বিজ্ঞানী
পদার্থবিজ্ঞানের অমর নক্ষত্র রিচার্ড ফাইনম্যান
বিজ্ঞানী হয়েও জীবদ্দশায় পেয়েছেন রকস্টারের খ্যাতি। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তিনি কিংবদন্তীতুল্য। তাঁর রসিকতাবোধ মানুষকে মুগ্ধ করেছে বারেবারে। কাজ করেছেন ম্যানহাটান প্রজেক্টে সে কালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে গবেষণার জন্য পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। তিনি রিচার্ড ফাইনম্যান। আজ ১১ মে তাঁর জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন রিচার্ড ফাইনম্যানের শৈশব, কৈশোর, গবেষণা…
শুরুর আগে
একবার হাওয়াইতে আমাকে এক বৌদ্ধমন্দির দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মন্দিরের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। এটা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না, আমি জানি।’ তারপর বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষকেই স্বর্গের দরজার চাবি দেওয়া হয়। কিন্তু এই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে।’
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কথাটা একই। এটা স্বর্গের দরজার চাবি হলেও, একই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে। তবে কোনটা যে কীসের দরজা—সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেব? এবং স্বর্গে প্রবেশের সম্ভাবনা বন্ধ করে দেব চিরতরে? নাকি কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এই চাবি ব্যবহার করা যায়—এ প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করে যাব? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, স্বর্গের দরজার চাবির মূল্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
—মিনিং অফ ইট অল, রিচার্ড ফাইনম্যান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সরকার পারমাণবিক বোমা বানাতে একটি বিপুল ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ম্যানহাটান প্রজেক্ট। প্রকল্পটির প্রধান পরিচালক ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। বড় বড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য ডাক পেয়েছেন এক তরুণ বিজ্ঞানীও। তাঁর বয়স কেবল বিশ পেরিয়েছে। উচ্ছলতার বয়স। সেই বয়সে তরুণ এই বিজ্ঞানীর ঘাড়ে চেপেছে জটিল সব গাণিতিক হিসাবনিকাশের দায়িত্ব। গুরুদায়িত্ব, বলা বাহুল্য। একটু এদিক-ওদিক হলেই হয়েছে! সামান্য ভুলের জন্যও গুনতে হতে পারে চড়া মাশুল।
তরুণ যেন জাদু জানেন। দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিলেন সবকিছু। সেই সঙ্গে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আর ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে কীভাবে আলাদা করা যায়, এ নিয়েও কাজ করলেন সফলভাবে।
শুধু তাই নয়। পরবর্তীতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি শাখা—কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নিজের উদ্ভাবিত স্বনামের ডায়াগ্রামটির জন্যই শুধু অমর খ্যাতি পেতে পারতেন। তবে থেমে যাননি শেখানেই। জীবদ্দশায় বিজ্ঞানী হয়েও পেয়েছিলেন রকস্টারের খ্যাতি। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মেধাবী শিক্ষক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তী পর্যায়ে। একবার পদার্থবিজ্ঞানের একাডেমিক কোর্স করিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের—সেই লেকচারগুলো বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, আজও সেই বই বহু তরুণকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেক দূর, বদলে গেছে অনেক কিছু, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা ম্লান হয়নি একটুও।
তরুণ সেই বিজ্ঞানীর নাম রিচার্ড ফাইনম্যান। তাঁর গল্প শোনার জন্য চলুন ফিরে যাই ১৯১৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে।
১.
