সাক্ষাৎকার
'বিজ্ঞান তো আর থেমে থাকে না, এগিয়ে যায়'—দীপেন ভট্টাচার্য, সাবেক গবেষক, নাসা
দীপেন ভট্টাচার্য মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সাবেক গবেষক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোরেনো ভ্যালি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। এ ছাড়া তিনি বিজ্ঞানচিন্তার নিয়মিত লেখক। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা ছাড়াও তাঁর লেখা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গবেষণার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞান প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করছেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।
বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে এই বিজ্ঞানীর মুখোমুখি হয়েছিলেন নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার, সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ ও সম্পাদনা দলের সদস্য কাজী আকাশ। জানতে চেয়েছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা, গবেষণা, শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের গল্প। সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত ও পরিমার্জিত কিছু অংশ প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: কেমন আছেন?
দীপেন ভট্টাচার্য: শুভ অপরাহ্ণ। আমি ভালো আছি।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মোরেনো ভ্যালি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলেজে পড়ানো ও সুপারভাইজ করার ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই।
দীপেন ভট্টাচার্য: পিএইচডি শিক্ষার্থীদের আমি যখন সুপারভাইজ করেছি, তখন এখানে ছিলাম না। ছিলাম ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায়, রিভারসাইডে। আমি যে দলে কাজ করতাম, তার নাম ছিল হাই এনার্জি অ্যাস্ট্রোফিজিকস গ্রুপ। হাই এনার্জি বা উচ্চ শক্তির জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আমি গামা রশ্মি নিয়ে কাজ করেছি। এক্স–রশ্মি ও গামা রশ্মি হলো হাই এনার্জি বা উচ্চ শক্তির তরঙ্গ। কারণ, তড়িচ্চৌম্বকীয় যে বর্ণালি—ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তির ফোটন বলি বা তরঙ্গ—এক্স-রশ্মি ও গামা রশ্মির শক্তিই সবচেয়ে বেশি। এটা একধরনের শক্তিশালী তড়িচ্চৌম্বক বিকিরণ। তীব্র বিস্ফোরণ হয় এ সময়। অর্থাৎ শক্তি সৃষ্টি হওয়ার একধরনের শক্তিশালী প্রক্রিয়া বলা যায়। কিংবা ধরুন, চারদিক থেকে বিভিন্ন বস্তু যখন অ্যাক্রেশন ডিস্ক ধরে ঘুরতে ঘুরতে ব্ল্যাকহোলে (কৃষ্ণগহ্বর) গিয়ে পড়ে, তখন গামা রশ্মির বিকিরণ হয়। অথবা ধরুন নিউট্রন স্টার—খুব উচ্চ শক্তির ইলেকট্রন বা প্রোটন যখন এর ওপরের চুম্বক ক্ষেত্রে আটকা পড়ে, তখন ওটা গামা রশ্মি বিকিরণ করে। এ রকম নানা ধরনের প্রক্রিয়া আছে। যাহোক, গামা রশ্মি নিয়ে আমি তখন গবেষণা করতাম।
আমার তখন অনেক শিক্ষার্থী ছিল। তখন একটি স্যাটেলাইট (কৃত্রিম উপগ্রহ) ছিল। নাম ছিল কম্পটন গামা রে অবজারভেটরি (বাংলায় বলা যায়, নভোমানমন্দির)। হাবল নভোদুরবিন যেমন দৃশ্যমান ও আলট্রাভায়োলেটে (অতিবেগুনি রশ্মি) কাজ করে, তেমনি কম্পটন কাজ করত গামা রশ্মি নিয়ে। এটার তথ্য ব্যবহার করেই মূলত আমরা কাজ করেছি। আরেকটা কাজ ছিল, যা গামা রশ্মির কাজের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত—আমাদের গ্যালাক্সিতে যেসব নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয়েছে, সুপারনোভা, তার যে অবশিষ্টাংশ থাকে, সেগুলো কীভাবে আমাদের গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে আছে, সেটাকে একটা সমীকরণ দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রকাশ করা।
