কল্পরথে সময় ভ্রমণ

বই, মুভি বা সিরিজ—কল্পবিজ্ঞানে সময় ভ্রমণ অতিপরিচিত ঘটনা। কেউ কেউ প্রিয়জনকে রক্ষার চেষ্টায়, কেউবা বড় কোনো বিপর্যয় প্রতিরোধে বা ভবিষ্যতের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে চলে যান ভিন্ন কোনো সময়ে, ভিন্ন বাস্তবতায়। এসব ঘটনার পেছনের কল্প-কার্যকারণ ও এর বাস্তবতা বিজ্ঞানের চোখে…

সময়কে উল্টো করে চালানোর একটি চেষ্টাও দেখা যায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও বইয়ে

সময়রেখা ধরে অতীতে ফিরে যাওয়া কিংবা ভবিষ্যতের হাতছানি। প্রিয়জনকে বাঁচানোর চেষ্টা, স্বৈরশাসকের অন্যায় ঠেকানো বা বড় কোনো বিপর্যয় প্রতিরোধ—টাইম ট্রাভেল নিয়ে বই, মুভি-সিরিজ কম নেই। এর কোনো কোনোটিতে দেখা যায় বৈজ্ঞানিক নানা তত্ত্বের প্রতিফলন, কোনোটিতে আবার প্রেম-ভালোবাসা বা সামাজিক বার্তাটিই বড় হয়ে ওঠে। এই সবকিছু, এমনকি বৈজ্ঞানিকভাবে টাইম ট্রাভেলের ধারণা গড়ে ওঠার আগেই সময়রেখা ধরে অতীত বা ভবিষ্যতে যাওয়ার কথা ভেবেছে মানুষ। ঠিক কবে, কখন এর সূচনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। প্রাচীন অনেক গ্রন্থে, গল্প ও উপন্যাস বা মুখে মুখে ফেরা কাহিনিতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে সময় ভ্রমণের এ ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে বইটির হাত ধরে, ছোটবেলায় সেই বই বোধ হয় পড়েছেন প্রায় সবাই। দ্য টাইম মেশিন। লেখক: এইচ জি ওয়েলস। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে।

এ বইয়ে দেখা যায়, একজন উদ্ভাবক বলছেন, স্থানের যেমন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নামের তিনটি মাত্রা রয়েছে, তেমনি চতুর্থ মাত্রাটি হলো সময়। এমন একটি যন্ত্র তিনি উদ্ভাবন করেছেন, যা এই চতুর্থ মাত্রায় ভ্রমণ করতে পারে; অর্থাৎ তাঁর ধারণা, যন্ত্রটি দিয়ে সময় ভ্রমণ করা সম্ভব। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি প্রথমে চলে যান ৮ লাখ ২ হাজার ৭০১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সেখানে ঘুরেফিরে চলে যান ভবিষ্যতে। নিজের সময় থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি বছর ভবিষ্যতে গিয়ে পৃথিবীর অবস্থা দেখে তিনি থমকে যান, কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফেরেন নিজের সময়ে। গল্পের কথক পরদিন দেখেন, এই সময় পরিভ্রামক আবার সময় ভ্রমণে যাচ্ছেন। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও গল্প কথকের ভাষ্যে জানা যায়, তিনি আর ফিরে আসেননি।

মজার ব্যাপার হলো, এর প্রায় ১০ বছর পর ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রকাশ করেন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এর হাত ধরে আমরা জানতে পারি, তাত্ত্বিকভাবে আসলেই ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। তবে অতীতে যাওয়ার কোনো সূত্র বা উপায় আজও বের করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তাই বলে কল্পনা কি আর বাধা মানে? ফলে কালে কালে বারবার, নানাভাবে কল্পনার রথে চেপে সময় ভ্রমণের বিষয়গুলো ফিরে ফিরে আসতে দেখা যায়।

সময় ভ্রমণের ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে বইটির হাত ধরে, ছোটবেলায় সেই বই বোধ হয় পড়েছেন প্রায় সবাই। দ্য টাইম মেশিন। লেখক: এইচ জি ওয়েলস। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে

