রকেট সায়েন্স

মহাকাশে নভোযান, নভোদুরবিন, কৃত্রিম উপগ্রহ কিংবা যেকোনো কিছু পাঠাতে চাইলে একমাত্র অবলম্বন রকেট। আমাদের আলোচ্য আন্তর্জাতিক নভোস্টেশনও মহাকাশে পাঠানো হয়েছে রকেটের মাধ্যমে। এই রকেট কীভাবে মহাকাশে পাঠানো হয়, সেখানে এটি কীভাবে দিক বা বেগ বদলায় রকেটবিজ্ঞানের এসব খুঁটিনাটি…

মাথার ওপর দিয়ে অবিরাম ছুটে চলা কয়েক হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ ছাড়া আধুনিক সভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাদের মাধ্যমে অটুট থাকে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগব্যবস্থা। অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা থাকে পৃথিবীর প্রতিটি কোণের মানুষ। সব সময় সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে তারা গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলের মতো করে আমাদের দেখেশুনে রাখে। আবার মুহূর্তে প্রয়োজনীয় তথ্য বা সংকেত পৌঁছে দেয় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মোটকথা, জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতে, আমরা সবাই প্রতিমুহূর্তে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ব্যবহার করে চলেছি।

২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মহাকাশে অবস্থানরত উপগ্রহের সংখ্যা ছিল আট হাজারের বেশি। অবশ্য তাদের বেশ কিছু এখন আর সচল নেই। তাদের মহাশূন্যে পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো পৃথিবীর শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ফাঁকি দেওয়া। কীভাবে করা হয় এই প্রায় অসম্ভব কাজটি? আবার মহাশূন্যে পৌঁছানোর পর কোন কৌশলে তারা ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করতে পারে? আর কীভাবেই-বা পৃথিবীতে বসে তাদের পরিচালনা করা হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে চলুন জেনে আসা যাক।

বল বনাম রকেট

ধরুন, আপনার হাতে একটি টেনিস বল আছে। সেটিকে ওপরের দিকে ছুড়ে মেরে একটি কৃত্রিম উপগ্রহের ভবলীলা সাঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর আপনি। কারণ, মনেপ্রাণে আপনি বিশ্বাস করেন, একদিন তাদের ব্যবহার করে রোবটরা দখল করে নেবে গোটা পৃথিবী। তাই সময় থাকতে থামাতে হবে তাদের। যাহোক, আপনি সর্বশক্তি দিয়ে ওপরের দিকে ছুড়ে মারলেন বলটি। সেটি কি আদৌ পৌঁছাতে পারবে কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর কাছে?

চীনে উৎক্ষেপণের পর একটি রকেট বিধ্বস্ত হয়েছে
ফাইল ছবি, রয়টার্স

যদি আপনি সুপারম্যান না হয়ে থাকেন, তাহলে অবধারিতভাবে বলটি কিছুটা ওপরে উঠে আবার বিপুল বিক্রমে নিচের দিকে পড়তে শুরু করবে। কতটা ওপর পর্যন্ত বলটি উঠতে পারবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করবে আপনার পেশিশক্তির ওপর। যত জোরে ছুড়ে মারবেন, তত ওপরে উঠবে বলটি। টেনিস বলটির এমন গতি হারিয়ে নিচের দিকে পড়ে যাওয়ার পেছনের মূল কারিগর পৃথিবীর আকর্ষণ বল। এটি শুধু টেনিস বল নয়; বরং অদৃশ্য এক শক্তিশালী বাঁধনে বেঁধে রাখে পৃথিবীপৃষ্ঠ ও এর আশপাশের সবকিছু।

