এবছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞনী। পৃথিবীর জলবায়ুর প্রথম সার্থক বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করেছেন দুজন বিজ্ঞানী ও একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জটিলতার পদার্থবিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী সমাধান আবিষ্কার করেছেন। চলতিবছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলের ঘোষণা দেওয়া হয় ৫ অক্টোবর ২০২১। বিজয়ী বিজ্ঞানীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে ৮ ডিসেম্বর ২০২১। এই তিন বিজ্ঞনীর হাতে নোবেল উঠল কেন?
আমরা এক জটিল মহাবিশ্বে বাস করি। বিজ্ঞানীরা এই জটিলতার রহস্য উন্মোচনে কাজ করে যাচ্ছেন শত শত বছর ধরে। কিন্তু সেই জটিল রহস্যের খুব সামান্যই আমরা জানতে পেরেছি। দৈনন্দিন যেসব কাজ আমরা করতে অভ্যস্ত, সেগুলো কত সহজেই যে করে ফেলি! কিন্তু সেই সহজ কাজও আসলে খুবই জটিল। ধরা যাক, হাত থেকে একটা কাচের গ্লাস ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেল। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিকসের সাহায্যে আমরা সহজেই হিসাব করতে পারি, গ্লাসটি কত বেগে ফ্লোরে পড়েছে, ত্বরণ কত ছিল, কত বল প্রয়োগ করা হয়েছে ইত্যাদি। এখন আমরা যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই, যদি একই উচ্চতা থেকে, একই বেগে, একই বলে, একই ত্বরণে আরেকটি গ্লাস ফ্লোরে ফেলি, সেই গ্লাসও ভাঙবে ঠিকই, কিন্তু হুবহু আগের মতো হবে না। ভাঙা কাচের সংখ্যা ভিন্ন হবে, টুকরাগুলো ভিন্ন আকৃতির হবে, ভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়বে, এ রকম অসংখ্য পার্থক্য থাকবে। তাই যেসব ঘটনার পূর্বাভাস আমরা শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে দিতে পারি, সেগুলো আসলে ঘটনাগুলোর সরল রূপ। সম্পূর্ণ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব। কারণ, ঘটনার অসংখ্য প্যারামিটারের যেকোনো একটিও যদি ভিন্ন হয়, পুরো ঘটনাই আলাদা আরেকটি ঘটনা হয়ে যায়। জটিল মহাবিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর গতিবিধির কিছু কিছু আমরা মোটামুটিভাবে বুঝতে পেরেছি। সেই হিসাবে কিছুটা পূর্বাভাসও দিতে পারছি। যেমন সৌরজগতের গ্রহগুলোর ভবিষ্যতের অবস্থান ইত্যাদি। কিন্তু সেই পূর্বাভাসের অনিশ্চয়তার পরিমাণও বেশ বড়।
প্রাকৃতিক জটিলতার একটি সহজ উদাহরণ হলো পৃথিবীর আবহাওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এখন সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু কতটুকু সূক্ষ্মভাবে সঠিক এসব পূর্বাভাস? কত লাখ লাখ প্যারামিটার হিসাব করতে হয় যদি আমরা সঠিকভাবে মেঘের গতি, তাপমাত্রা, বাতাসের বেগ, দিক, আর্দ্রতা—এসব মাপতে চাই। খুব সামান্য কিছুর পরিবর্তনেই আবহাওয়া বদলে যেতে পারে। লাখ লাখ প্যারামিটারের জটিলতার সমাধান করার চেষ্টা করি আমরা সহজ বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করার মাধ্যমে। এসব মডেলের ওপর ভিত্তি করে আমরা জটিল বিষয়কে সহজে বোঝার চেষ্টা করি। পৃথিবীর জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে ঘটছে, তা আমরা জানতে পারছি পৃথিবীর জলবায়ুর মডেলের ওপর গবেষণার মাধ্যমে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য যে এই পৃথিবীর মানুষ অনেকাংশে দায়ী, সেই ব্যাপারও বৈজ্ঞানিক মডেলের ব্যবহার করে হিসাব করে বের করেছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জটিলতার গবেষণার জন্য এ বছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন। পৃথিবীর জলবায়ুর প্রথম সার্থক বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করেছেন দুজন বিজ্ঞানী ও একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জটিলতার পদার্থবিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী সমাধান আবিষ্কার করেছেন।
২০২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্যুকুরো মানাবে, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব মিটিওরোলজির অধ্যাপক ক্লাউস হেসেলমান এবং ইতালির সাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটি অব রোমের অধ্যাপক জর্জিও পারিসি।
এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা আলাদা। কারণ, নোবেল পুরস্কারের গত ১২০ বছরের ইতিহাসে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন গবেষণা কিংবা জটিলতার পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এর আগে কাউকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
