্ধারণ করতে পারে।

প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পদার্থবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে টিকে রইল নিউটনের সূত্রগুলো। এরপর উনিশ শতকের শেষ দিকে টেলিগ্রাফ ও লাইট বাল্বের মতো নতুন কিছু উদ্ভাবন ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে বিপ্লবের জোয়ার বইয়ে দিল। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা পুরোপুরি নতুন ধারণার জন্ম দিল বিজ্ঞান জগতে।

নিউটোনিয়ান জগতের ঘাটতিগুলো প্রতি বছরই প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠতে লাগল। মেরি কুরির রেডিয়াম মৌল পৃথককরণ ও তেজস্ক্রিয়তার মতো আবিষ্কারগুলো নাড়া দিতে লাগল বিজ্ঞান জগতকে।

বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় বলের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৬০-এর দশকে কাজ শুরু করলেন স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। সে সময় আলোর একটা তত্ত্ব প্রণয়ন করেন তিনি। তবে এ তত্ত্বের ভিত্তি নিউটনের বলের সূত্রগুলো নয়, বরং ফিল্ড বা ক্ষেত্র নামে নতুন ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘নিউটনের পর পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গভীর ও সবচেয়ে কার্যকরী’ বিষয়টা হলো ক্ষেত্রের ধারণা।

এসব ক্ষেত্রকে কাগজের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোহার গুড়ো বা লৌহচূর্ণের মতো কল্পনা করা যায়। কাগজটির নিচে একটা চুম্বক রাখা হলে লোহার গুড়োগুলো চোখের পলকে মাকড়শার জালের মতো নতুন সজ্জায় আসতে দেখা যায়। এতে যে প্যাটার্ন দেখা যায়, তা উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত রেখায় বিস্তৃত। কাজেই যেকোনো চুম্বকের চারপাশে একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র থাকে। অর্থাৎ একটা অদৃশ্য বলের রেখার বিন্যাস, যা গোটা স্থানজুড়ে বিস্তৃত।

একইভাবে ক্ষেত্র তৈরি করে বিদ্যুৎও। বিজ্ঞানমেলায় স্থির বিদ্যুতের উৎস স্পর্শ করলে শিশুদের চুল খাড়া হয়ে যায়। তা দেখে তারা হেসে ফেলে। চুলগুলোতে আসলে ওই উৎস থেকে উদ্ভুত অদৃশ্য বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র রেখাগুলো বিস্তৃত থাকে।

নিউটন যেসব বলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, এসব ক্ষেত্র তার চেয়ে আলাদা। নিউটন বলতেন, স্থানের যেকোনো জায়গায় বল তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। কাজেই মহাবিশ্বের কোনো জায়গায় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার কথা গোটা মহাবিশ্বে। ম্যাক্সওয়েলের প্রতিভা হলো, তিনি পর্যবেক্ষণে বুঝতে পারলেন, চুম্বকীয় ও বৈদ্যুতিক প্রভাব নিউটনের বলগুলোর মতো মুহূর্তের মধ্যে চলাচল করতে পারে না। বরং চুম্বকীয় ও বৈদ্যুতিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার জন্য সময়ের দরকার। আবার একটা নিদিষ্ট গতিতেই কেবল এসব প্রভাব চলাচল করে। তার জীবনী লেখক মার্টিন গোল্ডম্যান লিখেছেন, ‘চুম্বকীয় ক্রিয়ার সময়ের ধারণাটা ম্যাক্সওয়েলের মাথায় অনেকটা বজ্রপাতের মতো আচমকা এসেছিল।’ যেমন ম্যাক্সওয়েল প্রমাণ করেছেন, কেউ যদি একটা চুম্বককে নাড়াচাড়া করে, তাহলে পার্শ্ববর্তী লোহার গুড়োকে নাড়াতে তা কিছুটা সময় নেবে।