টেনিস বল ওপরের দিকে ছুড়ে মারার মুহূর্তে এর মধ্যে থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ গতিশক্তি। এটি কাজ করে পৃথিবীর আকর্ষণের উল্টো দিকে। যখন গতিশক্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সেটি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। তবে যদি আমরা একে যথেষ্ট জোরে ছুড়ে দিতে পারি, তাহলে সেটি পৃথিবীর আকর্ষণ পুরোপুরি প্রতিহত করতে পারবে। পদার্থবিদেরা গণিত (ক্যালকুলাস) ব্যবহার করে সহজে এই গতিশক্তির মান বের করতে পারেন। পৃথিবীতে থাকা কোনো বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে, তাহলে সে অনায়াসে গ্র্যাভিটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারবে মহাশূন্যে। বিজ্ঞানীরা এই বেগের নাম দিয়েছেন মুক্তিবেগ। গ্রহ বা নক্ষত্রভেদে এর মান পরিবর্তিত হয়। যেমন সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে যাত্রা করে কোনো বস্তু মহাকাশে পৌঁছাতে হলে প্রতি সেকেন্ডে অতিক্রম করতে হবে প্রায় ৬১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সূর্যের আকার পৃথিবীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি হওয়ায় এমনটি হয়। অর্থাৎ মুক্তিবেগের মান সম্পূর্ণ নির্ভর করে গ্রহ বা নক্ষত্রের ভর ও ব্যাসার্ধের ওপর।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরে যেতে হলে সব সময় যে মুক্তিবেগের সমান বা এর চেয়ে বেশি বেগে যাত্রা করতে হবে, তা নয়। যদি যাত্রা করার পরে আলাদাভাবে ত্বরণ প্রয়োগের কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে কেবল এটি সত্য হবে। বল ছুড়ে মারার উদাহরণের কথা আরেকবার ভাবুন। বল হাত থেকে ছুটে যাওয়ার পর এর গতিবেগ ক্রমাগত কমতে থাকে।

প্রকৃতির এক অদ্ভুত রহস্যের উত্তর মেলে মুক্তিবেগের মাধ্যমে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পর্যায় সারণির সবচেয়ে হালকা দুটি মৌল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। তারা বেশ সহজলভ্য। খুঁজে পাওয়া যায় পৃথিবীসহ মহাবিশ্বের সবখানে। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা গ্যাসীয়। সে হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাদের সরব উপস্থিতি থাকার কথা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না বললে চলে। কেন এমন হয়?

কোনো পরমাণুর গড় গতিশক্তি নির্ভর করে তাপমাত্রার ওপর। একই তাপমাত্রার জন্য হালকা গ্যাসগুলোর পরমাণুর গতিশক্তি বেশি হয় এবং ভারী গ্যাসগুলোর পরমাণুর গতিশক্তি হয় কম। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরমাণুর গড় গতিশক্তির মান পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি হয়। ফলে খুব সহজে তারা চলে যেতে পারে মহাশূন্যে। অন্যদিকে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির মতো অপেক্ষাকৃত ভারী পরমাণুগুলোর গতিবেগ কম হওয়ায় তারা বাঁধা পড়ে থাকে বায়ুমণ্ডলে। ফলে বাতাসের প্রায় ৯৯ শতাংশ তৈরি তাদের দিয়ে। আর মহাবিশ্বজুড়ে প্রাচুর্য থাকার পরও বায়ুমণ্ডলে খুব কম দেখা মেলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের।

এবার একটা প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করা যাক। পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে বাইরে যেতে হলে সব সময় যে মুক্তিবেগের সমান বা এর চেয়ে বেশি বেগে যাত্রা করতে হবে, তা নয়। যদি যাত্রা করার পরে আলাদাভাবে ত্বরণ প্রয়োগের কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে কেবল এটি সত্য হবে। বল ছুড়ে মারার উদাহরণের কথা আরেকবার ভাবুন। বল হাত থেকে ছুটে যাওয়ার পর এর গতিবেগ ক্রমাগত কমতে থাকে। চাইলেও এ সময়ে ত্বরণ প্রয়োগ করে গতিবেগ বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। তাই পৃথিবীর গ্র্যাভিটি ফাঁকি দিতে হলে অবশ্যই বলটিকে ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। তবে যদি কোনোভাবে এর ওপরে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ত্বরণ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে অনেক কম বেগে যাত্রা করেও মহাশূন্যে পৌঁছানো সম্ভব। ঠিক এই কৌশল কাজে লাগানো হয় রকেটগুলোয়।