এ বছর দুটি আলাদা বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যদিও সূক্ষ্মভাবে বিষয় দুটি একটি বৃহত্তর জটিল কাঠামোপদ্ধতির অংশ। পুরস্কারের অর্ধেক অর্থ দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক মানাবে ও অধ্যাপক হেসেলমানকে। তাঁরা পৃথিবীর জলবায়ুর ভৌত কাঠামোর কার্যকর মডেল তৈরিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন, যার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য গাণিতিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
পুরস্কারের বাকি অর্ধেক অর্থ দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক পারিসিকে। তিনি পদার্থের জটিল ভৌত কাঠামোর ভেতরের সুপ্ত প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছেন, যার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টে যেসব সিস্টেম খুব বিশৃঙ্খল বলে মনে হয়, সেগুলোর ভেতরেও যে সুপ্ত শৃঙ্খলা আছে, তা বোঝা যায়। তাঁর পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষুদ্রতম পরমাণু থেকে শুরু করে সৌরজগতের গ্রহগুলোর জটিল গতিবিধিও বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং গাণিতিকভাবে হিসাব করা যায়।
বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রথম সার্থক মডেল তৈরি করেছেন স্যুকুরো মানাবে। তাঁর জন্ম ১৯৩১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাপানের শিংগু প্রদেশে। তাঁর বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া সব জাপানেই। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে বিএ, ১৯৫৫ সালে এমএ এবং ১৯৫৮ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
সেই সময় আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএস ওয়েদার ব্যুরো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। আমেরিকান আবহাওয়াবিদ (মিটিওরোলজিস্ট) জোসেফ স্মাগোরিনস্কির নেতৃত্বে কম্পিউটারের সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মডেল তৈরি করে গাণিতিক হিসাব–নিকাশ করা শুরু হয়। সেই সময়ের কম্পিউটারের আকার ছিল বিশাল, কার্যক্ষমতা ছিল খুবই কম। সেই কাজের জন্য একদল তরুণ গবেষক নিয়োগ দেওয়া হলো। জাপান থেকে আমেরিকায় এসে স্যুকুরো মানাবে যোগ দিলেন সেখানে জেনারেল সার্কুলেশন রিসার্চ সেকশনে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে। তারপর আমেরিকাতেই রয়ে যান মানাবে। ১৯৭৫ সালে তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পান।
ইউএস ওয়েদার ব্যুরো থেকে ১৯৬৩ সালে স্যুকুরো মানাবে সিনিয়র রিসার্চ মিটিওরোলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন জিওফিজিক্যাল ফ্লুইড ডায়নামিকস ল্যাবরেটরিতে। ১৯৯৭ পর্যন্ত তিনি কাজ করেন সেখানে। এই ল্যাবে কাজ করার সময়ই তিনি পৃথিবীর জলবায়ুর প্রথম সার্থক মডেল তৈরি করেন।
পৃথিবীর জলবায়ুর মডেল তৈরির চেষ্টা চলছে অনেক বছর ধরে। প্রায় ২০০ বছর আগে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ ফুরিয়ার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার কারণ আবিষ্কার করেন। সূর্যের আলোর যে পরিমাণ বিকিরণ পৃথিবীতে আসে, তার বেশির ভাগ ভূপৃষ্ঠ শোষণ করে। আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে যে পরিমাণ বিকিরণ নির্গত হয়, তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়। ফলে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসে, সেই আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। কিন্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপের যে বিকিরণ নির্গত হয়, তার কম্পাঙ্ক কম, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। ফলে সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে চলে যেতে পারে না। এই ব্যাপারকে আমরা গ্রিনহাউস ইফেক্ট বলছি। আপাতদৃষ্টে এই হিসাব সহজ মনে হলেও এখানে অনেকগুলো প্যারামিটার কাজ করে। তার সব কটিকে হিসাবের আওতায় আনার জন্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ইউএস ওয়েদার ব্যুরোতে আবহাওয়ার যে গাণিতিক মডেল তৈরি করা হলো, তাতে বাতাসের তাপমাত্রার পরিবর্তন, আর্দ্রতার পরিবর্তন, বাতাসের বেগ, মেঘ—এসবের সঙ্গে পৃথিবীর স্থলভাগ ও জলভাগের মিথস্ক্রিয়া কীভাবে ঘটে, তার বৈজ্ঞানিক হিসাব–নিকাশ করার জন্য কিছু মডেল দাঁড় করানো হলো। কিন্তু সেই মডেল দিয়ে পরিসংখ্যানের হিসাবে সম্ভাবনার কথা বলা যায়, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না।
