‘এক হাতে তালি বাজে না’ প্রবাদটি বহুকালের প্রচলিত। এটা শুধু কাব্যিকই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও বেশ যৌক্তিক। বিশ্বাস না হলে নিজেই একটু চেষ্টা করে দেখুন তো এক হাতে তালি বাজাতে পারেন কিনা। নিশ্চয়ই পারছেন না। কিন্তু কেন এক হাতে তালি বাজে না?
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা হাততালি দেওয়ার পেছনের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা খুঁজে বের করেছেন, হাততালি কীভাবে আমাদের উৎপাদিত শব্দকে প্রভাবিত করে? এই গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সানি জাং বলেন, ‘হাততালির মাধ্যমে আমরা আনন্দ, উত্তেজনা, শ্রদ্ধা প্রকাশ করি। ধর্মীয় আচার বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যও হাততালি দিই। ভবিষ্যতে শুধু মানুষের হাততালি শুনে তাকে চেনা যাবে’।
গবেষণায় দেখা যায়, তালুর ফাঁকা জায়গা দিয়ে দ্রুতবেগে বের হওয়া বাতাস চারপাশের বাতাসে ধাক্কা মারলে তালির শব্দ হয়। তালুর ফাঁকা অংশ যত বড়, শব্দের কম্পাঙ্ক তত কম।
সানি জাং একটা মুভি দেখে এ বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হন। ২০০৬ সালে নির্মিত ‘এক্স-মেন: দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড’ মুভির দৃশ্যে আর্কলাইট নামে এক চরিত্র হাততালি দিয়ে শক্তিশালী তরঙ্গ সৃষ্টি করে শত্রুদের অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। দৃশ্যটি দেখার পরই অধ্যাপক জাংয়ের মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে হাততালি দিলে কীভাবে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়?
এরপর সানি জাং গবেষণায় নামেন। তিনি প্রথমেই ১০ জন অংশগ্রহনকারীকে হাততালি দিতে বলেন। এ সময় সেই তালি রেকর্ড করা হয় উন্নতমানের ক্যামেরা ব্যবহার করে। অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্নভাবে হাততালি দেয়। যেমন, দুটি হাত একসঙ্গে করে হালকাভাবে, কখনো হাত শক্ত রেখে অথবা শুধু দুটি আঙুল দিয়ে তালুতে তালি দেওয়ার মাধ্যমে। এমনকি হাতে সামান্য বেবি পাউডার ছিটিয়ে তারা হাততালির ফলে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহ রেকর্ড করেন। গবেষকরা উন্নতমানের ক্যামেরা ব্যবহার করে হাততালির সময় হাতের আকার, আকৃতি, ত্বকের গঠন, উৎপন্ন শব্দ এবং হাতের গতি, চাপ ও বল পর্যবেক্ষণ করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, তালুর ফাঁকা জায়গা দিয়ে দ্রুতবেগে বের হওয়া বাতাস চারপাশের বাতাসে ধাক্কা মারলে তালির শব্দ হয়। তালুর ফাঁকা অংশ যত বড়, শব্দের কম্পাঙ্ক তত কম। মানে দুই হাত কাপের মতো করে তালি দিলে ভারী শব্দ উৎপন্ন হয়। আর একেবারে সোজা হাত বা শুধু আঙুল ঠেকিয়ে তালি দিলে শব্দ হয় হালকা ও তীক্ষ্ণ।
গবেষকরা আরও দেখেন, হাততালির সময় হাতের ভেতরের ফাঁকা জায়গার গঠন এবং বায়ুপ্রবাহের ধরণ অনেকটা হেল্মহোল্টজ রেজোনেটরের মতো। হেল্মহোল্টজ রেজোনেটর হলো এক ধরনের শব্দ উৎপাদনের যন্ত্র। সাধারণত একটা ফাঁপা পাত্র এবং সরু মুখওয়ালা জিনিস দিয়ে এই যন্ত্র তৈরি হয়। আমরা যখন সেই ফাঁপা পাত্রের মুখে ফুঁ দিই, তখন তার ভেতরের বাতাস কাঁপতে থাকে আর এক ধরনের নির্দিষ্ট শব্দ তৈরি হয়। সেই শব্দের উচ্চতা নির্ভর করে পাত্রের ভেতরের ফাঁপা জায়গা আর মুখের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ওপর।
দুটি হাত একসঙ্গে করে হালকাভাবে, কখনো হাত শক্ত রেখে অথবা শুধু দুটি আঙুল দিয়ে তালুতে তালি দেওয়ার মাধ্যমে। এমনকি হাতে সামান্য বেবি পাউডার ছিটিয়ে তারা হাততালির ফলে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহ রেকর্ড করেন।
একটা খালি বোতলের মুখে ফুঁ দিলে দেখবেন শব্দ তৈরি হয়। বোতলে যত বেশি পানি থাকবে, ভেতরের ফাঁকা জায়গা তত ছোট হবে এবং উৎপন্ন শব্দের তীক্ষ্ণতা তত বাড়বে।
প্রত্যেক মানুষের হাতের আকার, তালি দেওয়ার ধরণ, ত্বকের গঠন এবং ত্বকের পুরুত্বে ভিন্নতা রয়েছে। এই সবকিছুই তালির শব্দের ওপর প্রভাব ফেলে। এখন যেহেতু এর পেছনের বিজ্ঞান বোঝা গেছে, তাই ভবিষ্যতে হাততালির শব্দ ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তিকেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
তবে মানুষের শব্দ শোনার জন্য কোনো বস্তুকে সেকেন্ডে কমপক্ষে ২০ থেকে ২০ হাজার বার কম্পন হতে হবে। এক হাত দিয়ে তালি বাজাতে হলে আমাদের হাত বাতাসের মধ্যে সেকেন্ডে ২০ বা এর বেশি বার আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই সেখান থেকে বায়ুতে উৎপন্ন অন্দোলন আমরা শুনতে পাব। কিন্তু এক হাত দিয়ে এটা আসলে অসম্ভব। তাই একহাতে তালি বাজানোর বৃথা চেষ্টা না করাই ভালো।