এটা নিয়ে একটু যদি খুলে বলি—এই সমীকরণের সঙ্গে গামা রশ্মির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মনে করি, যখন একটি বড় তারা তার জীবন শেষে বিস্ফোরিত হয়, তখন সেই তারা থেকে অনেক কসমিক রে (মহাজাগতিক রশ্মি) বের হয়। মহাজাগতিক রশ্মি মানে, উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন, প্রোটন কিংবা যেকোনো নিউক্লিয়াস হতে পারে। আয়রন বা লোহা, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন—এগুলোর নিউক্লিয়াস। এগুলো খুব দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের পৃথিবীতেও আসে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও চুম্বকক্ষেত্র এ সময় কিছুটা ঢাল হিসেবে কাজ করে, যাতে এগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠে না আসে। এই মহাজাগতিক কণারা ছড়িয়ে যায় আমাদের গ্যালাক্সির তলে। এই কণারা গ্যালাক্সির চুম্বকীয় বলরেখা অনুসরণ করে আসে। আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যে চুম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড ছড়ানো আছে। এই ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বিভিন্নভাবে। এটাও একটা বড় গবেষণার বিষয়। এটা হতে পারে প্লাজমা। প্লাজমা মানে, ইলেকট্রন বা আয়নিত কোনো পদার্থ হতে পারে। সেগুলোর মধ্যে ম্যাগনেটিক ফিল্ডগুলো আটকা পড়ে। আমরা যখন আমাদের গ্যালাক্সির মানচিত্র দেখি, তখন দেখব এই সর্পিল বাহুগুলো আছে। এগুলো চুম্বকক্ষেত্রগুলোকে অনুসরণ করে। যখন বিস্ফোরণ হয় সুপারনোভা, সেই উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণাগুলো তখন এসব ক্ষেত্র (বা ক্ষেত্ররেখা) অনুসরণ করতে করতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমাদের গ্রহেও আসে। আবার এইসব কণাই গ্যালাক্সির বাহুতে গামা রশ্মি সৃষ্টি করে।
ধারণা করা হচ্ছে, সুপারনোভার এই অবশেষগুলো থেকেই শুরু হয়েছে মহাজাগতিক রশ্মির এবং এখনো এগুলো থেকে কিছু মহাজাগতিক রশ্মি বের হচ্ছে। এখন আমরা যদি সুপারনোভার অবশেষের একটি মানচিত্র তৈরি করতে পারি, তাহলে আমাদের গ্যালাক্সিতে যে গামা রশ্মি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তার মানচিত্র তৈরিতে এটা সহায়তা করতে পারে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিতে সুপারনোভার বিতরণ ব্যবস্থা থেকে গামা রশ্মির মানচিত্র তৈরি করা। সুপারনোভার এ রকম একটি প্রকল্প আমাদের ছিল। আমি ও আমার আরেক গ্র্যাজুয়েট ছাত্র মিলে করেছিলাম। অনেক আগের কাজ। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে করেছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের এই কাজ এখনো রেফার করা হয়। এমন না যে আমি সুপারনোভা রেমন্যান্টের বিশেষজ্ঞ। আমার চেয়ে অনেক বড় বিশেষজ্ঞ আছেন এ বিষয়ে। কিন্তু আমরা একটা সমীকরণ দিয়েছিলাম। স্বীকার করতেই হবে, এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। তারপরও এটা মানুষ ব্যবহার করে। কারণ, সমীকরণটি খুব সহজ। এ বছরও অনেক অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালের পেপারে আমাদের কাজটি রেফার করা হয়েছে। এই সমীকরণ দিয়ে বোঝা যায়, গ্যালাক্সির কোন বাহুতে কী পরিমাণ সুপারনোভা রেমন্যান্ট (অবশেষ) আছে। এমনকি ভয়েজারের ডেটা থেকে আমাদের গ্যালাক্সির মহাজাগতিক রশ্মির যে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানেও আমাদের এই সমীকরণ ব্যবহার করেছিল। এখন জিজ্ঞেস করলে আমি অবশ্য বলি, এটা থেকে আমি অনেক দূরে চলে এসেছি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আমি দেখলাম, এটার একটা জীবন আছে। এটা বেঁচে আছে এখনো।
