একটি আণুবীক্ষণিক ভ্রমণ

দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব অবস্থার মুখোমুখি হই, কোনো নক্ষত্রের কেন্দ্রে কিংবা গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের স্থানের ভৌত অবস্থা হতে পারে তার চেয়ে একেবারে ভিন্নরকম। তাই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে বিভিন্ন অবস্থায় বস্তুর আচরণ ও প্রকৃতি বোঝা জরুরি। অর্থাৎ বস্তুর মৌলিক উপাদান ও তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মকানুন আমাদের জানতে হবে।

এক টুকরো শক্ত বরফখণ্ডের কথা ভাবা যাক। দৈনন্দিন জীবনে এর সঙ্গে আপনি পরিচিত। অন্য বেশিরভাগ কঠিন পদার্থের মতো বরফের আকারেরও একটা নির্দিষ্ট অনমনীয়তা রয়েছে। কারণ কঠিন পদার্থ সুষমভাবে সজ্জিত পরমাণু দিয়ে গঠিত। আর পরমাণু হলো পদার্থের মৌলিক একক। পরমাণুর এরকম নিয়মিত বা সুষম বিন্যাসকে বলা হয় ক্রিস্টাল ল্যাটিস বা স্ফটিক জালি। বলা যায়, বেশিরভাগ কঠিন পদার্থের ক্রিস্টালাইন বা স্ফটিক-সদৃশ্য কাঠামো রয়েছে। পরমাণু নিঃসন্দেহে অতিক্ষুদ্র। এগুলো ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মধ্যে মোটামুটি ঘনিষ্ঠভাবে ঠাসা থাকে।

কোনো কঠিন পদার্থের এক সেন্টিমিটারের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে থাকতে পারে প্রায় একশ মিলিয়ন বা ১০ কোটি পরমাণু। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে দশের সূচক হিসেবে বলা যায়, বরফের এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যে পরমাণু থাকে ১০টি। তার মানে, একটা ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মধ্যে পরমাণুগুলোর মধ্যবর্তী ব্যবধান হবে এক সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ প্রায় ১/১০০,০০০,০০০ সেন্টিমিটার। এ সংখ্যাকে সাধারণত লেখা হয় ১০-৮ সেন্টিমিটার। এখানে ১০-৮ সংকেতে ৮-এর আগে বিয়োগ চিহ্ন থাকার অর্থ হল ১০ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ১০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ।

১০-৮ দৈর্ঘ্যকে বলা হয় এক অ্যাংস্ট্রম (সংক্ষেপে ১Å)। কাজেই একটা ক্রিস্টালের ভেতরে পরমাণুদের মধ্যকার ব্যবধান এক অ্যাংস্ট্রম। একটা কঠিন ছোট ঘনক, যার বাহুর দৈর্ঘ্য ১ সেমি, তাতে পরমাণু থাকবে প্রায় ১০২৪টি।

প্রশ্ন হলো, পরমাণুগুলোর একরম সুষম বা নিয়মিত সজ্জায় থাকার কারণ কী? দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট কিছু বল কাজ করে এসব পরমাণুর ভেতরে। এসব বল পরমাণুগুলোকে ক্রিস্টাল ল্যাটিস রূপে একত্রে আবদ্ধ রাখে, তাদের কঠিন পদার্থের মতো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্ম দেয়। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, বরফের ঘনক ছোট খণ্ডে ভাঙার জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়। ক্রিস্টালটিকে কিছু বল শক্তির যোগান দিয়ে একত্রে ধরে রাখে। বরফ ভাঙার সময় সেগুলো একধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

প্রক্রিয়াটি অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে ধরে নিয়ে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। একটা কঠিন বস্তুতে যদি ক্রমেই বেশি বেশি শক্তি সরবরাহ করা হয়, তাহলে কী ঘটবে? আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে উত্তরটা পেয়ে যাওয়ার কথা। তাপ একধরনের শক্তি। তাই এক টুকরো বরফে তাপ দেওয়ার মানে, তাতে ক্রমেই বেশি বেশি তাপের যোগান দেওয়া। আপনি জানেন, বরফের টুকরোয় যথেষ্ট তাপশক্তির যোগান দেওয়া হলে সেটা গলে গিয়ে পরিণত হবে তরল পানিতে। তাপ সরবরাহে শক্তির পরিমাণ যথেষ্ট হলে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের ভেতরের পরমাণুগুলোর বন্ধন ভেঙে ফেলবে। তাতে ভেঙে পড়বে বরফের কাঠিন্য। অন্য যেকোনো কঠিন পদার্থেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কঠিন পদার্থে তাপ দেওয়া মানে, তাতে ক্রমে বেশি বেশি তাপের যোগান দেওয়া। এক পর্যায়ে এমন মুহূর্ত আসে, যখন কঠিন পদার্থটা গলে যায় এবং তরলে রূপান্তরিত হয়। (বিভিন্ন কঠিন পদার্থকে গলানোর জন্য দরকারী তাপশক্তির পরিমাণ নিঃসন্দেহে ভিন্ন। একটুকরো লোহার চেয়ে একটুকরো বরফ গলানো অনেক সহজ।) এক গ্রাম বরফ গলাতে প্রায় ৮০ ক্যালরি শক্তি দরকার। এই পরিমাণটা, অর্থাৎ ‘ক্যালরি’ হলো শক্তি পরিমাপের একক। (ব্যায়াম ও ডায়েটের সঙ্গে সম্পর্কিত এই এককের কথা নিশ্চয়ই অনেকেই শুনেছেন। এর সবকিছু করা হয় শক্তির যোগান দিতে বা পুড়িয়ে ফেলতে)। পদার্থবিদ্যায় শক্তির জন্য আরও কিছু একক হরহামেশা ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন ঘন ব্যবহৃত হয় আর্গ (erg)। এক আর্গ মানে প্রায় ২.৩৮×১০-৮ ক্যালরি। কাজেই বলা যায়, এক গ্রাম বরফ গলাতে ৩.৪×১০ আর্গ দরকার। এতে বরফের দৃঢ়তা হারিয়ে যাবে এবং পানিও প্রবাহিত হবে সহজে।

