এ গল্পের শুরু প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগে। সেই সময় আমাদের মহাবিশ্বের সব পদার্থ, সবটা শক্তি ও সবটুকু জায়গা মিলেমিশে এক ছোট্ট বিন্দুর মধ্যে একাকার হয়েছিল। সে বিন্দুর আয়তন ছিল একটি ফুলস্টপের (.) এক ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম।
বিন্দুসম সেই মহাবিশ্ব ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত। প্রাকৃতিক যেসব মৌলিক বল দিয়ে এটি গড়ে উঠেছে, তার সবই এ সময় একত্রে মিলেমিশে ছিল। ওই বিন্দু থেকে ঠিক কেমন করে মহাবিশ্বটির জন্ম হয়েছিল, আমরা তা জানি না। স্রেফ এটুকু জানি যে ছোট্ট বিন্দুটা হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয়েছিল। ফলে ভীষণ বেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এর ভেতরের সবকিছু। এ ঘটনাকেই আমরা এখন বলি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ।
মহাকর্ষ নিয়ে আমাদের আধুনিক যে জ্ঞান, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯১৬ সালে, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের হাত ধরে। এ তত্ত্বের সারকথা হলো, পদার্থ এবং শক্তির জন্য এর চারপাশের স্থান-কাল বেঁকে যেতে পারে। আর ছোট্ট, অতিক্ষুদ্র (যেমন অণু-পরমাণু কিংবা পরমাণুর চেয়েও ছোট অতিপারমাণবিক কণা) সবকিছু নিয়ে আমরা যতটা বুঝি, তার শুরুটা হয়েছিল আরও চার বছর পর, মানে ১৯২০ সালে। সেটা ঘটেছিল কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাত ধরে। সমস্যাটা হলো, সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা—একটার সঙ্গে আরেকটা কিছুতেই মেলে না। তাই এমন একটা তত্ত্বের প্রয়োজন, যেটা ছোট-বড় সব পদার্থের পেছনের বিজ্ঞানকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবে। সেই তত্ত্বটার নাম দেওয়া হয়েছে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ।
আমরা এখনো এই কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্বের সবটুকু জানতে পারিনি। কিন্তু সমস্যাগুলো কোথায়, এটুকু বেশ বোঝা গেছে। এর একটা হলো মহাবিশ্বের শুরুর দিকের প্ল্যাঙ্ক যুগে। অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পরে, t = ০ থেকে t = ১০-৪৩ সেকেন্ডের মধ্যে। সহজ করে বললে, মহাবিস্ফোরণের পর ততক্ষণে মাত্র এক সেকেন্ডের দশ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেকেন্ডের এক ভাগ অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে মহাবিশ্ব আয়তনে বেড়ে হয়েছে ১০ মিটার (এক মিটারের একশ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ)। এই অকল্পনীয় ক্ষুদ্রতার নামকরণ করা হয়েছে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামে।
এ মানুষটি ১৯০০ সালে শক্তির কোয়ান্টাম ধারণার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। তাই তাকে বলা হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক।
এমনিতে আমাদের নিত্যদিনের জানাশোনা মহাবিশ্বের মধ্যে মহাকর্ষের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোনো ঝামেলা নেই। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ ক্ষেত্রও আলাদা। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত খুবই আলাদা দুই ধরনের সমস্যার ওপর এ দুটো জিনিস প্রয়োগ করেন। কিন্তু মহাবিশ্বের সূচনার প্ল্যাঙ্ক যুগে আমাদের এখনকার বিশাল পদার্থগুলো ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র আকৃতির। অর্থাৎ সে যুগে ছোট-বড় সব পদার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ কালটুকু ব্যাখ্যা করার মতো পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়ম এখনো আমাদের জানা নেই। তবে যতটুকু ধারণা করা যায়, এ যুগের শেষে এসে কোনো একভাবে মৌলিক অন্যসব বলের বাঁধন ছিঁড়ে মহাকর্ষ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহাকর্ষ ছাড়া অন্য বলগুলো তখনো একসঙ্গেই ছিল। আর এ সময়কাল থেকে সব আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে বেশ চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
মহাবিশ্ব তখনো প্রচণ্ড উত্তপ্ত। এই উত্তাপে ফোটনগুলো তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুহূর্তে পদার্থ-প্রতিপদার্থ যুগলে পরিণত হচ্ছে। পরমুহূর্তেই একে-অন্যের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরিত হয়ে আবারো ফিরে যাচ্ছে ফোটন অবস্থায়।