এখন আমার কিছু ব্যর্থতার কথা বলি। যেমন ইগ্রেট (এনার্জিটিক গামা রে এক্সপেরিমেন্ট টেলিস্কোপ) নামে গামা রে অবজারভেটরিতে একটি ডিটেক্টর ছিল। এ রকম মোট চারটি ডিটেক্টর ছিল—ইগ্রেট, অসি, কম্পটন ও ব্যাটসি। এর মধ্যে আমি তিনটির ওপরে কাজ করেছি। ইগ্রেটের তথ্য থেকে কিছু সুপারনোভার অবশেষ বিশ্লেষণ করেছি আমরা। আর কিছু গামা রশ্মি ছিল, যেগুলো কোথা থেকে আসছে, তা বোঝা যায়নি। মানে সেগুলো পালসার থেকে নাকি সুপারনোভা থেকে আসছে, নাকি অন্য কিছু, তা বোঝা যায়নি। আমরা ধারণা করেছিলাম, এটা হয়তো পালসার কিংবা আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে থেকে আসতে পারে। মানে, এগুলোর উৎস তখনো ছিল অজ্ঞাত। পরে দেখা গেছে, এটা পালসার থেকে এসেছে। আমরা অবশ্য বলেছিলাম, এটা পালসার নয়। কিন্তু বিজ্ঞান তো আর থেমে থাকে না, এগিয়ে যায়। তাই পরে বিষয়টি বোঝা গেছে। পরে ফার্মি নামে আরেকটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়। এটা এখনো আছে। এ থেকে দেখা গেছে, আমাদের আইডিয়া ঠিক ছিল না।
যাই হোক, পরে আরও কিছু শিক্ষার্থী আমাদের এসব কাজের ওপরে পিএইচডি করেছে। আমি এগুলোর খুঁটিনাটি বর্ণনায় এখন যেতে চাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলি, এগুলো ছিল মূলত এক্সপেরিমেন্টাল বা পরীক্ষণনির্ভর কাজ—নতুন ধরনের গামা দুরবিনের ওপর।
গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ নিয়ে কিছু বলি। মহাশূন্য থেকে আসা গামা রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়। আমরা যদি একটি ডিটেক্টর তৈরি করে সেটি একটি বেলুনে করে ৪০ কিলোমিটার ওপরে উঠিয়ে নিই, তাহলে গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ সম্ভব। কারণ, এটা বায়ুমণ্ডলের ওপরে। কিন্তু আমার ডিটেকটর ঠিক কী দেখছে, তার জন্য অনেক কিছু করতে হয়—যেমন মন্টিকার্লো সিমুলেশন। হয়তো এক লাখ গামা রশ্মি ডিটেক্টরের ওপর পড়ছে, কিন্তু আমার ডিটেক্টর দেখেছে মাত্র ১০টি গামা রশ্মি। তখন আমাকে মডেলে এটা বসিয়ে বলতে হবে, এখানে ১০টি মানে আসলে ১ লাখ। কারণ, এটার একটা এফিশিয়েন্সি (কার্যদক্ষতা) থাকে। অর্থাৎ ডিটেক্টরে ১ লাখ গামা রশ্মি পড়লে আমি হয়তো ১০টি শনাক্ত করতে পারব—এই হলো বিষয়। যা–ই করি, সে জন্য সিমুলেশন করতে হবে। আর এটা করতে অনেক সময় লাগে। এখনকার সব পর্যবেক্ষণ আসলে তা–ই। যতটা সময় নিয়ে আপনি পর্যবেক্ষণ করবেন, তার চেয়ে বেশি সময় দিতে হবে সিমুলেশন তৈরির পেছনে।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: এরকম ইন্টারেস্টিং কাজ তো আপনি আরও করেছেন।
দীপেন ভট্টাচার্য: হ্যাঁ। যেমন এর আগে আমি নাসায় ছিলাম তিন থেকে চার বছর। তখন আমি গামা রে অবজারভেটরিতে কাজ করেছি। আমার সে সময়কার একটি কাজ হলো, অসি নামের একটি ডিটেক্টর দিয়ে কিছু গ্যালাক্সি থেকে আমরা প্রথম গামা রশ্মি পাই। এনজিসি ২৫৩ নামে একটা গ্যালাক্সি আছে, সেটা থেকেও কিছু গামা রশ্মি পেয়েছিলাম। একবারই সেই গামা রশ্মি পাওয়া গেছে। আর কেউ কোনো দিন গামা রশ্মি পায়নি। এটা একটা বিষয়। মানে, এটা হয়তো একবারই ঠিকভাবে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছিলাম, নয়তো আমাদের ভুল ছিল। এটার ডিটেকশন ছিল ৫ সিগমার ওপরে।
