অসীমের সীমানায়

মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীলছবি: সংগৃহীত
নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রমাণ পেয়েছেন, অর্থাৎ এর আকার এখনো ক্রমবর্ধমান। হয়তো অসীমে গিয়েই শেষ হবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ! কিন্তু সে অসীমের অবস্থান কোথায়?

অসীম বা ইনফিনিটি নিয়ে মানুষ হয়তো সভ্যতার শুরু থেকেই ভেবেছে। সেই ভাবনায় কতটা গণিত ছিল, তা জানা কঠিন। তবে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আদিমানব যে বিস্মিত হয়েছিল, ভেবেছিল এর বিস্তারের কথা, তা নিয়ে কোনো বিবাদ থাকার কথা নয়। মায়া সভ্যতার আদিজ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কথা বলুন, কিংবা বলুন মিশরের ফেরাউনদের পিরামিড তৈরির ভাবনার কথা—অসীমের দিকে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আজন্ম। প্রশ্ন হলো, গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসীমের ভাবনা উপস্থাপিত হলো কখন?

বার্নার্ড বোলজানো নামে এক বোহেমিয়ান (প্রাচীন চেক সাম্রাজ্য) পাদ্রী প্রথম সতের শতকের শেষদিকে অসীমের গাণিতিক সংজ্ঞা দেন তাঁর প্যারাডক্স অব দ্য ইনফাইনাইট গ্রন্থে। গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসীমের অনুপস্থিতি যে প্যারাডক্স বা হেঁয়ালির জন্ম দেয়, তার সমাধানে বোলজানো অসীমের ধারণা উপস্থাপন করেন। পরে, ১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রুশ গণিতবিদ গিয়র্গ ক্যান্টর—সেট থিওরেম বা উপপাদ্যের প্রবর্তক—ত্রিকোণমিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কন্টিনুইটি বা অবিচ্ছিন্নতার ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অসীমের ওপর আলোকপাত করেন।

অসীমের গাণিতিক উপস্থিতি আজ সুদৃঢ়। তবু এর জাগতিক উপস্থিতি চিহ্নিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীদের। স্পেস বা মহাশূন্য কি অসীম? সময় কি অসীম? কিংবা মহাবিশ্ব? পৃথিবী বা মহাবিশ্বের কোথায় দেখা মিলবে অসীমের? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে সব মিলেছে, তা বলা যাবে না। তবে মানবকল্পনায় অসীমকে ধারণ করার ক্ষমতা যে অপ্রতুল, তা মানতেই হবে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞানচিন্তার বেশ কিছু পূর্ব প্রকাশিত লেখায় অসীমের ধারণার বিশদ আলোচনা হয়েছে। (সূত্র: ২-৫)

মহাবিশ্বে কেবল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরই অসীমের ধারণাকে ধরতে পারে বলে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে, ব্ল্যাকহোলের ভেতরে একটি সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু বিরাজ করে

অসীমকে সহজে বুঝতে গেলে সংখ্যা গণনার দিকে তাকানো যেতে পারে। আমার কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীকে যদি ১ থেকে গুনতে বলি এবং শর্ত দিই—যতক্ষণ সে কোনো সংখ্যা কল্পনা করতে পারছে, ততক্ষণ এ গণনা চালিয়ে যেতে হবে, সেই শিক্ষার্থীর জীবদ্দশায় হয়তো এই এসাইনমেন্ট শেষ হবে না। অর্থাৎ সংখ্যা গণনার কথা ভাবলে অসীমের একটা ধারণা পাওয়া যায়। এমন কোনো সংখ্যা কি রয়েছে যা অসীম বা ইনফিনিটির কাছাকাছি? যে সংখ্যাই আমরা ভাবি না কেন, ইনফিনিটি তারচেয়ে অনেক গুণ বড়।

অসীমকে কল্পনায় ধারণ করতে একটি প্যারাবল বা রূপক তৈরি করা হয়েছে। এর নাম, হিলবার্ট’স প্যারাডক্স অব দ্য গ্র্যান্ড হোটেল। ছোট করে বললে গল্পটি এমন দাঁড়ায়: গ্র্যান্ড হোটেলে অসীম সংখ্যক ঘর রয়েছে। ধরা যাক, বছরের কোনো এক সময়ে হোটেলের প্রায় সব ঘরে অতিথি আছেন। পরদিন একজন নতুন অতিথি হোটেলে রুম চাইলেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ রুম নম্বর ১-এর গেস্টকে রুম নম্বর ২-তে, রুম নম্বর ২-এর গেস্টকে রুম নম্বর ৩-এ—এভাবে প্রত্যেক অতিথিকে তার পরের রুমে স্থানান্তরিত হতে বলল। নতুন অতিথি রুম নম্বর ১-এ জায়গা পেলেন। পরদিন একসঙ্গে অসীম সংখ্যক অতিথি হোটেলে রুম চাইতে এলেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ একটু বিপাকে পড়ল। গ্র্যান্ড হোটেলে অসীম সংখ্যক রুম আছে, কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব। এবার হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক ঘরের অতিথিকে তার রুম নম্বরের দ্বিগুণ সংখ্যার রুম নম্বরে স্থানান্তরের অনুরোধ করল। অর্থাৎ, রুম নম্বর ১-এর গেস্ট রুম নম্বর ২-তে, রুম নম্বর ২-এর গেস্ট রুম নম্বর ৪-এ, রুম নম্বর ৩-এর গেস্ট রুম নম্বর ৬-এ—এভাবে সব অতিথি যখন তাদের নতুন রুমে স্থানান্তরিত হলো, বিজোড় নম্বরের রুমগুলো—অর্থাৎ রুম নম্বর ১, ৩, ৫, ইত্যাদি খালি হয়ে গেল নতুন অতিথিদের জন্য। গ্র্যান্ড হোটেলের অসীম সংখ্যক রুম এভাবে সবাইকেই জায়গা করে দিতে পারত। এ গল্পটার আরও অংশ আছে। প্রতিবার এরকম অতিথি এলে সমস্যা ও হোটেল কর্তৃপক্ষের বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান করে অসীম সংখ্যক রুমে জায়গা করে দেওয়া—এটাই গল্পের মূল কথা।