এই তরলে ক্রমে আরও শক্তির যোগান দিয়ে ওপরের পরীক্ষাটা আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়। এতে প্রথমে পানিটুকু কেবল উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে থাকবে। অচিরেই দেখা দেবে আরেকটা পরিবর্তন। তখন ওই তরল পরিণত হবে গ্যাসে। অর্থাৎ পানিটা পরিণত হবে বাষ্পে। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, পানির তুলনায় বাষ্প প্রায় অদৃশ্য। তার কারণ হলো, পানির পরমাণুর তুলনায় বাষ্প গঠনকারী পরমাণুগুলো অনেক বেশি পাতলাভাবে বিন্যস্ত থাকে। (এক ঘন সেন্টিমিটার পানির তুলনায় এক ঘন সেন্টিমিটার বাষ্পে প্রায় এক হাজার ভাগ কম পরমাণু থাকে।) যেকোনো কঠিন পদার্থের জন্য গ্যাসীয় দশা সাধারণ ঘটনা। পর্যাপ্ত শক্তির যোগান দিয়ে লোহা গলিয়ে লোহার পরমাণুর গ্যাসীয় বাষ্প তৈরি করা সম্ভব।

ওপরের ক্রমানুসারে আমরা পদার্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটা অবস্থা দেখলাম—কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়। নিজেদের অন্তস্থ উপাদানের ওপর ভিত্তি করে কিছু মৌল কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে (যেমন লোহা, তামা ইত্যাদি)। অন্যদিকে কিছু মৌল থাকতে পারে তরল অবস্থায় (যেমন পারদ, ব্রোমিন ইত্যাদি)। আর কিছু মৌল থাকে গ্যাসীয় অবস্থায় (যেমন অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি)। কাজেই তাপ দিয়ে বা শীতল করে যেকোনো মৌলকে অন্য যেকোনো অবস্থায় আনা সম্ভব। যেমন আমরা জানি, বাষ্পকে ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নিচে ঠান্ডা করলে তা পানিতে পরিণত হয়। মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (বা শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রার ১৮৩ ডিগ্রি নিচে) ঠান্ডা করলে অক্সিজেনকে তরলে পরিণত করা সম্ভব।

আমরা যত তাপশক্তি দিতে থাকি, ততই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। সে কারণে বলা যায়, কোনো বস্তুর শক্তির পরিমাণের পরিমাপই তাপমাত্রা। এভাবে দেখা যায়, যেকোনো বস্তুর জন্য সর্বনিম্ন শক্তি দশা ঘটে মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। কোনো বস্তুর তাপমাত্রা এই মানের নিচে নামিয়ে আনা অসম্ভব। অর্থাৎ কোনো বস্তুকে এরচেয়ে শীতল করা অসম্ভব। (কোনো বস্তুকে শীতল করতে ওই বস্তু থেকে তাপ বের করে আনতে হয়। কিন্তু সেটা যদি এর আগেই সর্বনিম্ন তাপীয় দশায় থাকে, তাহলে তা করা অসম্ভব।) পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে অন্য রকম একক ব্যবহার করা বেশি সুবিধাজনক, যাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির সঙ্গে মানানসই। এই একককে বলে কেলভিন। একে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে এতে শূন্য ডিগ্রি কেলভিন (0 K) মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের সমান। তাই কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রা পেতে, সেন্টিগ্রেডে প্রকাশিত তাপমাত্রার সঙ্গে ২৭৩ যোগ করতে হবে। কাজেই কেলভিন এককে মাইনাস ১৮৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা হবে -১৮৩+২৭৩=৯০ কেলভিন (অক্সিজেন এই তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হয়)।

দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে একত্রে আটকে ফেলে একটা হাইড্রোজেন অণু তৈরি করতে যে শক্তি দরকার, তা আসে পরমাণুগুলোর মাঝখানের নির্দিষ্ট বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স থেকে।

কঠিন পদার্থ থেকে শুরু করে যেকোনো পদার্থে ক্রমাগত আরও শক্তি যোগ করে প্রথমে তরলে, এরপর গ্যাসে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু গ্যাসে আরও শক্তি সরবরাহ করা হলে কী ঘটবে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য পদার্থের উপাদান সম্পর্কে জানতে হবে একটু গভীরভাবে। যেমন সবচেয়ে সরল গ্যাস হাইড্রোজেনের কথা ধরা যাক। হাইড্রোজেন গ্যাসের একেকটা একক আসলে হাইড্রোজেন পরমাণু নয়, বরং তা হাইড্রোজেনের অণু। দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় একটা হাইড্রোজেন অণু। (আসলে বরফ, পানি ও বাষ্পের বর্ণনার সময় আমরা কিছু ফাঁকিবাজি করেছি। বর্ণনা সরল করতেই সেটা করতে হয়েছে। পানির একেকটি অণু গঠিত হয় দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটা অক্সিজেন পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে।)

দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে একত্রে আটকে ফেলে একটা হাইড্রোজেন অণু তৈরি করতে যে শক্তি দরকার, তা আসে পরমাণুগুলোর মাঝখানের নির্দিষ্ট বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স থেকে। ওপরে যে কঠিন পদার্থের ক্রিস্টালাইন প্রকৃতির কথা বলেছি, তার জন্য যে ধরনের বল দায়ী, এখানেও ঠিক একই বল কাজ করে। এই বন্ধন ভাঙতেও পর্যাপ্ত শক্তির যোগান দিলে হাইড্রোজেন অণু ভেঙে দুটি আলাদা হাইড্রোজেন পরমাণুতে পরিণত হবে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটা হাইড্রোজেন অণুকে ভেঙে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে আনতে প্রায় ৭.২×১০-১২ আর্গ শক্তির প্রয়োজন। আবারও দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন অণু বা পরমাণুতে জড়িত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার জন্য অতিক্ষুদ্র সংখ্যার রাশি দরকার। এই রাশিগুলো আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার তুলনায় আলাদা। পারমাণবিক বা আণবিক প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকা শক্তিগুলো মাপতে আরেকটা একক ব্যবহার করা হয়। শক্তির এই এককের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় থাকা দরকার। একে বলা হয় ইলেকট্রন ভোল্ট (eV)। এক ইলেকট্রন ভোল্ট হলো ১.৬×১০-১২ আর্গের সমতূল্য। কাজেই হাইড্রোজেন অণুর বন্ধনের শক্তি প্রায় ৪.৫ ইলেকট্রন ভোল্ট। 

এই শক্তি সরবরাহের সম্ভাব্য একটা উপায় হলো দুটো হাইড্রোজেন অণুকে পর্যাপ্ত গতিতে সংঘর্ষ ঘটানো। কোনো গ্যাসে তাপ শক্তি দিলে অণুগুলো দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে। আবার আমরা জানি, গ্যাসটিতে তাপ শক্তি দিলে তার তাপমাত্রাও বাড়ে। আসলে দুটো বর্ণনা একই। কোনো গ্যাসের তাপমাত্রা আসলে তার গড় শক্তির পরিমাপ, যার সঙ্গে অণুগুলো গ্যাসের ভেতর চলাফেরা করে এলোমেলোভাবে। হাইড্রোজেন গ্যাসে কক্ষ তাপমাত্রায় (প্রায় ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, কেলভিন স্কেলে যার মান ২৭+২৭৩=৩০০ কেলভিন) প্রতিটি অণুর গড় শক্তি থাকে প্রায় ০.০২৬ ইলেকট্রন ভোল্ট। তাপমাত্রা ১০০ গুণ বেশি (যেমন ৩০ হাজার কেলভিন) হলে প্রতিটি অণুর শক্তি থাকত প্রায় একশ গুণ বেশি। অর্থাৎ প্রতিটি অণুর শক্তি থাকত প্রায় ২.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট। গ্যাসটিকে প্রায় ৫.২×১০ = ৫২ হাজার কেলভিন তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে, প্রতিটি অণুতে গড়ে ৪.৫ ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তির যোগান দেওয়া যায়। অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে হাইড্রোজেন অণুগুলো ভেঙে আলাদা আলাদা পরমাণুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হয় হাইড্রোজেনের পরমাণু দিয়ে, অণু দিয়ে নয়।

নাছোড়বান্দার মতো এরপরও যদি আরও শক্তি দিই, তাহলে কী হবে? এখন আমরা হাইড্রোজেন পরমাণুতে সরাসরি শক্তি সরবরাহ করছি। কাজেই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য একটা পরমাণুর প্রকৃতি ও গাঠনিক উপাদানগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।

গ্যাসটা যদি হাইড্রোজেন না হয়ে অন্য কোনো মৌল দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে? ধরা যাক, অক্সিজেন, তাহলে কী হবে? অক্সিজেনের একটা পরমাণু আটটি ইলেকট্রন ও একটি নিউক্লিয়াস দিয়ে গঠিত। এই নিউক্লিয়াসে রয়েছে আটটি নিউট্রন ও আটটি প্রোটন।

