পদার্থবিজ্ঞান
রহস্যের নাম স্ট্রিং থিওরি
মহাবিশ্ব যে কণাগুলো দিয়ে গড়ে উঠেছে, সেগুলো আসলে সুতার মতো কিছু একটা। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন স্ট্রিং। যে হাইপোথিসিস এই বিশেষ সুতা দিয়ে গড়া মহাবিশ্বের কথা বলে, তার নাম স্ট্রিং থিওরি। অনেকে মনে করেন, এটি সবকিছুর তত্ত্ব হওয়ার দাবীদার। রহস্যময় এ হাইপোথিসিসের নানাদিক...
গত শতাব্দীর ষাটের দশক। ইতিহাসের পাতায় যাকে বলা যায় চরম উত্তাল সময়। উন্মাদনার যুগ। সারা বিশ্বেই তখন চলছে উত্তেজনা, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। দেশে দেশে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন তরুণেরা। বিটনিক, হিপ্পি আন্দোলনে নতুন পৃথিবীর ডাক শোনা যাচ্ছে। অহিংস বিশ্বের ডাক দিয়ে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হলেন ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’-এর নায়ক মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। এদিকে আমাদের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর সঙ্গীদের আগরতলা মামলায় বন্দী করেছে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। সেটাই উসকে দিল ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান। তার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত বয়ে গেল রক্তগঙ্গা ’৭১-এ। ওদিকে মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধের পটভূমিতে চন্দ্রাভিযান নিয়ে লড়াই তুঙ্গে। চাঁদে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় চালাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। অ্যাপোলো অভিযান চলছে একের পর এক।
বিজ্ঞান গবেষণাতেও তখন উত্তাল সময়। ইউরোপের সেরা গবেষণাকেন্দ্র সুইজারল্যান্ডের সার্নে চলছে অন্য নাটক। শক্তিশালী পারমাণবিক বল নিয়ে বেশ একটা ধাঁধায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। অন্য অনেকের মতো সেই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছেন গ্যাব্রিয়েল ভেনিজিয়ানো। ইতালিয়ান পদার্থবিদ। বয়স ২৬ বছর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কণাত্বরক যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটছেন রাত-দিন। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, কোনো সমাধান মেলে না। হতাশ হন। আবার শুরু করেন। এক রাতে হুট করে মিলল ইউরেকা মোমেন্ট। পুরোনো একটা গাণিতিক সূত্রের সঙ্গে উপাত্তগুলোর অদ্ভুত এক মিল খুঁজে পেলেন ভেনিজিয়ানো। সে মিল বিস্ময়কর। কিন্তু অবোধ্য। কোনো রকম হাতের স্পর্শ ছাড়াই মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। শক্তিশালী পারমাণবিক বলে মিথস্ক্রিয়া করা কণাগুলোর ধর্ম বর্ণনা করতে পারছে সূত্রটি। প্রায় ২০০ বছর আগে বিখ্যাত সুইস গণিতবিদ লিওনার্দো অয়েলার সূত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন। সবাই একে চেনে অয়েলারের বিটা ফাংশন নামে। কিন্তু এই বিটা ফাংশনের সঙ্গে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক কী?
আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে স্ট্রিং থিওরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু বিনিময়ে গুনতে হবে মাশুল। মেনে নিতে হবে তিনটি শর্ত। প্রথমত, মহাবিশ্বের মাত্রা হতে হবে চারটি নয়, বরং ২৬টি। এর মধ্যে স্থানিক মাত্রা ২৫টি এবং সময়ের মাত্রা একটি। দ্বিতীয়ত, এমন এক কণা থাকতে হবে, যা আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে ছুটতে পারে।
সে জবাব দিতে পারলেন না ভেনিজিয়ানো। শুধু তিনিই নন, অন্যরাও চেষ্টা করে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। কেউ জানেন না জবাব। সেটা ১৯৬৮ সালের কথা। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ইতালির বিজ্ঞান জার্নাল ইল নোভো সিমেন্টোতে এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন ভেনিজিয়ানো। সেটা পড়ে বেশ কজন বিজ্ঞানী হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রহস্য উদ্ঘাটনে। তার দুই বছর পর আলাদা আলাদাভাবে প্রায় একই উত্তর দিলেন তিন বিজ্ঞানী। তাঁরা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউচিরো নামবু, নীলস বোর ইনস্টিটিউটের হোগার নীলসেন এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ লিওনার্দো সাসকিন্ড। তাঁরা বললেন, আমরা এত কাল কণাকে যেভাবে দেখে এসেছি, মৌলিক কণা আসলে সে রকম নয়; অর্থাৎ কণারা পয়েন্ট বা বিন্দুর মতো নয়, স্ট্রিং বা সুতার মতো। দুটি কণার মধ্যে শক্তিশালী পারমাণবিক বল যদি অতিক্ষুদ্র, চরম পাতলা এবং প্রায় রাবার ব্যান্ডের মতো সুতা আছে বলে ভাবা যায়, সেটা যদি ওই কণাদ্বয়কে সংযুক্ত করে, তাহলেই কেবল অয়েলারের সূত্র ব্যবহার করে গাণিতিকভাবে ওই কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এই সুতাগুলো শুধু একমাত্রায় থাকে। সেগুলো প্রসারিত হতে পারে, পারে সংকুচিত হতেও। ঠিক রাবার ব্যান্ডের মতো। আরও ভালো করে বললে, রাবার ব্যান্ডের মতোই এই সুতাগুলো শক্তি অর্জন করলে প্রসারিত হয় এবং শক্তি হারালে সংকুচিত হয়। আবার ধারণা করা হলো, রাবার ব্যান্ডের মতো কম্পিত হয় সুতা বা স্ট্রিংগুলো।
ভেনিজিয়ানোর গবেষণাপত্রে স্ট্রিং–সংক্রান্ত কোনো শব্দ ছিল না। কিন্তু বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমবার স্ট্রিং শব্দটি ব্যবহার করলেন এই তিন বিজ্ঞানী। এভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হলো একটা রহস্যময় তত্ত্বের। নাম স্ট্রিং থিওরি। রহস্যময় এ কারণে যে তখনো তত্ত্বটার অনেক কিছুই বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তার আচার-আচরণ উদ্ভট, পাগলাটে। আবোধ্য।
শক্তিশালী পারমাণবিক বল নিয়ে এত দিনের রহস্য উদ্ঘাটনে হইচই পড়ে যাবে—এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ট্রিং থিওরি এবং তার আবিষ্কর্তা তিন বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রে ঘটল উল্টো ঘটনা। এ বিষয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখে সেকালের নামকরা বিজ্ঞান জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস-এ পাঠালেন লিওনার্দো সাসকিন্ড। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণাপত্রটি স্রেফ বাতিল করে দিল জার্নাল কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্য, প্রকাশ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু এতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। গবেষণাপত্রটি ডাস্টবিনে ফেলার উপযোগী বলেও আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল জার্নালের সম্পাদনা দল।
স্বাভাবিকভাবে অনেকে স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শুধু তা–ই নয়, বিজ্ঞানে জন্ম নিল অদ্ভুত এক রহস্য। আমরা যে জগৎ চিনি ও জানি, সেটা কি আসলে এ রকম নয়? অবশ্য ’৭০-এর দশকে চারটির মধ্যে তিনটি সমস্যার সমাধান করে ফেললেন স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা।