সেই ১৮১৯ সালে প্রকাশিত বই রিপ ভ্যান উইঙ্কল থেকে শুরু করে হালের অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম মুভি—সবই আসলে টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণের গল্প। তবে মুভির ক্ষেত্রে টাইম ট্রাভেলের ধারণা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্যাক টু দ্য ফিউচার-এর হাত ধরে। একটি গাড়িতে ঘণ্টাপ্রতি ৮৮ মাইল বেগে ছুটে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র ডক ব্রাউন ও মার্টি—চলে যায় অতীত বা ভবিষ্যতে। সে জন্য অবশ্য দরকার পড়ে ১ দশমিক ২১ গিগাওয়াট বিদ্যুৎও। সেখানে মজার সব বিপদের মুখোমুখি হয় তারা, পৃথিবীকে উদ্ধার করে বড় বড় সব বিপর্যয় থেকে।

এত সব বই বা মুভির সব কটির কথা এই ছোট্ট লেখায় বলা সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং বলা যাক সময় ভ্রমণে সৃষ্ট জটিলতা বা হেঁয়ালিগুলোর কথা। পাশাপাশি বলব, মুভি ও বইয়ে ব্যবহৃত টাইম ট্রাভেলের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর কথা। তাহলে বই ও মুভিতে টাইম ট্রাভেলের ধারণা ও এর বাস্তবতা বা সমস্যাগুলো বোঝা যাবে সহজে। শেষেরটি দিয়েই শুরু করা যাক।

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অব আজকাবান বই এবং এটি অবলম্বনে বানানো মুভিতে দেখা যায়, হারমিওনি গ্রেঞ্জারের কাছে একটি জাদুর ঘড়ি আছে। এ ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে খানিকটা অতীতে চলে যেতে পারে সে, কয়েক ঘণ্টা বাড়তি সময় নিয়ে কিছু বাড়তি ক্লাস করতে পারে।

২.

উনিশ শতকে টাইম ট্রাভেল গল্পগুলোয় ব্যবহৃত অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি ছিল টাইম স্লিপ। একে অনেকে টাইম জাম্পও বলেন। দেখা যায়, এক বা একাধিক মানুষ অজানা কোনো উপায়ে সময় ভ্রমণ করে চলে গিয়েছেন অতীত বা ভবিষ্যতে। বুঝতেই পারছেন, সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানের চেয়ে একে ফ্যান্টাসিই বলা উচিত। এর ভালো উদাহরণ ১৮১৯ সালে প্রকাশিত ওয়াশিংটন আরভিংয়ের লেখা রিপ ভ্যান উইংকল। এ গল্পে দেখা যায়, রিপ ভ্যান উইংকল নামের ডাচ-মার্কিন এক তরুণ শিকারে বেরিয়ে পড়ে নিজের কুকুরটিকে নিয়ে। সেখানেই ঘটনাচক্রে ঘুমিয়ে পড়ে সে, যে ঘুম ভাঙে প্রায় ২০ বছর পর—তত দিনে বিপ্লব ঘটে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে, হয়ে গেছে আরও অনেক কিছু, যে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই।

রিপ ভ্যান উইংকেল বইয়ের প্রচ্ছদ

কাছাকাছি ঘটনা, হয়তো হাল আমলের মুভি দর্শকেরা বুঝতে পারবেন, দেখা যায়—মারভেলের সুপারহিরো মুভি ক্যাপ্টেন আমেরিকা: দ্য ফার্স্ট অ্যাভেঞ্জার–এও। যেখানে ক্যাপ্টেন আমেরিকা স্টিভ রজার্স ঘুমিয়ে পড়েন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, আর তাঁর ঘুম ভাঙে ২০১১ সালে—তত দিনে শেষ হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ক্যাপ্টেন আমেরিকার কাহিনিতে ফ্যান্টাসির সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগও রয়েছে খানিকটা। শীতকালে বিভিন্ন প্রাণী যেমন ঘুমিয়ে পড়ে—বাংলায় যাকে বলে শীতনিদ্রা, ইংরেজিতে হাইবারনেশন—ঠিক তেমনি ঘুমিয়ে পড়েন স্টিভ রজার্স।