আরও পড়ুন

সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপরও ঘুরপাক খায়। একে কাজে লাগিয়ে চাইলে আমরা মুক্তিবেগের মান কমবেশি করতে পারি। যদি মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকের সঙ্গে মিল রেখে একই দিকে যাত্রা করি, তাহলে মুক্তিবেগের মান কমে যাবে। আর পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে যাত্রা করলে ঘটবে উল্টো ঘটনা। এ পদ্ধতিতে মুক্তিবেগের মান ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করা যায়। বিষুবরেখার কাছে পৃথিবীর নিজ অক্ষের ওপরে ঘূর্ণন বেগের মান সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে এ অঞ্চল থেকে যাত্রা করলে মুক্তিবেগ কমানোর সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া যায়। তাই বিশ্বের বেশির ভাগ রকেট উৎক্ষেপণের ফ্যাসিলিটির অবস্থান এখানে।

মাল্টিস্টেজ রকেট

বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কমবেশি নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সঙ্গে পরিচিত। এর থেকে পাওয়া যায় ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র। সূত্রটির বিবৃতি অনেকটা এ রকম:

‘দুটি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো বল কাজ না করলে কোনো নির্দিষ্ট দিকে তাদের মোট ভরবেগ অপরিবর্তিত থাকে।’

এ নীতির ওপর ভিত্তি করে উৎক্ষেপণ করা হয় সব রকেট। রকেটের নিচের দিকের অংশে থাকা জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপন্ন করা হয় প্রচুর পরিমাণ গ্যাস। সেই গ্যাসগুলোকে নির্গত করানো হয় রকেটের নিচের দিক দিয়ে। প্রথমে জ্বালানি ও রকেট—দুটোই স্থির অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ এ সময় তাদের ভরবেগের সমষ্টি শূন্য। গ্যাস নির্গত হওয়ার ফলে নির্গমনের দিকে জ্বালানির কিছুটা ভরবেগ তৈরি হয়। সূত্র অনুসারে পুরো সিস্টেমের ভরবেগের সমষ্টি অপরিবর্তিত রাখার জন্য রকেটটির সামনের দিকে জ্বালানির সমপরিমাণ ভরবেগের সৃষ্টি হবে। ফলে রকেটটি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ছবি ২-তে রকেট চলার মূলনীতি দেখানো হয়েছে।

আরও পড়ুন
রকেট ব্যবহার করে মহাশূন্যে পৌঁছানোর পালা শেষ। এবার জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সেখানে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথ বজায় রেখে পরিভ্রমণরত থাকে। বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে নিউটনের চিন্তার জগৎ থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। ধরুন, মাটিতে একটি কামান রাখা আছে।
ছবি ১: নিউটনের কাল্পনিক কামান

মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর জন্য যেসব আধুনিক রকেট ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে সম্পূর্ণ জ্বালানি একসঙ্গে রাখা হয় না। কয়েকটি আলাদা ধাপে রাখা হয়। যাত্রাপথে এক ধাপের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সেই অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে সেই বিচ্ছিন্ন অংশ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এক ধাপের জ্বালানি শেষ হলে ব্যবহার করা হয় অন্য ধাপের জ্বালানি। এ রকেটগুলোকে বলা হয় মাল্টিস্টেজ রকেট। এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের মাল্টিস্টেজ রকেটের প্রয়োজন পড়ল?