পরমাণু আসলে একটা ‘নিউক্লিয়াস’ এবং ইলেকট্রন নামে কিছু কণা দিয়ে তৈরি। এ হিসেবে পরমাণুর মডেল তৈরি করা যায়। দেখা যায়, পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে একটা নিউক্লিয়াস। তাকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরছে ইলেকট্রন কণারা। (জোর দিয়েই বলতে হবে যে এটা অতিসরলীকৃত চিত্র। কক্ষপথের মতো ধারণা পারমাণবিক পরিসরের ক্ষেত্রে খাটে না। তবু পারমাণবিক কিছু ঘটনা বোঝার জন্য এটা বেশ কার্যকর। তাই চিত্রটা আমরা বারবার ব্যবহার করব।) খোদ পারমাণবিক নিউক্লিয়াস দুই ধরনের কণা দিয়ে গঠিত। সেগুলোর নাম প্রোটন এবং নিউট্রন। এদের মধ্যে প্রোটন ধনাত্মক চার্জ বহন করে এবং নিউট্রনের কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই। কাজেই প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত নিউক্লিয়াসের চার্জ বা আধান ধনাত্মক হয়। অন্যদিকে নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক। কোনো পরমাণুতে সমান সংখ্যক প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে। কাজেই সেটা বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ হয়। একটা পরমাণুর আকার মাত্র কয়েক অ্যাংস্ট্রম। (মনে আছে নিশ্চয়ই, এক অ্যাংস্ট্রম হলো ১০-৮ সেমি)। সে তুলনায় নিউক্লিয়াসের আকার অনেক ছোট। এর আকার প্রায় ১০-১৩ সেমি। (বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পরমাণুর সিংহভাগ জায়গাই খালি। আর সব বস্তুই গড়ে ওঠে পরমাণু দিয়ে। তার মানে বেশিরভাগ বস্তুই আসলে ফাঁপা!)

ইলেকট্রন এবং প্রোটন সমপরিমাণ, কিন্তু বিপরীত চার্জ বহন করে। ইলেকট্রনের চেয়ে প্রোটন প্রায় ২ হাজার গুণ ভারী। কাজেই সত্যি বলতে কী, সব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরমাণুর ভর তার নিউক্লিয়াসের নিউট্রন এবং প্রোটনের মধ্যেই থাকে।

হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে, এর নিউক্লিয়াসে কোনো নিউট্রন থাকে না। কাজেই হাইড্রোজেনের পারমাণবিক কাঠামো অতি সরল। এতে একটা মাত্র প্রোটন এবং একটা মাত্র ইলেকট্রন থাকে। ইলেকট্রনটা প্রোটনের চারপারশে ঘুরপাক খায়। হাইড্রোজেন অণুর মতো হাইড্রোজেন পরমাণুরও নিজস্ব এক বন্ধন শক্তি রয়েছে। হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন ও প্রোটন পরস্পরের ওপর একটা বল প্রয়োগ করে। সেটাই হাইড্রোজেন পরমাণুর কাঠামোগত স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী। এই বন্ধনের শক্তি প্রায় ১৩.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট। আমরা যদি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনে পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করতে পারি, তাহলে এই বন্ধন ধ্বংস বা ভেঙে ফেলা সম্ভব। এভাবে হাইড্রোজেন পরমাণুর গাঠনিক উপাদানগুলো—অর্থাৎ প্রোটন ও ইলেকট্রনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়।

হাইড্রোজেন গ্যাস উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে কাজটি করা সম্ভব। আমরা দেখেছি, ৫.২×১০ কেলভিন তাপমাত্রায় প্রতিটি কণার তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৪.৫ ইলেকট্রন ভোল্ট। কাজেই গ্যাসটিকে এই তাপমাত্রার তিনগুণ তাপমাত্রায় বা ১৫.৬×১০ কেলভিনে উত্তপ্ত করে, হাইড্রোজেনের প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যকার বন্ধন ধ্বংস যায় এবং তাদের আলাদা করা সম্ভব। আসলে এখানে হাইড্রোজেন অণু এবং হাইড্রোজেন পরমাণুকে বিচ্ছিন্ন করতে তাপমাত্রার যে হিসেবে করেছি, তা অতিরঞ্জিত। গ্যাসটি যখন নির্দিষ্ট কোনো তাপমাত্রায় থাকে, তখন এর সব অণুর শক্তি একই থাকে না। বেশিরভাগ অণুর শক্তি, ওই গ্যাসের তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সবসময়ই অতি সামান্য হলেও কিছু না কিছু অণু থেকেই যায়, যাদের তাপমাত্রা গড় শক্তির চেয়ে বেশি। শক্তিগুলোর বিন্যাস বা বন্টনের হিসাব করার সময় দেখা যায়, হাইড্রোজেন অণু বা তার পরমাণু ভাঙার জন্য যে তাপমাত্রা হিসাব করা হয়েছে, তার চেয়ে আসলে কম তাপমাত্রা দরকার। তবে এখানে আমরা যেসব মূল ধারণা অনুসন্ধান করতে চাই, তার জন্য এই সত্যটা প্রাসঙ্গিক নয়।