মহাবিশ্ব বাড়তে বাড়তে যখন ১০-৩৫ সেকেন্ড পেরিয়ে এল, শক্তির ঘনত্বও কমে আসতে লাগল ক্রমান্বয়ে। এ সময় একত্রিত বলগুলো দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগের নাম ইলেকট্রোউইক ফোর্স বা দুর্বল বৈদ্যুতিক বল। আর অন্য অংশটুকু হয়ে গেল স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। এর কিছু সময় পরে দুর্বল বৈদ্যুতিক বল আবারো দুই ভাগে ভাগ হয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল এবং উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স বা দুর্বল নিউক্লিয়ার বলে পরিণত হয়। বিজ্ঞানীদের জানামতে, এখন পর্যন্ত প্রকৃতির মৌলিক বল এ চারটিই। দুর্বল নিউক্লিয়ার বল মূলত মৌলের তেজস্ক্রিয় ভাঙনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এদিকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে বেঁধে রাখে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। আর বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল বেঁধে রাখে পরমাণু ও অণুকে। অন্যদিকে অণুর চেয়ে বড় আকারের সবকিছুকে বেঁধে রাখে মহাকর্ষ।
বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে এর মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব মাত্র এক সেকেন্ডের এক ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময় পেরিয়ে এসেছে।
সে সময় অতিপারমাণবিক কণা আকারে পদার্থ আর ফোটন হিসেবে শক্তির মধ্যে অবস্থান্তর প্রক্রিয়া চলছে (বলে রাখি, ফোটন হলো আলোর বাহক। সাধারণত এদের আলোর কণা বলা হয়। তবে এরা যতটা কণা, ততটাই তরঙ্গ হিসেবেও আচরণ করে)। মহাবিশ্ব তখনো প্রচণ্ড উত্তপ্ত। এই উত্তাপে ফোটনগুলো তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুহূর্তে পদার্থ-প্রতিপদার্থ যুগলে পরিণত হচ্ছে। পরমুহূর্তেই একে-অন্যের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরিত হয়ে আবারো ফিরে যাচ্ছে ফোটন অবস্থায়। এ পর্যায়ে একটা কথা বলে রাখা ভালো। অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ মোটেও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের কল্পনা নয়। নিখাদ বাস্তব। সবচেয়ে বড় কথা, এই যে ফোটনের পদার্থ-প্রতিপদার্থ অবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে আবার ফোটন দশায় ফিরে আসা, এ পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটছে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc² মেনে। কোনো পদার্থ থেকে কতটুকু শক্তি উৎপন্ন হতে পারে, কিংবা কোনো শক্তি পদার্থে রূপান্তরিত হলে এর ভর কতটুকু হবে-তার পেছনের রেসিপি মূলত এই সূত্র। এখানে c হলো আলোর বেগ। (সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। অনুবাদক) বিশাল এই সংখ্যাটা দিয়ে কোনো ভরকে গুণ করলে বোঝা যায়, এ প্রক্রিয়ায় সামান্য ভর থেকে কী বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে পারে।
কোয়ার্কের নামকরণের পেছনের গল্পটা সাহিত্য ও কল্পনা রসে বেশ সমৃদ্ধ। বিখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের একটা বই আছে, ফিনেগানস ওয়েক। সেই বইয়ের একটি উক্তি, 'থ্রি কোয়ার্ক ফর মাস্টার মার্ক' থেকেই মূলত এ নামকরণ।
শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল ও দুর্বল বৈদ্যুতিক বল আলাদা হয়ে যাওয়ার একটু আগে থেকে কিছুটা পরের সময় পর্যন্ত মহাবিশ্বের অবস্থা ছিল ফুটন্ত গরম স্যুপের মতো। এ স্যুপের উপাদান হলো কোয়ার্ক, লেপটন এবং তাদের যুগল প্রতিকণারা। সেই সঙ্গে আছে বোসন। এর কাজ বাকি উপাদানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবস্থান্তর প্রক্রিয়া ঘটানো। এই কণাগুলোকে ভেঙে আরও ক্ষুদ্র কোনো কণায় রূপান্তর করা যায় বলে এখনো জানা যায়নি। এক কথায় বললে, আমাদের জানামতে, এরাই এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের অবিভাজ্য ক্ষুদ্র কণা।
আমাদের সবার পরিচিত ফোটনও এক ধরনের বোসন। আগেই বলেছি, ফোটন হলো আলোর কণা।
পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে যাদের তেমন জানাশোনা নেই, তাদের কাছেও দুটো লেপটন বেশ পরিচিত। ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো। কোয়ার্কের বেলায় অবশ্য এভাবে উদাহরণ দেওয়া যাবে না। কারণ, এদের কোনোটাই অতটা পরিচিত নয়। কোয়ার্ক মূলত ছয় ধরনের। এদের নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। এসব নামের সঙ্গে ভাষাবিদ্যা কিংবা দর্শনের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো এক বিচিত্র কারণে এদের নামগুলো হলো : আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম কোয়ার্ক!