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের যে সরাসরি সম্পর্ক আছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন সুইডিশ পদার্থবিজ্ঞানী সান্তে আরহেনিয়াস। ১৯০৩ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। বাতাসের স্বাভাবিক উপাদানের মধ্যে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন মিলিয়ে ৯৯ ভাগ, বাকি ১ ভাগের মধ্যে খুব সামান্য পরিমাণে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড ও জলীয় বাষ্প পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ বের হয়, তা শোষণ করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটি কিন্তু খুবই দরকারি বিষয়। এ কারণেই পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি না হলে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হতো মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তাপমাত্রায় পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হতো না। বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস হিসাব করে দেখেছেন যে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি কমে গিয়ে অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি কমে যেতে পারে, যার ফলে পৃথিবীতে আবার বরফযুগ নেমে আসতে পারে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে কী হবে? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। সামান্য বেড়ে গেলেই পৃথিবীর জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।
তরুণ আবহাওয়াবিদ স্যুকুরো মানাবে জটিল বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার পরিবর্তন হিসাব করার জন্য একটি অত্যন্ত সরল মডেল তৈরি করলেন। তিনি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০ কিলোমিটার উঁচু একটি বায়ুস্তম্ভ ধরে নিলেন। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে এই উচ্চতায় ওজোনস্তর। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ বিকীর্ণ হয়, তা এই স্তরেই শোষিত হয়ে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। স্যুকুরো মানাবে হিসাব করে দেখতে চাইলেন বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের তারতম্য ঘটলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার কী পরিবর্তন ঘটে। সেই সময়ের কম্পিউটারের কয়েক শ ঘণ্টা সময় লাগল তাঁর মডেল দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার পরিবর্তন হিসাব করতে। কিন্তু হিসাবে যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত দরকারি। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বেড়ে যাবে। ১৯৬৭ সালে মানাবে এই মডেল প্রকাশ করেন। এটি ছিল তাঁর একমাত্রিক মডেলের পরীক্ষা। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি তাঁর একমাত্রিক মডেলকে ত্রিমাত্রিক মডেলে রূপান্তরিত করে আরও অনেকগুলো পরীক্ষা করলেন। তাঁর ত্রিমাত্রিক মডেল প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে।
এরপর জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক কারণ সন্ধানে সক্রিয় থেকেছেন বিজ্ঞানী মানাবে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় কাজ করার পর ৬৬ বছর বয়সে তিনি জাপানে ফিরে যান। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন জাপানে। ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন জাপানের ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের গ্লোবাল ওয়ার্মিং রিসার্চ প্রোগ্রামের পরিচালক। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জাপান মেরিন-আর্থ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অর্গানাইজেশনের কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে তাঁর পূর্ণকালীন চাকরি হলেও তিনি যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম ইন অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যান্ড ওশেনিক সায়েন্সের সিনিয়র মিটিওরোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন ২০০৫ সাল থেকে। এই ৯০ বছর বয়সেও তিনি সক্রিয়।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এর কারণ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি। স্যুকুরো মানাবের মডেল থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হলো কার্বন ডাই-অক্সাইডের এই বৃদ্ধি কি প্রাকৃতিকভাবেই ঘটছে, নাকি এর জন্য পৃথিবীর মানুষ দায়ী? এই প্রশ্নে পৃথিবীর মানুষ বিভক্ত। বিশেষ করে রাজনীতিবিদেরা মানতেই চাইছেন না যে এর জন্য মানুষ দায়ী। কীভাবে প্রমাণ করা যাবে যে এর জন্য মানুষ দায়ী না প্রকৃতি? এই মোক্ষম প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানী ক্লাউস হেসেলমানের মডেল থেকে। সে জন্যই হেসেলমানও এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
