পরমাণুর ভেতরে কী থাকে

একসময় মানুষ ভাবত, পরমাণু পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক। একে আর ভাঙা যায় না। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান পরমাণুকে ভেঙে আরও ক্ষুদ্র কণা আবিষ্কার করেছে। এসব ক্ষুদ্র কণা কী? পরমাণুর ভেতরে আসলে কী থাকে?

শিল্পীর তুলিতে পরমাণুসংগৃহীত

পরমাণুকে বলা হয় পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক। কোনো মৌলিক পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে সবচেয়ে ছোট যে কণায় ওই মৌলের গুণাগুণ অক্ষুণ থাকে, সেটাই ওই পদার্থের পরমাণু। যেমন সোনা বা লোহার কথাই ধরা যাক। একটুকরো লোহাকে ভাঙতে থাকলে এমন একটা পর্যায় আসবে, যখন ভাঙলে তাকে আর লোহা বলা যাবে না। কারণ তার মধ্যে আর লোহার ধর্ম থাকবে না। কাজেই লোহাকে ভাঙার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন যে খণ্ডটা লোহার নিজস্ব ধর্ম বজায় রাখতে পারবে, সেটাই লোহার পরমাণু।

পরমাণু খুব ক্ষুদ্র একটি একক। একে খালি চোখে দেখা যায় না। সেজন্য ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের মাইক্রোস্কোপ। সেই মাইক্রোস্কোপকে বলা হয় ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। প্রাচীন গ্রিস এবং প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতদের ধারণা ছিল পরমাণু অবিভাজ্য। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান পরমাণুকে ভেঙে আরও ক্ষুদ্র কণা আবিষ্কার করেছে। যেমন লোহার পরমাণুকে আরও ক্ষুদ্র কণায় ভাঙা সম্ভব। অবশ্য সেসব অতিপারমাণবিক (আসলে উপপারমাণবিক) কণায় লোহার ধর্ম বজায় থাকবে না।

পরমাণু ভাঙলে পাওয়া যাবে দুটি অংশ। নিউক্লিয়াস এবং তাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমান ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন ও নিউট্রন কণা দিয়ে। এই কণা দুটি নিউক্লিয়াসে ঠাসাঠাসি অবস্থায় একত্রিত থাকে। একটা পরমাণুর ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ হলো নিউক্লিয়াস। কিন্তু নিউক্লিয়াসেই পরমাণুর ৯৯.৯ ভাগ ভর থাকে। সে অর্থে পরমাণু সিংহভাগ জায়গা আসলে ফাঁকা। কাজেই পরমাণু ভাঙলে পাওয়া যাবে তিনটি অতিপারমাণবিক কণা। সেগুলো হলো: প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন। এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হাইড্রোজেন। কারণ হাইড্রোজেন পরমাণুকে ভাঙলে পাওয়া যাবে শুধু প্রোটন এবং ইলেকট্রন।

ইলেকট্রনের তুলনায় প্রোটন ও নিউট্রন বেশ বড় কণা। দুটোর ভরও প্রায় সমান। অন্যদিকে ইলেকট্রনের তুলনায় প্রোটনের ভর প্রায় ১ হাজার ৮৩৬ গুণ বেশি। অর্থাৎ ১ হাজার ৮৩৬টি ইলেকট্রনের ভর যোগ করলে প্রোটনের ভরের সমান হবে। কণাপদার্থবিজ্ঞানে ইলেকট্রনকে বলা হয় মৌলিক কণা। কারণ এদের আর ভাঙা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রোটন ও নিউট্রনকে বলা হয় যৌগিক কণা। কারণ এগুলোই শেষ কথা নয়। এদেরও ভাঙা সম্ভব। যেমন প্রোটন ও নিউট্রন ভাঙলে পাওয়া যাবে আরও ক্ষুদ্র কণা কোয়ার্ক। দুটো কণাই আসলে তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত হয়। তবে এদের গঠনে ভিন্নতা আছে। যেমন দুটি আপ কোয়ার্ক এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত হয় প্রোটন। অন্যদিকে দুটি ডাউন কোয়ার্ক এবং একটি আপ কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত হয় নিউট্রন কণা।

একটি আপ কোয়ার্কের চার্জ +২/৩ এবং একটি ডাউন কোয়ার্কের চার্জ -১/৩। প্রোটনের চার্জ কী হবে, তা এখান থেকে হিসেব করে বের করা যায়। +২/৩ +২/৩ -১/৩ = +১। অর্থাৎ প্রোটন কণা হবে ধনাত্মক চার্জবাহী। অন্যদিকে নিউট্রন হবে চার্জ নিরপেক্ষ। নিজেই হিসেব করে দেখুন: +২/৩ -১/৩ -১/৩ = ০। চার্জ শূন্য, মানে নিউট্রন কোনো চার্জ বহন করে না। এদিকে ইলেকট্রন ঋণাত্মক চার্জবাহী।

আরও পড়ুন
একটি প্রোটন তৈরি হয় দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে
উইকিমিডিয়া
কোয়ার্ক কণাদের গ্লু বা আঠার মতো একত্রে বেঁধে রাখে গ্লুয়ন কণা। এই কণাটিই শক্তিশালী পারমাণবিক বল বা স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের বাহক হিসেবে কাজ করে