বোসনের নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় [আসলে, বাঙালি বিজ্ঞানী] বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের নামে। আর লেপটন এসেছে গ্রিক Leptos থেকে। এর মানে হালকা কিংবা ক্ষুদ্র।
কিন্তু কোয়ার্কের নামকরণের পেছনের গল্পটা সাহিত্য ও কল্পনা রসে বেশ সমৃদ্ধ। বিখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের একটা বই আছে, ফিনেগানস ওয়েক। সেই বইয়ের একটি উক্তি, 'থ্রি কোয়ার্ক ফর মাস্টার মার্ক' থেকেই মূলত এ নামকরণ। পদার্থবিদ মারে গেল-মান প্রথমে ভেবেছিলেন, কোয়ার্ক পরিবারে মাত্র তিন ধরনের সদস্য আছে। তাই তিনি এ উক্তি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এদের নাম দেন কোয়ার্ক। বিচিত্র স্বভাব এবং কিছুতেই ধরা দিতে না চাওয়ার প্রবণতা আছে কোয়ার্কদের। এসব বৈশিষ্ট্য ও সংখ্যা (মানে, তিনটি) মিলে এ নামকরণ বেশ মানিয়ে গেল। [এই রসিকতাটির পেছনের ঘটনা বেশ লম্বা। সংক্ষেপে যদি বলি, কোয়ার্ক শব্দটি দিয়ে জার্মান ভাষায় এক ধরনের দুগ্ধজাত খাবারকে বোঝানো হয়। একই সঙ্গে এটি 'ননসেন্স' কথাটিরও সমার্থক। কবিতায় তাল মেলাতে গিয়ে এটিই ব্যবহার করেছেন জয়েস। ওদিকে, কোয়ার্কদের উদ্ভট কাজকর্মের জন্য ঠিক এ নামটিই বেছে নেন গেল-মান। অনুবাদক।] বাকি তিনটি কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয় আরও কিছুদিন পর। যাহোক, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। কোয়ার্কদের নামগুলো অনেক সহজ। এরকম সহজ নামকরণ জীববিজ্ঞানী বা রসায়নবিদরা তাদের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কখনোই কেন যেন করতে পারেন না। গেল-মান কোয়ার্কের ক্ষেত্রে কেমন করে সেটা করে ফেললেন, সে এক রহস্য বটে।
কোনো বিশাল কড়াইতে একদল কোয়ার্ককে বুঝি জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একদল পদার্থবিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো আমাদের পদার্থের এ অবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
যেমনটা বললাম, কোয়ার্কদের কাজকর্ম খুবই বিচিত্র। প্রোটনদের যেমন+১ চার্জ থাকে কিংবা ইলেকট্রনদের-১, তেমনি কোয়ার্কদের চার্জ হয় ভগ্নাংশে। এদের কখনোই নিজে থেকে ধরা সম্ভব নয়। কোয়ার্ক কণারা সবসময় নিজেদের সঙ্গে অন্য কোয়ার্কদের টেনে নিয়ে চলে। আরও বিচিত্র ব্যাপার হলো, এদের আপনি যত আলাদা করতে চাইবেন, যে বলটা এদের একসঙ্গে বেঁধে রাখে, সেটা আরও শক্তিশালী হতে থাকবে। দেখে মনে হবে, এরা বোধহয় অতিনিউক্লীয় কোনো রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। যদি কোনোভাবে এই হতচ্ছাড়া কোয়ার্কদের কিছুটা আলাদা করতে পেরে বেশ একটু আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার সে আনন্দ মিলিয়ে যাবে। কারণ, যে জায়গায় এরা আলাদা হয়ে যেতে শুরু করেছিল, চট করে সেই জায়গায় রাবার ব্যান্ডটা ভেঙে যাবে। তার পরই ভেঙে যাওয়া জায়গাগুলোতে যে শক্তি জমা হয়েছে, সেটা ব্যবহার করে E=mc² সূত্রের মাহাত্ম্য উসুল করার জন্য তৈরি হয়ে যাবে নতুন একগাদা কোয়ার্ক। ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। হ্যাঁ, যেখান থেকে শুরু করেছেন, সেখানে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কোয়ার্ক-লেপটন যুগের এ সময়ে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অনেক বেশি। এ সময় কণাগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে এত বেশি শক্তিশালী সংঘর্ষ হচ্ছিল যে, মেসন (একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতিকোয়ার্ক শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বন্ধন দিয়ে