গ্যাসটা যদি হাইড্রোজেন না হয়ে অন্য কোনো মৌল দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে? ধরা যাক, অক্সিজেন, তাহলে কী হবে? অক্সিজেনের একটা পরমাণু আটটি ইলেকট্রন ও একটি নিউক্লিয়াস দিয়ে গঠিত। এই নিউক্লিয়াসে রয়েছে আটটি নিউট্রন ও আটটি প্রোটন। আগেই বলেছি, স্বাভাবিক অবস্থায় একটা পরমাণুর ইলেকট্রনের সংখ্যা আর প্রোটনের সংখ্যা সমান থাকে। তাতে পরমাণুটি বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ হয়। (অক্সিজেন পরমাণুতে যে সমান সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, সেটা নিছক দুর্ঘটনা মাত্র। সাধারণভাবে এই দুটো কণা সমান সংখ্যায় থাকে না।) নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ইলেকট্রন বিভিন্ন পরিমাণ শক্তি নিয়ে আবদ্ধ থাকে। যেমন নিউক্লিয়াসের সর্বোচ্চ দূরে থেকে ঘুর্ণনরত ইলেকট্রনগুলো সবচেয়ে কম আকর্ষণ বল অনুভব করে। কাজেই তাদের বন্ধনও তুলনামূলকভাবে দূর্বল। অক্সিজেন পরমাণুতে সর্বোচ্চ দূরে থাকা ইলেকট্রনের বন্ধন শক্তি ১৩.৬ ইলেকট্রন ভোল্ট। বিপরীত দিকে অক্সিজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের ইলেকট্রনের বন্ধন শক্তি প্রায় ৮৭০ ইলেকট্রন ভোল্ট। কোনো পরমাণুতে বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করা হলে প্রথমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাইরের ইলেকট্রনগুলো। বাকি ইলেকট্রনগুলো তখন পরমাণুটিকে ঘিরে থাকে।

নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন করা বা ‘পরমাণুকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা’, যাই বলুন না কেন, এই পর্যায়ে নতুন একটা ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। স্বাভাবিক পরমাণুতে সমান সংখ্যক প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে। তাই সেটা বৈদ্যুতিকভাবে চার্জহীন বা চার্জ নিরপেক্ষ থাকে। এ ধরনের পরমাণু দিয়ে তৈরি কঠিন, তরল ও গ্যাসও থাকে বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ। কিন্তু কোনো হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন করা হলে পরমাণুটি বৈদ্যুতিকভাবে ধনাত্মক চার্জে পরিণত হয়। কারণ তার নিউক্লিয়াসে তখন ভারসাম্যহীন প্রোটন থাকে। বিচ্ছিন্ন হওয়া ইলেকট্রনটা আসলে ঋণাত্মক চার্জ বহন করত। একইভাবে কোনো অক্সিজেন পরমাণু থেকে দুটো ইলেকট্রন যদি বাইরে পাঠিয়ে দিই, তখন নিউক্লিয়াস দুটো প্রোটনের অতিরিক্ত ধনাত্মক চার্জের কারণে ভারসাম্যহীন অবস্থায় চলে যাবে। এরকম পরমাণু তখন এমন আচরণ করবে, যেন সেটা দুই একক ধনাত্মক চার্জ বহন করছে। সাধারণত একে বলা হয় অক্সিজেন আয়ন (চার্জ নিরপেক্ষ অক্সিজেন পরমাণুর বিপরীতে এটি ধনাত্মকভাবে চার্জিত)। [বাস্তবে অক্সিজেনের ধনাত্মক আয়ন তৈরি করা খুব কঠিন। অর্থাৎ ইলেকট্রন বের করে দেওয়া খুব কঠিন।] কাজেই কোনো চার্জহীন পরমাণু থেকে দুটো ইলেকট্রন সরিয়ে ফেলা হলে দুই একক ধনাত্মকভাবে চার্জিত আয়ন পড়ে থাকে। এই কারণে পরমাণুর কণাদের বিচ্ছিন্নতা বা পৃথকীকরণকে বলা হয় আয়নাইজেশন বা আয়নকরণ। আয়নাইজেশন প্রক্রিয়ায় বৈদ্যুতিকভাবে চার্জহীন অবস্থা (যেমন কঠিন, তরল বা গ্যাস) থেকে কোনো পদার্থকে বৈদ্যুতিকভাবে চার্জিত অবস্থায় (ধনাত্মক বা ঋণাত্মকভাবে চার্জিত) রূপান্তর করা হয়। পদার্থের এই চতুর্থ অবস্থাকে বলা হয় প্লাজমা। অ্যাস্ট্রোফিজিকস বা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা দখল করে আছে প্লাজমা।

মহাবিশ্বে সব মৌলের প্রাচুর্যতা সমান নয়। দেখা গেছে, মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় ৯০ ভাগ হাইড্রোজেন এবং ৯ ভাগ হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। বাকিটুকু বা মাত্র প্রায় ১ ভাগ তৈরি হয়েছে ১০০টি মৌলে।

পারমাণবিক স্তরে সব পদার্থই প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন দিয়ে গঠিত। তাই সব পদার্থেরই শ্রেণিবিভাগ করা যায় প্রোটন সংখ্যা দিয়ে (যাকে বলা হয় পারমাণবিক সংখ্যা) এবং নিউক্লিয়াসে নিউট্রন ও প্রোটনের মোট সংখ্যার (যাকে বলা হয় পারমাণবিক ওজন, কারণ এই সংখ্যা আমাদের জানায় যে পরমাণুটি কতটা ভারী) ভিত্তিতে।

প্রতিটি রাসায়নিক মৌলের একটা অনন্য পারমাণবিক সংখ্যা থাকে। শুরু হয় ১ দিয়ে। হাইড্রোজেনের জন্য ১, হিলিয়ামের জন্য ২ ইত্যাদি। মৌলের রাসায়নিক ধর্ম মূলত নির্ধারিত হয় মৌলটির ইলেকট্রন সংখ্যা দিয়ে। সেই সংখ্যাটা অবশ্যই নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যার সমান। কোনো মৌলের পারমাণবিক ওজন পুরোপুরি অনন্য নয়। যেমন হাইড্রোজেনের কথা ধরা যাক। মৌলটির নিউক্লিয়াসে প্রোটন থাকে একটা মাত্র। সে কারণেই তার পারমাণবিক ওজনে একটা সঙ্গতি দেখা যায়। ডিউটেরিয়াম নামে আরেকটা মৌল আছে, যার নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটন ও একটা নিউট্রন থাকে (আর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে একটা ইলেকট্রন)। স্পষ্টতই ডিউটেরিয়াম এবং হাইড্রোজেন দুটোতেই একই সংখ্যক প্রোটন (এবং ইলেকট্রন) থাকে। তাই তাদের পারমাণবিক সংখ্যা একই। কিন্তু ডিউটেরিয়ামের পারমাণবিক ওজন ২ (কারণ তার নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটন এবং একটা নিউট্রন রয়েছে)। অন্যদিকে হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ওজন ১।

মৌলের রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারিত হয় তার ইলেকট্রন সংখ্যার ভিত্তিতে। সে কারণে ডিউটেরিয়াম এবং হাইড্রোজেনের রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একরকম। (উদাহরণ স্বরূপ, ডিউটেরিয়ামের দুটো পরমাণু এবং অক্সিজেনের একটা পরমাণু একসঙ্গে মিলিত হয়ে হেভি ওয়াটার বা ভারী পানি তৈরি করে। একে D2O সংকেত দিয়ে প্রকাশ করা হয়। দুই পরমাণু হাইড্রোজেন যেমন অক্সিজেনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাধারণ পানি বা H2O তৈরি করে, এটাও সেরকম।) একইভাবে সাধারণ হিলিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ২ (কারণ এতে দুটি প্রোটন এবং দুটি ইলেকট্রন থাকে) এবং এর পারমাণবিক ওজন ৪ (কারণ এর নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন থাকে)। তবে হিলিয়ামের আরেকটি প্রজাতি আছে, যাকে বলা হয় হিলিয়াম-৩। এর পারমাণবিক সংখ্যা ২ (দুটো প্রোটন ও দুটো ইলেকট্রন থাকে) হলেও পারমাণবিক ওজন ৩ (কারণ এর নিউক্লিয়াসে দুটো প্রোটন ও একটা নিউট্রন থাকে)। আবার সাধারণ হিলিয়াম (একে বলে হিলিয়াম-৪) এবং হিলিয়াম-৩-এর রাসায়নিক ধর্ম প্রায় একই। হাইড্রোজেন ও ডিউটেরিয়াম, বা হিলিয়াম-২ ও হিলিয়াম-৪-এর মতো মৌলের এসব প্রজাতিকে বলা হয় আইসোটোপ। একই মৌলের আইসোটোপের রাসায়নিক ধর্ম এক হলেও তাদের পারমাণবিক নিউক্লিয়াস একেবারে আলাদা। তাদের আচরণও ভিন্ন।

পারমাণবিক সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুগুলো ক্রমেই বড় হতে থাকে। সাধারণভাবে জটিল সব ধর্ম দেখাতে শুরু করে। প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা ১ থেকে ৯২ পর্যন্ত। যেমন অ্যালুমিনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ১৩ এবং তার পারমাণবিক ওজন ২৭। এর মানে, অ্যালুমিনিয়ামের একটা পরমাণুতে ১৩টি প্রোটন থাকে (আর অবশ্যই তাতে ১৩টি ইলেকট্রনও থাকে)। আবার যেহেতু মৌলটির পারমাণবিক ওজন ২৭ এবং পারমাণবিক সংখ্যা ১৩, তার মানে মৌলটির নিউক্লিয়াসে অবশ্যই ২৭-১৩=১৪টি নিউট্রন রয়েছে।

জেনে হয়তো অবাক হবেন, মহাবিশ্বে সব মৌলের প্রাচুর্যতা সমান নয়। দেখা গেছে, মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় ৯০ ভাগ হাইড্রোজেন এবং ৯ ভাগ হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। বাকিটুকু বা মাত্র প্রায় ১ ভাগ তৈরি হয়েছে ১০০টি মৌলে। এদের বলা হয় হেভি এলিমেন্ট বা ভারী মৌল। (নিঃসন্দেহে আমাদের পৃথিবীর মতো গ্রহগুলোতে অনেক বেশি ভারী মৌল আছে। তবে মহাজাগতিক প্রাচুর্যতা গণনার ক্ষেত্রে পৃথিবী সাধারণ উদাহরণ নয়।)

কোনো পরমাণুর বন্ধন শক্তির মতো তার কাঠামোগত ধর্ম নির্ধারিত হয় নিউক্লিয়াসের প্রোটন এবং তার চারপাশে ঘূর্ণমান ইলেকট্রনের বিদ্যুৎচুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। এভাবে সব পদার্থের সব ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম চারটি অবস্থায় (কঠিন, তরল, গ্যাসীয় ও প্লাজমা) বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের কাঠামো গঠনে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল প্রধান ভূমিকা পালন করে না। যেমন অ্যালুমিনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ১৩টি প্রোটন ও ১৪টি নিউট্রন থাকে। প্রোটনগুলো ধনাত্মকভাবে চার্জিত। আবার একই ধরনের চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। সে কারণে নিউক্লিয়াসের প্রোটনগুলোকে একত্রে ধরে রাখার মতো যদি কোন বল না থাকত, তাহলে নিউক্লিয়াস ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যেত। আসলে নিউক্লিয়াসে বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল ছাড়াও আরেকটা বলের অস্তিত্ব রয়েছে। এই বল দুটি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।