১ সিগমা মানে, এটা আসলে ভুলের পরিমাণ। ধরুন, ১০০ মানুষকে আপনি গণনা করেছেন। এর বর্গমূল ১০। তার মানে ১ সিগমা মানে ১০। গামা রশ্মি বা কণাপদার্থবিজ্ঞানে, আপনি যে ব্যাকগ্রাউন্ডের তুলনায় হিসাবটা করছেন, ধরুন সেই ব্যাকগ্রাউন্ড হলো ১০০। আপনি ফলাফলে পেলেন ১৫০। তাহলে ১৫০-১০০ = ৫০, আর ৫০/১০ = ৫। মানে, এটা ৫ সিগমা ফলাফল। এরকম ৫ সিগমা ফলাফল পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য, মানে এটা ঠিক আছে। এর ওপরে হতে হয়, নিচে হলে হবে না। হিগস পার্টিকেলের সিগন্যাল যেমন ৫ সিগমার ওপরে ছিল।
পরে এনজিসি ২৫৩ থেকে আরও উচ্চ শক্তির রশ্মি পাওয়া গিয়েছিল। স্কেলটা একটু বোঝানো দরকার। আমরা যে আলো দেখছি, তা ধরুন ১০ ইলেকট্রন ভোল্ট। আপনি যখন ধীরে ধীরে অতিবেগুনি রশ্মিতে সরে আসবেন, তখন পাবেন ১০ ইলেকট্রন ভোল্ট। হাইড্রোজেনকে আয়নিত করতে হলে ১৩ ইলেকট্রন ভোল্ট দিতে হয়। এটাকে আপনি জুলে রূপান্তর করতে পারেন, এটা শক্তি পরিমাপের প্রচলিত আরেকটা একক। দৃশ্যমান আলো যেমন ০.১ ইলেকট্রন ভোল্ট, অতিবেগুনি রশ্মি ১০ ইলেকট্রন ভোল্ট। এভাবে ১০০ ইলেকট্রন ভোল্টে গেলে আপনি এক্স–রের কাছাকাছি যেতে পারবেন। আপনার হাড় ভাঙলে যখন এক্স–রে করা হয়, তখন আপনার দেহের মধ্য দিয়ে ১০ হাজার ইলেকট্রন ভোল্ট চলে যায়। গামা রশ্মি আসলে ৫০০ কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট। মানে হাফ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট। এখন একটা ইলেকট্রনের কথা যদি ভাবেন, তার স্থির-শক্তি হলো ৫১১ কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট। তার মানে, আপনি একটি ইলেকট্রন ও একটি পজিট্রনকে মেলালে—একটা কণা, অন্যটা প্রতিকণা—তখন আপনি দুটি গামা রশ্মি পাবেন। এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর দুটো গামা রশ্মি পাবেন, প্রতিটি ৫০০ কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট। এখন এগুলো একদম নিখাদ শক্তি। এটা আমরা আইনস্টাইনের E = mc2 অনুযায়ী পাই। আর এটা আমরা গামা রশ্মি ডিটেক্টরে সব সময়ই দেখি। কারণ, পজিট্রন তৈরি হলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রনের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই শক্তিটা বিকিরণ করে।
আমাদের গ্যালাক্সির যে তল, সেই তল এই গামা রশ্মিতে ভরা, খুব উজ্জ্বল। টেলিস্কোপ তুললেই আমরা ছায়াপথে এই উজ্জ্বলতা দেখি।
কিন্তু আপনি যখন ১০০ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের রশ্মি মাপতে যাবেন, ডিটেক্টর দিয়ে আর কোনো লাভ হবে না। ওই ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে এটা চলে যাবে। এটা একটা কণার মতো হয়ে যায় তখন। ১০০ মিলিয়নের এটাতেও হয়তো কাজ হতে পারে, ২০০ বা আরও বেশি ইলেকট্রন ভোল্টে আর কাজ হয় না। তখন আপনাকে অন্য পথে যেতে হবে।
পৃথিবীর বুকে যে ডিটেক্টর আছে, চেরেনকভ লাইট ডিটেক্টর—এ ধরনের উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে এসে তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। এ সময় এখান থেকে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড় তৈরি হয়। গামা রশ্মিটা তখন উল্টো হয়ে যায়। শক্তি থেকে ভর তৈরি হচ্ছে, কণা তৈরি হয়। এই ইলেকট্রনগুলো, মানে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়ের ইলেকট্রনগুলো আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলতে পারে।