রিচার্ড ফাইনম্যানের বাবা-মা ছিলেন ইহুদি। বাবা মেলভিল ফাইনম্যানের জন্ম বেলারুশের মিন্স্ক শহরে। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। নানারকম ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। আসলে বিজ্ঞান ভালোবাসতেন। কিন্তু এ নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি সেভাবে।
মা লুসিল ফিলিপস বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক ইহুদি পরিবারে। তাঁর বাবা-মাও মার্কিন ছিলেন না। পোল্যান্ড ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে শুরু করেছিলেন নতুন জীবন। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করাতেন লুসিল। ১৯১৭ সালে মেলভিল এবং লুসিলের বিয়ে হয়। এক বছর পরে, ১৯১৮ সালের ১১ মে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান—রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যান।
মেলভিল খুব চাইছিলেন, প্রথম সন্তান ছেলে হোক। ইচ্ছেপূরণের খুশিতে ছেলেকে যতভাবে সম্ভব, বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তোলার চেষ্টায় নামলেন তিনি। অযথা চাপ দেননি অবশ্য। তবে একজন মানুষের জীবনের গতিপথ কেমন হবে, তার পেছনে শৈশবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রিচার্ড মাইনম্যানের জীবনী লিখেছেন জেমস গ্লেইক। নাম, জিনিয়াস: দ্য লাইফ অ্যান্ড সায়েন্স অব রিচার্ড ফাইনম্যান। সেখানে ফাইনম্যানকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
ফাইনফ্যান তাঁর সিরিয়াস স্বভাব ও জ্ঞানের জন্য আগ্রহ পেয়েছেন বাবার দিক থেকে। আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন গল্প বলার চমৎকার ক্ষমতা ও রসিকতাবোধ।
সব পরিবারেই কিছু জটিলতা থাকে। কষ্ট হানা দিয়ে যায়। মাত্র চার সপ্তাহ বয়সে রিচার্ড ফাইনম্যানের ছোট ভাই মারা যায়। সে সময় রিচার্ডের বয়স কেবল পাঁচ বছর। বাবা-মা এলোমেলো হয়ে গেলেন অনেকটা। জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠল। পরের চার বছর প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন ছোট্ট ফাইনম্যান। এর মধ্যে পরিবার অনেকবার বাসা বদলেছে, যেন পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে দুঃসহ স্মৃতি থেকে। এ রকম সময়ে পৃথিবীতে এল ছোটবোন জোয়ান। পরের বছর ফার রকওয়েতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল ফাইনম্যান পরিবার।
স্কুলে যাওয়ার আগেই বিজ্ঞান ও গণিতে হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল রিচার্ডের। নিজে নিজেই শিখেছেন সবকিছু। সে সময় ইন্টারনেট ছিল না। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সাহায্য নিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সেই সঙ্গে বাসায়, নিজের ঘরে একটা ল্যাবরেটরিও বানিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ নিয়ে টুকটাক পরীক্ষা চালাতেন সেখানে। যাঁরা ইয়াং শেলডন দেখেছেন, অনায়াসে ছোট্ট শেলডনের ল্যাবরেটরির সঙ্গে ফাইনম্যানের গবেষণাগারের মিল খুঁজে পাবেন। মিল খুঁজে পাবেন ছোট রিচার্ডের সঙ্গেও।
ফার রকওয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখা গেল, তাঁর সমস্ত আগ্রহ বিজ্ঞান ও গণিতে। ইতিহাস, কলা ইত্যাদিতে কোনো আগ্রহই নেই। এমনকি তাঁর কাছে মনে হতো, মানুষ আবার কবিতা পছন্দ করে কীভাবে!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাইস্কুলে থাকতে ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি ইত্যাদি নিজে নিজে করতে গিয়ে sin, cos, tan, f(x)—এসবের বদলে নিজস্ব নোটেশন বা চিহ্ন ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন রিচার্ড। তাঁর কাছে নাকি নিজস্ব নোটেশন ব্যবহার করতেই সহজ লাগত। খাতা ভর্তি সেই নোটেশন দেখে এক বন্ধু তাঁকে একবার বলল একটা গণিত বুঝিয়ে দিতে। বোঝাতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, নোটেশন আসলে কারো ব্যক্তিগত জিনিস নয়!
