ইলেকট্রনিক পাঠশালা - ৫
সার্কিটের ভেতরে: কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সার্কিট এবং বিদ্যুৎ ও ইলেকট্রনের প্রবাহ পরিচয়
সাইকেল চালাতে শিখতে হলে কেবল তত্ত্ব শিখলেই হয় না, সত্যিকারে চালিয়েই শিখতে হয়। একইভাবে ইলেকট্রনিকস শিখতে হলে তত্ত্বের পাশাপাশি হাতে-কলমে সার্কিট তৈরি করতে হয়। সার্কিটের বিভিন্ন বিন্দুতে পরিমাপ করে তত্ত্বের সঙ্গে তার মিল-অমিলের কারণ চিন্তা করে খুঁজে বের করতে হয়। আবার কেবল সার্কিট তৈরিই নয়, কীভাবে তাকে খোলসবন্দী করে অন্য সবার ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, তা-ও শিখতে হয়। নইলে ওই সার্কিট কোনো কাজে আসবে না। এ পাঠশালায় তাই কিছু কাজের সার্কিট বানানো শেখানো হবে। সেই সঙ্গে তার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয় তত্ত্বও ধাপে ধাপে আলোচনা করা হবে। তাতে একসঙ্গে সব কটি দিকই শেখা হয়ে যাবে।
কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সের সার্কিট
কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সের সাহায্যে থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স পরিমাপের সার্কিট নিয়ে গত পর্বে আলোচনা করা হয়েছে। কীভাবে কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সার্কিট তৈরি করা যায় তা এ পর্বে তুলে ধরছি। তবে বৈদ্যুতিক কারেন্ট ও ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা একটি ঝামেলা তৈরি করে রেখেছেন। সে বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই আগেই। যেকোনো কঠিন বস্তুর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ কারেন্টের একমাত্র বাহক হচ্ছে ইলেকট্রন। আর ইলেকট্রন হচ্ছে নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট একটি কণা। ইলেকট্রন প্রবাহের দিক হচ্ছে ব্যাটারির বর্তনী বা সার্কিটে নেগেটিভ থেকে পজিটিভ প্রান্তের দিকে, যেমনটি ছবি ১-এ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রনের অস্তিত্ব আবিষ্কারের অনেক আগে স্থির-বিদ্যুৎ, চল-বিদ্যুৎ, ব্যাটারি ও বিদ্যুৎ প্রবাহের ধারণা আবিষ্কার হয়। তখন ধারণা করা হতো যে পজিটিভ চার্জের প্রবাহ হওয়ার ফলে বিদ্যুৎ কারেন্ট উত্পন্ন হচ্ছে (ছবি ২)। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে বিদ্যুতের অনেক সূত্র তৈরি হয়ে যায়।
ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা এক সমস্যায় পড়লেন। জানা গেল, কঠিন পদার্থে পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট পরমাণুর নিউক্লিয়াস যার যার অবস্থানে অনড় থাকে, সেগুলো বিদ্যুৎ প্রবাহে অংশ নেয় না। ইলেকট্রনের নড়াচড়ার ফলেই বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি হয়। এখন যদি ইলেকট্রনের প্রবাহের দিকটিকে বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক হিসেবে ধরা হয় তাহলে পুরোনো অনেক সূত্র পাল্টাতে হবে। এটিও তাঁরা চাচ্ছিলেন না। তখন একটি সমাধান হলো এভাবে যে বিদ্যুৎ কারেন্টের দিকটিকে আগের মতোই রেখে দেব। একে বলব, ‘প্রচলিত কারেন্ট’। কিন্তু মনের ভেতরে আমরা জানব যে ইলেকট্রনের সঠিক প্রবাহ উল্টো দিকে। যেহেতু আমরা সবাই জানব যে এটি মিথ্যা, তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। তবে জেনে রাখা ভালো, তরল পদার্থে যদি বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, সেখানে কিন্তু পজিটিভ ও নেগেটিভ দুই ধরনের চার্জযুক্ত কণাই নড়াচড়া করে। তবে এ ক্ষেত্রেও পজিটিভ চার্জের নড়ার দিকটিকেই বিদ্যুৎ কারেন্টের দিক হিসেবে ধরা হয়।
