গ্লু থেকে গ্লুয়ন

আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের মাঝখানে সুতা বা রাবার ব্যান্ডের মতো গ্লুয়ন, বেঁধে রেখেছে কণাগুলোকে একসঙ্গে

প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী পারমাণবিক বল। ইংরেজিতে, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স। বাংলায় একে সবল পারমাণবিক বল বা শক্তিশালী বলও বলা হয়। কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী, এই বলের বাহক কণার নাম গ্লুয়ন (Gluon)। প্রোটন ও নিউট্রন নামের হ্যাড্রন কণা তৈরি হয় তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে। কিন্তু কোয়ার্ক কণাদের প্রোটন বা নিউট্রনের ভেতরে বেঁধে রাখে কে? উত্তর, গ্লুয়ন কণা। বিজ্ঞানীদের মতে, এই কোয়ার্ক কণাদের মধ্যে গ্লুয়ন বিনিময় হওয়ার কারণে তারা পরস্পর শক্ত আঠার মতো একত্রে লেগে থাকে।

গ্লুয়ন একটি মৌলিক ও বোসন কণা। বৈদ্যুতিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ। তবে এরা কালার চার্জ বহন করে (অবশ্য এর সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত কালার বা রংয়ের কিংবা চার্জের কোনো সম্পর্ক নেই।)। এদের ভরহীন কণা মনে করা হয়। শূন্যস্থানে ছুটতে পারে আলোর গতিতে। এদের ক্ষয় নেই। কাজেই গ্লুয়নকে স্থিতিশীল মনে করা হয়। কোয়ার্কের সংখ্যা ছয় হলেও গ্লুয়ন আট ধরনের। এদের স্পিন ১।

গ্লুওনই বেঁধে রেখেছে আমাদের; বেঁধে রেখেছে গোটা বিশ্বকে, কারণ পরমাণুর মূল কণার ভেতরে তাদের বন্ধনেই আটকে থাকে কোয়ার্করা
ছবি: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

১৯৬২ সালের দিকে এক দঙ্গল মৌলিক কণা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা। এসব কণাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল পরস্পর সম্পর্কহীন। বিভিন্ন কণার এই দঙ্গলকে কোয়ার্ক মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন মার্কিন বিজ্ঞানী মারে গেল-মান। তাতে বিশৃঙ্খলাহীন কণার জঙ্গল হয়ে উঠল সুশ্রী। এ সময় মারে গেল-মান কোয়ার্ক কণাদের একত্রে আটকে রাখা বলবাহী কণার নামকরণ করেন গ্লুয়ন। শব্দটি নেওয়া হয়েছে ইংরেজি শব্দ গ্লু (Glue) থেকে, যার অর্থ আঠা। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অতিপারমাণবিক কণা বা কোয়ার্ক কণাদের এরা গ্লু বা আঠার মতো আটকে রাখে বলেই এমন নাম। অবশ্য ইংরেজি গ্লু শব্দটির আদি উৎপত্তি ফরাসি শব্দ গ্লু (glu) এবং লাতিন গ্লুটেন (gluten) থেকে। গমের মতো শস্যদানার নাইট্রোজেন বা প্রোটিনসমৃদ্ধ আঠালো অংশকে বলা হয় গ্লুটেন। গ্লুটেনও খাদ্যকণার বিভিন্ন অংশ একত্রে আটকে রাখে। তবে কণাপদার্থবিজ্ঞানের গ্লুয়ন কণার সঙ্গে ওই গ্লুটেনের কোনো সম্পর্ক নেই।

১৯৭২ সালে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস গড়ে তোলেন মারে গেল-মান এবং জার্মান পদার্থবিদ হ্যারল্ড ফ্রিটজ। ক্রোমোডাইনামিকস হলো শক্তিশালী বলের তত্ত্ব। তত্ত্বটি এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে বলটি ব্যাখ্যা করতে পারছে। দুটি বৈদ্যুতিক চার্জের মধ্যে বৈদ্যুতিক বল যেভাবে কাজ করে, কালার চার্জের মধ্যেও একইভাবে কাজ করে শক্তিশালী বল। এখানে বিশেষ ব্যাপার হলো, গ্লুয়ন কণাদেরও কালার চার্জ আছে। ফলে একটা গ্লুয়ন আরেকটা গ্লুয়নের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। এটাই পুরো বিষয়টিকে জটিল করে তোলে।

প্রোটন ও নিউট্রন যে কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, সেই কোয়ার্কগুলোকে একসঙ্গে ধরে রাখে গ্লুওন

বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের বাহক যেমন ফোটন, তেমনি সবল বলের বাহক গ্লুয়ন। ইলেকট্রন যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের উৎস হিসেব কাজ করে, তেমনি কোয়ার্ক কাজ করে গ্লুয়ন ক্ষেত্রের উৎস হিসেবে। তবে এই দুইয়ের মধ্যে গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও আছে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ে বৃত্তাকারভাবে। অন্যদিকে একটা কোয়ার্ক সুতার মতো একটা পাতলা ফ্লাস্ক টিউব তৈরি করে, যা অন্য আরেকটি ভিন্ন ধরনের কোয়ার্কে গিয়ে শেষ হয়। এসব বিষয় ঘিরেই গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস বা কিউসিডি (QCD)।