একই রকম ঘটনা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা কিংবদন্তিতেও। সাত তরুণ ও এক কুকুরের ঘুমিয়ে প্রায় ৩০০ বছর কাটিয়ে দেওয়ার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আরও কিছু উল্লেখযোগ্য বা পরিচিত বই ও মুভিতে এ ধরনের টাইম জাম্প দেখা যায়। যেমন হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অব আজকাবান বই এবং এটি অবলম্বনে বানানো মুভিতে দেখা যায়, হারমিওনি গ্রেঞ্জারের কাছে একটি জাদুর ঘড়ি আছে। এ ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে খানিকটা অতীতে চলে যেতে পারে সে, কয়েক ঘণ্টা বাড়তি সময় নিয়ে কিছু বাড়তি ক্লাস করতে পারে। এ পদ্ধতিতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে রক্ষা করে হ্যারি পটার, হারমিওনি ও রন উইজলি। একটু আধুনিকতর তবে একই রকম ব্যাখ্যাতীত টাইম জাম্প মেশিন দেখা যায় মেন ইন ব্ল্যাক মুভি সিরিজে। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো ইচ্ছেমতো যেকোনো সময়ে চলে যেতে পারে এর সাহায্যে। তবে এগুলোর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার আসলে উপায় নেই।

একটি গাড়িতে ঘণ্টাপ্রতি ৮৮ মাইল বেগে ছুটে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র ডক ব্রাউন ও মার্টি—চলে যায় অতীত বা ভবিষ্যতে

আরেকটি খুব প্রচলিত পদ্ধতি দেখা যায় বিভিন্ন কল্পগল্পে—ভবিষ্যতের কেউ যোগাযোগ করেন বর্তমানের কারও সঙ্গে। এইচ জি ওয়েলসের গল্প ‘দ্য কুইয়ার স্টোরি অব ব্রাউনলোস নিউজপেপার’ এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা চলে। এ গল্পে প্রায় ৪০ বছর ভবিষ্যতের এক সংবাদপত্র হাতে পেয়ে যান এক লোক। একই ঘটনা দেখা যায় ইট হ্যাপেন্ড টুমোরো মুভিতেও। একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, হাল আমলের ডিসির সুপারহিরো সিরিজ দ্য লিজেন্ড অব টুমোরো ও ফ্ল্যাশ এবং একই নাম ও চরিত্রের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র দ্য ফ্ল্যাশ–এও একই ঘটনা দেখা যায়।

বিশ শতকের শুরুতে প্রকাশিত এ গল্পের ওপর একই নামে নির্মিত হয়েছে মুভিও; অভিনয় করেছেন বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা ব্র্যাড পিট। এতে দেখা যায়, বৃদ্ধ বেঞ্জামিন বাটনের বয়স ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
ব্যাক টু দ্য ফিউচার মুভির পোস্টার

কেউ কেউ আবার স্বপ্নে বা কোনোভাবে ভবিষ্যতের ঘটনা দেখতে পান। ইংরেজিতে যাকে বলে প্রিকগনিশন। এভাবে ভবিষ্যতের ঘটনা বদলে ফেলতে গিয়ে একধরনের লুপ বা চক্রে পড়ে যায় গল্পের মূল চরিত্র। এতে দেখা যায়, একধরনের প্যারাডক্স বা হেঁয়ালির সৃষ্টি হয়েছে—বর্তমানের চরিত্র ভবিষ্যৎ জেনে ফেলে, তা ঠেকাতে যে উদ্যোগ নিচ্ছে বা অতীতের ঘটনা বদলাতে যে চেষ্টা করছে, তা-ই আসলে আগের সেই ভবিষ্যৎ বা অতীত ঘটনার পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ছে। এই চক্রকে বলা হয় প্রিডেস্টিনেশন; অর্থাৎ নির্ধারিত নিয়তি। প্রিডেস্টিনেশন নামে একটি চলচ্চিত্রই রয়েছে, তাতেও এ বিষয় দেখা যায়। একই সঙ্গে প্রিকগনিশনের পাশাপাশি এটিকে তাই টাইম লুপ বলতে পারেন। অবশ্য এ ধরনের আরও অনেক গল্প রয়েছে, যাতে টাইম লুপ বা সময়ের চক্র স্পষ্ট। যেখানে কোনো চরিত্র মারা যায় বা বড় কোনো ক্ষতি হয়, এই ক্ষতি বা মৃত্যু এড়াতে মূল চরিত্র যা যা করে, তা–ই ধীরে ধীরে সেই ক্ষতি বা মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।

