ইলেকট্রনিক পাঠশালা - ৩
থার্মিস্টরের মৌলিক ধর্ম ও গঠন
সাইকেল চালাতে শিখতে হলে কেবল তত্ত্ব শিখলেই হয় না, সত্যিকারে চালিয়েই শিখতে হয়। একইভাবে ইলেকট্রনিকস শিখতে হলে তত্ত্বের পাশাপাশি হাতে-কলমে সার্কিট তৈরি করতে হয়। সার্কিটের বিভিন্ন বিন্দুতে পরিমাপ করে তত্ত্বের সঙ্গে তার মিল-অমিলের কারণ চিন্তা করে খুঁজে বের করতে হয়। আবার কেবল সার্কিট তৈরিই নয়, কীভাবে তাকে খোলসবন্দী করে অন্য সবার ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, তা-ও শিখতে হয়। নইলে ওই সার্কিট কোনো কাজে আসবে না। এ পাঠশালায় তাই কিছু কাজের সার্কিট বানানো শেখানো হবে। সেই সঙ্গে তার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয় তত্ত্বও ধাপে ধাপে আলোচনা করা হবে। তাতে একসঙ্গে সব কটি দিকই শেখা হয়ে যাবে।
থার্মিস্টরের ভেতরের কথা
গত দুই পর্বে আমরা একটি থার্মিস্টর ব্যবহার করে একটি থার্মোমিটার বানানোর কৌশল ও ক্যালিব্রেট করতে শিখেছিলাম। এ পর্বে আমরা থার্মিস্টরের মৌলিক গঠন, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব। এটি মূলত একটি কঠিন বস্তু ও বিদ্যুৎ পরিবহনের ধর্মে এটি একটি সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী পদার্থ। অর্থাৎ এর বিদ্যুৎ পরিবহনক্ষমতা সুপরিবাহী ধাতু (যেমন তামা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি) থেকে কম, আবার কুপরিবাহী বস্তু (যেমন প্লাস্টিক, শুকনো কাঠ) ইত্যাদি থেকে বেশি। থার্মিস্টরে যাওয়ার আগে কঠিন বস্তুতে কীভাবে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়, তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলো একটির সঙ্গে অপরটি জোরালোভাবে লেগে থাকে। তাই তারা স্থান পরিবর্তন করতে পারে না। পরমাণুগুলোর চারদিকে ঘূর্ণমান ইলেকট্রন থাকে। এখান থেকে কিছু ইলেকট্রনকে যদি যার যার পরমাণুর কক্ষপথ থেকে কোনোভাবে সরিয়ে ফেলা যায়, তবে তা মুক্ত ইলেকট্রন (free electron) হিসেবে এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে লাফ দিয়ে চলাচল করতে পারে। এখন ছবি-১-এর মতো একটি কঠিন বস্তুর দুদিকে দুটি ধাতব পাত লাগিয়ে সে দুটিকে একটি ব্যাটারির দুই প্রান্তের সংযোগ দেওয়া হলে ব্যাটারির ভোল্টেজের কারণে বস্তুটির মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক বলক্ষেত্র (electric field) তৈরি হয়। বৈদ্যুতিক বলক্ষেত্র বলতে আমরা বুঝি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে একটি বৈদ্যুতিক চার্জ রেখে দিলে সেটি কোনো একদিকে নড়ার জন্য একটি বল বা চাপ অনুভব করবে। ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, ব্যাটারির নেগেটিভ প্রান্ত বস্তুটির বাঁদিকে ও পজিটিভ প্রান্ত বস্তুটির ডান দিকে সংযোগ দেওয়া আছে। যেহেতু ইলেকট্রনের ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জ আছে, মুক্ত ইলেকট্রনগুলো এ বলক্ষেত্রের প্রভাবে বস্তুটির বাঁ দিক থেকে ডান দিকে চলতে থাকবে (কারণ নেগেটিভ চার্জ নেগেটিভ প্রান্ত থেকে বিকর্ষিত হবে আর পজিটিভ প্রান্তের দিকে আকর্ষিত হবে)।
