পৃথিবীতে চৌম্বক মেরু তৈরি হলো কীভাবে

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়েছে জিওডায়নামো প্রক্রিয়ায়ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, মঙ্গলে ঘুরতে গেছেন। চারিদিকে ধূ ধূ মরুভূমি। হাঁটতে হাঁটতে দিক ভুলে গেছেন। দিক চেনার জন্য ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা কম্পাস। কিন্তু একি? কম্পাস তো কাজ করছে না! মঙ্গলে রওনা দেওয়ার আগে তো পৃথিবীতে দিব্যি কাজ করছিল। তাহলে এখন কেন কাজ করছে না? 

আসলে মঙ্গলে কম্পাস কাজ করার কথাও না। কারণ মঙ্গলে কোনো চৌম্বক মেরু নেই। তবে পৃথিবীতে আছে। তাই পৃথিবীতে কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্ণয় করা যায়। প্রশ্ন হলো, পৃথিবীতে এই চৌম্বক মেরু রয়েছে কেন?

সৌরজগতের চারটি পাথুরে গ্রহের একটি পৃথিবী। তবে কিছু বিশেষ কারণে পৃথিবী সৌরজগতের একটি অনন্য গ্রহ। যেমন এখানে শ্বাস নেওয়ার মতো বায়ুমণ্ডল আছে। পৃষ্ঠে আছে তরল পানি। সবচেয়ে বড় কথা, এটাই সৌরজগতের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ। অর্থাৎ এটা রয়েছে সূর্যের তুলনায় বাসযোগ্য অঞ্চলে। এ অঞ্চলকে গোল্ডিলকস অঞ্চলও বলা হয়। মানে, সূর্য থেকে পৃথিবী যে দূরত্বে আছে, তাতে এর সব পানি যেমন জমে যাচ্ছে না, তেমনি বাষ্পীভূতও হয়ে যাচ্ছে না।

সৌরজগতের চারটি পাথুরে গ্রহের একটি পৃথিবী
ছবি: সংগৃহীত

চৌম্বক মেরুর উৎপত্তিস্থল ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে। পৃথিবীর কেন্দ্র দুই ভাগে বিভক্ত। ভেতরে কঠিন কোর বা কেন্দ্র রয়েছে। আর এর বাইরে আছে গলিত ধাতব আবরণ বা স্তর। দুটি স্তরই লোহা ও নিকেলের সমন্বয়ে গঠিত। তবে এর মধ্যে অক্সিজেন, সিলিকন ও সালফারের মতো হালকা মৌলের মিশ্রণও থাকে।

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়েছে জিওডায়নামো প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ কেন্দ্রের বাইরের দিকে থাকা গলিত লোহার ঘূর্ণনের কারণে বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই প্রবাহই তৈরি করে চৌম্বকক্ষেত্র। এই চৌম্বকক্ষেত্র আবার বিদ্যুতের প্রবাহকে সচল রাখে।  এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় জিওডায়নামো বা ভূডায়নামো।

বিজ্ঞানীদের মতে, একটি গ্রহের নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। যেমন—

১) গ্রহটি যথেষ্ট দ্রুত বেগে ঘুরবে,

২) গ্রহটির অভ্যন্তরে অবশ্যই তরল মাধ্যম থাকবে,

৩) তরল মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ক্ষমতা থাকবে,

৪) গ্রহের কেন্দ্রে শক্তির উৎস থাকবে, যা কেন্দ্রের তরল স্রোতকে চালিত করবে। 

পৃথিবীর কেন্দ্র প্রচণ্ড ঘন ও উত্তপ্ত। বিশালাকার উজ্জ্বল মার্বেলের মতো অনেকটা। কিন্তু বাইরের স্তরটি তরল। এটি কঠিন অংশের চারপাশে তার নিজস্ব পরিবাহী স্রোতের সঙ্গে ঘোরে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই ঘূর্ণনই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র শক্তি পায় কেন্দ্রের গলিত লোহা কঠিনীভবনের মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় গলিত লোহা কঠিন লোহায় পরিণত হয়। কোরের শীতলীকরণ ও স্ফটিকীকরণের কারণে আশপাশের তরল লোহাকে আলোড়িত করে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি করেছে। ফলে পৃথিবীর বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত একটি চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।

চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব হতো না। কারণ চৌম্বকক্ষেত্র আমাদের সৌরঝড় থেকে রক্ষা করে। এটি না থাকলে সৌরঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল।

পৃথিবী ছাড়াও বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের চৌম্বকক্ষেত্র আছে। যদিও এগুলোর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। প্রতিরক্ষামূলক চৌম্বকীয় স্তর সব গ্রহে নেই। মঙ্গলে নেই, কারণ এর কেন্দ্রে পর্যাপ্ত উত্তপ্ত তরল নেই। শুক্রের তরল কেন্দ্র আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট দ্রুত ঘোরে না। বুধের চৌম্বকক্ষেত্র আছে, কিন্তু তা পৃথিবীর তুলনায় অত্যন্ত দুর্বল, মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। 

চৌম্বকক্ষেত্র ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব হতো না। কারণ চৌম্বকক্ষেত্র আমাদের সৌরঝড় থেকে রক্ষা করে। এটি না থাকলে সৌরঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। ফলে পৃথিবীতে শ্বাস নেওয়ার মতো বায়ু থাকত না। তবে পৃথিবীর চৌম্বক মেরু স্থির নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মিউজিয়াম গ্রিনউইচের তথ্য অনুসারে, চৌম্বকীয় উত্তর মেরু বছরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যায়। পাশাপাশি পৃথিবীর চৌম্বক মেরু উল্টে যায়। উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুতে এবং দক্ষিণ মেরু উল্টে হয় উত্তর মেরু হয়। প্রতি ২ লাখ বছরে বা আরও বেশি সময়ের ব্যবধানে এ ঘটনা ঘটে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, স্পেস ডট কম।