যুক্ত হয়ে যে অস্থায়ী কণা তৈরি করে) কিংবা ব্যারিয়ন (তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত কণা) তৈরি হয়েও স্থির থাকতে পারছিল না। ভেঙে আবার কোয়ার্ক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় এরা নিজেদের মধ্যে যুক্ত না হয়ে বরং মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দেখে মনে হবে, কোনো বিশাল কড়াইতে একদল কোয়ার্ককে বুঝি জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একদল পদার্থবিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো আমাদের পদার্থের এ অবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
মহাবিশ্বের শুরুর দিকে, এই সবকিছুর মধ্যে কোনো একসময়, যথাসম্ভব মৌলিক বলগুলোর কোনো একটি যখন বাকিগুলো থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন মহাবিশ্বের প্রতিসাম্য ভেঙে গিয়ে একটুখানি অপ্রতিসাম্য দেখা দেয়। দেখা গেল, প্রতি একশ কোটি একটি পদার্থের সঙ্গে প্রতিপদার্থ আছে একশ কোটি। মাত্র একটি কম। কোয়ার্ক-প্রতিকোয়ার্ক, ইলেকট্রন-পজিট্রন এবং নিউট্রিনো-প্রতিনিউট্রিনোর এ নিয়ত ভাঙা-গড়ার মধ্যে এই ছোট্ট অপ্রতিসাম্যটুকু অবশ্যই চোখে পড়ার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু এ ব্যাপারটিই মহাবিশ্বের রূপ আগাগোড়া বদলে দেবে।
প্রতি একশ কোটি পদার্থ মুহূর্তের মধ্যে একশ কোটি প্রতিপদার্থের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে গিয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ শক্তি থেকে আবারো তৈরি হচ্ছে পদার্থ-প্রতিপদার্থ। প্রতি একশ কোটিতে একটা করে যে পদার্থটা প্রতিবার বাকি থেকে যাচ্ছে, সেটার কিন্তু এখনো বাকিগুলোর মতো কোনো একটা প্রতিপদার্থকে খুঁজে নিয়ে হামলে পড়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু একটুখানি পরেই, মহাবিশ্ব যখন আকারে আমাদের সৌরজগৎকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করবে, তখন এ পদার্থটার আর এ সুযোগ থাকবে না। এ সময়, এতক্ষণ যেখানে একটু একটু করে তাপমাত্রা কথে আসছিল, সেখানে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা কমে যাবে এক ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন।
এর মধ্য দিয়ে আমাদের এই মহাবিশ্ব পেরিয়ে যাবে সেকেন্ডের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ!
প্রতি একশ কোটি হ্যাড্রন-প্রতিহ্যাড্রনের ভাঙা-গড়ার খেলায় জন্ম নিচ্ছে একশ কোটি ফোটন। আগের মতোই প্রতি একশ কোটি হ্যাড্রন-প্রতিহ্যাড্রনের ভাঙা-গড়ার খেলায় প্রতিবার একটা করে হ্যাড্রন বেঁচে যাচ্ছে। আসলে এক সময় মহাবিশ্বের রূপরেখা বদলে দেবে একাকী বেঁচে যাওয়া এ হ্যাড্রনগুলোই।
হঠাৎ এক ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় ক্রমশ শীতল হতে থাকা মহাবিশ্বের বর্তমান তাপমাত্রা ও ঘনত্ব কোয়ার্কগুলোকে জ্বাল দেওয়ার জন্য আর যথেষ্ট থাকবে না। তখন এরা নিজেদের জন্য সঙ্গী বেছে নিতে শুরু করবে। ফলে জন্ম নেবে নতুন এক ধরনের স্থায়ী ভারী কণা। এর নাম হ্যাড্রন (Hadron)।
গ্রিক হ্যাড্রন কথার অর্থ ভারী। মনে রাখতে হবে, এখন আর কোয়ার্করা প্রতিমুহূর্তে শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে না। কোয়ার্ক থেকে এই যে হ্যাড্রনের উৎপত্তি হচ্ছে, ফলে মহাবিশ্বে ভারী ও আমাদের খুব পরিচিত নয়, এমন নতুন বেশ কিছু কণার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল প্রোটন ও নিউট্রন। এরা সবাই আসলে বিভিন্ন রকম হ্যাড্রন। বিভিন্ন বিন্যাসে কোয়ার্কদের নিজেদের জন্য সঙ্গী বেছে নেওয়ার ফল।
