পদার্থবিদ্যা
অদ্ভুতুড়ে দ্বিচিড় পরীক্ষা
পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম অদ্ভুত পরীক্ষার নাম দ্বিচিড় পরীক্ষা। ইংরেজিতে যাকে বলে, ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট। এ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যায় অতিপারমাণবিক কণাদের দ্বৈত কণাতরঙ্গ ধর্মের কথা। বাস্তব বোধ-জ্ঞানের ধার ধারে না অতিপারমাণবিক এই কণারা। যেভাবে বিজ্ঞানীরা তাদের এই অদ্ভুতুড়ে আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন, তার সবিস্তার বিবরণ...
কোয়ান্টাম মেকানিকস বড় অদ্ভুত। বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের ভাষায়, ‘কেউ তাকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে না।’ এর মানে এই নয় যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়মকানুন ব্যবহার করে ক্ষুদ্র কণাদের জগৎ ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং ওপরের উক্তির মাধ্যমে ফাইনম্যান বুঝিয়েছেন, কোয়ান্টাম মেকানিকসের নিয়মকানুনগুলো নিজেরাই চূড়ান্ত রকমের অদ্ভুত। সহজাত বিচারবুদ্ধি দিয়ে তাদের বিচার না করা ভালো। কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুত আচরণ বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণের নাম ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট বা দ্বিচিড় পরীক্ষা। এর মাধ্যমে খুব সহজে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায় চিরচেনা জগতের সঙ্গে কোয়ান্টাম জগতের পার্থক্য। তাই এই একুশ শতকে এসেও বেসিক কোয়ান্টাম মেকানিকসের বেশির ভাগ কোর্স পড়ানো শুরু হয় এই এক্সপেরিমেন্টের খুঁটিনাটি বর্ণনা করার মাধ্যমে।
দ্বিচিড় পরীক্ষাটি কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো কোনো থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা নয়। বরং পরীক্ষাগারে বসে উপযুক্ত যন্ত্রপাতির সাহায্যে সহজে করা যায়। গত শতাব্দীতে অসংখ্যবার এই এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে করা হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও করা হবে। পরিপূর্ণভাবে এর তাৎপর্য বোঝার জন্য তিনটি আলাদা উপকরণ—টেনিস বল, আলো ও ইলেকট্রন ব্যবহার করে এক্সপেরিমেন্ট ব্যাখ্যা করব আমরা। চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক।
দুই
শুরু করা যাক বেশ কিছু টেনিস বল ও দুটি দেয়াল দিয়ে। দেয়াল দুটির অবস্থান পরপর। অর্থাৎ প্রথমটির ঠিক পেছনে অবস্থিত দ্বিতীয়টি। দেয়াল দুটির মধ্যে প্রথমটি পুরোপুরি নিরেট নয়। এতে রয়েছে দুটি সমান আকারের ফাঁকা। এই ফাঁকাগুলো দিয়ে খুব সহজে টেনিস বল আকারের বস্তু বের হয়ে যেতে পারে। এই ফাঁক দুটিকে আমরা স্লিট বা চিড় বলব। যেহেতু দুটি চিড় বা স্লিট, তাই এই এক্সপেরিমেন্টটির নাম দ্বিচিড় পরীক্ষা। এখন যদি দুটি চিড়বিশিষ্ট প্রথম দেয়ালের দিকে একের পর এক টেনিস বল ছুড়ে মারা হয়, তাহলে কী ঘটবে?