সময়কে উল্টো করে চালানোর একটি চেষ্টাও দেখা যায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও বইয়ে। এর সবচেয়ে ভালো ও পরিচিত উদাহরণ হতে পারে হালের ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত চলচ্চিত্র টেনেট—যাতে দেখা যায়, সময়ের কাঁটা উল্টো চলছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয় ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলা দিয়ে; আর এ বিশৃঙ্খলা পরিমাপের পদ্ধতিকে পদার্থবিজ্ঞানের গালভারী পরিভাষায় বলা হয় এনট্রপি। যেমন একটি ডিম বা কাচের গ্লাস হাত থেকে পড়ে গেলে ভেঙে যায়, তাতে বেড়ে যায় বিশৃঙ্খলা। তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো বলে, এই বিশৃঙ্খলা কমানোর কোনো উপায় নেই; অর্থাৎ এই বিশৃঙ্খলা বা ক্যাওস বৃদ্ধি এবং এর পরিমাপ—এনট্রপি সব সময় একদিকে এগোচ্ছে। এই এগোনোর দিকই সময়রেখার মাথায় তিরচিহ্ন হিসেবে বসে যায়; অর্থাৎ যেদিকে এনট্রপি বাড়ছে, তা-ই সময়ের অগ্রগতির দিক। সময়রেখা ধরে এগোনো যায়, যায় না পেছনে ফেরা।

টেনেট মুভির পোস্টার

টেনেট চলচ্চিত্রে দেখা যায়, এই বিশৃঙ্খলা কমানোর উপায় পাওয়া গেছে—বিশেষ এক যন্ত্রের মাধ্যমে এ কাজ করা হয়, তাতে সময়রেখার তির ঘুরে যায় উল্টো দিকে। ফলে এনট্রপি কমতে থাকে, ভাঙা কাচ জোড়া লেগে গ্লাস হয়ে যায়, ভাঙা ডিম থেকে পাওয়া যায় অভঙ্গুর ডিম। বাস্তবে যে এমনটা করা যায় না, তা তো বলা বাহুল্য।

সময়ের তির ঘুরিয়ে ফেলতে দেখা যায় মারভেলের ২০১৬ সালের চলচ্চিত্র ডক্টর স্ট্রেঞ্জ-এ। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে একধরনের ডার্ক ডাইমেনশন বা ভিন্নমাত্রার দেখা পাই আমরা। এই মাত্রার পেছনের ব্যাখ্যাটি অবশ্য খুব স্পষ্ট বা যৌক্তিক নয়।

সময়ের তির ঘুরে যাওয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি দেখা যায় মার্কিন ঔপন্যাসিক ফ্রান্সিস স্কট ফিটসজেরাল্ডের ‘দ্য কিউরিয়াস কেইস অব বেঞ্জামিন বাটন’ গল্পে। বিশ শতকের শুরুতে প্রকাশিত এ গল্পের ওপর একই নামে নির্মিত হয়েছে মুভিও; অভিনয় করেছেন বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা ব্র্যাড পিট। এতে দেখা যায়, বৃদ্ধ বেঞ্জামিন বাটনের বয়স ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বাস্তবে এমনটা সম্ভব—এ রকম কোনো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। যদিও পদার্থবিজ্ঞানের ভৌত সূত্রগুলো সময়ের তির বা সময় শুধু সামনেই যাবে—এ রকম কিছু বলে না। তবে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বা এনট্রপি একটি মহাজাগতিক সত্য। সময়কে তাই কখনো পেছনে চলতে দেখা যায় না।