মাইকেল ফ্যারাডে
ছবি: সংগৃহীত

কল্পনা করুন, একটা মাকড়শার জাল বাতাসে দুলছে। বাতাসের মতো একটা গোলমাল জালটার কোনো অংশে লাগার কারণে গোটা জালটাতেই এক ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষেত্র এবং মাকড়ার জাল নিউটনের বলগুলোর মতো নয়। এগুলো আসলে এমন কম্পনের অনুমোদন করে, যা একটা নিদিষ্ট বেগে চলাচল করে। এরপর এই চুম্বকীয় ও বৈদ্যুতিক প্রভাবের গতিবেগ মাপার প্রস্তুতি নিলেন ম্যাক্সওয়েল। সেটা ছিল উনিশ শতকের অন্যতম বড় একটা ঘটনা। এই ধারণা ব্যবহার করে অবশেষে আলোর রহস্য উদ্‌ঘাটন করেন ম্যাক্সওয়েল।

মাইকেল ফ্যারাড ও অন্য বিজ্ঞানীদের আগের গবেষণা থেকে ম্যাক্সওয়েলে জানতেন, একটা চলমান চুম্বকীয় ক্ষেত্র থেকে একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। একইভাবে একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রও তৈরি হতে পারে একটা চলমান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থেকে। আমাদের বিশ্ব বিদ্যুতায়িত করা জেনারেটর ও মোটর হলো এই দ্বান্দ্বিকতার প্রত্যক্ষ ফল। (আমাদের বাড়িঘর আলোকিত করতে আজ এই নীতি ব্যবহার করা হয়। যেমন একটা ড্যামে পড়ন্ত পানির সাহায্য একটা চাকা ঘোরানো হয়। এটিই একটা চুম্বককে ঘোরায়। এই চলমান চুম্বকীয় ক্ষেত্র একটা তারে ইলেকট্রন ঠেলে দেয়। সেগুলো উচ্চ ভোল্টেজের তারের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে আমাদের বসার ঘরের দেয়ালের সকেটে চলে আসে। একইভাবে একটা বৈদ্যুতিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ভেতরে আমাদের দেয়ালের সকেট থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এভাবে সেখানে চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা মোটরের ব্লেডগুলোকে ঘুরতে বাধ্য করে।)

ম্যাক্সওয়েলের প্রতিভা হলো, তিনি দুটো প্রভাবকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তিনি ভাবলেন, একটা পরিবর্তনশীল চুম্বকীয় ক্ষেত্র যদি একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে এবং একটা পরিবর্তনশীল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র যদি একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, তাহলে তারা উভয়ই হয়তো কোনো চক্রাকারে আবর্তনশীল গতির রূপ। অর্থাৎ যেখানে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র অনবরত পরস্পরকে সহায়তা করছে এবং একটা থেকে আরেকটায় পরিণত হচ্ছে। ম্যাক্সওয়েল অচিরেই বুঝতে পারলেন, এই চক্রাকার আবর্তনশীল গতির প্যাটার্ন একটা বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের চলন্ত ধারা তৈরি করবে। তাদের সবগুলো স্পন্দিত হবে একযোগে। আবার এই ক্ষেত্রের প্রতিটা একটা আরেকটায় বদলে যেতে থাকবে কখনোই শেষ না হওয়া একটা তরঙ্গে। এরপর এই তরঙ্গের গতিবেগ মাপলেন ম্যাক্সওয়েল।

চরম বিস্ময়ে তিনি দেখতে পান, ওই তরঙ্গের গতি আর আলোর গতি সমান। এরপর উনিশ শতকের সবচেয়ে বৈপ্লবিক বিবৃতি দিলেন ম্যাক্সওয়েল। তিনি দাবী করলেন, এই তরঙ্গটাই আসলে আলো। এরপর ম্যাক্সওয়েল একটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করে সহকর্মীদের উদ্দেশে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা এই সিদ্ধান্তে না এসে পারি না যে, একই মাধ্যমের আড়াআড়ি তরঙ্গিত গতি নিয়ে আলো গঠিত, যা আসলে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় পরিঘটনার কারণ।’ প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে আলোর প্রকৃতি একটা ধাঁধার মতো ঝুলে ছিল। অবশেষে আলোর সেই গুপ্ত রহস্য বুঝতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। নিউটনের বল তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলে এই ক্ষেত্রগুলো চলাচল করে একটা নিদিষ্ট গতিতে। আর সেই গতিটাই হলো আলোর গতি।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল
ছবি: সংগৃহীত

