পদার্থবিজ্ঞান
কক্ষতাপমাত্রায় অদৃষ্টপূর্ব কোয়ান্টাম দশা
বাস্তব জীবনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করা কঠিন। এ জন্য কক্ষতাপমাত্রায় কোনো পদার্থে কোয়ান্টাম দশা দেখা সম্ভব কি না, এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে সেই অসাধ্য সাধন করেছেন বাংলাদেশের সন্তান, বাংলাদেশি-মার্কিন বিজ্ঞানী ও গবেষক জাহিদ হাসান। এ আবিষ্কার এত গুরুত্বপূর্ণ যে পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার ম্যাটেরিয়ালস-এর অক্টোবর সংখ্যার মলাটে জায়গা করে নিয়েছে। সেই আবিষ্কারের আদ্যোপান্ত…
বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। কোয়ান্টাম মেকানিকসের জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলো ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। তখনো বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ধারণা করতে পারেননি, কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে লাগবে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ব্যবহার দূরের কথা, এর কলকবজা বুঝতে পারা তখন দুরূহ ছিল অনেকের জন্য। রিচার্ড ফাইনম্যানের মতো বিজ্ঞানী বলেছেন, কেউ যদি দাবি করেন তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস বুঝেছেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস আসলে বোঝেন না। তবু এই দুর্বোধ্য বিষয়ের অন্তর্নিহিত শক্তি ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তিতে কাজে লাগাতে অবিরাম গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। তার সুফল আমরা একুশ শতকে এসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোগ করছি।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ক্রমেই হয়ে উঠছে কোয়ান্টাম প্রযুক্তিনির্ভর। আর এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি সহজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য যে বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করছেন ও ক্রমাগত সাফল্য লাভ করছেন, তাঁদের অন্যতম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ইউজিন হিগিনস অধ্যাপক জাহিদ হাসান। তাঁর নেতৃত্বে, তাঁর গবেষণাগারে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে স্বাভাবিক কক্ষতাপমাত্রায় কোয়ান্টাম দশা। যে কোয়ান্টাম দশা এত দিন শুধু পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পাওয়া গেছে, সেখানে তা বিশেষ কিছু পদার্থে স্বাভাবিক কক্ষতাপমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করার ঘটনা অদৃষ্টপূর্ব। অর্থাৎ আগে কখনো দেখা যায়নি। এ আবিষ্কার এত গুরুত্বপূর্ণ যে পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার ম্যাটেরিয়ালস-এর অক্টোবর সংখ্যার মলাটকাহিনি হয়েছে এ ঘটনা। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে হইচই ফেলে দিয়েছে প্রফেসর জাহিদ হাসানের এই আবিষ্কার। খুলে দিয়েছে কোয়ান্টাম ন্যানো প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনার দ্বার। অচিরেই প্রচলিত ইলেকট্রনিকসের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে এটি।
কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই হঠাৎ এক দিনে হয়ে যায় না। প্রফেসর জাহিদ হাসানের দীর্ঘ ১৭ বছরের ধারাবাহিক গবেষণার ফসল এই সফলতা। বাংলাদেশি-মার্কিন অধ্যাপক জাহিদ হাসান এক্সপেরিমেন্টাল কোয়ান্টাম টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়াল গবেষণার অগ্রদূত। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে স্নাতক শেষ করে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ২০০২ সালে। কোয়ান্টাম টপোলজি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তিনি ত্রিমাত্রিক বিসমাথ-অ্যান্টিমনির কেলাসে আবিষ্কার করেছেন টপোলজিক্যাল বিন্যাস।