সব শুনে ভীষণ হতাশ হলেন বিজ্ঞানী সাসকিন্ড। নিজের মাথাটা আবর্জনার বিনে ঠুকে গেছে বলে মনে হলো তাঁর। তিনিসহ স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের আরও হতাশ হতে হলো, যখন দেখা গেল, অতিপারমাণবিক কণাদের উচ্চশক্তির পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের সঙ্গে মোটেও খাপ খাচ্ছে না তত্ত্বটা। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে রীতিমতো সাংঘর্ষিক। সে সময় অতিপারমাণবিক কণাদের শক্তিশালী বলের ব্যাখ্যায় গড়ে উঠছিল আরেকটা তত্ত্ব। তার নাম কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিক্স। সেটা সন্তোষজনক সফলতার সঙ্গে সবকিছু ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছিল। কাজেই স্ট্রিং থিওরি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন বেশির ভাগ বিজ্ঞানী। তত্ত্বটা প্রায় বাতিলের খাতায় নাম লেখায়, এমন অবস্থা।
ঠিক এ সময় তত্ত্বটার অভিভাবক হিসেবে এগিয়ে এলেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জন হেনরি শোয়ার্জ। প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বটা নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, তত্ত্বটায় গভীর ও তাৎপর্যময় কিছু একটা আছে। বেশ কয়েক বছর দিন-রাত তত্ত্বটা নিয়ে পড়ে থাকলেন শোয়ার্জ। এর বিভিন্ন গাণিতিক দিক নিয়ে ভাবতে থাকেন। হিসাব কষেন পাতার পর পাতা। এ সময় তাঁর সঙ্গে একে একে কাজ করেন স্ট্রিং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অ্যান্ড্রু নেভ্যু, মাইকেল গ্রিন, জোয়েল শার্কসহ আরও অনেকে।এ থিওরির কিছু সমস্যা শনাক্ত করেন স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা। সেগুলো দূর করতে যুক্তিসংগতভাবে তাঁরা এই তত্ত্বকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সঙ্গে অবশ্যই খাপ খাওয়ানোর সিদ্ধান্তে নেন; অর্থাৎ গতির আপেক্ষিকতা ও আলোর গতি এবং পরমাণুর ক্ষুদ্র জগতের বিজ্ঞানের সঙ্গে মানানসই করার চেষ্টা করেন তত্ত্বটাকে। কয়েক বছরের চেষ্টায় তা সম্ভব হলো। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে অদ্ভুত দুটি সমস্যার মুখোমুখি হন তাত্ত্বিকেরা।
আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে স্ট্রিং থিওরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু বিনিময়ে গুনতে হবে মাশুল। মেনে নিতে হবে তিনটি শর্ত। প্রথমত, মহাবিশ্বের মাত্রা হতে হবে চারটি নয়, বরং ২৬টি। এর মধ্যে স্থানিক মাত্রা ২৫টি এবং সময়ের মাত্রা একটি। দ্বিতীয়ত, এমন এক কণা থাকতে হবে, যা আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে ছুটতে পারে। এই কণার নাম দেওয়া হলো ট্যাকিয়ন। তৃতীয়ত, ভরহীন কিছু কণার অস্তিত্ব থাকতে হবে। সেই কণা কখনো স্থির থাকতে পারবে না।
এ রকম উদ্ভট ফলাফল আসার পর মাথায় হাত পড়ল স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের। আমাদের পরিচিত জগৎ চারমাত্রিক। তাহলে বাকি ২২টি মাত্রা কই? আবার ট্যাকিয়ন নামের কোনো কণার অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শুধু তা–ই নয়, কণাটা খোদ তত্ত্বটাকে নড়বড়ে করে তুলল। স্ট্রিং থিওরিকে প্রায় সবাই মনে করতে লাগল এলেবেলে তত্ত্ব হিসেবে। এ তত্ত্ব আর এর গবেষকদের নিয়ে রঙ্গরসিকতা করতে শুরু করলেন অন্য বিজ্ঞানীরা। এ নিয়ে নামকরা পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের রসিকতার কাহিনি চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকে একদিন জন শোয়ার্জের সঙ্গে লিফটে দেখা হয়েছিল এই নোবলজয়ীর। তিনি খোঁচা দিয়ে শোয়ার্জকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, জন। আজ তুমি কত মাত্রায় আছ?’