ম্যাক্সওয়েলের এই কাজগুলো আটটি জটিল-কঠিন পার্শিয়াল ডিফারেশিয়াল সমীকরণে সংকলন করা হয় (যা ম্যাক্সওয়েল’স ইকুয়েশন বা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ নামে পরিচিত)। প্রত্যেক ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার ও পদার্থবিদকে গত দেড় শতাব্দী ধরে সেগুলো মুখস্থ করতে হয়েছে। (বর্তমানে এই মহিমান্বিত আটটি সমীকরণ আঁকা টিশার্টও কিনতে পাওয়া যায়। টিশার্টে এসব সমীকরণের আগে উল্লেখ করা থাকে, ‘শুরুতে ঈশ্বর বললেন...’ এবং সবশেষে লেখা থাকে, ‘...আর তারপর আলো এল।’

উনিশ শতকের শেষ দিকে নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলোর পরীক্ষামূলক সাফল্য মিলল ব্যাপকভাবে। তাতে আগ বাড়িয়ে কিছু পদার্থবিদ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন, বিজ্ঞানের এই মহান দুই স্তম্ভই মহাবিশ্বের সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তার উপদেষ্টার কাছে গিয়ে বললেন, তিনি পদার্থবিদ হতে চান। কিন্তু তাকে অন্য কোনো বিষয়ে পড়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছুই আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন ওই উপদেষ্টা। তিনি বললেন, পদার্থবিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কারের আর বাকি নেই। এই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল উনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ লর্ড কেলভিনের কথাতেও। তিনি দাবি করলেন, পদার্থবিজ্ঞান অবশ্যই পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। শুধু দিগন্তে কিছু ছোটখাটো ‘মেঘ’ জমে আছে, যা এখনও ব্যাখ্যা করা যায়নি।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নিউটোনিয়ান জগতের ঘাটতিগুলো প্রতি বছরই প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠতে লাগল। মেরি কুরির রেডিয়াম মৌল পৃথককরণ ও তেজস্ক্রিয়তার মতো আবিষ্কারগুলো নাড়া দিতে লাগল বিজ্ঞান জগতকে। সেইসঙ্গে জনসাধারণের মনোযোগও আকর্ষণ করল। রেডিয়াম নামের এই বিরল, দীপ্তিমান পদার্থের মাত্র কয়েক আউন্সও অন্ধকার ঘরে অজানা কোনো উপায়ে আলোকিত করে তুলতে পারত। মেরি কুরি আরও দেখালেন, সম্ভবত সীমাহীন পরিমাণ শক্তি পরমাণুর কোনো অজানা উৎস থেকে আসছে। সেটা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিকে অস্বীকার বা লঙ্ঘণ করে। শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিতে বলা হয়েছে, শক্তিকে তৈরি বা ধ্বংস করা যায় না। কিন্তু ওই ছোটখাটো ‘মেঘ’টাই অচিরেই বিংশ শতাব্দীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবের জন্ম দেবে। সেই বিপ্লব দুটো হলো আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব।

সবচেয়ে বিব্রতকর ব্যাপারটা হচ্ছে, নিউটনের বলবিদ্যার সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে একীভূত করার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব নিশ্চিত করল, আলো একটা তরঙ্গ। কিন্তু এতে একটা প্রশ্নের উত্তর তখনও বাকি রয়ে গেল। প্রশ্নটা ছিল: তরঙ্গায়িত আন্দোলন ব্যাপারটি কী? বিজ্ঞানীরা জানতেন, আলো শূন্য মাধ্যমে চলাচল করতে পারে (আসলে লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র থেকে বাইরের মহাকাশের ভেতর দিয়ে আলো ভ্রমণ করে)। কিন্তু সংজ্ঞানুসারে, ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান হলো ‘কোন কিছুই নয়’ বা ‘শূন্যতা’। তাই এখানে একটা প্যারাডক্সের জন্ম হলো: শূন্যতা আন্দোলিত হয়!