ছুড়ে মারার কাজটি যদি কোনো সাধারণ মানুষ করেন, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়, তিনি সব কটি বলকে প্রথম দেয়ালের একই জায়গায় লাগাতে পারবেন না। সেগুলো গিয়ে আঘাত করবে দেয়ালের বিভিন্ন অংশে। বেশির ভাগ বলই ধাক্কা খেয়ে ফেরত চলে আসবে অথবা এদিক–সেদিক চলে যাবে। তবে স্বল্পসংখ্যক বল চিড়গুলোর ফাঁক গলে পেছনে চলে যাবে। চিড় গলে বেরিয়ে যাওয়া বলগুলো গিয়ে ধাক্কা দেবে পেছনের দ্বিতীয় দেয়ালে। প্রতিটি ধাক্কা লাগার স্থানকে যদি আমরা একটি ডট দিয়ে আলাদাভাবে চিহ্নিত করি, তাহলে দ্বিতীয় দেয়ালের গায়ে কেমন নকশা ফুটে উঠবে? নিচের ছবিটা দেখুন (ছবি ১)। নকশার আকৃতি হবে মোটামুটি প্রথম দেয়ালে থাকা স্লিটগুলোর আকারের মতো।
ওপরে বলা পরীক্ষাটি থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। ম্যাক্রোস্কপিক জগতের বস্তু ঠিক এভাবেই আচরণ করে। এবার টেনিস বলের পরিবর্তে আলোকতরঙ্গ দিয়ে একই পরীক্ষা আবার করা যাক। দেখা যাক, কেমন ফলাফল আসে।
মূল আলোর উৎস এমনভাবে রাখা হয় যে ঠিক দ্বিতীয় দেয়ালের ওপরে নতুন তরঙ্গগুলো আপতিত হয়ে লব্ধি তরঙ্গ তৈরির ঘটনা ঘটে, তাহলে সেখানে উজ্জ্বল আলো ও অন্ধকারের মিশেলে একধরনের অপূর্ব নকশা তৈরি হবে।
তিন
ধরা যাক, দ্বিচিড়বিশিষ্ট প্রথম দেয়ালের সামনে এবার একটি আলোর উৎস রাখা আছে। সেখান থেকে ক্রমাগত নির্গত হতে পারে এক রঙের আলোকতরঙ্গ। তরঙ্গ দিয়ে পরীক্ষাটি শুরু করার আগে আমাদের কয়েকটি কাজ সেরে নিতে হবে। প্রথম দেয়ালে থাকা চিড়গুলোর মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে অনেকখানি। সেই সঙ্গে কমিয়ে ফেলতে হবে চিড়ের ব্যাসার্ধও। যেন টেনিস বল তো দূরে থাক, মাছিও ঢুকতে না পারে ফাঁক গলে। এরপরই শুরু করা যাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা।
উৎস থেকে এক বর্ণের আলোকতরঙ্গ বেরিয়ে গিয়ে প্রথমে পৌঁছাবে দুই চিড়ের দেয়ালের কাছে। সেগুলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রমের সময়ে মূল আলোকতরঙ্গটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে তৈরি করবে আলাদা দুটি তরঙ্গ। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, চিড় দুটিই যেন আলাদা আলোকতরঙ্গের উৎস হিসেবে কাজ করছে। যাহোক, নতুন সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গগুলো এবারে দ্বিতীয় দেয়ালের দিকে এগোবে। সে সময় এরা একে অন্যের ওপর আপতিত হবে এবং তৈরি করবে লব্ধি তরঙ্গ। বিজ্ঞানীরা এ ঘটনার নাম দিয়েছেন ব্যতিচার।
নতুন সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গগুলো যদি একই দশায় একে অন্যের ওপরে গিয়ে পড়ে (বিজ্ঞানের ভাষায় বলে, উপরিপাতিত হয়), তাহলে উৎপন্ন লব্ধি তরঙ্গের বিস্তার হবে সবচেয়ে বেশি। একে বলা হয় গঠনমূলক ব্যতিচার। এ সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল আলো দেখতে পাওয়া যায়। আর যদি তরঙ্গগুলো ঠিক বিপরীত দশায় উপরিপাতিত হয়, তাহলে লব্ধি তরঙ্গের বিস্তার হয় সর্বনিম্ন। এর নাম ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার। তাদের বেলায় কোনো ধরনের আলো আর দেখতে পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়।
যদি মূল আলোর উৎস এমনভাবে রাখা হয় যে ঠিক দ্বিতীয় দেয়ালের ওপরে নতুন তরঙ্গগুলো আপতিত হয়ে লব্ধি তরঙ্গ তৈরির ঘটনা ঘটে, তাহলে সেখানে উজ্জ্বল আলো ও অন্ধকারের মিশেলে একধরনের অপূর্ব নকশা তৈরি হবে। নকশাটি দেখতে অনেকটা জেব্রা ক্রসিংয়ের মতো। অর্থাৎ ডোরাকাটা দাগের মতো করে উজ্জ্বল আলোর এলাকা ও অন্ধকার এলাকা পরপর অবস্থান করে। ওপরের ছবিগুলো একবার দেখলে পুরো বিষয়টি সহজে বোঝা যাবে (ছবি ২)। ওপরের দ্বিতীয় ছবিতে পরীক্ষাগারে পাওয়া সত্যিকারের ব্যতিচার নকশা দেখানো হয়েছে।