এখানে কথাটাকে ভুল মনে হতে পারে। আসলে, আলোর গতিবেগ সবচেয়ে বেশি ভ্যাকুয়ামে। কিন্তু আয়নায় আলোর গতিবেগ হয়ে যায় সেকেন্ডে দুই লাখ কিলোমিটার। পানিতে এ গতিবেগ আরও কমে যায়। আপার অ্যাটমোস্ফিয়ারে (বায়ুমণ্ডলের একদম ওপরের স্তরে) বা বায়ুতে তার গতিবেগ অল্প কমে যায়। ৩ লাখ কিলোমিটার থেকে কমে হয়তো ২ লাখ ৯০ হাজার কিলোমিটার বা এরকম হয়। এটা আমি নিশ্চিত নই। তো, এখানে যে ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়ের ইলেকট্রন চলছে, তা এই ২ লাখ ৯০ হাজার কিলোমিটারের চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করছে। তখন তারা আলোয় পরিণত হয়—চেরেনকভ লাইট। এ আলোটা খুব কম সময় থাকে। মাত্র ১০ ন্যানোসেকেন্ড। সেটি কোন হিসাবে পৃথিবীর বুকে পড়ে, এটা বের করা খুব কঠিন কাজ। এ কাজে আমি কিছুদিন যুক্ত ছিলাম।
মানে, আপনি তো কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তো, কাজ হলো ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব বানানো। চেরেনকভ লাইট তখন এসে পড়বে এই ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবের ওপরে। এটার মূল কাজ হচ্ছে ইলেকট্রনিকসের কাজ। ১০ ন্যানোসেকেন্ড কম্পাঙ্কের সিগন্যাল ধরা। সেই সঙ্গে নির্ণয় করা যে গামা রশ্মি কোথায় এবং কীভাবে এসে পড়েছে।
আমাদের একটি প্রকল্প ছিল, এডিসন পাওয়ার প্ল্যান্ট। অনেকগুলো আয়না ছিল জমিতে। তারা একটা ওয়াটার টাওয়ারে পানি তুলে—সূর্যের আলো এসে আয়নায় পড়ত, সেটা প্রতিফলিত করে পানিকে গরম করে বিদ্যুৎ তৈরি করত। এটাকে রিনিউয়েবল এনার্জি প্রকল্প বলে। তবে এটার কার্যকারিতা অত ভালো না। ওদের একটা পাইলট প্রকল্প ছিল এটা। শত শত আয়না ছিল ওদের। গ্র্যাব পালসার থেকে গামা রশ্মি আসতে পারে। তাই রাতের বেলা কীভাবে এই সব আয়না গ্র্যাব পালসারের দিকে তাক করা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছিলাম।
গামা রশ্মি বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে এসে চেরেনকভ লাইটে পরিণত হবে, সেখান থেকে এসে এই আয়নায় পড়বে, সেখানে প্রতিফলিত হয়ে যাবে টাওয়ারে। সেখানে আমাদের ডিটেক্টর থাকবে, মানে শনাক্ত করা যাবে। এটা খুব কঠিন কাজ। আমরা রাতের পর রাত কাটিয়েছি সেখানে। এত কঠিন কাজ, আমি আর ওতে ফিরতে চাই না। অনেক ঝামেলা।
অর্থাৎ এরকম উচ্চ শক্তি নিয়ে যদি কাজ করতে চান, তাহলে পৃথিবীটাকেই ডিটেক্টর হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। এই যে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে এসে পড়ছে, সেটা।
এর চেয়েও যদি বেশি হয়, টেরা ইলেকট্রন ভোল্ট, তখন ওই কণাগুলো সরাসরি নেমে আসে। মানে, এগুলো আর তরঙ্গ থাকে না। এগুলো শনাক্ত করতে তাই পার্টিকেল ডিটেক্টর লাগে। এসব ক্ষেত্রে আপনি যদি এমন ১০টি ফোটন পান, সেটাও একটা বড় ব্যাপার। এ কাজের সঙ্গে আমি কিছুদিন যুক্ত ছিলাম। এরপর সেখান থেকে সরে আসি। তবে কাজটি মজার ছিল। রাতের বেলা আপনি একা বসে অপেক্ষায় আছেন, কখন ডিটেক্টরে কিছু ধরা পড়বে।
গামা রশ্মির মধ্যে অনেক ভাগ আছে। কোন এনার্জি রেঞ্জে কাজ করছেন, তার ওপর নির্ভর করে বিষয়টা। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটা এনার্জি রেঞ্জ নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দেয় ওই কাজ করার জন্য। যেমন সবচেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন কণা পাওয়া গেছে, যেটার শক্তি ১০১৮ ইলেকট্রন ভোল্ট। অনেকে বলছে, এটা হয়তো আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে থেকে এসেছে। মানে আমরা এখনো জানি না, কী করে এত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এটি একটি সমস্যা।