গণিত আর বিজ্ঞানে যত ভালোই হোন, অন্যান্য বিষয় পারতেন না একেবারেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এটা ভয়াবহ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে ‘ইহুদি’ পরিচয়। যুক্তরাষ্ট্রে তখনও ইহুদিদেরকে অন্যরা সহজে নিতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আছে, সেই কোটার চেয়ে বেশি ইহুদি ভর্তি করে না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাঁকে নেয়নি। তা হোক, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ফি ১৫ ডলার নিয়ে সেটাও আর ফিরিয়ে দেয়নি তারা। সে জন্য ফাইনম্যান জীবনভর তাদের ক্ষমা করতে পারেননি! শেষ পর্যন্ত তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, মানে এমআইটিতে। সেটা ১৯৩৫ সালের কথা।
অনার্স শেষ করতে করতে ১৯৩৯। এই সময়টাকে ফাইনম্যানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে। পড়তে গিয়েছিলেন গণিত। তখন টের পেলেন, কোর্সটা এমনিতে বেশ সহজ। কিন্তু ওর কোন জিনিসটা বাস্তবে কাজে লাগবে, সেটা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। এমন সময় আর্থার এডিংটনের লেখা ম্যাথম্যাটিক্যাল থিওরি অব রিলেটিভিটি বইটা হাতে পেলেন। পড়ার পর বুঝলেন, এরকম কিছুই শিখতে চান তিনি। বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধানে গণিত ব্যবহার করতে চান। তখনো তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্র। চট করে গণিত থেকে সরে এলেন, ভর্তি হলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। কিন্তু অল্প কদিন পরেই বুঝলেন, মন টানছে না। আবারো বিষয় বদলে ভর্তি হলেন পদার্থবিজ্ঞানে। শুরু হলো তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়।
২.
পদার্থবিজ্ঞানের যে কোর্সটা নিয়েছিলেন, সেটা ঠিক স্ট্যান্ডার্ড কোর্স ছিল না। ‘ইন্ট্রোডাকশন টু থিওরেটিক্যাল ফিজিকস’ নামের এই কোর্সটা ছিল অনার্স শেষ করে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য। অথচ ফাইনম্যান তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কিন্তু সেই কোর্স নিয়েও তিনি ঠিক তৃপ্তি পেলেন না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপরে সরাসরি কোনো কোর্স ছিল না। কাজেই টি. এ. ওয়েল্টন নামের আরেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিলে এ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন তিনি। তখন ১৯৩৬ সাল। সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তাঁদের মধ্যকার চিঠিগুলো থেকে জানা যায়, নিজেরা মিলে স্থান-কালের এমন একটা রূপ তাঁরা বিকশিত করতে চাচ্ছিলেন, যেখানে—
‘…মহাকর্ষ যেমন স্থানের সঙ্গে যুক্ত একটা ঘটনা, বৈদ্যুতিক বলকেও তেমনি স্থানের সঙ্গে যুক্ত একটি ঘটনা হিসেবে প্রকাশ করা যাবে।’
বছরখানেক পরে ফাইনম্যান পল ডিরাকের লেখা দ্য প্রিন্সিপালস অব কোয়ান্টাম মেকানিকস বইটা পড়ে ফেললেন। বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, ডিরাকের আইডিয়ার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব ভাবনা কতটা মেলে বা আদৌ মেলে কি না। এভাবে ফাইনম্যানের জীবনে ডিরাক পরিণত হলেন আদর্শে। জেমস গ্লেইক লিখেছেন, এক জীবনে ডিরাকের চেয়ে বেশি সম্মান আর কোনো বৈজ্ঞানিককে তিনি দিয়েছেন বলে জানা যায় না।
এভাবে শেষ হলো অনার্স। চিন্তা করলেন, এবারে পিএইচডি করবেন। এমআইটিতে পড়াশোনা করে বেশ খুশি ছিলেন ফাইনম্যান। কাজেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান জন স্লেটারের কাছে আবেদন করলেন, এখানেই পিএইচডি করতে চান। স্লেটার উত্তরে জানালেন, ফাইনম্যানের নিজের ভালোর জন্যই এখানে না করে অন্য কোথাও পিএইচডি করা উচিত। এবং সে জন্য প্রিন্সটন বেশ ভালো হবে।