আরেক ধরনের সময় ভ্রমণের ব্যবহার দেখা যায় কল্পবিজ্ঞানে। এর নাম অলটারনেট টাইমলাইন বা বিকল্প সময়রেখা কিংবা বলা যায়, ভিন্ন সময়রেখা। ফিলিপ কে ডিকের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল থেকে শুরু করে মারভেলের অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম কিংবা লোকি সিরিজ—সবখানেই এর ব্যবহার দেখা যায়।

তবে হাল আমলের বাংলা বিজ্ঞান কল্পগল্পের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে অতীত ও বর্তমানের মিলে যাওয়া, সময়ের পেছনে গিয়ে চুরি করে ফেলা গল্পের আইডিয়া—সব মিলিয়ে সময় ভ্রমণের এক ভিন্ন স্বাদের আখ্যানের দেখা মেলে শিবব্রত বর্মনের বিজ্ঞান কল্পগল্প সংকলন বানিয়ালুলুর ‘প্রতিদ্বন্ধী’ গল্পে।

বাংলা ভাষায়ও সময় ভ্রমণের ব্যবহার রয়েছে কল্পবিজ্ঞানে। একধরনের সময় ভ্রমণ করতে দেখা যায় মহাকাশে, যেখানে নভোযান ছুটতে পারে আলোর কাছাকাছি বেগে—ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে বা হাইপার ডাইভ দিয়ে চলে যায় বহুদূর কোনো নক্ষত্রজগতের গ্রহে বা ভিন্নমাত্রায়। এ ধরনের সময় ভ্রমণ মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেশ কয়েকটি বইয়ে রয়েছে। এ ছাড়া সময় ভ্রমণের আরও কিছু পদ্ধতি দেখা যায় তাঁর বিভিন্ন বই ও গল্পে। যেমন ত্রিনিত্রি রাশিমালা, সময়ের অপবলয়।

প্রিডেস্টিনেশন মুভির পোস্টার

তবে সুনির্দিষ্ট ধরনের সময় ভ্রমণের প্রচেষ্টাও দেখা যায়। হুমায়ূন আহমেদের তোমাদের জন্য ভালোবাসা বইতে দেখা যায় চতুর্মাত্রিক এক অশুভ শক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে বিভিন্ন গ্রহকে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের এক মাইক্রোফিল্মে মেলা সূত্র ধরে পাওয়া যায় এ সমস্যার সমাধান। টাইম প্যারাডক্স, বহুমাত্রা ও প্যারালাল ইউনিভার্সের মিশেলে ভিন্ন এক সময়ে পৌঁছে গিয়ে অন্য রকম কিছু প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন অনন্ত নক্ষত্র বীথি। তাঁর ফিহা সমীকরণেও দেখা যায় সময় সমীকরণ সমাধানের চেষ্টা।

বলতে হলে বলা প্রয়োজন অনেক বইয়ের কথাই। তবে হাল আমলের বাংলা বিজ্ঞান কল্পগল্পের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে অতীত ও বর্তমানের মিলে যাওয়া, সময়ের পেছনে গিয়ে চুরি করে ফেলা গল্পের আইডিয়া—সব মিলিয়ে সময় ভ্রমণের এক ভিন্ন স্বাদের আখ্যানের দেখা মেলে শিবব্রত বর্মনের বিজ্ঞান কল্পগল্প সংকলন বানিয়ালুলুর ‘প্রতিদ্বন্ধী’ গল্পে। বলা প্রয়োজন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের ‘ঈশ্বরের গণিত’ গল্পটির কথাও—এক বিজ্ঞানী যেখানে সময়রেখা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে পান, বিশেষ যানে লাফ দিয়ে তিনি পৌঁছে যান এ রেখার ভিন্ন এক বিন্দুতে, ভিন্ন সময়ে।

