প্রতিপদার্থ ও বিজ্ঞানী পল ডিরাক

আজ ৮ আগস্ট পল ডিরাকের জন্মদিন। ভারতের সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকসের অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক পুরুষোত্তম চক্রবর্তীর লেখায় জানুন পল ডিরাক সম্পর্কে। কীভাবে তিনি বদলে দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের গতিপথ...

আদ্রিয়েন মরিস পল ডিরাককে বলা চলে সর্বকালের সেরা তাত্ত্বিক-পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম। সংক্ষেপে তাঁকে বলা হয় পল ডিরাক। তাঁর উদ্ভাবিত ‘রিলেটিভিস্টিক ওয়েভ ইকুয়েশন’ বা ‘আপেক্ষিক তরঙ্গ সমীকরণ’কে সংক্ষেপে ‘ডিরাক সমীকরণ’ নামে পরিচিত। এটি পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যাজাত (Relativistic Quantum Mechanics) একটি তরঙ্গ-সমীকরণ। এই ডিরাক সমীকরণ শুধু ফার্মিয়নদের (ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন… ইত্যাদি বস্তুকণা)  গতিপ্রকৃতি বা আচরণই ব্যাখ্যা করে না, এর হাত ধরেই সর্বপ্রথম প্রতিপদার্থের (Antimatter) পূর্বাভাস পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় এর আধুনিক তত্ত্ব।

ডিরাক বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর প্রণীত তরঙ্গ সমীকরণ ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে, তা প্রতিইলেকট্রনের অস্তিত্বের সম্ভাব্যতাকে জোরদার করে। এই কাজের জন্য তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে আরউইন শ্রোডিঙ্গারের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

ডিরাকের প্রতিইলেকট্রন কণার অনুমান বাস্তবায়িত হয় ১৯৩২ সালে। কার্ল ডি অ্যান্ডারসন তাঁর ক্লাউড চেম্বার এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে শনাক্ত করেন এক নতুন কণা। (ক্লাউড চেম্বার মানে, কাচের তৈরি বাষ্পে ভর্তি বিশেষ কক্ষ। মূলত আয়নিত বিকিরণের মধ্যে কী ধরনের কণা আছে, তা শনাক্ত করতে ব্যবহৃত বিশেষ কণা শনাক্তকারক বা পার্টিকেল ডিটেকটর।) যাহোক, এই নতুন কণার বৈদ্যুতিক আধান ছিল ধনাত্মক। আর এর পরিমাণ হুবহু ইলেকট্রনের ঋণাত্মক আধানের সমান। এই কণার ঘূর্ণন বা স্পিন ১/২ এবং ভর ইলেকট্রনের ভরের সমান। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে এই নতুন কণাটির একমাত্র বিপরীত বৈদ্যুতিক আধান ছাড়া আর সব ইলেকট্রনের ধর্ম বা আচরণের মতো। এই মৌলিক কণাটি পজিট্রন নামে নামাঙ্কিত হয়, যা মূলত প্রতিইলেকট্রন (Antielectron)। 

পল ডিরাক

একটি কম শক্তির পজিট্রনের সঙ্গে একটি কম শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রনের সংঘর্ষের ফলে কণাদুটির সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটে। এ সময় এদের সম্মিলিত ভরের সমপরিমাণ শক্তি গামারশ্মির ফোটন কণার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ফোটন হলো আলোর ক্ষুদ্রতম একক, একটি ভরহীন কণা। আলোর শক্তি এই কণাগুচ্ছের মধ্যে নিহীত। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো তড়িৎচুম্বকীয় বলের (Electromagnetic Force) ক্যারিয়ার বা বাহক এই ফোটন। শূন্যস্থানে আলোর গতিবেগের সমান বেগে ধাবিত হয় এটি। আমরা জানি, এই বেগ প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। 

অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা অনেক প্রচেষ্টার পর অ্যান্টিহিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল প্রতিকণা। কিছু নির্দিষ্ট ধর্ম, যেমন আধান বা চার্জ, ঘূর্ণন বা স্পিন কিংবা অন্যান্য কোয়ান্টাম প্যারামিটার ইত্যাদি ছাড়া কণা ও তার প্রতিকণার সব ধর্ম একই হয়। তাই কণা ও তার প্রতিকণার ভর এবং আয়ুস্কাল বা স্থায়িত্বও এক হতে হবে। 