প্রকৃতিতে কোয়ার্ক কণাকে কখনও আলাদা পাওয়া যায় না। এরা সবসময় জোড় বেঁধে থাকে। কোয়ার্ক কণাদের গ্লু বা আঠার মতো একত্রে বেঁধে রাখে গ্লুয়ন কণা। এই কণাটিই শক্তিশালী পারমাণবিক বল বা স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের বাহক হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়াসের দিকে আকর্ষণ করে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল। প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে এটি অন্যতম। চার্জ বহন করে এমন যেকোনো কণার ওপর এই বলটি কাজ করে। এর বাহক কণাকে বলা হয় ফোটন। এই বলটির কারণেই ইলেকট্রন সবসময় নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই বলটির কারণেই আমাদের বর্তমান ইলেকট্রিক্যাল বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, দুটি সমধর্মী চার্জ তো চুম্বকের মতো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তাহলে প্রোটনগুলো নিউক্লিয়াসে একত্রে থাকে কীভাবে? বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের কারণে তো প্রোটনগুলোকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা! আসলে নিউক্লিয়াসে আরেকটি বল কাজ করে, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেটি হলো শক্তিশালী পারমাণবিক বল। স্বল্পপাল্লার এই বলটি বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। সে কারণে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলকে উপেক্ষা করে নিউক্লিয়াসে আধিপত্য বিস্তার করে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। এই বলটিই নিউক্লিয়ার ফিশন এবং পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বিপুল শক্তির পেছনে দায়ী।

নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের কক্ষপথ
সংগৃহীত

তবে কোনো বিশেষ কারণে এই বলটির চেয়ে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাতে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়। একে বলা হয় পারমাণবিক ক্ষয়। সাধারণত তেজস্ক্রিয় (যেমন ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম) পরমাণুতে এই ঘটনা ঘটে। পরমাণুর এ ঘটনার পেছনে কাজ করে আরেকটি বল। সেটি দুর্বল পরমাণবিক বল বা উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স নামে পরিচিত, যা শুধু অতিপারমাণবিক পরিসরে কাজ করে। প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে এটি একটি। এর কাজ সবল নিউক্লিয়ার বলের ঠিক উল্টো। এ বলের প্রভাবে কোয়ার্কের চেহারা পাল্টে যেতে পারে। মানে, নিউট্রনের ভেতরের একটি ডাউন কোয়ার্ক পরিণত হতে পারে আপ কোয়ার্কে। তাতে নিউট্রন পরিণত হবে একটি প্রোটন এবং ইলেকট্রনে। নিউক্লিয়ার ফিউশনের জন্য এই বলটি দায়ী। এ প্রক্রিয়ার কারণে সূর্যসহ সব নক্ষত্রের বুকে ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরিণত হচ্ছে হিলিয়ামে। সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। আবার এ বলটির কারণে পৃথিবীর কেন্দ্র উত্তপ্ত হচ্ছে এবং এ গ্রহে প্রাণের টিকে থাকার উপযোগী পরিবেশ বজায় থাকছে। এ ছাড়া ভারী প্রজন্মের মৌলগুলো বিভাজিত হয়ে সাধারণ স্থিতিশীল মৌল পরিণত হচ্ছে এই দুর্বল বলের কারণেই।

তবে কোনো বিশেষ কারণে এই বলটির চেয়ে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাতে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়। একে বলা হয় পারমাণবিক ক্ষয়

কোনো পরমাণুর নিউট্রন ও প্রোটন সংখ্যার ওপর নির্ভর করে সেটি কোন মৌলের পরমাণু হবে। যেমন আগেই বলেছি, সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজনের প্রোটন সংখ্যা একটি। আর প্রকৃতিতে সবচেয়ে ভারী যে মৌলটি পাওয়া যায়, সেটি হলো ইউরেনিয়াম। এর প্রোটন সংখ্যা ৯২টি। এর ইলেকট্রন সংখ্যাও ৯২টি। তবে প্রকৃতিতে দুরকম ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। এর একটি হলো ইউরেনিয়াম-২৩৫, অন্যটি ইউরেনিয়াম-২৩৮। প্রথমটির নিউট্রন সংখ্যা ১৪৩টি এবং দ্বিতীয়টিতে ১৪৬টি। এদেরকে বলা হয় আইসোটপ।

উল্টো দিক থেকে যদি বলি, তাহলে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের প্রভাবে তিনটি কোয়ার্ক একত্রিত হয়ে গঠিত হয় প্রোটন ও নিউট্রন। এই প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হয়ে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস। আর বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের প্রভাবে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণমান ইলেকট্রন সমেত গঠিত হয় পরমাণু। এটাই গোটা মহাবিশ্বে আমাদের চেনা-জানা বস্তু বা পদার্থের গাঠনিক একক।

 লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: ওয়ান থিং ইউ নিড টু নো/ মার্কাস চোন

ডিকে: ফাইন্ড আউট সিরিজ

উইকিপিডিয়া