ক্লাউস হেসেলমানের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৫ অক্টোবর জার্মানির হামবুর্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর বাবা ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। কেমব্রিজ হায়ার স্কুল সার্টিফিকেট পাস করেছেন ইংল্যান্ড থেকে। তারপর জার্মানিতে ফিরে এসে হামবুর্গে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন এক বছর। ১৯৫৫ সালে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গটিনজেন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব হামবুর্গের ইনস্টিটিউট অব নেভাল আর্কিটেকচারে যোগ দেন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ১৯৬১ সালে তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লা হোইয়ার ইনস্টিটিউট ফর জিওফিজিকস অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ফিজিকসের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে ফিরে আসেন জার্মানিতে। ১৯৬৪ সালে হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে তিনি হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির থিওরেটিক্যাল জিওফিজিকসের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব জিওফিজিকসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। ১৯৭৫ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব মিটিওরোলজি স্থাপিত হয়। ইনস্টিটিউটের প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৮৮ সালে তাঁকে জার্মান ক্লাইমেট কম্পিউটার সেন্টারের সায়েন্টিফিক ডিরেক্টর করা হয়। ১৯৯৯ সালে ৬৮ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তারপর থেকে এই ৯০ বছর বয়সেও তিনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব মেটিওরোলজির অবসরোত্তর অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৮০ সালে অধ্যাপক ক্লাউস হেসেলমান পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনে মানুষের যে ভূমিকা আছে, তা প্রমাণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন খুবই জটিল প্রক্রিয়ায় ঘটছে। স্থানীয় আবহাওয়ার প্যারামিটার আর বৈশ্বিক জলবায়ুর প্যারামিটার এক নয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর গাণিতিক প্রক্রিয়া ভীষণ জটিল ও অনিশ্চয়তায় ভরা। আমাদের পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন সুষম নয়। কারণ, মহাকাশ থেকে যে সৌরবিকিরণ পৃথিবীতে এসে পড়ে, তা সব জায়গায় সমানভাবে পড়ে না। পৃথিবী নিজের অক্ষে প্রায় ২৪ ডিগ্রি কোণে ঝুঁকে আছে বলেই পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তন, ঋতু পরিবর্তন দেখা যায়। বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রার ভিন্নতার কারণে বায়ুপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। স্থলভাগের জলবায়ু আর জলভাগের জলবায়ুর মধ্যেও আছে ব্যাপক পার্থক্য। এই জটিল জলবায়ুর পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস একেবারে সঠিকভাবে দিতে হলে আমাদের জানতে হবে মহাবিশ্বের সব কটি কণার সঠিক অবস্থান ও গতিবেগ। কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব।
অধ্যাপক হেসেলমান দেখলেন আমাদের আবহাওয়ার একটি আদর্শ সাম্যাবস্থা ধরে নিয়ে তার পরিবর্তনকে যদি দ্রুত পরিবর্তনশীল গোলমাল বা নয়েজের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে একটি সমাধান পাওয়া যেতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানে আকাঙ্ক্ষিত তথ্যকে আমরা সিগন্যাল এবং অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্যকে নয়েজ বা গোলমাল হিসেবে ধরে নিয়ে সিগন্যাল টু নয়েজ রেশিও বা তথ্য ও গোলমালের অনুপাত হিসাব করা হয়। তথ্যের চেয়ে গোলমাল বেশি হলে রেজাল্টের কোয়ালিটি খারাপ হয়। সেভাবে হিসাব করলে ধরা যায়, শান্ত আবহাওয়ার নয়েজ কম, ঝোড়ো আবহাওয়ায় নয়েজ বেশি। এখন এই নয়েজের পরিমাণ এবং প্রভাব যদি হিসাব করা যায়, তাহলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। সেভাবে পুরো পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনও হিসাব করা সম্ভব।