আপনারা বলতে পারেন, গণিত তো মন গড়া, গ্র্যান্ড হোটেল বলে কোনো প্রকৃত হোটেল নেই। মহাবিশ্বে কি অসীমের খোঁজ পাওয়া আদৌ সম্ভব? এর উত্তর একাধারে হ্যাঁ এবং না। মহাবিশ্বের সীমানায় মানুষের পক্ষে পৌঁছানো আজও অসম্ভব। আলোর বেগ মানুষের জন্য অত্যন্ত দ্রুত হলেও মহাবিশ্ব পাড়ি দেওয়ার জন্য তা অত্যন্ত ধীর গতি, অনেকটা শম্বুকগতির মতো। এ জন্যই, আলোর গতিতে যাত্রা করেও এক মানবজনমে আমরা আমাদের গ্যালাক্সিটাই পাড়ি দিতে পারব না, মহাবিশ্বের কিনারায় পৌঁছানো তো অবাস্তব। তাই অসীমের সীমানার চাক্ষুষ প্রমাণ সম্ভব নয়। তবে মহাবিশ্বের শেষ সীমানার দৈর্ঘ্যের খোঁজ বিজ্ঞানীরা গণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রায় ১ লাখ বিলিয়ন বিলিয়ন (অর্থাৎ ১০২৩) কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যাসের একটি বৃত্ত মহাবিশ্বকে ধারণ করতে সক্ষম। সমস্যা হলো, নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রমাণ পেয়েছেন, অর্থাৎ এর আকার এখনো ক্রমবর্ধমান। হয়তো অসীমে গিয়েই শেষ হবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ! কিন্তু সে অসীমের অবস্থান কোথায়?

মহাবিশ্বে কেবল ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরই অসীমের ধারণাকে ধরতে পারে বলে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে, ব্ল্যাকহোলের ভেতরে একটি সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু বিরাজ করে (ছবি ১)। এটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি স্পেস বা স্থান, যার ঘনত্ব অসীম, যেখানে ব্ল্যাকহোলের সব ভর একীভূত হয়েছে, সেটিই ইনফিনিটি—অসীম।

অন্যভাবে ভাবলে, দৈর্ঘ্যে ছোট যেকোনো বস্তুর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। আমি ন্যানোটেকনোলোজি নিয়ে গবেষণা করি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে ভাবাই আমার কাজ। ধরুন, ১ মিটার (প্রায় ৩ ফুট) লম্বা একটি লাঠিকে আমরা ভাঙা শুরু করলাম। প্রথমে অর্ধেক করা হলো, তারপর দুটো ৫০০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ ভাগকে আবারো দুই ভাগ করা হলো। এমনি করে অসীম সংখ্যকবার আমরা লাঠিটিকে দ্বিখণ্ডিত করলাম (ছবি ২)। বিজ্ঞান বলছে, আমরা একে অসীম সংখ্যকবার ভাঙতে পারব না। স্পেস আসলে ফাইনাইট বা সসীম। সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য, যার মান ১.৬ × ১০-৩৫ মিটার; অর্থাৎ ১ মিটারের প্রায় ১০ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। আর এই সসীম স্থানিক মাত্রার ধারণা থেকে স্থান বা স্পেসকে ডিসকন্টিনিউয়াস বলে ধরা হয়। অর্থাৎ যেকোনো দৈর্ঘ্যের স্পেস বা স্থানই অসংখ্য প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমন্বয়ে গঠন করা সম্ভব। স্থান বা স্পেস তাই ডিসক্রিট, কন্টিনিউয়াস নয়।     

চিত্র ২: একটি বস্তুকে সমান দুই ভাগে ভাগ করার পর, প্রতিটি খন্ডকে সমভাবে দ্বিখণ্ডিত করা হতে থাকলে ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যে পৌঁছানো সম্ভব। (সূত্র: Dall-E-2 free AI platform ব্যবহার করে নির্মিত)
সময়ের স্কেলে অসীমের অর্থ কী দাঁড়ায়? একটি বাক্সে যদি একটি বস্তুকে রেখে দেওয়া যায়, যেমন ধরা যাক একটি আপেল, তবে ১ বছর পর আপেলটিতে পঁচন ধরবে।

আরেকভাবে স্থান ও অসীমের বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আমাদের মহাবিশ্ব যদি সসীম সংখ্যক পরমাণু দিয়ে তৈরী হয়ে থাকে এবং এ মহাবিশ্বে যদি সসীম সংখ্যক বস্তু থেকে থাকে, তবে এই বস্তুগুলো সসীম সংখ্যকভাবে বিন্যস্ত হতে পারবে। মহাবিশ্ব যদি অসীম হয় তবে এই বিন্যাস মহাবিশ্বের বিশালত্বে আবারও আবির্ভূত হতে বাধ্য। অর্থাৎ, প্যাটার্ন রিপিট হবে। মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও এই পৃথিবীর মতো আরেকটি গ্রহ থাকা তাই স্বাভাবিক; সেখানকার মানচিত্রে বাংলাদেশের উপস্থিতি থাকাও অস্বাভাবিক নয়। সেখানে ঢাকা শহরে আপনার মতো কোনো অধিবাসীর উপস্থিতিও কি অবাস্তব? অসীমের বিচারে এই সমান্তরাল পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, বোঝাই যায়।

অন্যদিকে, সময়ের স্কেলে অসীমের অর্থ কী দাঁড়ায়? একটি বাক্সে যদি একটি বস্তুকে রেখে দেওয়া যায়, যেমন ধরা যাক একটি আপেল, তবে ১ বছর পর আপেলটিতে পঁচন ধরবে। ১০০ বছর পর আপেলটি ক্ষয়ে ধুলায় পরিণত হবে। লক্ষ বছর পর সে ধূলিকণায় অবস্থিত রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে মৌলিক কণার প্লাজমা তৈরি হবে, এরপর সে প্লাজমা আবারো বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাজমার সামনে লাখো বিলিয়ন বিলিয়ন সংখ্যক কম্বিনেশন রয়েছে। সময় যদি অসীম হয়, তবে এ সব কম্বিনেশনের কারণে চক্রাকারে সেই প্লাজমা হয়তো ফের আপেলে পরিণত হবে। সময়ের অসীমত্ব কি এভাবে মানুষ বা জীবের অমরত্বকেও ইঙ্গিত করে?   

এখন বাজারে বিজ্ঞানচিন্তার জুন ২০২৪ সংখ্যা

বিজ্ঞানচিন্তা কিনুন এই লিংক থেকে।

আরও পড়ুন

মহাবিশ্বের অসীমতার কথা ধরি কিংবা প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য—এগুলোকে কল্পনায় আনতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কী হবে, মানুষ হিসেবে আমার, আমাদের অস্তিত্ব যে কত নগন্য, অসীমের ধারণা কেবল একেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয়। এই দৈনন্দিন বোঝাপড়া, এই ভ্রমণ, বিলাস, আর ভোজনের অর্থ কী তবে? বিদ্যমান দ্বন্দ্ব আর বিবাদেরই-বা মানে কোথায়? অসীমের ধারণা যখন জীবনকে প্রায় অর্থহীন করে তোলে, তখনি আমার স্ত্রীর আলিঙ্গন, পুত্রের দৃঢ় করমর্দন আর কন্যার ভুবনভোলানো হাসি জীবনকে অর্থ দেয় আরেকটিবার। পরিবার, বন্ধুরা, আমাদের আপনজনেরাই আমাদের জীবনকে পূর্ণতা দেয়, করে তোলে অর্থপূর্ণ। এই সসীম জীবন তাই সুন্দর। অসীমের সীমানায়, ধূমকেতুর পিঠে চড়ে ভ্রমণের কীই-বা প্রয়োজন? আমার আনন্দের অসীমতা যে আমার সামনেই রয়েছে!    

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র।

সূত্র: ১. Bolzano, B. 2013, Paradoxes of the Infinite. Routledge, Oxfordshire, England, UK.

২. মোহাম্মদী, ফারসীম মান্নান। ১৩ মার্চ, ২০২২। ‘জেনো, অসীম ধারা, কাছে আসার প্রক্রিয়া’, বিজ্ঞানচিন্তা

৩. মাহমুদ, আব্দুল্যাহ আদিল। ২৬ জুলাই, ২০২২। ‘অসীম ও মহাবিশ্ব’, বিজ্ঞানচিন্তা

৪. জিহাদ, রফিকুন্নবী। ২৯ আগস্ট, ২০২১। ‘অসীম সিরিজ’, বিজ্ঞানচিন্তা

৫. কাইয়ুম, আব্দুল। ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১। ‘শূন্য দিয়ে ভাগ করতে সমস্যা কোথায়?’, বিজ্ঞানচিন্তা