এসব বলকে বলা হয় স্ট্রং ফোর্স ও উইক ফোর্স (বাংলায় যথাক্রমে শক্তিশালী বল ও দুর্বল বল। সবল পারমাণবিক বল ও দুর্বল পারমাণবিক বল নামেও পরিচিত)। এদের চরিত্র আলাদা। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়ে শক্তিশালী বল অনেক শক্তিশালী। নিউক্লিয়াসকে একত্রে বেঁধে রাখতে শক্তি যোগায় এই বল। একটা সাধারণ পারমাণবিক নিউক্লয়াসের একটা বন্ধন শক্তি থাকে, যা ৭ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট থেকে শুরু করে ৫০০ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে। এরকম নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে আমরা সংক্ষেপে MeV একক ব্যবহার করব। এর মানে এক মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট। বিভিন্ন নিউক্লিয়াসের বন্ধন শক্তি বেশ জটিল পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হয়। এখানে দুটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়। সামগ্রিকভাবে লোহা পর্যন্ত পারমাণবিক সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি নিউক্লিয়নের (অর্থাৎ প্রতিটি প্রোটন বা নিউট্রন) বন্ধন শক্তিও বাড়ছে। তারপর তা কমে যাচ্ছে। এভাবে পর্যায় সারণির সবগুলো নিউক্লিয়াসের মধ্যে লোহা হয়ে উঠছে সবচেয়ে স্থিতিশীল মৌল। এখান থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, লোহার চেয়ে হালকা মৌলের তুলনায়, লোহার চেয়ে ভারী মৌলগুলোর আচরণ ভিন্ন ভিন্ন হবে। আর সেটা হবে নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত। এই গড় আচরণ ছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট মৌলে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার দেখা যায়। যেমন হিলিয়ামের বেশ উচ্চ বন্ধন শক্তিসহ চরমভাবে স্থিতিশীল একটা নিউক্লিয়ার কাঠামো রয়েছে। পারমাণবিক বল তার পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের কণাগুলোকে বেঁধে রাখে। তাই এই বলগুলো পরাভূত করে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলা সম্ভব।

নিউক্লিয়াসের ফিশন এবং ফিউশনের সঙ্গে শক্তির পরিবর্তনও জড়িত। আমরা আগে দেখেছি, বন্ধনের শক্তি বিভিন্ন মৌলতে বিভিন্ন।

এ পরিস্থিতিটা হাইড্রোজেন অণু ও হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে আমরা যা করেছি, ঠিক তার মতোই। দুটি অণু বা দুটি পরমাণুর মধ্যে যথেষ্ট উচ্চ গতিতে সংঘর্ষ ঘটালে আণবিক বা পারমাণবিক বন্ধনকে পরাভূত করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করা যায়। একইভাবে খুব উচ্চ গতিতে দুটো নিউক্লিয়াসকে পরস্পরের সঙ্গে আঘাত করলে পারমাণবিক বলকে পরাভূত করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিতে পারি। এরকম পর্যাপ্ত শক্তিশালী সংঘর্ষে আসলে যেকোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। যেমন আমরা যদি নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস দিয়ে আঘাত করি, তাহলে দুটি ভিন্ন ধরনের নিউক্লিয়াস পাব। সেগুলো হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একটা আইসোটোপ। মূলত নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসে সাতটি প্রোটন ও সাতটি নিউট্রন থাকে। অন্যদিকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে থাকে দুটো প্রোটন ও দুটো নিউট্রন। চূড়ান্ত পর্যায়ে অক্সিজেনের আইসোটোপে নয়টি নিউট্রন ও আটটি প্রোটন থাকে। অন্যদিকে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস গঠিত হয় একটা প্রোটন দিয়ে। এরকম উচ্চ শক্তির সংঘর্ষে নিউক্লিয়াস ভেঙে ফেলে নাইট্রোজেন ও হিলিয়ামকে রূপান্তর করছি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন মৌলে। যথেষ্ট উচ্চ শক্তি সহজলভ্য হলে সত্যি সত্যিই একটা মৌলকে আরেকটা মৌলে রূপান্তর করা সম্ভব হতো নিয়মিত।

এরকম প্রক্রিয়ায় একটা নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটো নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে পারে। একে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন বা পারমাণবিক বিভাজন। আবার দুটো নিউক্লিয়াসকে একত্রে ফিউজ করে বা জোড়া লাগিয়ে নতুন মৌল তৈরি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াকে বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বা পারমাণবিক একীভবন। অর্থাৎ ফিশনের ঠিক উল্টো প্রক্রিয়া। যেমন ডিউটেরিয়াম মৌলের কথা ধরা যাক। এর পারমাণবিক নিউক্লিয়াস তৈরি হয় একটা প্রোটন ও একটা নিউট্রন কণা দিয়ে। দুটো ডিউটেরিয়ামের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে একটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করা যায়। কিন্তু আমরা জানি, সব পারমাণবিক নিউক্লিয়াসই ধনাত্মকভাবে চার্জিত। আবার সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তাই দুটো ডিউটেরিয়াম পরমাণুর পরস্পরকে বিকর্ষণ করার প্রবণতা থাকে। এই দুটো নিউক্লিয়াসকে একত্রে জোড়া লাগাতে শুরুতেই অতিউচ্চ শক্তি দিয়ে সংঘর্ষ ঘটিয়ে নিউক্লিয়াসদের ওই বিকষর্ণ পরাভূত করতে হয়। এরকম উচ্চ শক্তিতে নিউক্লিয়াস দুটো পরস্পরের খুব কাছে আসতে পারে। সেগুলো এতই কাছে চলে আসে যে তাদের বৈদ্যুতিক বিকর্ষণকে হারিয়ে দেয় পারমাণবিক আকর্ষণ। এতে বোঝা যায়, কণাগুলো অতিউচ্চ তাপমাত্রায় অতিউচ্চ গতিতে চলাফেরা করলেই কেবল নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটা সম্ভব।

নিউক্লিয়াসের ফিশন এবং ফিউশনের সঙ্গে শক্তির পরিবর্তনও জড়িত। আমরা আগে দেখেছি, বন্ধনের শক্তি বিভিন্ন মৌলতে বিভিন্ন। ধরা যাক, আমরা A ও B নিউক্লিয়াসকে একত্রে জোড়া লাগিয়ে C নিউক্লিয়াস পাই। C-এর এই বন্ধনশক্তি যদি A ও B-এর মিলিত বন্ধনশক্তির চেয়ে কম হয়, তাহলে এই প্রক্রিয়ায় নিঃসৃত শক্তির তারতম্য হবে। অন্যদিকে C-এর বন্ধনশক্তি বেশি হলে এ প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করতে বাড়তি শক্তির যোগান দিতে হবে। কোনো প্রক্রিয়ায় শক্তি শোষিত হবে নাকি নিঃসৃত হবে, তা নির্ভর করে পারমাণবিক সংখ্যার ওপর। ক্রান্তিকালের সূচনা হয় ৫৬ পারমাণবিক সংখ্যায়। এই মৌলটি আমাদের কাছে আয়রন বা লোহা নামে পরিচিত। আগেই বলেছি, লোহার প্রতি নিউক্লিয়নে বন্ধনশক্তি সর্বোচ্চ। কাজেই লোহার ডান দিকে বন্ধনশক্তির বক্ররেখা নিচের দিকে নামতে থাকে। এই এলাকায় যেকোনো মৌলকে ভেঙে হালকা মৌলে রূপান্তর করতে পারি, যাদের বন্ধনশক্তি উচ্চ মানের। অর্থাৎ সেগুলো বেশি স্থিতিশীল। এ ধরনের প্রক্রিয়া প্রকৃতির বেশ পছন্দের। সাধারণভাবে লোহার চেয়ে ভারী মৌলগুলো ভেঙে যাওয়ার সময় শক্তি বেরিয়ে আসে। কিন্তু লোহার চেয়ে হালকা মৌলের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ঠিক উল্টো। এখানে দুটো হালকা মৌলকে একত্রে জোড়া লাগিয়ে বন্ধনশক্তি বাড়ানো যায়। আবার এ ধরনের প্রক্রিয়া বেছে নিয়ে হালকা মৌলগুলোর নিউক্লিয়ার ফিউশনে শক্তি নিঃসৃত হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌল ফিশন প্রক্রিয়ায় শক্তি নিঃসরণ করে। অন্যদিকে হাইড্রোজেনের মতো হালকা মৌল শক্তি নিঃসরণ করে ফিউশন প্রক্রিয়ায়। নিঃসন্দেহে দুটো নিউক্লিয়াস একত্রে জোড়া লাগাতে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বিকর্ষণকে হারিয়ে দিতে হয়। তাই এ প্রক্রিয়া শুধু অতি উচ্চ তাপমাত্রাতেই ঘটা সম্ভব।

ওপরে যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হলো, তা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বা পারমাণবিক চুল্লি এবং পারমাণবিক বোমা উভয়ের নিউক্লিয়ার শক্তি নিঃসরণের মূল ভিত্তি। যেমন হাইড্রোজেন বোমা বানানো হয়েছিল ফিউশন বিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে। দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একত্রে ফিউজ বা জোড়া লাগালে প্রায় ০.৪ মেগা ইলেকট্রনভোল্ট শক্তি বেরিয়ে আসে। এক গ্রাম হাইড্রোজেনের (এতে পরমাণু থাকে ৬×১০২৩টি) ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি নিঃসৃত হয় প্রায় ১০১৭ আর্গ। সে তুলনায় এক গ্রাম কয়লা পোড়ালে মাত্র ১০১১ আর্গ শক্তি নির্গত হয়। দেখা যাচ্ছে, নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া কত বেশি শক্তিশালী। মৌলিক স্তরে এই পার্থক্যের কারণ পারমাণবিক ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের শক্তিমত্তার মধ্যে তফাত। কয়লা পোড়ানো হলো রাসায়নিক বিক্রিয়া। এটি বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে হাইড্রোজেন ফিউশন নিয়ন্ত্রিত হয় পারমাণবিক বল দিয়ে।

থানু পদ্মানাভানের আফটার দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস বই থেকে

* ঈষৎ সংক্ষিপ্ত