পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো?

একদিকে অগ্নিতপ্ত উজ্জ্বল চিরস্থায়ী দিন; অন্যদিকে, হিমশীতল অন্ধকার অনন্ত রাত। না, কোনো ভিনগ্রহের গল্প শোনাচ্ছি না। আমাদের চিরচেনা পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো, তার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছি।

আহ্নিক গতি মানে নিজ অক্ষের ওপরে পৃথিবীর ঘূর্ণন। পৃথিবীসহ সৌরজগতের ৮টি গ্রহ তো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছেই। সেই সঙ্গে সবগুলো গ্রহ নিজেদের অক্ষের ওপরও ঘুরছে লাটিমের মতো। কিন্তু কেমন হতো, যদি পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপরে স্থির থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করত? পৃথিবীর প্রাণ বৈচিত্র্যে কি পরিবর্তন আসত? আদৌ কি প্রাণ টিকে থাকতে পারত পৃথিবীতে?

পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘন্টায় নিজ অক্ষের ওপরে একবার ঘুরছে। আর সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করছে ৩৬৫ দিনে। নিজ অক্ষের ওপরে পৃথিবীর ঘুর্ণনের কারণেই দিন আসে, নামে রাত। দেখতে পাই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। ঋতুর পালাবদল আসে পৃথিবীতে।

আরও পড়ুন

পৃথিবীর এই ঘূর্ণন না হলে বছরের অর্ধেকটা সময় থাকত দিন, বাকি অর্ধেকটা রাত। বিষয়টা যে ঝামেলার, তা আর বলতে! এমনটা মহাবিশ্বে সাধারণত হয় না। সামান্য হলেও বস্তু তার নিজ অক্ষের ওপরে ঘূর্ণায়মান থাকে। এর কাছাকাছি যে বিষয়টি হয়, তার নাম ‘টাইডাল লকিং’। আহ্নিক গতি না থাকলে যতটা সমস্যা হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা হতো পৃথিবী যদি সূর্যের সঙ্গে ‘টাইডালি লকড’ অবস্থায় থাকত। কোনো বস্তুর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি যখন সমান হয়, তখন ওই বস্তুটি কেন্দ্রে থাকা বস্তুর সঙ্গে ‘টাইডালি লকড’ অবস্থায় থাকে। যেমনটা চাঁদের বেলায় আমরা দেখি।

চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যতটা সময় নেয়, ঠিক ততটাই সময় নেয় নিজ অক্ষের ওপর একবার নিজের ঘূর্ণনটা সেরে নিতে। ফলে আমরা পৃথিবী থেকে সবসময় চাঁদের একটি পিঠ দেখতে পাই। অন্য পিঠটা ঢাকা থাকা নিকশ আঁধারে। এবার পৃথিবীর কথায় আবার ফেরা যাক।

পৃথিবী সূর্যের সঙ্গে টাইডালি লকড অবস্থায় থাকলে পৃথিবীর অর্ধেকটা সবসময় সূর্যের দিকে থাকত। বাকি অর্ধেকটা থাকত অন্ধকারে। এর মানে হলো, পৃথিবীর অর্ধেকে থাকত চিরস্থায়ী দিন, অন্যদিকে থাকতো আঁধারে ঢাকা সীমাহীন রাত। সেক্ষেত্রে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হতো এই দিন ও রাতের মধ্যবর্তী স্থানে। আসুন, অদ্ভুত সেই পৃথিবী থেকে একবার ঘুরে আসি।

আরও পড়ুন

আলো-আঁধার, অর্থাৎ দিন ও রাতের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলা হয় টার্মিনেটর লাইন। টাইডাল লক অবস্থায় থাকা পৃথিবীর এটাই হতো একমাত্র অঞ্চল, যেখানে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতো। অনেকটা সৌরজগতের গোল্ডিলকস জোনের মতো। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, এই টার্মিনেটর লাইনের প্রশস্ততা হতো প্রায় ৬০ কিলোমিটারের মতো। যেমনটা এখন প্রতিদিনই পৃথিবীর নানা জায়গায় হয়। পার্থক্য হতো, সে সময় এই টার্মিনেটর লাইনটা হতো স্থির ও চিরস্থায়ী।

যারা ঢাকার জনসংখ্যার ভীড় দেখে আঁতকে ওঠেন, তারা ওই জায়গায় মানুষের ভীড় কেমন হতো, তা হয়তো কল্পনা করতে পারছেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর পৃথিবীর পরিধি প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। সবমিলিয়ে, প্রায় ২৪ লাখ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ১৬টা বাংলাদেশের সমান। এটুকু জায়গায় পৃথিবীর সব মানুষের বাসস্থান, কর্মস্থল, বিনোদন কেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র চিকিৎসা কেন্দ্র সবকিছু। আর হ্যাঁ, পুরো জায়গাটা সমতল ভুমি হলেই কেবল পুরোটুকু ব্যবহার করা যাবে। মাঝে সমুদ্র বা পাহাড় থাকলে জায়গা যাবে কমে।