এগুলোর কোনোটিই যে ব্যবহারিকভাবে সম্ভব নয়, তা বলা বাহুল্য। কোনো কোনোটি—যেমন সময়ের তির ঘুরে যাওয়া বা ভবিষ্যতের বার্তা—ভৌত সূত্রগুলোও কার্যকারণ বা যৌক্তিক উপায়ে ঘটাই সম্ভব নয়, ব্যবহারিকভাবে সম্ভব হওয়ার বিষয়টি তো আরও পরের ব্যাপার।

ডগলাস অ্যাডামসের বিখ্যাত ‘দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি’ সিরিজের বই দ্য রেস্টুরেন্ট অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ইউনিভার্স-এ দেখা যায়, মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ওই রেস্তোরাঁয় আসে বিশেষ এক ঘটনা উপভোগের জন্য।

৩.

সময় ভ্রমণের চেষ্টায় বিভিন্ন প্রহেলিকা দেখা যায়। এর একটি ইতিমধ্যেই বলেছি টাইম লুপ বা সময় চক্রের কথা বলতে গিয়ে। প্রিডেস্টিনেশন বা নির্ধারিত ভবিতব্যের প্রসঙ্গে এ কথা এসেছিল। এ ধরনের প্যারাডক্সগুলোর মধ্যে বিখ্যাত গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের কথা হয়তো সবাই জানেন। কেউ অতীতে গিয়ে নিজের দাদাকে মেরে ফেললে তার আসলে জন্মই হওয়ার কথা নয়। যুক্তির ধারায় এটি তাই টেকে না।

বাটারফ্লাই ইফেক্ট বা অতীতে গিয়ে সামান্য পরিবর্তনের ফলে বর্তমান বা ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিবর্তনের বিষয়টিও বেশ আলোচিত ও প্রচলিত একটি হেঁয়ালি। এ শব্দগুচ্ছ প্রবর্তন করেন মার্কিন গণিতবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ। বাটারফ্লাই ইফেক্ট তথা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোই পৃথিবী বদলে দেওয়ার পেছনে দায়ী। এ ধরনের হেঁয়ালির দেখা মেলে মার্কিন লেখক রে ব্র্যাডবেরির ‘আ সাউন্ড অব থান্ডার’ গল্পে। দেখা যায়, অতীতে গিয়ে একটি প্রজাপতিকে পায়ে দলে মেরে ফেলায় বর্তমানে বদলে গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, বদলে গেছে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় গল্পের মূল চরিত্রটির অতীতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এ ঘটনাগুলো একই ধারাবাহিকতায় আর ঘটতে পারে না।

রে ব্র্যাডবেরির ‘আ সাউন্ড অব থান্ডার’ একটি ক্লাসিক গল্প, প্রথম প্রকাশিত হয় কয়লারস ম্যাগাজিনে, ১৯৫২ সালে।

‘আ সাউন্ড অব থান্ডার’ গল্পটিতে একই সঙ্গে দেখা যায় টাইম ট্যুরিজম বা ভিন্ন সময়ে ঘুরে আসার বিষয়টিও। ডগলাস অ্যাডামসের বিখ্যাত ‘দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি’ সিরিজের বই দ্য রেস্টুরেন্ট অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ইউনিভার্স-এ দেখা যায়, মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ওই রেস্তোরাঁয় আসে বিশেষ এক ঘটনা উপভোগের জন্য। কী ঘটনা, তা তোলা রইল পাঠকের জন্য।

সময়ের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ হতেও দেখা যায় বিভিন্ন গল্পে। দেখা যায়, মানুষ ফিরে ফিরে ইতিহাস পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন। কেউ কেউ অতীতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই মেরে ফেলতে চান হিটলারের মতো স্বৈরশাসককে, কেউ আরও বড় কোনো বিপর্যয় ঠেকাতে চান, কেউ ভবিষ্যৎ জেনে ফেলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে চান। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটি ব্যাপারই চোখে পড়ে—কার্যকারণ ও যুক্তির ধারায় এগুলোর কোনোটিই বাস্তবে ঘটা সম্ভব নয়। তা হলে কী হবে, কল্পনার রথে চড়ে সময় ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে তো কোনো ক্ষতি নেই!

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন