পদার্থবিজ্ঞান
নিউক্লিয়াস থেকে গভীর মহাকাশে
বিগ ব্যাংয়ের পর বিজ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে নাকি সর্বপ্রথম জন্ম হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের। বিজ্ঞানের এই শাখাটি বেশ মজার। তবে বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্বের কারণে অনেকের কাছেই বিষয়টি জটিল, কঠিন, দুর্বোধ্য। তাঁদের জন্যই পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণ ও কঠিন তথ্যের পেছনের অপার সৌন্দর্য ও সারল্য তুলে এনেছেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ ওয়াল্টার লুইন, লিখেছেন ফর দ্য লাভ অব ফিজিকস—পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা। প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার। বইটির নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকের জন্য।
ঘটনাটা বিস্ময়কর। সত্যি বলছি। আমার মায়ের বাবা ছিলেন নিরক্ষর এক জিম্মাদার। কিন্তু দুই প্রজন্ম পর আমি হয়ে গেলাম এমআইটির ফুল প্রফেসর। সে জন্য ডাচ শিক্ষাব্যবস্থার কাছে আমি ঋণী। এককালে পড়তাম নেদারল্যান্ডসে ডেলফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট স্কুলে। সেখানেই এক ঢিলে তিন পাখি মেরেছি।
একদম শুরু থেকে আমি হাইস্কুলে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে শুরু করি। গ্র্যাজুয়েট স্কুলে পড়ার খরচ জোগাতে ডাচ সরকারের কাছ থেকে ঋণ না নিয়ে আমার কোনো উপায় ছিল না। যদি ফুলটাইম পড়াতাম—মানে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২০ ঘণ্টা—তাহলে প্রতিবছর আমার ঋণের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মওকুফ করে দিত ডাচ সরকার। এই পড়ানোর আরেকটা সুবিধা ছিল, সে ক্ষেত্রে আমাকে সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে হবে না। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হলে বিষয়টা আমার জন্য হতো ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, চরম বিপর্যয়কর। সব ধরনের কর্তৃত্ববাদের প্রতি আমার অ্যালার্জি আছে। আমার ব্যক্তিত্বের ভেতরেই আছে সেটা। জানতাম, আমাকে শেষ পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখতে হবে এবং মেঝে ঝাড়পোঁছ করতে হবে। তাই ফুলটাইম গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান পড়াতাম আমি। সপ্তাহে ২২ ঘণ্টা। রটারডামের লিবানন লাইসিয়ামে ১৬ ও ১৭ বছর বয়সীদের পড়াতাম। ফলে একই সঙ্গে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া ও সরকারের ঋণ শোধ এড়িয়েই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ফেলি আমি।
তাদের পড়াতে গিয়ে নিজেও শিখতাম। আমার কাছে হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ানো মানে ছিল, এই তরুণদের মনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। ব্যাপারটা আমার খুব রোমাঞ্চকর লাগত। সব সময় চেষ্টা করতাম, ক্লাসটা যাতে মজার হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মজা করতাম সে জন্য। স্কুলে বেশ কড়াকড়ি থাকলেও আমি কাজটা করতাম। আমাদের ক্লাসরুমের দরজাগুলোর ওপরের দিকে ছিল ছোট্ট এক জানালা। ছোট্ট সেই জানালা দিয়ে এক স্কুলের হেডমাস্টার মাঝেমধ্যে চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের ওপর স্পাইগিরি করতেন। বিশ্বাস করা যায়?