নিচের ছবিতে ডিরাকের ‘ক্লাউড-চেম্বার এক্সপেরিমেন্ট’-এর মাধ্যমে একটি পজিট্রনের পথরেখা দেখা যাচ্ছে, যে পথরেখার বক্রতা স্বভাবতই ইলেকট্রনের পথরেখার বক্রতার ঠিক বিপরীত। স্কটল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী চার্লস থম্পসন উইলসন এ ক্লাউডচেম্বার উদ্ভাবন করেন। আগে যেমন বলেছি, এটি মূলত একটি কাচের আবদ্ধ কক্ষ বা প্রকোষ্ঠ (Sealed Chamber)। অতিপৃক্ত বা সুপার স্যাচুরেটেড জলীয়বাষ্প দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। শক্তিশালী আলফা কণা দিয়ে এ কক্ষের ভেতরের বাস্পকণার অণু-পরমাণুদের আয়নীভূত করা হয়। এসব গতিশীল আয়নের নিজেদের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হতে পারে নতুন কোনো বিচ্ছুরিত মৌল-কণা বা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেল, যার গতিপথের রেখা (Track) দৃশ্যমান হবে কাচের প্রকোষ্ঠের বাইরে থেকে।

ক্লাউড-চেম্বার এক্সপেরিমেন্টে একটি পজিট্রনের পথরেখা দেখা যাচ্ছে

এবারে ডিরাকের কথা বলি। ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল ডিরাকের জন্ম ১৯০২ সালের ৮ আগষ্ট। কোয়ান্টাম মেকানিকস ও কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনেমিকসের সূচনা ও উন্নয়নে মৌলিক অবদানের জন্য তিনি বিশ্ববরেণ্য। পদার্থবিজ্ঞানে ডিরাকের গাণিতিক সমীকরণ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি আসলে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মেলবন্ধন। এই সমীকরণ থেকেই অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়। আর এ কাজের জন্য ডিরাককে বলা হয় ‘ফাদার অব ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস’।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লুকাসিয়ান চেয়ার-প্রফেসর অব ম্যাথমেটিকস’ হিসেবে নিযুক্ত হন। এই দুর্লভ সম্মান ডিরাকের আগে পেয়েছিলেন একমাত্র স্যার আইজাক নিউটন। পল ডিরাক ১৯২৩ সালে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণির কলাবিদ্যায় স্নাতক লাভ করেন। জীবনের শেষ ১৪ বছর অধ্যাপনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস তাঁর স্মরণে প্রবর্তন করে ‘ডিরাক পদক’। ১৯২৬ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যার রালফ হাওয়ার্ড ফাউলারের অধীনে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য পিএইচডি ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, যার নামে নামাঙ্কিত ভারতবর্ষের মুম্বাইতে অবস্থিত ‘ভাবা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র’। অ্যাটমিক রিয়েকটর নির্মাণ ও পারমাণবিক শক্তি গবেষণায় এ প্রতিষ্ঠানের স্থান বিশ্বে অগ্রগন্য।

ডিরাকের সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সীমা আসে নভেম্বর ১৯৩৩-এ। তিনি জানতে পারলেন, সে বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তিনি। নোবেল প্রাপ্তির খবরে যেকোনো প্রাপকই যে যারপরনাই উচ্ছসিত ও আনন্দিত হবেন, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু ডিরাকের ক্ষেত্রে এরকমটি হলো না। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। ডিরাক ঠিক করলেন, এই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন। কারণ, নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রচারের বিপুল আলো তাঁর গায়ে আছড়ে পড়বে, তা আগে থেকে অনুমান করে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন তিনি। বুঝতে পারেন, সেই ঝক্কি তিনি সামলাতে পারবেন না।

ব্রিটিশ পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ডিরাককে বোঝালেন, ‘এটা তোমার করা ঠিক হবে না; কারণ নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে আরও বহুগুণ বেশি প্রচারের ধাক্কা সামলাতে হবে তোমাকে।’ এ কথা শুনে ডিরাক অনিচ্ছাভরে একরকম বাধ্য হয়েই নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে সময় লন্ডন নিউজ পেপার ‘সানডে ডিসপ্যাচ’-এ ডিরাক সম্পর্কে লেখা হয়, ‘একত্রিশ বছর বয়সী এই কেমব্রিজ প্রফেসর গজলা হরিণের মতন লাজুক এবং ভিক্টোরিয়ান পরিচারিকার মতন বিনয়ী ও নম্র।’     

একদিকে যেমন অসম্ভব কম কথা বলতেন, অন্যদিকে ছিলেন প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, লাজুক এবং খানিকটা ভীতু প্রকৃতির। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটতেন, একদম রাস্তার ধার ঘেঁষে বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটতেন। যাতে কারো সঙ্গে কথা বলতে না হয়। এতই কম কথা বলতেন যে তাঁর কেমব্রিজের সহযোগী বন্ধুরা পরিহাস করে ‘ডিরাক’ নামের একটি একক চালু করেছিলেন। ১ ডিরাক মানে, এক ঘন্টায় একটি শব্দ বলা।   