এই কিছুদিন আগের কথা। সুইজারল্যান্ডে ইউরোপীয় কণা-পদার্থবিজ্ঞান যুগ্ম গবেষণায় একটি বিশাল অ্যাকসিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্র ব্যবহার করে হ্যাড্রন বিমের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে মহাবিশ্বের ওই অবস্থাটুকু আবারো তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ যন্ত্রটার নাম দেওয়া হয়েছে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (LHC)। (ইউরোপীয় কণা-পদার্থবিজ্ঞান যুগ্ম গবেষণার ইংরেজি নাম দি ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, সংক্ষেপে সার্ন। সংক্ষিপ্ত নামেই এটি বেশি পরিচিত)
সরল কথায়, এই সামান্য অপ্রতিসাম্যের ফলে কোয়ার্ক লেপটন স্যুপের জায়গা দখল করে নিল হ্যাড্রন। এর ফল হলো যুগান্তকারী। শুরু হলো অ্যাড্রন যুগ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব শীতল হতে লাগল। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন মৌলিক কণা জন্ম নেওয়ার জন্য আগে যে পরিমাণ শক্তি ছিল, সেটার পরিমাণ গেল কমে। কোয়ার্কদের যুগ শেষ। তাই যে ফোটনগুলো তখন ছিল, এরা আর E = mc2 সূত্রের হাত ধরে কোয়ার্ক-প্রতিকোয়ার্ক তৈরি করতে পারছিল না। শুধু তাই নয়, এতক্ষণ পদার্থ-প্রতিপদার্যের ধ্বংসযজ্ঞের ফলে যে পরিমাণ ফোটন তৈরি হয়েছে, মহাবিশ্বের ক্রমশ বেড়ে চলার ফলে এদের পরিমাণও গেল অনেক কমে। ফলে শক্তির পরিমাণ এত কমে গেল যে, হ্যাড্রন-প্রতিহ্যাড্রন যুগল তৈরির জন্য অবশিষ্ট শক্তি আর যথেষ্ট রইল না।
প্রতি একশ কোটি হ্যাড্রন-প্রতিহ্যাড্রনের ভাঙা-গড়ার খেলায় জন্ম নিচ্ছে একশ কোটি ফোটন। আগের মতোই প্রতি একশ কোটি হ্যাড্রন-প্রতিহ্যাড্রনের ভাঙা-গড়ার খেলায় প্রতিবার একটা করে হ্যাড্রন বেঁচে যাচ্ছে। আসলে এক সময় মহাবিশ্বের রূপরেখা বদলে দেবে একাকী বেঁচে যাওয়া এ হ্যাড্রনগুলোই। আমাদের জানা-অজানা সব পদার্থ, গ্রহ-নক্ষত্র, এমনকি সব গ্যালাক্সির জন্মের পেছনের মূল উৎস হিসেবেও কাজ করবে এরা। পদার্থ-প্রতিপদার্থের এই নিয়ত ভাঙা-গড়ার খেলায় যদি প্রতি একশ কোটিতে একটা করে হ্যাড্রন বেঁচে না যেত, তাহলে মহাবিশ্বের সব পদার্থ তাদের প্রতিপদার্থের সঙ্গে সংঘর্ষে বিলীন হয়ে যেত। আলো—স্রেফ আলো ছাড়া এই মহাবিশ্বে আর কিছু থাকত না।
সময়ের হিসাবে এতক্ষণে আমাদের এই শিশু মহাবিশ্ব পেরিয়ে এসেছে এক সেকেন্ড। হ্যাঁ, এক সেকেন্ড।
এর মধ্যেই মহাবিশ্ব বিস্তৃত হয়েছে কয়েক আলোকবর্ষ সমান (আলোকবর্ষ মানে, আলো এক বছরে যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে। প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার)। সূর্য থেকে এর নিকটবর্তী নক্ষত্রের যেটুকু দূরত্ব—মোটামুটি এটুকু [আসলে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটির দূরত্ব প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ। এর নাম প্রক্সিমা সেন্টাউরি]। কিন্তু এখনো এর তাপমাত্রা রয়ে গেছে কয়েকশ কোটি ডিগ্রি। ইলেকট্রন ও পজিট্রন ভেঙেচুরে শক্তিতে রূপান্তর করা এবং সেখান থেকে আবার ইলেকট্রন-পজিট্রন তৈরির জন্য এ শক্তি যথেষ্ট। কিন্তু মহাবিশ্ব তো আর স্থির বসে নেই। মহাবিশ্ব নিয়ত বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এর তাপমাত্রাও ধীরে ধীরে কমছে। তাই একসময় কোয়ার্ক ও হ্যাড্রনের সঙ্গে যা হয়েছিল, এবারে সেটাই শুরু হলো ইলেকট্রনের সঙ্গে। ফোটনের সমুদ্রে ইলেকট্রন-পজিট্রনের ভাঙা-গড়ার খেলায় প্রতি একশ কোটিতে একটা করে ইলেকট্রন ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যেতে লাগল। একটুখানি পরেই দেখা গেল, প্রতিটি প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য একটি করে ইলেকট্রন ঠিক ঠিক বেঁচে গিয়েছে।