ইহুদি ছিলেন বলে সামান্য সমস্যা হতেও পারত। প্রিন্সটনের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হ্যারি স্মিথ। স্লেটারকে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানতেও চেয়েছিলেন, ফাইনম্যান ইহুদি কি না। তবে স্লেটার চিঠিতে ফাইনম্যানের বেশ প্রশংসা করলেন। ইতিহাস, সাহিত্য, কলা ইত্যাদি বিষয়ে রেজাল্ট ভালো না হলেও পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর ফলাফল ছিল অসম্ভব ভালো। ফলে সুযোগ পেয়ে গেলেন প্রিন্সটনে। এখানে তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার হিসেবে ছিলেন বিজ্ঞানী জন হুইলার। কিন্তু হুইলারের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনোরকম কুলকিনারা না পেয়ে, আবারো নিজের আগের আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ফাইনম্যান। প্রিন্সটনে তিনি প্রথম যে সেমিনারে বক্তৃতা দেন, সেখানে দর্শকসারিতে আইনস্টাইন, পাউলির মতো বিজ্ঞানীরাও উপস্থিত ছিলেন। পাউলি তাঁর সব কথা শুনে বললেন, ‘জিনিসটা ঠিক মনে হচ্ছে না। কী যেন একটা সমস্যা আছে…’
ফাইনম্যান পরে কাজ করতে গিয়ে বুঝলেন, আসলেই সমস্যা আছে। ফলে আরেকদিক থেকে নতুন করে এগোলেন তিনি। ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ-চৌম্বক তত্ত্বের তরঙ্গ মডেলটাকে অন্য আরেকটা মডেল দিয়ে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। এই মডেলটা স্থান-কালের সঙ্গে কণাদের মিথস্ক্রিয়ার ওপরে ভিত্তি করে তৈরি। এই সময় ফাইনম্যানের ক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু বোঝা গেল। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন, বলা যায়। গ্লেইক লিখেছেন, ‘তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ফাইনম্যানের যে দক্ষতা, সে রকম দক্ষতা আইনস্টাইন, ডিরাক বা লেভ লাউন্দাউয়ের মতো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কারো মধ্যে ছিল না।’
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ফাইনম্যানের যে দক্ষতা, সে রকম দক্ষতা আইনস্টাইন, ডিরাক বা লেভ লাউন্দাউয়ের মতো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কারো মধ্যে ছিল না।—জেমস গ্লেইক, লেখক
থিসিস নিয়ে গবেষণার শেষ বর্ষে ছিলেন তিনি। ঠিক এ সময় এল ম্যানহাটান প্রকল্পে কাজ করার প্রস্তাব। প্রথমে একবাক্যে না করে দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘থিসিসের কাজে আবারো ফিরে গেলাম। তিন মিনিট এ নিয়ে ভাববার পরেই আমার চিন্তা অন্যদিকে ঘুরে গেল। হিটলারের নৃশংসতা ততদিনে পৃথিবী দেখে ফেলেছে। সে যদি আমাদের আগে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে কী হবে, সেটা ভাবতে গিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।’
এভাবে ফাইনম্যান যোগ দিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টে। তাঁর মূল গবেষণার বিষয় ছিল, কীভাবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকে ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে আলাদা করা যায়। ওদিকে হুইলার তখন শিকাগো চলে গেছেন। ফার্মির সঙ্গে মিলে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বানানোর কাজ শুরু করেছেন। হুইলারের অনুপস্থিতিতে ফাইনম্যানের থিসিসের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ইউজিন উইগনার। তিনি ফাইনম্যানকে বললেন থিসিস পেপারটা লিখে ফেলতে। পেপার লেখা শেষ হলে উইগনার নিজেই পেপারটা দেখে দিলেন। এর মাধ্যমে ১৯৪২ সালে রিচার্ড ফাইনম্যানের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন হলো।
৩.