এখানে ব্যাটারি মুক্ত ইলেকট্রনের একটি পাম্প হিসেবে কাজ করে। এর পজিটিভ প্রান্ত বাইরে থেকে আসা মুক্ত ইলেকট্রনকে গ্রহণ করে তার নিজের ভেতরে নিয়ে নেয়। আর নিজের ভেতর থেকে ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় নেগেটিভ প্রান্ত দিয়ে। সে ইলেকট্রনগুলো আবার কঠিন বস্তুটির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্তে প্রবেশ করে। এভাবে ব্যাটারিটি ইলেকট্রনের একটি চক্রাকার প্রবাহ সৃষ্টি করে। এ কাজটি করতে ব্যাটারিটি রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে শক্তি নেয়। এখন প্রবাহের পরিমাণ কতটা হবে তা নির্ভর করে ব্যাটারির ভোল্টেজের ওপর। এ ছাড়া বস্তুটির ভেতর সহজে নড়াচড়া করতে পারে এ রকম কতগুলো মুক্ত ইলেকট্রন আছে তার ওপর। যদি সাধারণ অবস্থায় অনেক মুক্ত ইলেকট্রন থাকে, তবে সে বস্তুটিকে আমরা বলব সুপরিবাহী (যেমন তামা, অ্যালুমিনিয়াম)। আর যদি সাধারণ অবস্থায় কোনো মুক্ত ইলেকট্রনই না থাকে, তবে তাকে আমরা বলব কুপরিবাহী (যেমন প্লাস্টিক, শুকনো কাঠ)। এবার বোঝা খুব সহজ, অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে সাধারণ অবস্থায় অল্প কিছু মুক্ত ইলেকট্রন থাকে।
তবে সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রনের অন্য রকমের একটি চলাচল আছে, যার ধর্ম মুক্ত ইলেকট্রনের থেকে ভিন্ন। ছবি-২-এ একটি কেলাসিত সেমিকন্ডাক্টরের (এ ক্ষেত্রে জার্মেনিয়াম) পরমাণুগুলোর সজ্জার একটি সহজ চিত্র দেখানো হয়েছে। এর পরমাণুগুলোকে পাশাপাশি এ ধরনের বিশেষ সজ্জায় ধরে রাখার জন্য এদের ইলেকট্রনগুলো বিশেষ একধরনের আকর্ষণব্যবস্থা তৈরি করে। একে ‘কো-ভ্যালেন্ট বন্ড’ (Co-valent Bond) বলা হয়। সাধারণ তাপমাত্রায় এর কিছু কিছু বন্ড ভেঙে ইলেকট্রন বেরিয়ে মুক্ত ইলেকট্রন হয়ে যেতে পারে। অপর দিকে রেখে যাওয়া খালি জায়গাটি আকর্ষণের একটি বলক্ষেত্র তৈরি করে। ফলে পাশের অন্য কোনো পরমাণু থেকে কখনো একটি ইলেকট্রন তার নিজস্ব বন্ধন বা বন্ড ভেঙে এ খালি জায়গার দখল নিতে পারে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে নতুন ইলেকট্রনটি কিন্তু তার নিজের আগের অবস্থানে একটি খালি জায়গা সৃষ্টি করে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, খালি জায়গাটি স্থান পরিবর্তন করছে বা নড়ছে, যদিও এ ক্ষেত্রে আসলে ইলেকট্রনই কিন্তু উল্টো দিকে নড়ছে। তবে মুক্ত ইলেকট্রন যত সহজে কেলাসিত বস্তুটির ভেতরে চলাচল করতে পারে, পরের ইলেকট্রনটির ক্ষেত্রে কিন্তু সে রকম নয়। পাশে কোথাও বন্ড-ভাঙা খালি জায়গা পেলেই কেবল সে নড়তে পারে। একটি খালি জায়গা থাকার কারণে কেবল এ ধরনের ইলেকট্রন চলাচল হয়। তাই বিদ্যুৎ পরিবহনে এর অবদানকে আলাদা করতে খালি জায়গাটির নড়াচড়া কল্পনা করে একে ‘মুক্ত গর্ত’ (free hole) নাম দেওয়া হয়েছে। খালি জায়গা বা মুক্ত গর্তের নড়ার দিক হচ্ছে ইলেকট্রনের নড়ার দিকের ঠিক উল্টো। তাই কল্পনা করা হয়, যেন মুক্ত হোল একটি পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট কণা। মজার ব্যাপার হলো, এভাবে গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করে সেমিকন্ডাক্টরের ধর্মকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার জন্য এভাবেই তাত্ত্বিক দিকটিকে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে নিজের ভেতরে সব সময় জানতে হবে এটি সম্পূর্ণ একটি কল্পনা, আসলে ‘মুক্ত গর্ত’ বলে কিছু নেই। ইলেকট্রনের একটি ভিন্ন ধর্মীয় নড়াচড়াকে আলাদা করার জন্য এ কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টরের তাপমাত্রা যদি বাড়ানো যায়, তবে তার ভেতরের আরও কো-ভ্যালেন্ট বন্ড ভেঙে মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত গর্ত তৈরি হবে। তাই মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত গর্তের সংখ্যা যত বাড়বে