যে বাষ্পমেঘ থেকে সূর্যের জন্ম, সেখানে প্রচুর পরিমাণ ভারী ভারী পদার্থ জমে ছিল। এরা একসঙ্গে জমে গিয়ে তৈরি হলো পাথুরে ও বাষ্পীয় সব গ্রহ, শত-সহস্রগ্রহাণু এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ধূমকেতু। পুরো প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। তবু এদের মধ্যে তৈরি হলো চমৎকার শৃঙ্খলা।
নিয়ত শীতল হতে থাকা মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এতক্ষণে কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। প্রোটনের সঙ্গে প্রোটন ও নিউট্রন যুক্ত হয়ে তৈরি হচ্ছে পরমাণুর নিউক্লিয়াস। এর পেছনে গ্লু বা আঠা হিসেবে কাজ করছে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। নব্বই শতাংশ হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সঙ্গে দশ শতাংশ হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, সঙ্গে আছে সামান্য ডিউটোরিয়াম (ভারী হাইড্রোজেন), ট্রিটিয়াম (আরো ভারী হাইড্রোজেন) এবং লিথিয়াম। এই হচ্ছে এ মুহূর্তে আমাদের মহাবিশ্বের সামগ্রিক চিত্র।
সময়ের হিসাবে বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে মহাবিশ্ব এর মধ্যে পেরিয়ে এসেছে মাত্র দুই মিনিট।
তার পরের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছরে আসলে তেমন কিছু হয়নি। মহাবিশ্ব তখনো যথেষ্ট উত্তপ্ত। ইলেকট্রনগুলো এর মধ্যে শুধু এলোমেলো ছুটে বেড়িয়েছে। নিজেরাও ঠোকাঠুকি করেছে সময়ে সময়ে। এরপর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে যখন তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে এলো (এ তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার অর্ধেক), এদের এলোমেলো ছোটাছুটি গেল থেমে। মুক্ত এই ইলেকট্রনগুলো বাঁধা পড়ল নিউক্লিয়াসের সঙ্গে। এই বাঁধা পড়াটা একটুখানি অনুভব করতে হবে।
একমুহূর্ত আগেও আপনি যদি মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ মেলে তাকাতেন, তাহলে আপনার দৃষ্টিশক্তি আটকে যেত চোখের ঠিক সামনেই।
সবকিছু মনে হতো কিম্ভুতকিমাকার এক ধরনের জগাখিচুড়ি। কারণ, ফোটনেরা ইলেকট্রনের সঙ্গে ধাক্কা না খেয়ে বেশিদূর যেতে পারত না। এলোমেলো ছুটে চলা ইলেকট্রনের সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে এমন সংঘর্ষের ফলে আলোর কোনো ব্যাপ্তি ছিল না বললেই চলে। কোনো কিছু থেকে আমাদের চোখে আলো এসে পড়লেই কেবল আমরা সেটা দেখতে পাই। চোখের ঠিক সামনেই যে ইলেকট্রনগুলো ছোটাছুটি করছে, ওগুলো ছাড়া আর কিছুতে গিয়ে আলো পড়বে কেমন করে! কিন্তু এই মুহূর্তে এসে পুরো বিষয়টাই পাল্টে গেল। ইলেকট্রনরা বাঁধা পড়ল নিউক্লিয়াসের সঙ্গে। তাই ফোটনের ছুটে চলায় ঝামেলা পাকানোর মতো আর কেউ রইল না।
আলো আর আলো—এক সাগর আলোর তরঙ্গে স্নান করে মহাবিশ্বের পটভূমিতে চিত্রায়িত হলো নতুন ইতিহাস। গঠিত হলো পরমাণু। সূচনা হলো পরমাণু দিয়ে গঠিত আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের।
পরের একশ কোটি বছর ধরে ক্রমান্বয়ে মহাবিশ্বের আয়তন যেমন বেড়েছে, তেমনি কমে গেছে তার তাপমাত্রাও। মহাকর্ষের টানে চারপাশে বিক্ষিপ্ত পদার্থগুলো জায়গায় জায়গায় একসঙ্গে জমে গিয়ে জন্ম হয়েছে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের। এ সময়ের মধ্যে জন্ম নিয়েছে প্রায় একশ বিলিয়ন গ্যালাক্সি। আর এদের প্রত্যেকের ভেতর জন্ম নিয়েছে শত বিলিয়ন নক্ষত্র। এ নক্ষত্রগুলোর কেন্দ্রে নিয়ত ঘটে চলেছে থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। ভরের দিক থেকে এরা ছিল আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় দশগুণ ভারী। অবশ্য এর কারণও আছে। এই পরিমাণ ভারী না হলে এদের কেন্দ্রের ভেতর হাইড্রোজেনের চেয়ে এত ভারী ভারী ডজনখানেক পদার্থ তৈরি হবে কেমন করে? এই যে ভারী পদার্থগুলো নক্ষত্রের পেটে জন্ম নিচ্ছে, এদের হাত ধরেই জন্ম নেবে ভবিষ্যতের গ্রহ-নক্ষত্র, জন্ম নেবে প্রাণ।