গামা রশ্মি সৃষ্টি হয় কীভাবে—আমাকে একটি উচ্চ শক্তির ইলেকট্রন তৈরি করতে হবে। এই ইলেকট্রনের গতিবেগ সেকেন্ডে মনে করেন ১ বা ২ লাখ কিলোমিটার। আলোর গতিবেগ ৩ লাখ কিলোমিটার। ইলেকট্রনটা এখানে রিলেটিভেস্টিক। আমরা যে রেডিও বিকিরণ পাই, তা আলট্রারিলেটিভিস্টিক। প্রায় আলোর বেগে চলে। আলোর গতির প্রায় ০.৯৯। কিন্তু এটা কী করে হলো? ইলেকট্রনের এত বেগ কে দিল? এটার সমাধান এখনো পুরোপুরি হয়নি। এটা একটা তাত্ত্বিক সমস্যা।
যেমন একটা সাধারণ মডেলের কথা বলি। যখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়, তখন সেখানে একটা শকওয়েভ তৈরি হয়। এটা পার্টিকেল বা কণাকে ধাক্কা দেয়। ওখানে ম্যাগনেটিক ট্র্যাপ বা চুম্বকীয় ফাঁদ (চুম্বকক্ষেত্র) থাকে। এই ফাঁদের এক পাশে ধাক্কা খেয়ে সে আবার এ পাশে ফিরে আসে। এ পাশে আবার ধাক্কা খেয়ে ওপাশে যায়। অনেকটা টেবিল টেনিসের মতো। দুই পাশে এভাবে ধাক্কা খেতে খেতে একটু একটু করে গতিবেগ বাড়তে থাকে। এভাবে বেগ বাড়তে বাড়তে ইলেকট্রনটা একসময় বেরিয়ে আসবে। তখন এর বেগ আলোর গতিবেগের কাছাকাছি চলে আসে। এটি একটি মডেল। মোটামুটি কম্পিউটার সিমুলেশনে পাওয়া যায়। কিন্তু এরকম মডেল আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। আমরা জানি, সক্রিয় গ্যালাক্সিকেন্দ্র বা কোয়েসার থেকে জেট বেরিয়ে আসে, আলোর গতির কাছাকাছি বেগে ছুটতে থাকে। কিন্তু এত বেগ সে কীভাবে পেল? আমাকে তো একটা মেকানিজম বের করতে হবে।
এরকম কিছু সমাধান নিয়ে গত ৬০–৭০ বছর ধরেই কাজ চলছে। কিন্তু ব্ল্যাকহোল বা সক্রিয় গ্যালাক্সিকেন্দ্র থেকে দুই দিকে যে জেট বের হয়, কেন হয়, এত বেগ কোত্থেকে আসে—এগুলোর সমাধান এখনো পুরোপুরি হয়নি।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: বর্তমানে আপনি কী নিয়ে গবেষণা করছেন? সে বিষয়ে আমাদের পাঠকদের জন্য একটু সহজ ভাষায় বলুন।
দীপেন ভট্টাচার্য: বর্তমানে আমি কোনো গবেষণা করছি না। প্রায় ১০ বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ে গবেষণা করেছি। বাংলাদেশের কোস্টলাইনের একজনের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে আমি এখন আর কোনো কাজ করছি না। আগামী বছর অবসর নেব ভাবছি। তবে এরপর গায়া স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করতে চাই। আমাদের গ্যালাক্সির বাহুগুলো কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা নিয়ে কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার শৈশবের কথা বলুন। আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।
দীপেন ভট্টাচার্য: আমার বাড়ি টাঙ্গাইল। বেড়ে উঠেছি ঢাকায়। আমার প্রথম স্কুল সেগুনবাগিচার আইডিয়াল স্কুল। ক্লাস থ্রিতে আমাকে ভর্তি করানো হয়েছিল। আমি মূল শিক্ষা পেয়েছি আমার এক মামা ও কাকার কাছে। তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন। (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা) শ্রীকান্ত উপন্যাসের নতুনদার মতো করে তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি বাসায় জানালাম যে আর স্কুলে যেতে চাই না। বাসা থেকে বলল, ঠিক আছে যেও না। এরপর বাংলাবাজারের কিশোরী লাল জুবিলী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হই। পঞ্চম শ্রেণিতে আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হই। এসএসসি পরীক্ষা সেখান থেকে দিয়েছি।