এবার কনস্ট্যান্ট কারেন্টের সার্কিটে আসি। ছবি ৩-এ একটি সার্কিট দেখানো হয়েছে। ব্যাটারিকে তার সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে বাঁ দিকে। এর পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রান্ত দুটিও দেখানো আছে। খেয়াল করতে হবে যে পজিটিভ প্রান্তকে নির্দেশ করা রেখাটির দৈর্ঘ্য অপরটি থেকে একটু বড়। দুটিকে সমান করে দেখানো যাবে না, তাহলে তাকে আমরা ক্যাপাসিটর নামে অন্য একটি জিনিস বুঝব। একটি বড় ও একটি ছোট রেখা দিয়ে আমরা একটি ব্যাটারি সেল নির্দেশ করতে পারি। আর একাধিক হলে সেগুলোকে একাধিক সেলের সিরিজ সংযোগ হিসেবে দেখাতে পারি, যেভাবে এখানে দেখানো হয়েছে। তবে অনেক হলেও দুটি বা তিনটি সেলের সাংকেতিক চিহ্ন যথেষ্ট। যতগুলো সেল, ততগুলোই যে করতে হবে কোনো কথা নেই। এই সার্কিটে নতুন দুটি ইলেকট্রনিক কমপোনেন্ট বা যন্ত্রাংশের সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে, যন্ত্রাংশ দুটি হচ্ছে জেনার ডায়োড ও ট্রানজিস্টর। যে ট্রানজিস্টর দেখানো হয়েছে সেটি একটি এনপিএন (npn) ট্রানজিস্টর। এর সম্পর্কে পরে আরও লিখব।
এ সার্কিটে ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্তে আমরা ‘গ্রাউন্ড’-এর একটি সাংকেতিক চিহ্ন এঁকেছি। এর অর্থ এই নয় যে এ প্রান্তটিকে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এর অর্থ হলো যে এ সার্কিটের প্রতিটি বিন্দুর ভোল্টেজকে গ্রাউন্ডের সাপেক্ষে তুলনা করে বলা হবে।
এ সার্কিটে ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্তে আমরা ‘গ্রাউন্ড’-এর একটি সাংকেতিক চিহ্ন এঁকেছি। এর অর্থ এই নয় যে এ প্রান্তটিকে মাটির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এর অর্থ হলো যে এ সার্কিটের প্রতিটি বিন্দুর ভোল্টেজকে গ্রাউন্ডের সাপেক্ষে তুলনা করে বলা হবে। এটি কেন করছি? আসলে একটি বিন্দুতে ভোল্টেজ কত—এ কথাটির কোনো অর্থ নেই। দুটি বিন্দুর মধ্যে ভোল্টেজ পার্থক্য কত, এটি আমরা বলতে পারি। কিন্তু বারবার এভাবে বলতে গেলে কথা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তাই কথাকে ছোট ও সহজ করতে আমরা সার্কিটে একটি পছন্দমতো বিন্দুকে ‘গ্রাউন্ড’ ধরে নিই। ওই সার্কিটের সব বিন্দুর ভোল্টেজকে এই গ্রাউন্ড বিন্দুর ভোল্টেজের সাপেক্ষে হিসাব করে থাকি ও সেভাবেই বলে থাকি। যদি বলি, ‘ক’ বিন্দুতে ভোল্টেজ ‘১০ ভোল্ট’, এর অর্থ হচ্ছে ‘ক’ বিন্দুর ভোল্টেজ গ্রাউন্ড বিন্দুর থেকে ১০ ভোল্ট বেশি। এ মানটি ‘-১০ ভোল্ট’ হলে বোঝা যেত যে ‘ক’ বিন্দুর ভোল্টেজ গ্রাউন্ড বিন্দুর থেকে ১০ ভোল্ট কম। এমনিভাবে ‘খ’ বিন্দুর ভোল্টেজ যেটি বলা হবে, তা-ও হবে গ্রাউন্ডের সাপেক্ষেই।
কারেন্টটিই প্রবাহিত হচ্ছে ব্যাটারির এ দ্বিতীয় সার্কিট লুপের ক ও খ বিন্দুর মধ্যে সংযোগ দেওয়া থার্মিস্টরের মধ্য দিয়ে। তাই সেটিও কনস্ট্যান্ট থাকবে।
এবার আসি কনস্ট্যান্ট কারেন্ট সোর্সের কথায়। জেনার ডায়োডটি ট্রানজিস্টরের ‘গ’ বিন্দুর ভোল্টেজকে কনস্ট্যান্ট রাখে। এর ফলে ট্রানজিস্টরের খ ও ঘ বিন্দুর মধ্য দিয় যে কারেন্ট যায় তা কনস্ট্যান্ট থাকে। আর এ কারেন্টটিই প্রবাহিত হচ্ছে ব্যাটারির এ দ্বিতীয় সার্কিট লুপের ক ও খ বিন্দুর মধ্যে সংযোগ দেওয়া থার্মিস্টরের মধ্য দিয়ে। তাই সেটিও কনস্ট্যান্ট থাকবে। কীভাবে ট্রানজিস্টর এ কাজটি করে তা পরের পর্বে আলোচনা করব। এখানে থার্মিস্টর ছাড়া বাকি অংশটুকু হচ্ছে মূল সার্কিট, আর থার্মিস্টরটি হচ্ছে তার বোঝা বা ‘লোড’। তাহলে থার্মিস্টরের দুই প্রান্তের মধ্যকার ভোল্টেজটিই হবে তার রেজিস্ট্যান্সের মানের সমানুপাতিক (আগের পর্বে বলা হয়েছে)। এ ভোল্টেজটিকে একটি ভোল্টমিটার দিয়ে মেপে নিলেই হলো।
চলবে...