ওপরের তিনটি সমস্যা ছাড়াও চতুর্থ আরেকটা সমস্যাও ছিল। স্ট্রিং থিওরি কণার কথা বলে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির সব কটি কণার কথা নয়। যেমন বোসন কণা ঠিক আছে, কিন্তু ফার্মিয়ন কণাদের পাওয়া যায় না এ তত্ত্বে। মানে কোয়ার্ক নামের কোনো কণার অস্তিত্ব তখন স্ট্রিং থিওরিতে নেই। মোদ্দাকথায়, আমাদের চেনা জগতের বর্ণনা বা ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলো স্ট্রিং থিওরি।
স্বাভাবিকভাবে অনেকে স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শুধু তা–ই নয়, বিজ্ঞানে জন্ম নিল অদ্ভুত এক রহস্য। আমরা যে জগৎ চিনি ও জানি, সেটা কি আসলে এ রকম নয়? অবশ্য ’৭০-এর দশকে চারটির মধ্যে তিনটি সমস্যার সমাধান করে ফেললেন স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা। সে সময় তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পিয়েরে রেমন্ড স্ট্রিং বর্ণনাকারী সমীকরণগুলোকে নতুন রূপ দেওয়ার উপায় খুঁজে পান। এতে স্ট্রিং থিওরি থেকেও ফার্মিয়ন কণাদের পাওয়া গেল। তিনি দেখতে পান, তত্ত্বটার যদি নতুন একটা সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য থাকে, তাহলে একে সংগতিময় বা যুক্তিসংগত করে তোলা সম্ভব। এভাবে সুপারসিমেস্ট্রি আবিষ্কার করে বসেন পিয়েরে রেমন্ড। স্ট্রিং থিওরিতে সুপারসিমেট্রি জুড়ে দেওয়ার পর এর নতুন নাম হলো সুপারসিমেট্রিক স্ট্রিং থিওরি। সংক্ষেপে, সুপারস্ট্রিং থিওরি।
প্রায় একই সময়ে আরেকটা সংস্করণ আবিষ্কার করেন অ্যান্ডু নেভ্যু এবং জন শোয়ার্জ। তাঁদের সংস্করণে ট্যাকিয়ন ছিল না। আবার ফার্মিয়ন কণার অস্তিত্বও পাওয়া গেল। মাত্রার সংখ্যাও ছিল মাত্র ১০টি। স্ট্রিং থিওরির এই সংস্করণও ছিল আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সঙ্গে মানানসই। এভাবে নতুন একটা চেহারায় নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে স্ট্রিং থিওরি তথা সুপারস্ট্রিং থিওরি।
ঠিক এ সময়ই বড় একটা পদক্ষেপ নিলেন জোয়েল শার্ক এবং জন শোয়ার্জ। একটা হাইপোথেটিক্যাল কণার অস্তিত্বের কথা কল্পনা করলেন দুই বিজ্ঞানী। কাল্পনিক সেই কণার নাম গ্র্যাভিটন; অর্থাৎ মহাকর্ষ কণা। স্ট্রিং থিওরি মতে, একটা বস্তু আরেকটাকে আকর্ষণ করে এই কণাদের আন্তবিনিময়ে।
নতুন নাম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পালক খসে (যুক্ত নয়) গেল স্ট্রিং থিওরির দেহ থেকে। মানে দুটি সমস্যা দূর করা গেল তত্ত্বটা থেকে। এতে ট্যাকিয়নের মতো অবাস্তব কণার কোনো অস্তিত্ব আর রইল না। সেই সঙ্গে মাত্রার সংখ্যা নেমে এল ২৬ থেকে মাত্র ১০টিতে। কাজেই সুপারস্ট্রিং থিওরির মাত্রা ১০টি। অবশ্য তা–ও আমাদের চেনাপরিচিত মাত্রা থেকে ছয়টি বেশি। কিন্তু এই মাত্রাগুলো কই থাকে? সেগুলো আমরা দেখি না কেন? কেন অনুভব করি না? তার উত্তরও আছে সুপারস্ট্রিং থিওরির কাছে। সেটা বলার আগে আরেকটা কথা বলে নিই।
দেখা যাচ্ছে, ’৭০-এর দশকে স্ট্রিং থিওরির প্রধান কিছু সমস্যা দূর করে ফেলা সম্ভব হলো। তবে একটা সমস্যার সমাধান তখনো বাকি। সমস্যাটির কথা আগেই বলেছি। ওই যে বলেছিলাম, ভরহীন কিছু কণার অস্তিত্ব থাকতে হবে, যা কখনো স্থির থাকতে পারবে না। এ রকম চরিত্রের একটা কণা হলো ফোটন। এরও ভর নেই। কখনো স্থির থাকে না। কিন্তু গাণিতিক হিসাব কষে আরেকটা এ রকম কণা পেলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তেমন ভরহীন কণার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। তাহলে ঘটনা কী? হিসাব মেলে না।