অর্থাৎ টেনিস বলের মতো বড় আকারের বস্তু এবং আলোর তরঙ্গ দিয়ে করা একই পরীক্ষার ফলাফল সম্পূর্ণ আলাদা।
যদি কোনো চিড়কে ঢেকে না রেখে একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করি, তাহলে কি একই ধরনের নকশা দেখতে পাব?
চার
এবারে গন্তব্য কোয়ান্টাম জগতে। তৃতীয় ও শেষবারের মতো একই পরীক্ষা আবার করব আমরা। পরীক্ষার মূল উপকরণ হবে ইলেকট্রন। অর্থাৎ দ্বিচিড়বিশিষ্ট প্রথম দেয়ালের সামনে এবার আমরা রাখব ইলেকট্রনের একটি উৎস। সেখান থেকে প্রথম দেয়ালের দিকে ক্রমাগত ছুড়ে দেওয়া যাবে ইলেকট্রনদের। প্রথম দেয়ালের পেছনে আগের মতোই থাকবে পর্দারূপী আরেকটি নিরেট দেয়াল।
ইলেকট্রন দিয়ে পরীক্ষা শুরু করার আগে আমাদের অবশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে নিতে হবে। প্রথম দেয়ালে থাকা দুই চিড়ের একটিকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর শুরু হবে দেয়ালের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলেকট্রন ছুড়ে দেওয়া। কী ঘটবে এখন?
বেশির ভাগ ইলেকট্রন প্রথম দেয়ালের মধ্যে শোষিত হয়ে যাবে। খুব সামান্যসংখ্যক ইলেকট্রন খোলা চিড় পেরিয়ে পেছনের দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছাবে। ধরে নিই, দ্বিতীয় দেয়ালের যে স্থানে ইলেকট্রন আঘাত করবে, সেখানে একটি সাদা দাগ তৈরি হবে। বেশ কিছু সময় ধরে ইলেকট্রন উৎসটি চালু রাখা হলে পেছনের দেয়ালে ক্রমাগত সাদা দাগের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। একসময় দেখা যাবে, পেছনের দেয়ালে চিড়ের আকারের একটি উজ্জ্বল সাদা দাগ তৈরি হয়েছে। টেনিস বল দিয়ে পরীক্ষা করার সময় যেমন নকশা পাওয়া গিয়েছিল, অনেকটা সে রকম। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে ইলেকট্রনকে কণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে টেনিস বল হলো ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদির মতো অনেক কণার সমষ্টি। তাই দুই ক্ষেত্রে একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
এবার আমরা যদি কোনো চিড়কে ঢেকে না রেখে একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করি, তাহলে কি একই ধরনের নকশা দেখতে পাব? স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে, এবারে পেছনের দেয়ালে চিড় আকারের দুটি উজ্জ্বল সাদা দাগ দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু সব কমনসেন্সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যাখ্যাতীতভাবে এবারে দেয়ালে ফুটে উঠবে ব্যতিচারের নকশা! ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল আলো দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সময়। পরের পৃষ্ঠার নিচের ছবিতে দেখুন ঘটনাটি (ছবি ৪)।
যদি বেশ কিছু সময় ধরে ইলেকট্রন উৎসকে চালু রাখা হয়, তাহলে পেছনের দেয়ালে পৌঁছানো ইলেকট্রনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি স্পষ্ট হবে ব্যতিচার নকশা। ছবি ৩-এর চারটি ছবির প্রথমটিতে দাগের সংখ্যা কম। এতে ব্যতিচারের নকশা মোটেই দৃশ্যমান নয়। তবে পরের ছবিগুলোতে ক্রমাগত দাগের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে ব্যতিচারের নকশা। কী ব্যাখ্যা হতে পারে এমন অদ্ভুত ঘটনার?