স্কুলটার সংস্কৃতি পুরো রপ্ত করতে পারিনি আমি। গ্র্যাজুয়েট স্কুলে থাকায় আমার ভেতর উত্সাহ টগবগ করত। আমার লক্ষ্য ছিল, সেই উত্সাহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে সেটা তাদের চারপাশের জগতের সৌন্দর্য নতুনভাবে দেখতে সহায়তা করে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়া, যাতে তারা পদার্থবিজ্ঞানের জগতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। তারা যাতে বুঝতে পারে, পদার্থবিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে সবখানে; বিদ্যাটা ঘিরে রেখেছে আমাদের জীবনের চারধার। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কিছু শেষ করার চেয়ে কিছু একটা উন্মোচন করা আসলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাসে কোনো বিষয় শেষ করা বিরক্তিকর ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষার্থীরাও সেটা বোঝে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো খুলে খুলে দেখালে, বিভিন্ন সমীকরণের ভেতর দিয়ে তাদের সবকিছু দেখিয়ে দিলে এবং সব নতুনত্ব ও উত্তেজনার ভেতর দিয়ে আবিষ্কারের প্রক্রিয়াগুলো হাতে-কলমে করে দেখালে, তাতে অংশ নিতে বেশি পছন্দ করে তারা।
ক্লাসরুমের বাইরে আমি সেটা করতাম ভিন্ন এক উপায়ে। প্রতিবছর আমাদের স্কুলে সপ্তাহব্যাপী ছুটি ঘোষণা করা হতো। তখন কোনো শিক্ষক বাচ্চাদের নিয়ে যেতে পারতেন বেশ দূরে ও সেকেলে ধাঁচের কোনো ক্যাম্পসাইটে। একবার সে কাজটা করেছিলাম আমার স্ত্রী হিউবার্থা আর আমি। দুজনের কাছেই ওটা ছিল ভীষণ পছন্দের। সে সময় আমরা সবাই একসঙ্গে রান্না করতাম, তাঁবুতে ঘুমাতাম। শহরের আলো থেকে আমরা তখন ছিলাম অনেক অনেক দূরে। তাই একবার মাঝরাতে সব বাচ্চাকে ঘুম থেকে জাগালাম। শুরুতেই চকলেট দিলাম সবার হাতে। আকাশভরা নক্ষত্র দেখাতে সবাইকে তাঁবুর বাইরে নিয়ে গেলাম। সবাই মিলে আকাশে একে একে বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্রহ শনাক্ত করলাম। সেদিন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে তার পরিপূর্ণ শোভায় দেখার সুযোগ পেয়েছিল তারা।
আমি আসলে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করিনি কিংবা কাউকে তা শেখাইনি। বরং মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম কিছু কণা শনাক্ত করতে কিছু পরীক্ষা ডিজাইন করছিলাম। কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আমার মুগ্ধতা ছিল সব সময়। সত্যি বলতে কী, যে মানুষ পদার্থবিদ হিসেবে পৃথিবীতে পা রেখেছেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা না থেকে পারেই না। আমি এমন অনেক পদার্থবিদের কথা জানি, যাঁরা হাইস্কুলে পড়ার সময় বাধ্য হয়ে নিজেই টেলিস্কোপ বানিয়ে নিয়েছেন। হাইস্কুলে পড়ার সময় একটা টেলিস্কোপ বানিয়ে নিয়েছিলেন আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও এমআইটির সহকর্মী জর্জ ক্লার্ক। সে জন্য ৬ ইঞ্চি আয়না পলিশ করেছেন তিনি। কিন্তু পদার্থবিদেরা জ্যোতির্বিজ্ঞান এত পছন্দ করেন কেন?
এর একটা উত্তর হলো, পদার্থবিজ্ঞানের বেশ কিছু অগ্রগতি—যেমন কক্ষপথসংক্রান্ত গতির বিভিন্ন তত্ত্ব পাওয়া যায় জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন, পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্ব থেকে। তা ছাড়া জ্যোতির্বিদ্যা আসলে একধরনের পদার্থবিজ্ঞান, যা বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে রাতের নিঃসীম আকাশপটে। সেসব অক্ষরের মধ্যে রয়েছে গ্রহণ (সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ), ধূমকেতু, উল্কাপাত, গ্লোবিউলার ক্লাস্টার, নিউট্রন স্টার, গামা রশ্মি বিস্ফোরণ, বিকিরণের জেট, গ্রহগত নীহারিকা, সুপারনোভা, গ্যালাক্সিগুচ্ছ, কৃষ্ণগহ্বর। আকাশের দিকে শুধু একবার তাকিয়ে নিজেকে কিছু অনিবার্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করুন: আকাশের রং নীল কেন? সূর্যাস্তের রং কেন লাল? মেঘের রং কেন সাদা? এসব প্রশ্নের উত্তর আছে পদার্থবিজ্ঞানের কাছে।