এ ধরনের জটিল পদ্ধতির একটি সমাধান অনেক বছর আগে আইনস্টাইনও করেছিলেন, যার নাম ব্রাউনিয়ান গতি। কোনো তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না, এ রকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোনো নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেগুলোর গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। ১৮ শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেওয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন প্রমাণ করেছিলেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের সমান বা তার চেয়ে ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওই রকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো সেগুলোর থার্মাল ডায়নামিকস। বোলটজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। হেসেলমান আবহাওয়ার উপাদানগুলোকে ব্রাউনিয়ান গতির মতো ধরে নিয়ে একটি স্ট্যাটিসটিক্যাল মডেল দাঁড় করালেন। সেই মডেল চমৎকার কাজ করল। তিনি গাণিতিকভাবে প্রমাণ করলেন যে ভূপৃষ্ঠের জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটলেও সমুদ্রে সেই পরিবর্তন হয় অনেক ধীর প্রক্রিয়ায়। তাই মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেলেও সমুদ্রের তাপমাত্রা সেই পরিমাণে বাড়তে কয়েক হাজার বছর লেগে যেতে পারে।
জলবায়ুর পরিবর্তনে মানুষের কি কোনো ভূমিকা আছে? থাকলে কতটুকু আছে? অধ্যাপক হেসেলমান তাঁর জলবায়ুর মডেলের সাহায্যে জলবায়ুর পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা হিসাব করে বের করলেন। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর প্রভাবে তাপমাত্রার কতটুকু পরিবর্তন হয়, তা হিসাব করলেন। আর মানুষের প্রভাব, যাকে তিনি নাম দিলেন ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’, তা–ও হিসাব করলেন। ১৮৫০ সালের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১৭০ বছরে পৃথিবীতে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে ৪০ শতাংশ। এই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রকৃতি গত লাখ বছরেও তৈরি করতে পারেনি। মানুষের জ্বালানি ব্যবহার ও অন্যান্য কারণে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ১ ডিগ্রি।
পৃথিবীর অনেক রাজনৈতিক নেতা বিজ্ঞানের এই সত্যকে মেনে নিতে চান না। এবারের নোবেল পুরস্কার এমন একটা সময়ে দেওয়া হলো যে নেতারা হয়তো মেনে নিতে বাধ্য হবেন। ২০২১ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কনফারেন্স হবে ৩১ অক্টোবর গ্লাসগো। সেখানে অবশ্যই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে মেনে নেওয়া হবে।
এবার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টির জটিলতা বিবেচনা করে নোবেল দেওয়া হলো জটিলতার পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় তাত্ত্বিকভাবে সবচেয়ে সফল পদার্থবিজ্ঞানী জর্জিও পারিসিকে। পদার্থবিজ্ঞানের যেসব কাজকর্মকে আপাতদৃষ্টে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয়, সেগুলোর মধ্যেও একটা সমন্বয়ের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন ইতালিয়ান এই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।
জর্জিও পারিসির জন্ম ১৯৪৮ সালের ৪ আগস্ট ইতালির রোমে। তাঁর দাদা ও বাবা বংশপরম্পরায় ছিলেন নির্মাণশ্রমিক। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর মতো নির্মাণশ্রমিক না হয়ে ভালো কিছু করুক। অন্তত ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু জর্জিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন সায়েন্স ফিকশন। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই পড়তে পড়তে তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝোঁকেন। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর, তিনি ১৯৭০ সালে স্যাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটি অব রোম থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তিনি ইতালির ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি অব ফ্রাসকাটিতে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। এই ল্যাবরেটরিতে ১.