ঠিক এ সময়ই বড় একটা পদক্ষেপ নিলেন জোয়েল শার্ক এবং জন শোয়ার্জ। একটা হাইপোথেটিক্যাল কণার অস্তিত্বের কথা কল্পনা করলেন দুই বিজ্ঞানী। কাল্পনিক সেই কণার নাম গ্র্যাভিটন; অর্থাৎ মহাকর্ষ কণা। স্ট্রিং থিওরি মতে, একটা বস্তু আরেকটাকে আকর্ষণ করে এই কণাদের আন্তবিনিময়ে। এভাবে স্ট্রিং থিওরির বড় একটা সমস্যার সমাধান হলো। একই সঙ্গে সম্ভব হলো মহাকর্ষ বলের সঙ্গে প্রকৃতির অন্য বলগুলোকে একীভূত করার কাজটা। স্ট্রিং থিওরিকে থিওরি অব এভরিথিং বলার এটাও অন্যতম এক কারণ।
আসলে স্ট্রিং থিওরির বেশ কিছু উদ্ভটতা আছে সত্যি, কিন্তু তারপরও পদার্থবিজ্ঞানের দুটি বড় তত্ত্বকে জুটিবদ্ধ করতে পারছে এটি। অনেকে বলে তত্ত্ব দুটির মধ্যে বিবাহবন্ধনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে স্ট্রিং থিওরি। সেই তত্ত্ব দুটি হলো সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব। অন্য কোনো তত্ত্ব ব্যবহার করে সেটা করা সম্ভব হয়নি। ফলে স্ট্রিং থিওরির কারণে বিজ্ঞানীদের হাতে এখন কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির একটা সসীম তত্ত্ব রয়েছে। এভাবে গুটিকয় স্ট্রিং তাত্ত্বিক নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিলেন বলেই একসময় প্রায় আস্তাকুঁড় থেকে ফিরে আসে তত্ত্বটি। এরপর স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কাজ শুরু করেন শত শত বিজ্ঞানী। সময় ১৯৮০-এর দশক। একে বলা হয় প্রথম সুপারস্ট্রিং বিপ্লব।
আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, স্ট্রিং থিওরি মতে, কণা নয়, বস্তুজগতের মৌলিক একক আসলে স্ট্রিং বা তার বা সুতার মতো কিছু একটা। এই সুতার আকার একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চেয়েও কোটি কোটি কোটি... ভাগ ছোট। প্রায় ১০-৩৩ সেন্টিমিটার।
এর প্রায় এক দশক পর শুরু হয় দ্বিতীয় সুপারস্ট্রিং বিপ্লব। সেবার, মানে ১৯৯৫ সালের দিকে আরেকটা রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গেল স্ট্রিং থিওরি। ফলাফল হিসেবে আবির্ভূত হলো নতুন আরেকটা তত্ত্ব। সে তত্ত্বের নাম এম–থিওরি বা এম–তত্ত্ব। আসলে ’৯০-এর দশকে এসে আদি স্ট্রিং থিওরি থেকে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের পাঁচটি আলাদা সংস্করণ পাওয়া গেল। তাদের প্রতিটিই সসীম ও সুসংজ্ঞায়িত। পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি দেখতে প্রায় একই রকম, শুধু তাদের স্পিনের বিন্যাস কিছুটা আলাদা। কিন্তু পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি থাকার দরকার কী?
প্রশ্নটার জবাব দিলেন পদার্থবিদ এডওয়ার্ড উইটেন। তিনি বলেন, আসলে একটা গুপ্ত এগারো-মাত্রিক তত্ত্ব রয়েছে, যার ভিত্তি মেমব্রেন বা পর্দা, শুধু স্ট্রিং নয়। একেই বলা হলো এম-তত্ত্ব। স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি সংস্করণ কেন, সে ব্যাখ্যা দিতেও সক্ষম হলেন তিনি। তিনি বললেন, তার কারণ একটা এগারো-মাত্রিক পর্দা দশ-মাত্রিক স্ট্রিংয়ে চুপসে যাওয়ার পাঁচটি উপায় আছে। অন্য কথায়, স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি সংস্করণের সব কটি আসলে একই এম-থিওরির ভিন্ন ভিন্ন গাণিতিক প্রকাশ। কাজেই স্ট্রিং থিওরি আর এম-থিওরি আসলে একই তত্ত্ব। পার্থক্য শুধু, স্ট্রিং থিওরি এগারো-মাত্রিক এম-তত্ত্বের দশ-মাত্রায় সংকুচিত রূপ।
মোটাদাগে, এই হলো স্ট্রিং থিওরির সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস।