প্রেমিকা আরলিন গ্রিনবমের টিউবার্কিউলোসিস ধরা পড়ল এ সময়। যখন পরিবারের সমর্থন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন পাননি একটুও। সবার অমতে, পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আরলিনকে বিয়ে করেন ফাইনম্যান। এ সময়ে সেখানে তাঁর পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না। ব্যক্তি ফাইনম্যান দৃঢ়তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায় এ থেকে।
১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখার আগেই আরলিন মারা যান। ফাইনম্যান আবারো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজ বলতে, এ সময় তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। গবেষণা বাদ দিয়ে সেটা নিয়েই দিন কাটাতে থাকেন তিনি।
প্রায় বছর পাঁচেক শিক্ষকতা ছাড়া তেমন কোনো কাজ করেননি। তারপরেই আগের সেই তাড়নাটা ফিরে এল। গবেষণা করতে হবে। এ সময়, ১৯৫০ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া ইরস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেকে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। সেখানেই তিনি বাকি কর্মজীবন কাটিয়েছেন। এখানে থাকতেই একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ ফ্রেশম্যান ও সফোমরদের পদার্থবিজ্ঞান শেখানোর দায়িত্ব নেন তিনি। ঠিক করলেন, প্রচলিত ধারার লেকচার দেবেন না। অগ্রসর শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার মতো করে সাজানো হলো লেকচারগুলো। অথচ শুরু থেকে যাঁরা শিখছেন, তাঁরাও অনায়াসে ঢুকে যেতে পারবেন বিষয়ের গভীরে। সেই লেকচারেরই লিখিত সংস্করণ হিসেবে পরে প্রকাশিত হয় দ্য ফাইনম্যান লেকচারস অব ফিজিকস। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন এ বইয়ের গুরুত্ব।
এ সময় তিনি আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর মূল অবদানও এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতেই। আরও ঠিক করে বললে, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসে। নতুন একধরনের ডায়াগ্রামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আমাদের। তাঁর নামে এই ডায়াগ্রামের নাম দেওয়া হয়েছে ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম। সিস্টেম বা ব্যবস্থার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াশীল কণাদের আচরণ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে এই ডায়াগ্রাম ব্যবহার করা হয়।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসে চমৎকার অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন রিচার্ড ফাইনম্যান।
৪.
কণাপদার্থবিজ্ঞানে আরও বেশ কিছু কাজ করেছেন তিনি। যেমন কণাদের স্পিন নিয়ে কাজ করেছেন। “দ্য থিওরি অব পার্টন’স” নামে একটা তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন ফাইনম্যান। এই মডেলটি হ্যাড্রন (প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) কণাদের নিয়ে কাজ করে। কণাপদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান গবেষণাগুলোতে তাঁর এই মডেল দারুণ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
১৯৭৯ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। পাকস্থলিতে ক্যানসার ধরা পড়লে সেটার অপারেশন করান তিনি। সফল হয়েছিল অপারেশনটা। ততদিনে ফাইনম্যান রকস্টারের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের বক্তৃতা বা লেকচারগুলোর সংকলন বের হওয়ার পরে অবিশ্বাস্য পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর এ খ্যাতি পরিপূর্ণতা পায় স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনার তদন্তের মাধ্যমে।