১ গিগা-ইলেকট্রনভোল্ট শক্তির ইলেকট্রন সাইক্লোট্রন আছে। সেখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি অতিথি বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করেছেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ইউরোপের অনেক গবেষণাগারে। ১৯৮১ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব রোমে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। তারপর তিনি কোয়ান্টাম থিওরির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন স্যাপিয়েনজা ইউনিভার্সিটি অব রোমে। বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সেও তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।
তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অধ্যাপক জর্জিও পারিসি একটি বিখ্যাত নাম। বিশেষ করে ইতালির বিজ্ঞানজগতের উন্নয়নে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি হলেন ইতালির ষষ্ঠ নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণার ব্যাপ্তি বিশাল। বিশৃঙ্খলার পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার ছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন পার্টিক্যাল ফিজিকস ও স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজিকসেও। ১৯৭৯ সালে তিনি আবিষ্কার করেন প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন কীভাবে বিন্যস্ত থাকে। মৌলিক কণার মৌলিক গঠন বুঝতে সাহায্য করেছে অধ্যাপক পারিসির আবিষ্কার।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে তিনি যে গবেষণার ভিত তৈরি করেন, সেটা বিশৃঙ্খলার পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় বলা চলে কিছুটা শৃঙ্খলা নিয়ে আসে। তাঁর ‘স্পিন-গ্লাস’ তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। বস্তুর ক্ষুদ্রতম জগৎ আপাতদৃষ্টে যতটুকু শৃঙ্খলা মেনে চলে বলে মনে করা হয়, আসলে ততটা নয়। ধরা যাক গ্যাসের কথা। তাপমাত্রা বাড়লে গ্যাসের অণুগুলো ছোটাছুটি করে বিশৃঙ্খলভাবে। তাপমাত্রা কমাতে থাকলে এগুলোর গতি আস্তে আস্তে কমতে থাকে, এগুলো ক্রমে স্থির হয়। তাপমাত্রা আরও কমলে গ্যাস তরল হয়। একই পরিমাণ গ্যাসে একইভাবে তাপমাত্রা কমালে ও বাড়ালে বিভিন্নবার বিভিন্ন রকমের আণবিক বিন্যাস দেখায়। তাহলে আর শৃঙ্খলা থাকল কীভাবে?
অধ্যাপক পারিসি খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে দেখালেন যে কণাগুলো অনবরত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে, হতাশ হয়ে পড়ে। কীভাবে? যদি কোনো অবস্থায় একটি কণার স্পিন হয় ওপরের দিকে, অন্যটির নিচের দিকে, তাহলে তৃতীয় কণার স্পিন কোন দিকে হবে, তা কীভাবে নির্ধারিত হয়—যদি কণাগুলো সব একই রকমের হয়? তৃতীয় কণার ওপর প্রথম কিংবা দ্বিতীয় যেকোনো একটার প্রভাব থাকতে পারে বা দুটিরও প্রভাব থাকলে তৃতীয় কণাটি কি ভিন্ন একটা দিক বেছে নিতে পারে? এই অবস্থাকে স্পিন ফ্রাস্ট্রেশন বা ঘূর্ণন-হতাশা বলা যেতে পারে। ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক পারিসি লোহা ও তামার একটি সংকর পদার্থের মধ্যে চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্যে লোহা ও তামার পরমাণুর স্পিন পরীক্ষা করে দেখেন চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে পরমাণু কোন দিকে ঘুরবে, সে ব্যাপারে দ্বিধা দেখা দেয়। ফলে দেখা যায়, একই পদার্থের পরমাণু হলেও একই চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিকে ঘুরছে। এর কারণ কী? অধ্যাপক পারিসি এই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে পেয়েছেন।
নোবেল কমিটি যদিও বলছে, অধ্যাপক পারিসির গবেষণা এবং অধ্যাপক মানাবে ও হেসেলমানের গবেষণার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক আছে, কিন্তু সে ব্যাপারে জলবায়ুবিজ্ঞানীদের বেশ সন্দেহ আছে। কারণ, স্বয়ং অধ্যাপক মানাবেই অধ্যাপক পারিসির গবেষণার সঙ্গে পরিচিত নন। সে যা–ই হোক, এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কাজ করার ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
সূত্র: www.nobelprize.org, PNAS vol. 103 (21) 2006, Science 292: 641-642 (2001), Physics Today Special edition 2021.