টপোলজি গাণিতিকভাবে খুবই জটিল জ্যামিতিক বিজ্ঞান। কোনো জ্যামিতিক আকার যদি ক্রমেই পরিবর্তিত হতে থাকে, আর যতই পরিবর্তন হোক না কেন, যদি মূল অংশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, তাহলে তাদের একই টপোলজিক্যাল সেটের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা যায়। মোটাদাগের উদাহরণ হিসেবে মৃৎশিল্পের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। এক তাল মাটি থেকে যখন ধাপে ধাপে আকার পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি পাত্র তৈরি হয়, তখন প্রতিটি ধাপের আকার একেকটি টপোলজিক্যাল স্তর। কিন্তু মূল কাঠামো থেকে যদি কোনো অংশ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেটা আর প্রথম টপোলজির অংশ থাকে না। সেটা থেকে আরেকটি নতুন টপোলজির সূচনা করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে টপোলজির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। জীববিজ্ঞানে টপোলজি ব্যবহারের বিশাল ক্ষেত্র অপেক্ষা করে আছে। জীবকোষগুলো আণুবীক্ষণিকভাবে প্রতিক্ষণে আকার বদলাচ্ছে। সেগুলোর গঠন পর্যবেক্ষণে তো বটেই, শরীরের প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের প্রতিটি মোচড় ব্যাখ্যা করা যায় টপোলজি দিয়ে।
অধ্যাপক জাহিদ হাসান টপোলজি প্রয়োগ করে চলেছেন পদার্থবিজ্ঞানের কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিকস, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে। তিনি আবিষ্কার করেছেন টপোলজিক্যাল ডিরাক ম্যাটেরিয়াল বা ডিরাক সেমিমেটাল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি সেমিকন্ডাক্টরের জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে। তারপর তাঁর হাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে টপোলজিক্যাল ম্যাগনেটিক ম্যাটেরিয়াল। ২০১৪-১৫ সালে তিনি আবিষ্কার করেছেন সম্পূর্ণ নতুন একধরনের টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়াল। এর নাম দেওয়া হয়েছে ম্যাগনেটিক ভাইল সেমিমেটাল। জার্মান তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হারমান ভাইল (Weyl)। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেছিলেন। এ ধরনের সেমিমেটাল পাওয়ার সম্ভাবনার তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন বিশ শতকের প্রথমার্ধে। অধ্যাপক জাহিদ হাসান সেই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত করেছেন গবেষণাগারে এই সেমিমেটাল আবিষ্কারের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিস থেকে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট (স্বত্ব) পেয়েছেন বাংলাদেশি-মার্কিন এই বিজ্ঞানী।
এই কোয়ান্টাম টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়ালগুলো আবিষ্কারের সূচনা হয়েছে ১৯৮০-৮৫ সালে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু মূল হল ইফেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল শতাধিক বছর আগে। কোনো পরিবাহীর ভেতর দিয়ে যখন বিদ্যুৎ চালনা করা হয়, তখন বিদ্যুৎপ্রবাহের সঙ্গে লম্বভাবে যদি ভোল্টেজ মাপা হয়, তাহলে ওই পরিবাহীর মধ্যে ভোল্টেজের কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু যদি বিদ্যুৎপ্রবাহের সঙ্গে লম্বভাবে কোনো চৌম্বক প্রবাহ প্রয়োগ করা হয়, তখন পরিবাহীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলো চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে যায়। ফলে পরিবাহীর ভেতর ভোল্টেজের পার্থক্য দেখা যায়। মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এডউইন হল (Hall) এটা আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর শুধু পরিবাহী নয়, অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রেও হল ইফেক্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৮০ সালে। ১৯৮৫ সালে জার্মান প্রফেসর ক্লাউস ফন ক্লিটজিং পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য।
কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় কোয়ান্টাম টপোলজির মাধ্যমে। এর পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম টপোলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। আবিষ্কৃত হয়েছে টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর বা অপরিবাহী, টপোলজিক্যাল সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী, টপোলজিক্যাল ম্যাগনেট বা চুম্বক এবং প্রফেসর জাহিদ হাসান আবিষ্কার করেছেন ভাইল সেমিমেটাল।
এই আবিষ্কারগুলো ধারাবাহিকভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আসছে। ১৯৯৮ সালে ফ্র্যাকশনাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট লাভলিন, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির হোর্স্ট স্টুর্মার এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড্যানিয়েল সুই (Tsui)। তারপর ২০১৬ সালে টপোলজিক্যাল ফেজ ট্রানজিশন ও টপোলজিক্যাল ফেজেজ অব ম্যাটারের তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড থাউলেস, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডানকান হ্যালডেন এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল কস্টারলিৎজ। এর ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক জাহিদ হাসানের নোবেল পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এ পর্যন্ত যতগুলো টপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম ম্যাটেরিয়াল ও সেমিমেটাল আবিষ্কৃত হয়েছে, তার সব কটিই কাজ করে শুধু পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পরিবেশে। এ রকম পরিবেশ তৈরি করা প্রচুর খরচসাপেক্ষ। আর উন্নত গবেষণাগারে কেবল তা করা সম্ভব। তাই তাদের বাস্তব প্রয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা তাপমাত্রা। কক্ষতাপমাত্রায় কাজ না করলে এসব পদার্থ কাজে লাগানো সহজ নয়।
পদার্থের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার ব্যাপার অত্যন্ত দরকারি। পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়বীয়—এ তিন অবস্থার কথা আমরা জানি। কক্ষতাপমাত্রায় পদার্থের এ তিন অবস্থা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এর বাইরে পদার্থের আরও দুটি অবস্থা আছে—প্লাজমা ও কোয়ান্টাম কনডেনসেট। এ দুটি পদার্থের বিশেষ অবস্থা। অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থের পরমাণুর গতি এত বেশি বেড়ে যায় যে ইলেকট্রনগুলো পরমাণু থেকে আলাদা হয়ে আয়নিত গ্যাসে পরিণত হয়। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মোট পদার্থের ৯৯ শতাংশ প্লাজমা অবস্থায় আছে। আমাদের সূর্যসহ সব নক্ষত্রে পদার্থগুলো প্লাজমা অবস্থায় টগবগ করে ফুটছে ভীষণ উত্তপ্ত অবস্থায়। অন্যদিকে পদার্থের কোয়ান্টাম ঘনীভবন বা কোয়ান্টাম কনডেনসেট পাওয়া যায় তাপমাত্রা কমতে কমতে পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে। সত্যেন বসু এবং আইনস্টাইনের গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে পদার্থের বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট।
অপরিবাহী পদার্থের ভেতর কন্ডাকশন ব্যান্ড ও ভ্যালেন্স ব্যান্ডের মধ্যে শক্তির পার্থক্য প্রায় ১০ ইলেকট্রন-ভোল্ট। অর্ধপরিবাহীর ভেতর শক্তিস্তরের পার্থক্য পদার্থভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