বিজ্ঞানীরা প্রথমে এ ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকটা এ রকমভাবে—উৎস থেকে নিঃসরিত হওয়ার পরে বেশির ভাগ ইলেকট্রন দেয়ালের মধ্যে শোষিত হয়। বাকি ইলেকট্রনগুলোর কিছু অংশ বাঁ দিকের চিড় ব্যবহার করে পেছনের দেয়ালে পৌঁছায়। আর বাকি অংশের ইলেকট্রনরা ব্যবহার করে ডান দিকের চিড়। দুটি চিড় থেকে আসা ইলেকট্রনরা একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে দেয়ালের ওপরে তৈরি করবে ব্যতিচার নকশা।
ব্যাখ্যাটি বেশ সম্ভাবনাময় হলেও আসলে সঠিক নয়। কেন এমনটা বলছি, তা ব্যাখ্যা করা যাক। যদি আমরা উৎস থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলেকট্রন দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারার পরিবর্তে একবারে একটি একটি করে ছুড়ে মারি, তাহলে কেমন হবে? এবার তো ওপরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ব্যতিচার নকশা পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একবারে মাত্র একটি ইলেকট্রন পেছনের দেয়ালে পৌঁছালে অন্যদের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সবিস্ময়ে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, স্লিটের মধ্য দিয়ে একবারে একটি ইলেকট্রন পাঠালেও ঠিকই তৈরি হয় ব্যতিচার নকশা। তবে তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাবে না এই নকশা। কয়েক ঘণ্টা ধরে ইলেকট্রন উৎস চালু রাখলে একটি একটি করে ইলেকট্রন এসে পড়বে দেয়ালের ওপরে। তারা সবাই মিলে তৈরি করবে এই ব্যতিচার নকশা। অর্থাৎ ইলেকট্রনগুলো এমনভাবে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়বে, যেন দিন শেষে জেব্রা ক্রসিংয়ের মতো ব্যতিচার নকশা ফুটে ওঠে। মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে এক্সপেরিমেন্টটি করা হোক না কেন, সব সময় একই ফলাফল পাওয়া যাবে। সত্যিই অদ্ভুত, তাই না?