সেমিকন্ডাক্টরের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহন ক্ষমতা হিসাব করতে হলে ‘মুক্ত ইলেকট্রন’ ও ‘মুক্ত গর্ত’ দুটির সংখ্যাকেই আলাদাভাবে হিসাবের বিবেচনায় নিতে হয়। সাধারণত বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে যতগুলো মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি হবে ঠিক ততগুলো মুক্ত গর্ত থাকবে। কিন্তু কতগুলো বিশেষভাবে তৈরি সেমিকন্ডাক্টরে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য বস্তুর পরমাণু ঢুকিয়ে এ দুটির সংখ্যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অসমান করা যায়। এর বিশেষ অবদান রয়েছে ইলেকট্রনিকসের অবাক করা সব কর্মকাণ্ডে। এ সম্পর্কে পরে যথাযথ সময়ে আলোচনা করা যাবে।
এবার আসি থার্মিস্টরের কার্যকরণের মূল বিষয়টিতে। সেমিকন্ডাক্টরের তাপমাত্রা যদি বাড়ানো যায়, তবে তার ভেতরের আরও কো-ভ্যালেন্ট বন্ড ভেঙে মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত গর্ত তৈরি হবে। তাই মুক্ত ইলেকট্রন ও মুক্ত গর্তের সংখ্যা যত বাড়বে, সেমিকন্ডাক্টরের বৈদ্যুতিক বাধা বা ‘রোধ’ বা ‘রেজিস্ট্যান্স’ তত কমবে। তাপমাত্রার সঙ্গে রেজিস্ট্যান্সের পরিবর্তনের এ ধর্মকে ব্যবহার করেই থার্মিস্টর তৈরি করা হয়েছে। নামটিরও এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তাপ সম্পর্কীয় বিশেষণের ইংরেজি হচ্ছে ‘থার্মাল’। এ শব্দটির প্রথম দুটো অক্ষর আর ‘রেজিস্টর’ (রেজিস্ট্যান্স আছে যার) এর শেষের দুটো অক্ষর মিলিয়ে করা হয়েছে ‘থার্মিস্টর’।
এবার আসি নেগেটিভ বা পজিটিভ টেম্পারেচার কো-অ্যাফিশিয়েন্ট থার্মিস্টরের নামের বিষয়ে। ওপরের ব্যাখ্যায় আমরা দেখেছি যে তাপমাত্রা বাড়লে সেমিকন্ডাক্টরের রেজিস্ট্যান্স কমে যায়। এ কমার ধরনটি সরল নয়, একটি বক্ররেখা দিয়ে একে গ্রাফে দেখানো হয়, আগের পর্বে আমরা দেখেছি। তবে গ্রাফের খুব অল্প অংশকে আমরা যদি সরলরেখা ধরে নিই, তাহলে সে অংশকে বর্ণনা করার জন্য আমরা একটি সহজ সমীকরণ ব্যবহার করতে পারি, যেটি হলো R = R0+ aT। এখানে T হলো পরিমাপের তাপমাত্রা, R হলো T তাপমাত্রায় থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স এবং R0 হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স। ডান দিকের a হলো T-এর সহগ বা কো-অ্যাফিশিয়েন্ট। যেহেতু তাপমাত্রা বাড়লে রেজিস্ট্যান্স কমে, তাই a, অর্থাৎ T-এর কো-অ্যাফিশিয়েন্টের মান ঋণাত্মক বা নেগেটিভ হতে হবে। এখান থেকেই এনটিসি বা নেগেটিভ টেম্পারেচার কো-অ্যাফিশিয়েন্ট থার্মিস্টরের নামটি এসেছে। আমাদের ব্যাখ্যা করা সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরি থার্মিস্টরটি এ জন্য নেগেটিভ টেম্পারেচার কো-অ্যাফিশিয়েন্ট থার্মিস্টর। তবে বিশেষ কিছু জটিল প্রক্রিয়ায় এমন থার্মিস্টর তৈরি করা যায়, যাদের রেজিস্ট্যান্স তাপমাত্রা বাড়লে বাড়ে। এদের পজিটিভ টেম্পারেচার কো-অ্যাফিশিয়েন্ট থার্মিস্টর বলা হয়।