১৯০০ সালের মধ্যে নিউটোনিয়ান বলবিদ্যা ব্যাখ্যা করা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে লাগল। গোটা বিশ্ব তখন একটা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত।

নিউটোনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন এভাবে: আলো এমন তরঙ্গ দিয়ে গঠিত, যা কোনো অদৃশ্য ‘ইথার’-এ আন্দোলিত হয়। ইথার হলো একটা স্থিতিশীল গ্যাস, যা গোটা মহাবিশ্ব ছেয়ে আছে। ইথারকে পরম জড়কাঠামো হিসেবে ধরে নেওয়া হলো, যার সাপেক্ষে সব গতিবেগ মাপা যেতে পারে। এখানে কোনো সংশয়বাদী হয়তো বলে উঠতে পারে, পৃথিবী যেহেতু সূর্যের চারপাশে ঘুরছে এবং সূর্য আমাদের ছায়াপথের চারপাশে ঘুরছে, তাহলে আসলে কে চলাচল করছে তা বলা মুশকিল। নিউটোনিয়ান পদার্থবিদরা এর উত্তরে বললেন, সৌরজগত চলাচল করছে স্থির ইথার সাপেক্ষে। কাজেই আসলে কে চলাচল করছে তা নির্ধারণ করা সম্ভব।

যাহোক, ইথার ক্রমেই জাদুকরী ও উদ্ভট সব ধর্ম ও গুণাগুন ধারণ করতে শুরু করল। যেমন পদার্থবিদরা জানতেন, তরঙ্গ বা ঢেউ ঘন মাধ্যমে দ্রুত চলাচল করে। কাজেই শব্দের কম্পন বাতাসের চেয়ে পানিতে দ্রুত বেগে চলতে পারে। তবে আলো দুর্দান্ত এক গতিবেগে চলাচল করে (সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল)। এর মানে, যুক্তি অনুযায়ী, আলোর স্থানান্তর বা চলাচলের জন্য ইথার অবশ্যই অবিশ্বাস্যরকম ঘন। কিন্তু সেটা কীভাবে হওয়া সম্ভব? কারণ ইথারকে বাতাসের চেয়েও হালকা বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। দিনে দিনে রহস্যময় এক পদার্থে পরিণত হল ইথার। এটা একই সাথে পরম স্থিতিশীল, ওজনহীন, অদৃশ্য, গতিবেগ শূন্য। এমনকি তা ইস্পাতের চেয়েও শক্তিশালী এবং সবরকম যন্ত্রের কাছে অশনাক্তযোগ্য।

১৯০০ সালের মধ্যে নিউটোনিয়ান বলবিদ্যা ব্যাখ্যা করা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে লাগল। গোটা বিশ্ব তখন একটা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে কে? অন্য পদার্থবিদরাও ইথার তত্ত্বের ফাঁকফোকর সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তারাও বেশ সংকোচের সাথে সেগুলো মেরামত করে নিউটোনিয়ান কাঠামোর সাথে মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে এই সমস্যার একেবারে হৃদপিণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম হন আইনস্টাইন। তার কোনো কিছু হারানোর ভয় ছিল না। তিনি বললেন, নিউটনের বল এবং ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্র পরস্পরের সঙ্গে বেমানান। বিজ্ঞানের এই দুটি ভিত্তির যেকোনো একটার অবশ্যই পতন হতে হবে। একদিন এই দুটি ভিত্তির একটা শেষপর্যন্ত সত্যিই ভেঙে পড়বে। তাতে তছনছ হয়ে যাবে দুই শতকের বেশি সময় ধরে বিরাজমান পদার্থবিজ্ঞান। সেই সঙ্গে মহাবিশ্ব এবং তার বাস্তবতা সম্পর্কে বিপ্লব ঘটে যাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও। নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যাকে আইনস্টাইন এমন এক চিত্রের মাধ্যমে হটিয়ে দেবেন, যা সামান্য শিশুও বুঝতে পারবে।