এই অল্প জায়গার বাইরে গ্রহের অন্য কোনো জায়গা বসবাস উপযোগী হবে কি না, তা নির্ভর করবে বায়ুমণ্ডলের তাপ পরিবহন ক্ষমতার ওপর। যদি দুই গোলার্ধেই যথেষ্ট শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ থাকে, তবে একদিক থেকে গরম বাতাস আর অন্যদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস চলাচল করতে পারে। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এখনকার মতো হলে, কিছু মেঘ দেখা দিতে পারে দিনের আকাশেও। সেক্ষেত্রে কিছুটা তাপমাত্রা কমত এ অংশে। অনেকটা এখনকার ক্রান্তীয় অঞ্চলের মতো তাপমাত্রা বিরাজ করত এই পুরোটা গোলার্ধে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

মানুষের জীবন ধারণ করা বেশ চ্যালঞ্জিং হতো টাইডালি লকড পৃথিবীতে। তাপমাত্রার সামান্য পার্থক্যের কারণেই বায়ুমণ্ডলীয় চাপে বড় পরিবর্তন হয়। ফলাফল, ঘূর্ণিঝড়, হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ। বৈরি সেই পৃথিবীতে এখনকার চেয়ে শত শত গুণ শক্তিশালী ঝড় দেখা যেত হরহামেশাই।

বেঁচে থাকার জন্য সেই পৃথিবীতে যে জিনিসটি পাওয়া সবচেয়ে কঠিন হতো, তা হচ্ছে সুপেয় তরল পানি। খুব সৌভাগ্যবান হলে দিনের দিকটার কিছু অংশে হয়তো পাওয়া যেত তরল পানি। কিন্তু সেটা যথেষ্ট হতো না। অন্যদিকে অন্ধকার আকাশের নিচে তাপমাত্রা না থাকায় সব পানি জমে বরফে রূপ নিত।

দিনের দিকটার বেশিরভাগ পানি বাষ্প হয়ে মিশে যেত বায়ুমণ্ডলে। তারপর বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে এসব পানির কণা এসে ঠাঁই নিত কম তাপমাত্রার অঞ্চল, অর্থাৎ রাতের অংশে। পরে আবার ফিরে আসত দিনের অংশে। বায়ু ও পানি প্রবাহের অদ্ভুত এক চক্র চলত পৃথিবীজুড়ে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পানির জন্য হয়তো অন্ধকার অংশে স্থাপন করতে হতো ফ্যাক্টরি, সেটা উজ্জ্বল অংশের তাপ ব্যবহার করে বরফ গলিয়ে সরবরাহ করত তরল পানি। অথবা দিনের দিকটা থেকে জলীয়বাষ্পের মেঘ ধরে সেটাকে তরল পানিতে পরিণত করার যেত।

অদ্ভুত সেই পৃথিবীতে যে জিনিসটা মানুষের হাতে পর্যাপ্ত থাকত, সেটা সূর্যের আলো। সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতার উন্নয়ন করা তুলনামূলক সহজ হতো। তবে এই সৌরশক্তিকে ধরতে হলে সৌরকোষগুলোর প্রচুর তাপশক্তি সহ্য করার ক্ষমতা প্রয়োজন। সেভাবেই তৈরি করতে হতো ওগুলোকে। সেটা কতটা সম্ভব হতো, তা প্রযুক্তিগত প্রশ্ন। আজ সে আলোচনা থাকুক। প্রসঙ্গে ফিরি।

দিনের অংশে সর্বনিম্ন প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করত। সঙ্গে থাকত ধুলিময় বাতাস। ফলে সৌর প্যানেলের কর্মক্ষমতা নেমে আসত প্রায় ৫০% শতাংশে। তবে এই উচ্চ তাপমাত্রা কাজে লাগিয়ে আরেকভাবেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। যাকে বলে থার্মোইলেকট্রিক প্রযুক্তি। যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হোক না কেন, তা দিয়ে ভারী কাজ করা হতো কঠিন।

চরম আবহাওয়ার পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকতে পারলেও মারাত্মক সমস্যা হতো প্রাণী এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের জীবন ধারণে। জীবজগৎ হয়তো এখানকার এত বৈচিত্রময় হতো না।

এ ছাড়া পৃথিবীর উজ্জ্বল অংশে সূর্য ছাড়া অন্যকোনো মহাজাগতিক বস্তু দেখা সম্ভব হতো না। ফলে, মহাকাশ নিয়ে মানুষের কৌতুল কতটা তৈরি হতো, সে আরেক প্রশ্ন। দার্শনিক প্রশ্ন। ওতে আর না যাই আপাতত।

মোটের ওপর পৃথিবী সূর্যের সঙ্গে টাইডালি লকড অবস্থায় থাকলে, অর্থাৎ পৃথিবীর আহ্নিক গতি অনেক কম হলে জীবন টিকে থাকতে পারত। ভূ-পৃষ্টে জীবন ধারণ কষ্ট হলে বাস করা যেত ভূ-গর্ভেও। এমনটাই মনে করেন অনেকে। জীবন ও প্রকৃতি সেক্ষেত্রে হতো পুরোপুরি ভিন্ন।

এবার কল্পনা করুন তো, আহ্নিক গতি না থাকা বা কম হওয়ার চেয়ে যদি অনেক বেশি হতো, সেক্ষেত্রে কী হতো? এমন যদি হতো'র পরের কোনো পর্বের জন্য তোলা রইল সেই গল্পটা। তার আগে, আপাতত ভাবতে থাকুন। দেখুন তো, ভেবে আসলেই বের করতে পারেন কি না!

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াট ইফ শো ডট কম, উইকিপিডিয়া