যেখানে জন্ম নিয়েছে, তারা যদি সেখানেই সেভাবেই রয়ে যেত, তাহলে এরা আসলে কোনো কাজে আসত না। কিন্তু অনেক ভারী এসব নক্ষত্র ভেতরে ভেতরে একেবারে জ্বলে-পুড়ে গিয়ে একসময় প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরিত হয়। ফলে এদের পেটের ভেতর জন্ম নেওয়া রাসায়নিক পদার্থগুলো ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্যালাক্সি জুড়ে। এভাবেই নয়শ কোটি বছর পরে মহাবিশ্বের অখ্যাত কোনো এক অংশে, ভার্গো সুপারক্লাস্টারের সীমান্ত অঞ্চলের অখ্যাত এক গ্যালাক্সির (মিল্কিওয়ে) অজানা একপ্রান্তে, ওরিয়ন বাহুর মধ্যে জন্ম নিল নিতান্ত সাধারণ এক নক্ষত্র—সূর্য।
আইডিয়া নিয়ে মজা করা যায়, কিন্তু কাউকে সন্তুষ্ট করা যায় না। কিন্তু সেটা বিষয় নয়। এই আইডিয়াগুলো আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা অজ্ঞ। আমাদের তাই প্রতিনিয়ত এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতে হবে।
যে বাষ্পমেঘ থেকে সূর্যের জন্ম, সেখানে প্রচুর পরিমাণ ভারী ভারী পদার্থ জমে ছিল। এরা একসঙ্গে জমে গিয়ে তৈরি হলো পাথুরে ও বাষ্পীয় সব গ্রহ, শত-সহস্রগ্রহাণু এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ধূমকেতু। পুরো প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। তবু এদের মধ্যে তৈরি হলো চমৎকার শৃঙ্খলা। এরা সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরা শুরু করল। বাকি যে ধ্বংসাবশেষগুলো ছিল, সেগুলো কক্ষপথে ঘুরতে থাকা বিশাল গ্রহ ও গ্রহাণুগুলোর সঙ্গে জুড়ে যেতে লাগল।
পুরো বিষয়টা কিন্তু এত শান্ত, স্থিরভাবে ঘটেনি। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা দুটো জিনিস একসঙ্গে জুড়ে যাওয়ার সময় ভয়াবহ শক্তিশালী সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে পাথুরে এই গ্রহগুলোর পৃষ্ঠতল গলে গেছে। তাই এদের মধ্যে পদার্থের কোনো জটিল অণু তৈরি হতে পারছিল না।
একটা সময়ে এসে সৌরজগতে এভাবে ছুটে এসে জুড়ে যাওয়ার মতো ধ্বংসাবশেষ ফুরিয়ে এল। শীতল হয়ে এল গ্রহগুলোর পৃষ্ঠ। আমাদের আজকের এই পৃথিবী গঠিত হলো সৌরজগতের এমন এক অঞ্চলে, যেখানে সৌভাগ্যবশত সমুদ্রের পানি তরল হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। পৃথিবী যদি সূর্যের আর একটুখানিও কাছে থাকত, তাহলে সমুদ্রের সব পানি সূর্যের উত্তাপে বাষ্প হয়ে যেত। আর একটুখানি দূরে হলে সব পানি জমে হয়ে যেত বরফ। অর্থাৎ, একটু এদিক-ওদিক হলেই আমাদের আজকের এই চিরচেনা প্রাণ মোটেও এমন হতো না।
পৃথিবীর এই বিশাল সমুদ্র তখন জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ভরা। কেমন করে এসব পদার্থ থেকে জীবনের শুরু হয়েছিল, সেটি আমাদের আজও ঠিক জানা নেই। একসময় জৈব যৌগ পাল্টে গিয়েছিল প্রাণে। এই প্রাণ মানে এককোষী কোনো ব্যাকটেরিয়া, যারা অ্যামাইটোসিস প্রক্রিয়ায় প্রজননে সক্ষম। যেহেতু তখনো অক্সিজেনের কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল না, তাই এরা নিশ্বাস নিত অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায়। মজার বিষয় হলো, নিশ্বাস ছাড়ার সময় এরা ছাড়ত অক্সিজেন। ছোট্ট এই ব্যাকটেরিয়ার হাতে পড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড ভরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগল, ভরে উঠতে লাগল অক্সিজেনে। যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন জমে যাওয়ার পরে সমুদ্রে ও মাটির বুকে জন্ম নেবে নতুন প্রাণ, যারা নিশ্বাস নেবে এ অক্সিজেনেই। সাধারণত দুটি করে অক্সিজেন পরমাণু একসঙ্গে মিলে তৈরি করে অক্সিজেন অণু (O2)। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে এরাই তিনটে করে মিলে তৈরি করে ওজন (O3)। এই ওজন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করে আমাদের পৃথিবীকে।