এবার এই তত্ত্ব কী বলে, সে বিষয়ে কিছু বলা যাক। আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, স্ট্রিং থিওরি মতে, কণা নয়, বস্তুজগতের মৌলিক একক আসলে স্ট্রিং বা তার বা সুতার মতো কিছু একটা। এই সুতার আকার একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চেয়েও কোটি কোটি কোটি... ভাগ ছোট। প্রায় ১০-৩৩ সেন্টিমিটার। এটা বিভিন্নভাবে কাঁপতে পারে। এই কাঁপার ধরনের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে কোয়ার্ক বা ইলেকট্রনের মতো ভিন্ন ভিন্ন কণা। আবার স্ট্রিং থিওরিতে মাত্রার সংখ্যা ১০টি। কিন্তু আমরা স্রেফ চারটি মাত্রা অনুভব করতে পারি। তাহলে বাকি মাত্রাগুলো কোথায়? সেগুলো আমরা দেখতে পাই না কেন? স্ট্রিং থিওরির মতে, বাকি ছয়টি মাত্রা অতি অল্প পরিসরে কুঁকড়ে গেছে। সেগুলো এতই ক্ষুদ্র যে পরমাণুগুলো এসব মাত্রার মধ্যে ঢুকতে পারে না। তাই সেগুলো আমরা অনুভব করতে পারি না।
কাজেই এখন পর্যন্ত তত্ত্বের অ্যাসিড টেস্টে ব্যর্থ হয়েছে স্ট্রিং থিওরি। তাই নামে থিওরি থাকলেও এখনো এটি আসলে একটি হাইপোথিসিস বা প্রস্তাবিত তত্ত্ব। তবে স্ট্রিং থিওরির প্রবর্তকেরা তাতে দমে যাননি। তাঁরা এখন পরোক্ষভাবে এটা পরীক্ষা করে দেখার উপায় খুঁজছেন।
সেটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু তারপরও স্ট্রিং থিওরিকে নিখুঁত বলা যায় না। এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তত্ত্বটা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়নি। কাল্পনিক কণা গ্র্যাভিটন বা সুপারসিমেট্রির মাধ্যমে পাওয়া সুপারপার্টনার কণার কোনো অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্র্যাভিটনের কথা বলা যাক। এই কণা যে শক্তি ধারণ করে, তাকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক এনার্জি। সেটা আমাদের এখন পর্যন্ত তৈরি করা সবচেয়ে বড় কণাত্বরক যন্ত্র লার্জ হ্যার্ডন কলাইডার বা এলএইচসি যে শক্তি তৈরি করে, তার চেয়ে কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বেশি। বর্তমানে এলএইচসির যে আকার, তার চেয়ে কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বড় আরেকটা এলএইচসি বানানোর চেষ্টা করার কথা ভাবুন। তাহলে তত্ত্বটা সরাসরি প্রমাণের জন্য যে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের দরকার হবে, তার আকার হবে একটা গ্যালাক্সির সমান। আরও মজার ব্যাপার হলো, স্ট্রিং থিওরির একেকটি সমাধান হলো একেকটা গোটা মহাবিশ্ব। কাজেই এর সমাধানের পরিমাণও অসীমসংখ্যক। তাই তত্ত্বটাকে সরাসরি পরীক্ষা করার জন্য গবেষণাগারে একটা শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করা প্রয়োজন। সেটা মানুষের পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, এককথায় অসম্ভব।
কাজেই এখন পর্যন্ত তত্ত্বের অ্যাসিড টেস্টে ব্যর্থ হয়েছে স্ট্রিং থিওরি। তাই নামে থিওরি থাকলেও এখনো এটি আসলে একটি হাইপোথিসিস বা প্রস্তাবিত তত্ত্ব। তবে স্ট্রিং থিওরির প্রবর্তকেরা তাতে দমে যাননি। তাঁরা এখন পরোক্ষভাবে এটা পরীক্ষা করে দেখার উপায় খুঁজছেন। সেই সঙ্গে তৃতীয় সুপারস্ট্রিং বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করছেন তাত্ত্বিকেরা। সেটাই হয়তো মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে স্ট্রিং থিওরির। কিংবা অর্থহীন একটা তত্ত্ব হিসেবেও প্রমাণিত হতে পারে এটি। স্ট্রিং থিওরির ভাগ্যে কী আছে, তার উত্তর আসলে বলে দেবে সময়।