সূক্ষ্মভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, পদার্থের সব ধর্মই কোয়ান্টাম মেকানিকস দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়বীয় দশায় কোয়ান্টাম মেকানিকসের ধর্মগুলো থেকে যায় অদৃশ্য। কিন্তু তাপমাত্রা যখন কমানো হয়, পরমাণুর গতি ক্রমেই কমতে শুরু করে। আর কণাগুলোর কম্পনও থেমে যায় ধীরে ধীরে। এ অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কিন্তু এ রকম শীতল পরিবেশ তৈরি করে গবেষণা করা আর প্রযুক্তিগতভাবে কাজে লাগিয়ে সাধারণের ব্যবহার উপযোগী বস্তুতে রূপান্তর করা ভিন্ন বিষয়। তাই এ ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করছেন, সেসব বিজ্ঞানীর সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছেন—কক্ষতাপমাত্রায় যদি কোয়ান্টাম ইফেক্ট দেখার মতো কোনো পদার্থ পাওয়া যেত! এই অসাধ্য সাধন করেছেন অধ্যাপক জাহিদ হাসান ও তাঁর গবেষক দল। তাঁরা বিসমাথ-ব্রোমাইড সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কার করেছেন কক্ষতাপমাত্রায়।
পদার্থের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার ভিত্তিতে আমরা পদার্থকে পরিবাহী, অপরিবাহী ও অর্ধপরিবাহীতে ভাগ করি। তবে পদার্থের কোয়ান্টাম শক্তিস্তরের ভিত্তিতে তাদের আরও সূক্ষ্মভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আসলে, যেকোনো পদার্থের ভেতরে ইলেকট্রন মূলত দুটি স্তর বা ব্যান্ডে থাকে। এর একটি হলো কন্ডাকশন বা পরিবহন ব্যান্ড, আরেকটি ভ্যালেন্স বা যোজনী ব্যান্ড। এ দুটি ব্যান্ড বা স্তরের মধ্যে ফাঁক আছে কি না, তার ভিত্তিতে পদার্থের পরিবাহিতার বিষয়টি বোঝা যায়।
পরিবাহীর মধ্যে কন্ডাকশন (পরিবহন) ও ভ্যালেন্স (যোজনী) ব্যান্ডের মধ্যে কোনো ফাঁক থাকে না। সেখানে ইলেকট্রনের প্রবাহে তাই কোনো সমস্যা হয় না। অপরিবাহী পদার্থের ভেতর কন্ডাকশন ব্যান্ড ও ভ্যালেন্স ব্যান্ডের মধ্যে শক্তির পার্থক্য প্রায় ১০ ইলেকট্রন-ভোল্ট। অর্ধপরিবাহীর ভেতর শক্তিস্তরের পার্থক্য পদার্থভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ইনসুলেটর বা অপরিবাহী পদার্থ বললে আমরা যেমন ধরে নিই যে তার ভেতর দিয়ে কোনো ইলেকট্রনই প্রবাহিত হবে না, কোয়ান্টাম টপোলজির গবেষণায় যে টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর ব্যবহৃত হয়, তার ক্ষেত্রে এটা খাটে না। টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর কাজ করে ভিন্নভাবে। এই অপরিবাহীর ভেতরে কোনো ইলেকট্রনপ্রবাহ থাকে না। কিন্তু এর প্রান্ত ঘেঁষে যেসব ইলেকট্রন থাকে, তারা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে, ফলে প্রান্তে ইলেকট্রন প্রবাহ থাকে। আকারের পরিবর্তন হলেও এই ইলেকট্রন প্রবাহে তার কোনো প্রভাব পড়ে না।
টপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম দশার পরীক্ষায় টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর ব্যবহার করেছে অধ্যাপক জাহিদ হাসানের দল। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল বিসমাথ-ব্রোমাইডের সংকর পদার্থে ভাইল কণার ধর্ম পরিলক্ষিত হয় কি না, তা দেখা। কিন্তু তাঁরা এই সংকরে ভাইল কণার ধর্ম খুঁজে পাননি। তবে তাঁদের আগের গবেষণা বিসমাথ-অ্যান্টিমনির সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করে দেখলেন যে বিসমাথ-ব্রোমাইডের সংকরে কক্ষতাপমাত্রায় কোয়ান্টাম স্পিন হল ইফেক্ট পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তাঁরা এটা করে দেখিয়েছেন।
এ আবিষ্কারের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কোয়ান্টাম স্পিন কাজে লাগিয়ে তৈরি হবে আরও শক্তিশালী ইলেকট্রনিকস। ন্যানোটেকনোলজি এবং পুরো ম্যাটেরিয়াল ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যাবে কোয়ান্টাম ম্যাটেরিয়ালের দিকে। দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম মেকানিকস থেকে বিরাট উত্তরণ ঘটিয়ে সবার ব্যবহারোপযোগী কোয়ান্টাম পদার্থের নতুন জগৎ তৈরি করার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছেন আমাদের বাংলাদেশের সন্তান জাহিদ হাসান।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
তথ্যসূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ; প্রিন্সটন ডট এডু; টম গারলিংহাউজ, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি; নেচার ম্যাটেরিয়ালস, অক্টোবর ২০২২