১৯৭১ সালের আগে ও পরে আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ বা ৭৩ সাল থেকে আমি আকাশ দেখা শুরু করেছি। তখন হয়তো নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়ি। ঢাকার আকাশ তখন খুব পরিষ্কার ছিল। আমি তখন কয়েকটি বই পড়েছিলাম। একটির নাম জ্যোতির্বিদ্যার খোশখবর (ইয়াকভ পেরেলমানের লেখা)। রুশ বই। খুব ভালো বই। আব্দুল জব্বারের তারা পরিচিতিসহ আরও কয়েকটি বই ছিল। সেই সময় অনুসন্ধিৎসু চক্র নামে আমরা একটি বিজ্ঞান ক্লাব করেছিলাম, সেই ক্লাবটির পক্ষ থেকেই ১৯৭৬ সালে আমরা প্রথম বিজ্ঞান মেলা করি তখনকার বিজ্ঞান যাদুঘরে । কয়েকটি ভালো প্রজেক্ট ছিল। প্ল্যানেটারিয়াম–জাতীয় একটি প্রকল্প আমি তখন করেছিলাম। স্লাইড করে দেখিয়েছিলাম।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: এর পরেই কি আপনি পড়াশোনার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান?
দীপেন ভট্টাচার্য: হ্যাঁ, ১৯৭৭ সালে আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যাই। বাংলাদেশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বা এমন কিছু একটায় ইন্টারভিউ দিয়ে স্কলারশিপ পেয়ে চলে যাই। জিওলজি পড়তে গিয়েছিলাম। এরপর ওটাকে পরিবর্তন করার সুযোগ এলে আমি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যাই। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম। ক্রিমিয়ায়, এখন যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন মানমন্দিরে প্র্যাকটিক্যাল করেছি। অনেক জায়গায় অবশ্য যেতে পারতাম না। সে সময় আমাদের কিছু ভালো শিক্ষক ছিলেন। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি জ্যোতির্বিদ্যার ইনস্টিটিউট ছিল—স্তের্নবার্গ ইনস্টিটিউট, সেখানে আমাদের অনেক ক্লাস হতো। সেখানে তখন ইয়াকভ জেলদোভিচ পড়াতেন। হকিং তার বিখ্যাত রেডিয়েশনের আইডিয়ার আগে ওরকম একটা আইডিয়া ছিল জেলদোভিচের। কোনো বস্তু খুব দ্রুত ঘুরলে সে বিকিরণ করতে করতে ছোট হবে। কিপ থর্নের একটি বইয়ে ওনার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। থর্নের বইটির নাম ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড টাইম ওয়ার্পস। কীভাবে পারমাণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা বানানো হলো ও কারা কারা যুক্ত ছিলেন, তাও খুব ভালোভাবে বইটিতে লেখা আছে। জেলদোভিচও মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে ওই কাজে যুক্ত ছিলেন।
ভিতালি গিনজবার্গও ছিলেন তখন। সুপারকন্ডাকটিভিটি থিওরির জন্য পরে নোবেল পেয়েছিলেন তিনি। উনি কসমিক রে পড়াতেন। ছিলেন ভ্লাদিমির ব্রাগিনস্কি, রেডিওফিজিকস পড়াতেন। উনি মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ ডিটেকশনের জন্য বিশাল অবদান রেখেছিলেন, পরে লাইগো (LIGO) টিমেরও সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে তাঁরা যে বিশাল সব বিজ্ঞানী, সে সম্বন্ধে আমাদের খুব একটা ধারণা ছিল না। ১৯৮১ বা ৮২ সালে স্টিফেন হকিং আমাদের ইনস্টিটিউশনে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম। কৃষ্ণগহবরের বিকিরণ-সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তখন অত ভালো বুঝতাম না। জেলদোভিচ ওনার উপস্থাপনা করেছিলেন। এরপর চন্দ্রশেখর এসেছিলেন। আমার মনে আছে, চন্দশেখরকে একটি প্রশ্ন করে কিছুটা তর্কের ব্যাপার তৈরি করছিলেন জেলদোভিচ। কিন্তু চন্দ্রশেখর সেটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এটাই অবশ্য তখন বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।
এরপর আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে আসি। এটা ১৯৮৩ সালের কথা। মস্কোতে বসেই ভিসা পেয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: এর মাঝে আর দেশে ফেরেননি?