এই অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে কোয়ান্টাম জগতে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় কণাদের তরঙ্গের মতো আচরণ। একটিমাত্র ইলেকট্রন দিয়েও ব্যতিচার নকশা পাওয়ার একটিমাত্র উপায় থাকতে পারে। আর সেটি হলো, কোনো না কোনোভাবে ইলেকট্রন তরঙ্গের মতো আচরণ করে। ফলে একটি ইলেকট্রন একই সঙ্গে দুটি চিড়ের মধ্য দিয়ে চলে যেতে পারে। পরে দুই ভাগ হয়ে নিজেই নিজের সঙ্গে ঘটায় ব্যতিচার। ফলে দেয়ালে পাওয়া যায় অপূর্ব নকশা। ঠিক যেমনটা ঘটে আলোকতরঙ্গ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সময়ে। আলোকে যেমন শুধু তরঙ্গ বা শুধু কণা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, ঠিক তেমনি ইলেকট্রনকেও শুধু কণা ভাবার অবকাশ নেই। এর মধ্যেও রয়েছে তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য। শুধু ইলেকট্রন নয়, সব কণার মধ্যে রয়েছে তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য। তবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বস্তুগুলোতে এ রকম হতে দেখা যায় না। কারণ, বস্তু যত বড় হয়, তত লোপ পায় এর তরঙ্গ ধর্ম। তাই তারা দৃশ্যমান হয় কেবল কোয়ান্টাম জগতে।
ডিটেক্টর চালু থাকা অবস্থায় পরীক্ষা শুরু করলে দেখা যাবে, ইলেকট্রনগুলোর দুটি স্লিটের যেকোনো একটির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা ঠিক ৫০ শতাংশ।
পাঁচ
কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুতুড়ে নিয়মকানুন মেনে নেওয়া যে কারও জন্য বেশ কষ্টকর। এমনকি প্রথম দিকে আইনস্টাইন পর্যন্ত মানতে চাননি। কোয়ান্টাম জগতের অনিশ্চয়তা নিয়ে ছিল তাঁর ঘোর আপত্তি। ধরা যাক, এমনই কোনো এক কোয়ান্টাম মেকানিকসবিরোধী পদার্থবিদ দ্বিচিড় পরীক্ষা আরেকটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। ইলেকট্রন আসলেই একসঙ্গে দুটি চিড়ের মধ্য দিয়ে যায় কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানার জন্য বসালেন ডিটেক্টর। তারা খুব সংবেদনশীল। আগত ইলেকট্রনের গতিপথ সামান্যতম প্রভাবিত না করেই ডিটেক্টরগুলোর মাধ্যমে জেনে নেওয়া সম্ভব, কোন চিড়ের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে ইলেকট্রনরা।
এবার ডিটেক্টর চালু থাকা অবস্থায় পরীক্ষা শুরু করলে দেখা যাবে, ইলেকট্রনগুলোর দুটি স্লিটের যেকোনো একটির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা ঠিক ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ কিছু ইলেকট্রন প্রথম চিড় দিয়ে চলে যাবে। বাকিদের গন্তব্য হবে দ্বিতীয় চিড়। অর্থাৎ সুনির্দিষ্টভাবে কোন ইলেকট্রন ঠিক কোন চিড় দিয়ে যাবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে ডিটেক্টরসহ এক্সপেরিমেন্টটি করলে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে পেছনের দেয়ালে। সেখান থেকে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাবে ব্যতিচার নকশা। তার পরিবর্তে দেখা যাবে দুটি সাদা উজ্জ্বল দাগ। যার আকার–আকৃতি হুবহু চিড়ের মতো। অর্থাৎ টেনিস বল দিয়ে পরীক্ষা করার সময় যেমন ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, ঠিক তেমন।
যে মুহূর্ত থেকে চিড়ের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রনের গতিপথের তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হবে, সেই মুহূর্ত থেকে ইলেকট্রন তরঙ্গের মতো আচরণ করা বন্ধ করে দেবে। তখন তাদের আচরণ হবে শতভাগ স্বাভাবিক কণার মতো। ফলে তারা তরঙ্গের মতো একসঙ্গে দুটি চিড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে যেকোনো একটি চিড়ের মধ্য দিয়ে যাবে। আর তাতেই পাওয়া যাবে স্বাভাবিক নকশা। ডিটেক্টর সরিয়ে ফেলে পরীক্ষা করলে ভেলকিবাজির মতো আবার হাজির হবে ব্যতিচারের ডোরাকাটা নকশা। পরিমাপ পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো সিস্টেমের প্রভাবিত হওয়ার অন্যতম উদাহরণ হলো এই ঘটনা। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও আসলেই এমনটা ঘটে। হাজারবার একই পরীক্ষা করে পদার্থবিদেরা এর সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবার একই ফলাফল পাওয়া গেছে। তাই কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুনগুলো আমাদের সহজাত বিচারবুদ্ধির বাইরে গেলেও কিছু করার নেই। কারণ, রহস্যময় প্রকৃতির খেয়াল এটাই।