প্রথম সমস্যা ওজন নিয়ে। রকেটের জ্বালানি যে ট্যাংকের ভেতরে রাখা হয়, তার ওজন অনেক বেশি। জ্বালানি পুড়ে যাওয়ার পর এর আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে না। যদি সব জ্বালানি একসঙ্গে রাখা হয়, তাহলে যাত্রার শেষ পর্যন্ত ট্যাংকটি শুধু শুধু বহন করে নিয়ে যেতে হয়। ফলে অতিরিক্ত ভর বহনের দরুন অপচয় হয় মূল্যবান জ্বালানি। অন্যদিকে যদি জ্বালানি কয়েক ধাপে রাখা হয়, তাহলে প্রতি ধাপের কাজ শেষে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায় সেই খালি ট্যাংক। ফলে দ্বিতীয় ধাপের জ্বালানি ব্যবহার করে বেশি পথ অতিক্রম করা যায়।

দ্বিতীয় সমস্যা রকেট ইঞ্জিনের নজল (ইঞ্জিন থেকে বেরিয়ে আসা পাইপ) নিয়ে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ইঞ্জিনে জ্বালানির মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং এর মাধ্যমে উৎপন্ন গ্যাস একটি নজল দিয়ে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। এর ফলে সৃষ্ট ভরবেগ পুঁজি করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় রকেট। রকেটের অবস্থান যখন বায়ুমণ্ডলের ভেতরে হয়, তখন নজলের আকার অবশ্যই ছোট হতে হবে। কারণ, বায়ুমণ্ডলের ভেতরে নজল থেকে বের হওয়া গ্যাসের প্রবাহ চারদিকে বেশি দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে দেওয়া খুবই বিপজ্জনক। ছোট নজলে গ্যাসের প্রবাহ অনেকটা সরলরৈখিক হয়। অন্যদিকে বড় নজল ব্যবহার করা হলে বাতাসের চাপ উপেক্ষা করে নির্গত গ্যাসের প্রবাহ অনেক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। ফলে তৈরি হতে পারে টারবুলেন্স। এর প্রভাবে ক্রমাগত কাঁপতে কাঁপতে একসময় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে গোটা রকেট। তাই বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ছোট নজল ব্যবহারের বিকল্প নেই। তবে ছোট নজলসমেত কেবল একটি ইঞ্জিন দিয়ে মহাশূন্যে যাওয়ার প্রয়োজনীয় ভরবেগ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই ব্যবহার করতে হয় এমন কয়েকটি ইঞ্জিন।

আরও পড়ুন

এবার মহাশূন্যে কেমন আকারের নজলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা জেনে নেওয়া যাক। মহাশূন্যে বাতাসের চাপের অস্তিত্ব নেই। তাই চাইলে ছোট বা বড়—দুই ধরনের নজলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বড় নজলবিশিষ্ট ইঞ্জিন ব্যবহার করলে জ্বালানির আউটপুট বেশি পাওয়া যায়। তাই মহাশূন্যে বড় নজলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুই পরিস্থিতিতে আমাদের দুই ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে। কেবল মাল্টিস্টেজ রকেট হলে এই চাহিদা মেটানো সম্ভব।

মহাশূন্যে চলাফেরা

রকেট ব্যবহার করে মহাশূন্যে পৌঁছানোর পালা শেষ। এবার জেনে নেওয়া যাক কীভাবে সেখানে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথ বজায় রেখে পরিভ্রমণরত থাকে। বিষয়টি বোঝার জন্য প্রথমে নিউটনের চিন্তার জগৎ থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। ধরুন, মাটিতে একটি কামান রাখা আছে। এর থেকে সোজাসুজি সামনের দিকে একটি গোলা ছুড়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পৃথিবীপৃষ্ঠের সমান্তরালে চলার পর সেটি ক্রমেই নিচের দিকে নামতে থাকবে। একসময় মাটিতে পড়ে যাবে। এমন হওয়ার পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ে মহাকর্ষ বল। আমরা যদি অনেক বেশি পরিমাণ বারুদ ব্যবহার করে খুব জোরে গোলাটি ছুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি, তাহলে সেটি মাটিতে পড়ার আগে আরও পথ অতিক্রম করবে। এ সময় সেটির পৃথিবীর সমান্তরালে চলার সময়কাল আগের চেয়ে বেশি হবে। অর্থাৎ আমরা যদি যথেষ্ট বেগে গোলাটি ছুড়ে দিতে পারি, তাহলে সেটির পৃথিবীপৃষ্ঠের সমান্তরালে চলার সময়কাল এত বেশি হবে যে সেটি আর মাটিতে পড়বে না। সেই সময় গোলাটি পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকবে। ছবি ১ একবার দেখলে মূল আইডিয়াটা ধরতে পারবেন।