জানেন হয়তো, চারটি মৌলিক বলের মধ্যে শক্তিশালী বলই সবচেয়ে শক্তিশালী। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়ে এটি প্রায় ১০০ গুণ শক্তিশালী। অন্যদিকে মহাকর্ষ বলের চেয়ে এর শক্তি প্রায়  ১০৩৮ গুণ বেশি। আগেই বলেছি, এ বলকে গ্লুয়ন কণার বিনিময় হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে অন্যদের চেয়ে এর আলাদা ও বিশেষ এক ধর্ম আছে। মহাকর্ষ ও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দূরত্ব বাড়লে বলের পরিমাণ কমে। কিন্তু শক্তিশালী বল এ ব্যাপারে উল্টো। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোয়ার্ক কণাদের মধ্যে দূরত্ব যত বেশি হয়, এ বলও তত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিষয়টা আজব বলে মনে হলেও এটাই সত্যি।

প্রকৃতির অন্য মৌলিক বলগুলো এরকম নয়। অন্যদের ক্ষেত্রে দূরত্ব বাড়লে বলের শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। গ্লুয়ন তথা শক্তিশালী বলের ব্যাপারটা রাবার ব্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। রাবার ব্যান্ড টেনে যত লম্বা করা হয় বা টেনে দূরে নেওয়া হয়, তার মধ্যে তত বেশি শক্তি জমা হয়। একইভাবে দুটি কোয়ার্ককে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের মাঝখানের শক্তি হঠাৎ এত বেড়ে যায় যে তাতে নতুন একটা কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্ক জোড়া তৈরি হয়। এভাবে একজোড়া কণা থেকে দুই জোড়া কণা তৈরি হয়। এ কারণে প্রকৃতিতে নিঃসঙ্গ কোয়ার্ক পাওয়া যায় না। এরা সবসময় জোড় বেঁধে থাকে। তাই শক্তিশালী বল শুধু স্বল্প দূরত্বে কাজ করে। অর্থাৎ অতিপারমাণবিক পরিসরে।

এভাবেই গ্লুওন (সুতা বা স্পিংয়ের মতো দেখাচ্ছে ছবিতে) বেঁধে রেখেছে কোয়ার্কদের (ছবিতে গোলাকৃতির দেখানো হয়েছে)
আরও পড়ুন

বুঝতেই পারছেন, গ্লুয়নের কাজ-কারবার পরমাণুর গভীরে, নিউক্লিয়াসে। প্রোটন ও নিউট্রন কণার মধ্যে কোয়ার্ক কণাদের একত্রে ধরে রাখে গ্লুয়ন। দুটি আপ ও একটি ডাউন কোয়ার্কে গঠিত হয় প্রোটন। আর দুটি ডাউন কোয়ার্ক এবং একটি আপ কোয়ার্ক মিলে গঠিত হয় নিউট্রন। অতিপারমাণবিক কণার গভীরে গ্লুয়নের কাজ-কারবার নিয়ে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদেরা। তাতে তাঁরা দেখেছেন, প্রোটন বা নিউট্রনের ভেতরে খুব অস্থিতিশীল বা উত্তাল অবস্থা। এ ধরনের বুদবুদের স্যুপের ভেতর গ্লুয়ন ও কোয়ার্ক অ্যান্টিকোয়ার্ক যুগল অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রোটনের ভেতরের এই অস্থিরতা দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্কের মতো আচরণ করে। এটাই প্রোটনের গাঠনিক একক।

গ্লুয়ন কণা প্রথম শনাক্ত করা হয় ১৯৭৯ সালে। কাজটি করা হয়েছিল সে কালের সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সিলেটরে পেট্রাতে (PETRA—Positron–Electron Tandem Ring Accelerator)। জার্মানির হামবুর্গ শহরে অবস্থিত এ কণাত্বরক যন্ত্রে ইলেকট্রন ও অ্যান্টিইলেকট্রন উচ্চ শক্তিতে ত্বারিত করে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটানো হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় একগুচ্ছ নতুন কণা তৈরি হয়। কণাগুলো প্রায়ই তিনটি একত্রে গুচ্ছবদ্ধ অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। একে বলা হয় থ্রি জেট ইভেন্ট। এই তিনটি কণার জেটকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যদি ধরে নেওয়া হয় সেগুলোর উৎপত্তি আসলে দুটি কোয়ার্ক এবং একটি গ্লুয়ন থেকে। এভাবেই কোয়ার্ক ও গ্লুয়ন কণা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।

কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা
আরও পড়ুন

এরপর সুইজারল্যান্ডের জেনেভার কাছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সিলেটর এলএইচসিতে গ্লুয়ন নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সেখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পরের কিছু মুহূর্তের মতো অবস্থা। তা তৈরি করতে ভারী সিসার নিউক্লিয়াসকে অতি উচ্চ গতিতে ত্বারিত করে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটানো হয়েছে। ফলাফল হিসেবে পাওয়া গেছে অতি উচ্চশক্তির কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের মিশ্রণ। একে বলা হয় কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিস্ফোরণের অতি অল্প সময় পর মহাবিশ্বে অতি উচ্চতাপমাত্রায় এরকম পদার্থ বিরাজ করছিল। আদিম এই কসমিক স্যুপ শীতল হওয়ার পর কোয়ার্ক কণা গ্লুয়নের কারণে একত্রিত হয়ে প্রোটন ও নিউট্রন তৈরি করে। এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের বস্তুজগৎ, আমি, আপনি এবং চারপাশের সবকিছু। কাজেই গ্লুয়ন কণার ভূমিকা বুঝতেই পারছেন।

সূত্র:

পার্টিকেল ফিজিকস: আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন/ ফ্রাঙ্ক ক্লোজ

হাউ টু ফাইন্ড আ হিগস বোসন/ ইভো ভ্যান ভালপেন

কোয়ার্কি কোয়ার্ক/ বেনজামিন বার এবং বোরিস লেমার, রিনা পিকোলো

উইকিপিডিয়া