দীপেন ভট্টাচার্য: একবার সাত–আট মাস দেশে ছিলাম। সে পর্যায়ে বেশি দিনের জন্য দেশে ফেরা হয়নি। ছুটিতে আসতাম। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে এক বছরের জন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলাম।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: নিউ হ্যাম্পশায়ারে যাওয়ার পরে কী করলেন?
দীপেন ভট্টাচার্য: মস্কোতে সেইফার্ট (Seyfert) গ্যালাক্সি নিয়ে কাজ করেছি। এগুলো কোয়েজারের মতোই হাই এনার্জি গ্যালাক্সি, তবে অত শক্তিশালী নয়। কাজটা ছিল, সেইফার্ট গ্যালাক্সির কেন্দ্রের উচ্চ শক্তির নিউক্লয়াস (এখন আমরা জানি সেগুলো অনেক ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর) কী করে আশপাশের গ্যাসকে আয়নিত করে, তা নিয়ে। নিউ হ্যাম্পশায়ারে এসে আমি গামা রশ্মি গ্রুপে যুক্ত হই। আমার পিএইচডি থিসিস ছিল মহাশূন্য থেকে একধরনের ছড়ানো গামারশ্মি পাওয়া যায়, তার ওপরে। এজন্য আমাকে ক্র্যাব নেবুলা বা কাঁকড়া নিহারীকা পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছিল। এই নিহারীকা একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ, সুপারনোভাটিকে প্রায় এক হাজার বছর আগে চীনা জ্যোতির্বিদরা দেখেছিলেন। নিহারীকাটির মধ্যে একটি পালসারও আছে। গামা জ্যোতির্বিদরা এই পালসার ও নিহারীকা থেকে আসা বিকিরণ দিয়ে তাদের দুরবিন ক্যালিব্রেট করেন।
এরপরে আমি নাসায় যোগ দিই, সেই সম্বন্ধে তো আগেই বলেছি। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় যোগ দিই। সেখানে আমরা এক নতুন ধরনের গামা রশ্মি দুরবিন তৈরি করি, সেটা কয়েকবার নাসার বেলুনে চড়িয়ে বায়ুমণ্ডলের ওপরে পাঠানো হয়। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সঙ্গে একটি খুব উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি নিয়ে সান্ডিয়া ন্যাশানাল ল্যাবেও কাজ করি। বেশ পরে এই কলেজে (মোরেনো ভ্যালি কলেজে) পড়ানো শুরু। এটা শুধুই পড়ানো, কোনো গবেষণা নয়। স্লোন ডিজিটাল স্কাই সার্ভে নিয়ে কিছুদিন কাজ করেছি। তাদের একটি বিরাট ডেটা সেট আছে। গ্যালাক্সিগুলো কীভাবে ক্লাস্টারে পুঞ্জিভূত হয়, সেটা নিয়ে। আর এখন তো গল্প লিখতে অনেক সময় যায়।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। যদিও এখনো অনেক গল্প শোনা বাকি রয়ে গেছে, তবু আপাতত এখানে একটু বিরতি দিই। অনেক অজানা বিষয় জানা হলো এ আলোচনায়। ধন্যবাদ।
দীপেন ভট্টাচার্য: আপনাদেরও ধন্যবাদ। কথা বলে আমারও ভালো লেগেছে।