১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জারে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে। উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয় নভোযানটি। এ নভোযানে ছিলেন সাত নভোচারী। তাঁদের সবাই মারা যান। এ ঘটনার তদন্তের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়, তাতে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী হিসেবে ছিলেন ফাইনম্যান। তবে সরকারি কাজ বলেই এতে তিনি উৎসাহী ছিলেন না। তার ওপরে ক্যানসারের সমস্যাটা তো ছিলই। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন, কমিটির সদস্যদের সঙ্গে তাঁর মত না মিললেও নিজের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করবেন তিনি। তা ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য এ ধরনের তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট প্রকাশ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। ফাইনম্যানের আশঙ্কা ভুল ছিল না। ১৯৮৬ সালের ৯ জুন প্রথম প্রেসিডেন্টকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়, তাতে ফাইনম্যানের অভিযোগগুলো জায়গা পায়নি। পরে অবশ্য রিপোর্টে তাঁর অভিযোগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘অ্যাপেনডিক্স এফ’-এ।
রকেটের মোটর সেফটিতে যে রবারের ও-রিং ছিল, প্রচন্ড ঠান্ডায় সেই রবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফাইনম্যান সাংবাদিকদের সামনে একটুকরো রবার বরফ-পানিতে ডুবিয়ে দেখিয়েছিলেন, তাপমাত্রা ভীষণ কমে গেলে কীভাবে রবারের কার্যকারিতা কমে যায়
এ সময় ফাইনম্যান নিজের রিপোর্টও প্রকাশ করেন। এ বিষয়টি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটির শিক্ষক ও গবেষক প্রদীপ দেব এক লেখায় লিখেছেন, ‘তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ন্যাশনাল টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে ছোট্ট পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, কী ঘটেছিল আসলে। রকেটের মোটর সেফটিতে যে রবারের ও-রিং ছিল, প্রচন্ড ঠান্ডায় সেই রবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফাইনম্যান সাংবাদিকদের সামনে একটুকরো রবার বরফ-পানিতে ডুবিয়ে দেখিয়েছিলেন, তাপমাত্রা ভীষণ কমে গেলে কীভাবে রবারের কার্যকারিতা কমে যায়। ফাইনম্যান সেই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন।’
এ ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর মারা যান রিচার্ড ফাইনম্যান। ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ৬৯ বছর বয়সে ক্যানসারে ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
একজীবনে তিনি দারুণ সব স্বীকৃতি পেয়েছেন নিজের কাজের জন্য। নোবেল পুরস্কারের কথা তো আগেই বলেছি। এ ছাড়াও আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এবং রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের স্বীকৃতি উল্লেখযোগ্য।
তাঁর বিখ্যাত সব বইয়ের তালিকায় আছে দ্য ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিকস, এর মধ্য থেকে বাছাইকৃত ছয়টি করে অধ্যায় নিয়ে প্রকাশিত সিক্স ইজি পিসেস ও সিক্স নট সো ইজি পিসেস, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস, কিউইডি: দ্য স্ট্রেঞ্জ থিওরি অব লাইট অ্যান্ড ম্যাটার, মিনিং অব ইট অল ইত্যাদি।
৫.
এ লেখায় শুধু ভালো ভালো কথাই লেখা হলো। তবে ফাইনম্যান নিজের দোষত্রুটির ব্যাপারেও ছিলেন স্পষ্টবাদী। পদার্থবিদ্যার যেসব বিষয় বুঝতেন না, স্বীকার করে নিতেন সরাসরি। দ্বিচারিতা তাঁর মধ্যে ছিল না। একইরকম স্পষ্টভাবে, নিজের অনেক দোষত্রুটির কথা খোলাখুলি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী শিউরলি ইউ আর জোকিং, মি. ফাইনম্যান বইতে।
এ সব দোষের কোনোটি নিয়ে আলাদা করে লিখতে চাই না। লেখার আলোচ্য বিষয় সীমাবদ্ধ থাকুক তাঁর কাজের মধ্যেই। তবু এটুকু বলতেই হয়, দোষে-গুণেই মানুষ। তবে মানুষ তাঁকে পদার্থবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবেই মূলত মনে রেখেছে।
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে রিচার্ড ফাইনম্যান এক অমর নক্ষত্র। বিজ্ঞানের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে যুগ যুগ ধরে।