যেসব কণা আকাশ নীল করে তোলে, তার তুলনায় মেঘের পানির ফোঁটাগুলো বেশ বড়। এ বড় কণাগুলোয় আলো বিচ্ছুরিত হলে এতে সব রং বিচ্ছুরিত হয় সমভাবে।
সূর্যের আলো আসলে রংধনুর সব রঙের সমন্বয়ে গঠিত। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো যাওয়ার পথে তা সব দিকের বায়ুর অণু ও অতিক্ষুদ্র ধূলিকণায় বিচ্ছুরিত হয়। মানে, তাতে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় ওই আলো। এসব ধূলিকণার আকার এক মাইক্রনের চেয়েও ছোট (এক মাইক্রন হলো এক ইঞ্চির ১/২৫,০০০ ভাগ)। এ ঘটনাকে বলা হয় র্যালে স্ক্যাটারিং বা র্যালে বিচ্ছুরণ। সব রঙের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছুরিত হয় নীল রং। এর পরিমাণ লাল আলোর চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। কাজেই দিনের বেলা আকাশের যেকোনো দিকে তাকালে দেখা যাবে নীলের আধিপত্য (সাবধান! ভুলেও সূর্যের দিকে তাকাবেন না)। তাই আকাশের রং নীল। কিন্তু আপনি যদি চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চাঁদের আকাশের দিকে তাকান (হয়তো ছবিতে দেখেছেন), তাহলে আকাশ নীল নয়, বরং কালো দেখাবে। ঠিক আমাদের রাতের আকাশের মতো। কিন্তু কেন এমন হয়? এর কারণ, চাঁদের কোনো বায়ুমণ্ডল নেই।
কিন্তু সূর্যাস্তের রং লাল কেন? আকাশের রং যে কারণে নীল, এখানেও ঠিক একই কারণ দায়ী। সূর্য যখন দিগন্তের কাছে থাকে, তখন তার রশ্মিগুলো অনেক বেশি বায়ুমণ্ডল পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। তাই এ সময় সবচেয়ে বেশি বিচ্ছুরিত হয় সবুজ, নীল ও বেগুনি আলো। মূলত ওই আলো থেকে এই রংগুলো বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়। এরপর ওই আলো যখন আমাদের চোখে এবং আমাদের মাথার ওপরের মেঘগুলোয় এসে পড়ে—তখন সেই আলোর সিংহভাগ গঠিত হয় হলুদ, কমলা ও বিশেষ করে লাল রঙে। তাই সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় আকাশে দেখা যায় প্রায় লালচে আগুন রং।
মেঘের রং সাদা কেন? যেসব কণা আকাশ নীল করে তোলে, তার তুলনায় মেঘের পানির ফোঁটাগুলো বেশ বড়। এ বড় কণাগুলোয় আলো বিচ্ছুরিত হলে এতে সব রং বিচ্ছুরিত হয় সমভাবে। তাই সে আলো আমাদের চোখে সাদা দেখায়। কিন্তু মেঘ যদি আর্দ্রতায় খুব বেশি ঘন থাকে, কিংবা মেঘটা যদি অন্য মেঘের ছায়ার ভেতর থাকে, তাহলে তার ভেতর দিয়ে খুব বেশি আলো চলাচল করতে পারে না। কাজেই মেঘটি কালো দেখায়।
হাতে-কলমে পরীক্ষাটা দেখানোর মাধ্যমে একসঙ্গে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি আমি। সেগুলো হলো: আকাশ নীল কেন এবং মেঘের রং সাদা কেন?
আমার ক্লাসে আমি হাতে-কলমে যেসব পরীক্ষা করে দেখাতে পছন্দ করি, তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘নীল আকাশের’ একটা টুকরা তৈরি করা। সেটা করতে ক্লাসের সব আলো নিভিয়ে দিই। এরপর ক্লাসরুমের ছাদ থেকে খুব উজ্জ্বল একটা স্পটলাইট তাক করি ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে। স্পটলাইটটা খুব সাবধানে আগলে রাখতে হয়। এরপর আমি কয়েকটা সিগারেট জ্বালিয়ে সেগুলো ওই আলোকরশ্মিতে ধরে রাখি। র্যালে বিচ্ছুরণ তৈরি করতে ধোঁয়ার এ কণাগুলো যথেষ্ট ছোট। আগেই বলেছি, সবচেয়ে বেশি বিচ্ছুরিত হয় নীল আলো। কাজেই শিক্ষার্থীরা নীল রঙের ধোঁয়া দেখতে পায়। পরীক্ষাটা আরও একধাপ এগিয়ে নিই এরপর। ধোঁয়াগুলো নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসের ভেতর নিয়ে এক মিনিট বা তারও বেশি সময় আটকে রাখি। কাজটা আমার জন্য সব সময় সহজ হয় না। তবে বিজ্ঞানের জন্য মাঝেমধ্যে আত্মত্যাগ তো করতেই হয়। ধোঁয়াগুলো এরপর বুক থেকে বের করে আলোকরশ্মির ওপর ছেড়ে দিই। তখন সাদা ধোঁয়া দেখতে পায় শিক্ষার্থীরা। এভাবে সাদা মেঘ তৈরি করি আমি! ধোঁয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আমার ফুসফুসের ভেতর থাকাকালে বড় হয়ে ওঠে। কারণ, সেখানে অসংখ্য জলীয় বাষ্প রয়েছে। কাজেই এই বেলা রংগুলো বিচ্ছুরিত হয় সমানভাবে। তখন ওই বিচ্ছুরিত আলোটা সাদা দেখায়। নীল আলো থেকে সাদা আলোর এই পরিবর্তন সত্যি বিস্ময়কর!