ডিরাকের জীবনীকাররা ডিরাকের বেড়ে ওঠা ও তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে পারিবারিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ডিরাকের বেশ কয়েকজন আত্মীয়পরিজন গভীর ডিপ্রেশনের শিকার হয়েছিলেন। একুশ বছরে তাঁদের পরিবারের ছজন আত্মহনন করেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ডিরাকের অগ্রজ ভ্রাতাও। ডিরাকের মা ছিলেন ব্রিটিশ আর বাবা ফ্রেঞ্চভাষী সুইশ। বন্ধুরা ডিরাককে মানসিকভাবে অস্বাভাবিক মনে করতেন। তাঁর চরিত্রে পাণ্ডিত্যের গভীরতা ও মানসিক উন্মাদনার এক অদ্ভূত মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হতো।

অগ্রজভ্রাতা ছাড়াও ডিরাকের অনুজ এক বোন ছিলেন। পরিবারের বাকি সদস্যদের মতন ডিরাকের ছেলেবেলাও সুখের ছিল না। যার একমাত্র কারণ ডিরাকের বাবা, যিনি ছিলেন অসম্ভব একগুঁয়ে, জেদী ও রাগী। বাড়িতে সবার কাছে তিনি ছিলেন এক আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। তিনি যা মনে করতেন, সেটিই ছিল পরিবারের শেষ কথা। তিনি স্কুলে ফ্রেঞ্চ পড়াতেন। সেখানেও মেনে চলতে হতো কঠোর অনুশাসন, যা অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। পরবর্তী সময়ে ডিরাক ছোটবেলায় বাবার কর্তৃত্ব ও নিদারুণ যন্ত্রণা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন একাধিক সময়।

ডিরাকের মা, ভাই ও বোনকে রান্নাঘরে ডিনার করতে হতো। টেবিলে খেতে বসতেন শুধু ডিরাক ও তাঁর বাবা। ডিরাককে খেতে বাধ্য করতেন বাবা। সে সময় ডিরাককে নির্ভুল ভাবে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে হতো। উচ্চারণ বা ব্যাকরণের সামান্য ভুল হলেই পীড়নের মাত্রা বাড়ত। অসুস্থতা বোধ করছেন বলে ডিরাক ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে যেতে চাইলেও যেতে দিতেন না বাবা। এসব নানা কারণে ডিরাকের হজমশক্তির দারুণ সমস্যা তৈরি হয়। এ ছাড়াও ভাষার ব্যাপারে স্বাভাবিক প্রবণতা চলে যায় ডিরাকের। ফ্রেঞ্চ তো বলতেনই না। এই যন্ত্রণা আজীবন ডিরাকের সঙ্গী হয়ে রইল।

ছোটবেলা থেকেই ডিরাক অসম্ভব অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। প্রচারের আলো এড়িয়ে চলতেন সবসময়। যখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত, তখন সেই উত্তরটুকু ছাড়া খুব একটা কথা বলতেন না। নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন তিনি। এভাবেই সামাজিক মেলামেশায় অক্ষম ও কোনো বিষয়ে কিছু বলায় অপারদর্শী হয়ে ওঠেন ডিরাক। ছোটবেলা থেকেই গাণিতিক সমাধানের অসাধারণ পারঙ্গমতা ছিল। তবে সাহিত্য বা শিল্প নিয়ে ডিরাকের কোনো আগ্রহ ছিল না। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্রে একদিকে যেমন শব্দব্যবহার ও বাক্যগঠনের নৈপুণ্য দেখা গিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সাহিত্যগুণ ও গাণিতিক উপস্থাপনার মেলবন্ধন ঘটেছে, যা তাঁর রচনাগুলির এক একটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে চূড়ান্ত মাস্টারপিস হিসেবে। 

অনেকে মনে করেন, বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞানকে উচ্চতার তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পল ডিরাকের অবদান আইনস্টাইনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অথচ আইনস্টাইন, নীলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, শ্রোডিঙ্গার ও রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম যত মানুষ জানেন, সে তুলনায় ডিরাকের নাম জানেন অনেক কম মানুষ। ড্যানিশ পদার্থবিদ নীলস্ বোর তাঁকে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জেস্ট ম্যান’ বলতেন। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত জগতের এই অসাধারণ প্রতিভার নাম আজও অনেকের কাছে অজানাই থেকে গিয়েছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস, কলকাতা, ভারত