ধরুন, আপনি আয়েশ করে শুয়ে আছেন খাটে, খেলা দেখছেন। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার টি-২০ ম্যাচ। দারুণ জমে উঠেছে খেলা। বন্ধুকে জানাতে চান বিষয়টা। জানাতে হলে মোবাইলটা লাগবে। কিন্তু মোবাইল রয়েছে খাট থেকে বেশ খানিকটা দূরে টেবিলের ওপর। উঠতেও ইচ্ছা করছে না। আপনি হাত বাড়ালেন টেবিলের দিকে। হুট করে মোবাইলটা হাতে চলে এলো। কেমন হতো এরকম হলে?
শারীরিক শক্তি খরচ না করে কোনো কিছু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো গেলে দারুণ হতো না? বিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের ক্ষমতাকে বলে টেলিকাইনেসিস। দুটি গ্রিক শব্দ, ‘টেলি’ ও ‘কাইনেসিস’ নিয়ে এ শব্দটি গঠিত। টেলি মানে দূরবর্তী, আর কাইনেসিস মানে নড়াচড়া। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের ভাষায় কোনো ব্যক্তির শারীরিক শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই কোনো পদার্থের আকার, আকৃতি বা অবস্থা পরিবর্তন করতে পারাই টেলিকাইনেসিস। মানে, শুধু মানসিক শক্তি দিয়ে বস্তুর অবস্থা পরিবর্তন করার নামই টেলিকাইনেসিস। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রাশিয়ান লেখক ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষক আলেকজান্দার অ্যাক্সাকভ (Alexandar Aksakov)।
মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ‘ছদ্মবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের অফার’-এর তালিকায় টেলিকাইনেসিসকে অন্তর্ভূক্ত করেন। তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া টেলিকাইনেসিসকে গ্রহণ করা বোকামি। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেটস ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল অস্বাভাবিক বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গবেষণার জন্য একটি দল গঠন করে। এ সময় দলটি ১৩০ বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাস পর্যালোচনা করেও টেলিকাইনেসিসের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি।
পদার্থবিজ্ঞানের মতে, মস্তিষ্কের তরঙ্গ কোনো পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে না। কেননা, এটি আমাদের মাথার খুলির বাইরের কোনো কিছুকে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ ছাড়াও টেলিকাইনেসিস শক্তির নিত্যতার সূত্রের লঙ্ঘন করে। আমরা জানি, শক্তির কোনো সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। মহাবিশ্বের শুরুতে যে শক্তি ছিল, আজও তা-ই আছে। আমরা খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তি অর্জন করি। সেটা ব্যয় করে বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন করি। কিন্তু যদি মানসিক শক্তি ব্যবহার করে কোনো বস্তুকে সরানো হয়, তাহলে সেটির অবস্থান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি কোথা থেকে এল? আইজ্যাক নিউটনের গতির সূত্রানুসারে, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে চলতে থাকে। আর স্থির বস্তু সবসময় স্থির থাকে।
যাহোক, এখনও অনেকে টেলিকাইনেসিসে বিশ্বাস করেন। এ বিষয়ে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে ১ হাজার ৭২১ জন সাধারণ মানুষকে ফোন ও ইমেইল করে টেলিকাইনেসিসে বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২৮ শতাংশ পুরুষ ও ৩১ শতাংশ নারী টেলিকাইনিসিসে বিশ্বাসের কথা জানান! এ ছাড়াও অনেকে দাবি করে বলেন, তাঁদের নিজের টেলিকাইনেটিক ক্ষমতা আছে। অনেকে শুধু তাকিয়ে থেকে চামচ বাঁকিয়ে ফেলার পেছনে টেলিকাইনেসিস কাজ করে বলে বিশ্বাস করেন। যদিও এতে টেলিকাইনিসিসের কিছু নেই। এটা শুধু বিজ্ঞান ও হাত সাফাইয়ের খেলা। ব্রিটিশ জাদুকর ইউরি গেলার (Uri Geller) তাঁর চামচ বাঁকানোর জাদু দেখানোর জন্য বিখ্যাত।
বর্তমানে হলিউডের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে টেলিকাইনেসিসের দেখা মেলে। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ক্যারি সিনেমার মূল চরিত্র ক্যারিকে দেখানো হয় টেলিকাইনেটিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। এ ছাড়াও নেটফ্লিক্সের ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ সিরিজেও টেলিকাইনেসিসের দেখা মেলে।
তবে এখন পর্যন্ত কেউ সত্যিকার টেলিকাইনেটিক ক্ষমতা দেখাতে পারেননি। বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে জাদুকরদের সব কৌশলের ব্যাখ্যা দেওয়া আজ সম্ভব। তাই যারা নিজেদের টেলিকাইনেটিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দাবি করেছেন, তাঁদের নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে ক্ষমতা দেখাতে বলার পর কেউ আর পারেননি। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা টেলিকাইনেটিক ক্ষমতার অধিকারীদেরর জন্য বড় অঙ্কের টাকা পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু যেকোনো জায়গায় তাঁদের এই ক্ষমতা দেখাতে পারতে হবে। শুধু তাঁদের নিজেদের বাছাই করা পরিবেশে দেখালে হবে না। তাই যদি কারো সত্যিই টেলিকাইনেটিক ক্ষমতা থাকে, তাহলে সহজেই অনেক অর্থের মালিক হতে পারবেন তিনি। এখনও এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক: শিক্ষার্থী, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ঢাকা
সূত্র: উইকিপিডিয়া, গুগল