হাতে-কলমে পরীক্ষাটা দেখানোর মাধ্যমে একসঙ্গে দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি আমি। সেগুলো হলো: আকাশ নীল কেন এবং মেঘের রং সাদা কেন? এখানে আরেকটা খুব মজার প্রশ্ন রয়েছে। সেটা আলোর পোলারাইজেশন বা মেরুকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গিয়ে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখাতে পারি। খালি চোখে একমাত্র এ গ্যালাক্সিটাই দেখা যায়। ওটা প্রায় ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ (বা ১৫ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইল) দূরে। গ্যালাক্সিটা প্রায় ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্র নিয়ে গঠিত। ভাবুন একবার—২০০ বিলিয়ন বা ২০ হাজার কোটি নক্ষত্র। কিন্তু খালি চোখে এটাকে আমরা দেখতে পাই স্রেফ অস্পষ্ট আলোর ছোপের মতন। আমরা অসংখ্য উল্কাপিণ্ডও দেখেছি। বেশির ভাগ মানুষ এগুলোকে বলে শুটিং স্টার বা খসে পড়া তারা। যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে পারলে প্রতি চার বা পাঁচ মিনিট পরপর একটা করে উল্কা দেখা সম্ভব। সেকালে মহাকাশে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ছিল না, কিন্তু এখন এগুলোর সংখ্যা প্রচুর। দুই হাজারের বেশি স্যাটেলাইট ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে। প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আকাশের কোনো একদিকে দৃষ্টি স্থির করলে অন্তত একটি স্যাটেলাইট দেখা যাবে। বিশেষ করে ওগুলো দেখা যায় সূর্যাস্তের কয়েক ঘণ্টা পরে বা সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে—যখন স্যাটেলাইটের ওপর সূর্য ওঠে না বা অস্ত যায় না (অর্থাৎ সূর্য যখন ওগুলোর ঠিক ওপরে থাকে, সে সময়টা ছাড়া)। তখন স্যাটেলাইটের নিজের আলো বা সূর্যের আলো তার ওপর প্রতিফলিত হয়ে ধরা পড়বে আপনার দুচোখে। স্যাটেলাইটটা পৃথিবী থেকে যত দূরে থাকবে, আর তাতে সেই স্যাটেলাইট ও পৃথিবীতে সূর্যাস্তের সময়ের মধ্যকার পার্থক্য যত বেশি হবে, তত বেশি রাত পর্যন্ত দেখা যাবে ওটা। এসব স্যাটেলাইট চেনা খুব সহজ। কারণ, আকাশের যেকোনো বস্তুর চেয়ে এগুলো দ্রুতগতিতে চলাচল করে (ব্যতিক্রম শুধু উল্কা)। কোনো কিছু যদি আকাশে মিটমিট করে জ্বলে, বিশ্বাস করুন, সেটা আসলে বিমান।
আকাশে তারা দেখার সময় বুধ গ্রহটা সবাইকে দেখাতে খুব পছন্দ করি আমি। সব সময়। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ হওয়ায় খালি চোখে এটাকে দেখা খুব কঠিন। বছরের গুটিকয়েক সন্ধ্যা বা সকাল গ্রহটা দেখার জন্য সর্বোত্তম। সূর্যকে মাত্র ৮৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে গ্রহটা। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে রোমানদের দ্রুতগামী মেসেঞ্জার বা বার্তাবাহক দেবতার নামে। একে দেখা এত কঠিন; কারণ, এর কক্ষপথ সূর্যের খুব কাছে। পৃথিবী থেকে দেখলে, গ্রহটা কখনোই সূর্য থেকে ২৫ ডিগ্রির বেশি দূরে থাকে না। ঘড়িতে ১১টা বাজলে দুটা কাঁটার মধ্যে যে কোণ তৈরি হয়, তার চেয়েও এ কোণ ছোট। একে শুধু দেখা যায় সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরে ও সূর্যোদয়ের কিছু আগে। পৃথিবী থেকে দেখলে, এ সময় গ্রহটা সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে সব সময় দিগন্তের কাছাকাছি থাকে গ্রহটা। কাজেই একে দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কখনো যদি গ্রহটাকে আকাশে খুঁজে পান, তাহলে সেটা হবে সত্যি বিস্ময়কর ব্যাপার!