শুধু পৃথিবীতেই নয়, মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই সরল কিংবা জটিল অণু গঠনে কার্বনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের প্রাণের পেছনেও এর অবদান অনেক। আর সব পদার্থ মিলে যে কয়েক রকম পদার্থের অণু তৈরি করেছে, কার্বন একাই করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
কিন্তু জীবনের মূল কথাই হলো এটি ভঙ্গুর এবং অনিশ্চিত। পৃথিবীর বুকে বেশ কয়েকবারই এসে হামলে পড়েছে বিশাল সব গ্রহাণু ও ধূমকেতু। এর ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভেঙে পড়েছে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র। এই তো, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের কথা (পৃথিবীর বয়স হিসেবে মাত্র দুই শতাংশ আগের ঘটনা)। দশ ট্রিলিয়ন টনের একটি গ্রহাণু এসে আছড়ে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে, আজকের ইউকাটান পেনিনসুলায়। এর ফলে পৃথিবীর প্রায় সত্তর শতাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, ডাইনোসরের বিলুপ্তিও ঘটেছিল এরই ফলে।
কিন্তু, এর আগে কী হয়েছিল? কী হয়েছিল শুরুর আগে?
এ ব্যাপারে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের এখনো কোনো ধারণা নেই। কিংবা বলা যায়, আমাদের সবচেয়ে চমৎকার আইডিয়াও এখনো এদিক থেকে নিতান্ত সামান্য।
কিন্তু যদি এমন হয় যে মহাবিশ্ব পুরোটা সময়ই এখানেই ছিল, এমন একটা অবস্থায়, যেটা ব্যাখ্যা করার মতো বিজ্ঞান আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। একটা মাল্টিভার্স বা বহু মহাবিশ্ব হতে পারে না, যেটা প্রতিনিয়ত এমন নতুন নতুন মহাবিশ্বের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে? কিংবা হতে পারে না, মহাবিশ্ব একেবারে শূন্য থেকেই হঠাৎ করে জন্ম নিয়ে নিয়েছে? কে জানে।
আসলে এসব আইডিয়া নিয়ে মজা করা যায়, কিন্তু কাউকে সন্তুষ্ট করা যায় না। কিন্তু সেটা বিষয় নয়। এই আইডিয়াগুলো আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা অজ্ঞ। আমাদের তাই প্রতিনিয়ত এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতে হবে। ছুটে বেড়াতে হবে নতুন কিছু জানার জন্য। যারা নিজেদের অজ্ঞতার বিষয়টি বোঝেন না, তারা শিখতেও পারেন না। জ্ঞান আর অজ্ঞতার মাঝে নিজেরাই বোকার মতো দেয়াল তুলে দিলে কেমন করে শিখবেন?
আমরা যেটুকু জানি ও দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারি, সেটা হলো-মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল। সেটা একসময় বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে এবং রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। আর হ্যাঁ, আমাদের প্রত্যেকের শরীরের প্রতিটি পরমাণুর পেছনের সবকিছু, সবকিছুকেই বিগ ব্যাং পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়। বোঝা যায়, প্রায় পাঁচশ কোটি বছর আগে বিস্ফোরিত কোনো এক প্রচণ্ড ভারী নক্ষত্রের পেটের চুলাতেই তৈরি হয়েছে এসব পরমাণু।
আমরা নক্ষত্রের সন্তান। তারপর মহাবিশ্বকে জানার জন্য মহাবিশ্বের কাছ থেকেই জ্ঞান ও শক্তি সংগ্রহ করে ছুটে চলেছি সব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে।
আর এটা কেবল শুরু।