রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার—পৃথিবী
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
মানুষের পক্ষে পৃথিবী থেকে শত শত কিলোমিটার ওপরে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তারা চাঁদে গেছে, মঙ্গল এবং শুক্র গ্রহে পাঠিয়েছে স্বয়ংক্রিয় স্টেশন। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি হয়তো প্রধান রহস্যটি রয়েছে আমাদের পায়ের তলায়—ভূগর্ভে। অথচ ভূগর্ভের গভীরে প্রবেশ করা এখনও সম্ভব হয়নি। কেবল কয়েকটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ভেতরে ১৩ কিলোমিটারের বেশি দৃষ্টিপাত করা গেছে। কিন্তু আরও গভীরে কী হচ্ছে? আর একেবারে কেন্দ্রস্থলে?
পৃথিবী হচ্ছে শক্ত খোসাযুক্ত বাদামের মতো। তার ভেতরে আছে উত্তপ্ত নিউক্লিয়াস। ওখানে তাপমাত্রা ব্লাস্ট-ফার্নেসের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। আর তার মানে সব পদার্থও গলে আছে। ভূপৃষ্ঠের দিকে যত কাছে পৌঁছানো যায়, তাপমাত্রা ততই কম। তবে ২০ কিলোমিটার গভীরেও সে তাপমাত্রা অতি উচ্চই থেকে যায়—৬০০ ডিগ্রি। গলে যাওয়া পদার্থসমূহ বিপুল শক্তিতে ‘খোসার’ গায়ে চাপ দেয়, যেন তা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে চায়, এবং ফাটল দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। পথিমধ্যে যদি পানি থাকে তা মুহূর্তের মধ্যে ফুটে উঠে, পরিণত হয় বাষ্পে এবং মাটির তলা থেকে বেগে বইতে শুরু করে উষ্ণ প্রস্রবণ।
পানি গরম করতে ও ফোটাতে লোকে প্রচুর মূল্যবান জ্বালানি খরচ করে। আর এখানে জ্বালানি খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই—উষ্ণ প্রস্রবণগুলোতে কেবল পাইপ বসিয়ে দিলেই হলো, পানি সরাসরি শহরে ও গ্রামে গিয়ে পৌঁছবে। অনেক জায়গায় ঠিক তা-ই করা হচ্ছে।
তাছাড়া ভূগর্ভস্থ বাষ্প এবং গরম পানি সরবরাহ করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে। পাইপ দিয়ে বাষ্প যায় টার্বাইনে এবং তা টার্বাইনগুলোকে ঘুরায়, আর ইলেকট্রিক জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সাধারণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যা হয়, ব্যাপারটা প্রায় তারই মতো। তবে এই স্টেশনগুলোতে স্টিম বয়লারের প্রয়োজন নেই। তা আছে মাটির তলায়। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নাম হচ্ছে জিওথার্মাল স্টেশন বা ভূ-তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়া) প্রথম জিওথার্মাল স্টেশন নির্মিত হয় কামচাৎকায়। ১৯৬৬ সালে তা বিদ্যুৎ ও তাপ দেয় জেলেদের শহর ওজিওরনায়াকে। তাপ সরবরাহ করা হয় ঘরবাড়ি আর হট-হাউসগুলোতে, শহরের বাসিন্দারা প্রায় সারা বছর খায় পেঁয়াজ পাতা, পার্সলে আর শসা।
এ ধরনের স্টেশন অন্যান্য দেশেও নির্মিত হচ্ছে। আর ফ্রান্সের প্যারিসের কাছে গরম পানির একটি হ্রদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এবার বিজ্ঞানীরা ভাবছেন সে পানি কোথায় সরবরাহ করলে সবচেয়ে ভালো হয়—প্যারিসবাসীদের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কিংবা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে।
ভূগর্ভস্থ বয়লার ব্যবহার করার জন্য উষ্ণ প্রস্রবণ বা হ্রদ খুঁজে বের করা মোটেই জরুরী নয়। ইঞ্জিনিয়ররা নিজ হাতে তা গড়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন।
মাটিতে দুটি ছিদ্র কূপ খনন করা হয় এবং ভূপৃষ্ঠে থেকে অনেক গভীরে ওগুলোকে ভূগর্ভস্থ খাল দিয়ে যুক্ত করা হয়। একটি ছিদ্র কূপ দিয়ে ঠান্ডা পানি ছাড়া হয় উত্তপ্ত শুরগুলোতে, আর অন্যটি দিয়ে গরম পানি ও বাষ্প ওপরে উঠতে থাকে। ভূগর্ভস্থ তাপ আছে সর্বত্র, ভূপৃষ্ঠের যেকোনো বিন্দুর তলায়। তা আছে মস্কোর তলায়, সাহারায়, তুন্দ্রাঞ্চলে। আর সবাই জানে যে তুন্দ্রায় ‘বছরের বারো মাস শীত, বাকি সময়—গ্রীষ্মকাল’, এবং ওখানেই ভূ-তাপের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তবে এ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ নিউক্লিয়াসে নিহিত শক্তির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশমাত্র। যদি সেই নিউক্লিয়াসের নাগাল পাওয়া যেত, তাহলে লোকে বহু হাজার বছর নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারত।
তবে এ কাজটি করা মহাকাশে যাওয়ার চেয়ে অনেক গুণ কঠিন। এখন ভূগর্ভে ‘দৃষ্টিপাত করা’ যায় কেবল ছিদ্র কূপের সাহায্যে। ছিদ্র খনন করা হয় বিশাল বিশাল ড্রিল দিয়ে—বোরিং মেশিন দিয়ে। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যান্ত্রিক দন্তযুক্ত—তুরপুনযুক্ত—ইস্পাতের পাইপ ধীরে ধীরে ঘুরতে ঘুরতে মিটারের পর মিটার ক্রমশই নিচের দিকে নামতে থাকে। তবে অধিক গভীরতায় পাইপের লম্বা স্তম্ভ নিজের ভারেই ভেঙে যায়। ভূগর্ভে সত্যিকার ভ্রমণের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কোনো কিছু উদ্ভাবন করা দরকার। হয়তো বিশেষ জাহাজ—ভূগর্ভযান।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ভূগর্ভযান নির্মাণ করা হয়েছে কীভাবে জ্যান্ত ছুঁচো কাজ করে তা দেখে। ছুঁচো তার ধারাল দাঁত দিয়ে মাটি কেটে তুলে এবং পরে মাথা ঘুরিয়ে তা দুরমুশ করে দ্রুত সামনের দিকে এগোতে থাকে।
যান্ত্রিক ‘ছুচো’ সজ্জিত হয় শক্ত ধাতব দাঁত, ঘূর্ণ্যমান মজবুত ‘গলা’ আর বায়ুদের ইঞ্জিন দিয়ে। পরীক্ষার সময় তা প্রবেশ করে খুব গভীরে—সাত কিলোমিটার গভীরে।
তাই এটা খুবই সম্ভব যে একদিন কল্পকাহিনীতে নয়, সংবাদপত্রে আমরা ভূগর্ভযানে করে পথিবীর কেন্দ্রাভিমুখে পরিচালিত অভিযানের খবর পড়তে পারব।