মহাকাশে নক্ষত্র দেখার মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের বিপুলতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি আমরা। যদি রাতের আকাশে নিয়ম করে তাকাতে থাকি ও চোখজোড়া খাপ খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় দিই, তাহলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের আরও বহুদূরের উপরিকাঠামোটাও বেশ দারুণভাবে দেখতে পাব। সেখানে ১০০ থেকে ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্র এমন গুচ্ছাকারে সাজানো থাকে, যেন নির্মল ও স্বচ্ছ এক বুনন। আমাদের জন্য সে দৃশ্য বিমল আনন্দের। মহাবিশ্বের আকার আমাদের কাছে অগম্য, কল্পনাতীত। আমাদের চিন্তা ও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে একে উপলব্ধি করার জন্য মিল্কিওয়ে দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।
গ্যালাক্সিদের এই মহাপ্রাচীর প্রায় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দীর্ঘ। কথাটা শুনে কি আপনার মাথা ঘুরছে? তা যদি না হয়, তাহলে আরও শুনুন।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী আমাদের গ্যালাক্সিতে যত নক্ষত্র আছে, গোটা মহাবিশ্বে মোট গ্যালাক্সির সংখ্যাও হয়তো সে পরিমাণ। আসলে টেলিস্কোপ দিয়ে গভীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করলে যা দেখা যায়, তার বেশির ভাগই গ্যালাক্সি। এত বিপুল দূরত্ব থেকে একেকটা নক্ষত্র আলাদা করা অসম্ভব। এসব গ্যালাক্সির প্রতিটিতে নক্ষত্রের সংখ্যা কোটি কোটি। অথবা আমাদের চেনা ও পরিচিত মহাবিশ্বের বৃহত্তম একক কাঠামোর কথা ভাবুন। একে বলা হয় গ্রেট ওয়াল অব গ্যালাক্সিস বা গ্যালাক্সিদের মহাপ্রাচীর। স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভে নামে বড় এক প্রকল্পের মাধ্যমে এটি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের চেনা মহাকাশের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। এতে একযোগে কাজ করেছেন তিন শতাধিক জ্যোতির্বিদ ও প্রকৌশলী এবং ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। স্লোয়ান টেলিস্কোপে আকাশ পর্যবেক্ষণ করা হতো প্রতি রাতে। এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০০ সালে। চলে ২০২০ পর্যন্ত। গ্যালাক্সিদের এই মহাপ্রাচীর প্রায় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দীর্ঘ। কথাটা শুনে কি আপনার মাথা ঘুরছে? তা যদি না হয়, তাহলে আরও শুনুন। মোটাদাগে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব ছড়িয়ে আছে ৯০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে (এটা কিন্তু পুরো মহাবিশ্ব নয়, মহাবিশ্বের স্রেফ একটা অংশমাত্র। আসলে আমরা শুধু এটুকুই দেখতে পারি। অবশ্যই খালি চোখে নয়, সব দুরবিন, মানমন্দির—সব মিলে)।
পদার্থবিজ্ঞানের শক্তি এটাই। এই বিদ্যা আমাদের বলতে পারে, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা তারও বেশি গ্যালাক্সি নিয়ে গঠিত [বর্তমান হিসাবে ২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ কোটির ওপর]। আরও বলতে পারে, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সব পদার্থের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ হলো সাধারণ পদার্থ। আমাদের চেনা-পরিচিত এই সাধারণ পদার্থ দিয়েই নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি (এবং আপনি ও আমি) গঠিত। অন্যদিকে মহাবিশ্বের মোট পদার্থের ২৩ শতাংশকে বলা হয় ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু (এই পদার্থ অদৃশ্য)। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, এ অদৃশ্য পদার্থের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আমরা এখনো জানি না, জিনিসটা আসলে কী। মহাবিশ্বের বাকি ৭৩ শতাংশ হলো শক্তির পরিমাণ। একে বলা হয় ডার্ক এনার্জি বা গুপ্ত শক্তি। এ শক্তিও অদৃশ্য। এটা আসলে কী, তা-ও কারও জানা নেই। মোদ্দাকথা হলো, মহাবিশ্বের ৯৬ শতাংশ ভর-শক্তি সম্পর্কে আমরা একেবারে অজ্ঞ। পদার্থবিজ্ঞানে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু আমাদের এখনো অনেক রহস্যের সমাধান করা বাকি। তবে একে আমি খুব অনুপ্রেরণাদায়ক বলে মনে করি।