ছবি ২: রকেট চলার মূলনীতি

এই মানস পরীক্ষা প্রথম মাথায় এসেছিল নিউটনের। এর কয়েক শ বছর পর বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর চারদিকে ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করাতে সক্ষম হন। প্রথমে রকেট ব্যবহার করে কৃত্রিম উপগ্রহকে ওপরের দিকে ওঠানো হয়। একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠানোর পর ধীরে ধীরে এর দিক পরিবর্তন করা হয়। যেন এটি পৃথিবীর সমান্তরালে চলতে পারে। পৃথিবীর সমান্তরালে চলার সময় কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল রাখা হয়। এই বেগের কারণে কৃত্রিম উপগ্রহের ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বলের প্রভাব নাকচ হয়ে যায়। ফলে সহজে ভারসাম্য বজায় রেখে পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করতে পারে উপগ্রহগুলো। খুব সতর্কতার সঙ্গে হিসাব–নিকাশ করে বিজ্ঞানীরা উপগ্রহের এই বেগের (কক্ষীয় বেগ) মান নির্ধারণ করেন। কারণ, সামান্য কমবেশি হলে সব আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। বেগের মান কম হলে কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর আকর্ষণ বল পুরোপুরি নাকচ করতে পারবে না। ফলে ক্রমে এটির কক্ষপথের ব্যাসার্ধ কমে যাবে এবং একসময় পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়বে। আর যদি কক্ষীয় বেগের মান বেশি হয়, তাহলে সেটি পৃথিবীর চারদিকে ঘোরা বাদ দিয়ে সোজা যাত্রা করবে গভীর মহাশূন্যের দিকে। যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ কিলোমিটার ওপরে ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে গতিশীল রাখতে হয়, তাহলে এর কক্ষীয় বেগের মান হতে হবে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার। ভূপৃষ্ঠ থেকে কক্ষপথের দূরত্ব যত বেশি হবে, তত কম বেগে গতিশীল রাখতে হবে কৃত্রিম উপগ্রহকে। যেমন এক হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় প্রয়োজনীয় কক্ষীয় বেগের মান হবে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার।

আরও পড়ুন
যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ পুরোপুরি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ কম উচ্চতার কক্ষপথ থেকে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে অথবা উল্টোটা, তাহলে কীভাবে সেটি করা হয়? ছবি ৩ লক্ষ করুন। সেখানে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের পথে ঘূর্ণমান রয়েছে।
ছবি ৩: হোম্যান ট্রান্সফারের মাধ্যমে কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ পুরোপুরি পরিবর্তন করা যায়। অর্থাৎ কম উচ্চতার কক্ষপথ থেকে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে অথবা উল্টোটা করা যায়
User

ভারসাম্যপূর্ণ কক্ষপথে পরিভ্রমণরত থাকার পরও বায়ুমণ্ডলের প্রভাবে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কক্ষপথ থেকে সামান্য বিচ্যুত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের কথাই ধরুন। এর অবস্থান পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওপরে। ভূপৃষ্ঠের মোটামুটি ৬২ কিলোমিটার ওপর থেকে মহাশূন্য শুরু হলেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রভাব প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত থাকে। তাই সেখানে অল্প হলেও কিছু পরিমাণ গ্যাসীয় অণু-পরমাণুর অস্তিত্ব সব সময় থাকে। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ৯০ মিটার পর্যন্ত পৃথিবীর দিকে সরে আসতে পারে। তবে এতে চিন্তার কিছু নেই। বিচ্যুতির পরিমাণ বেশি হলে স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত রকেট ব্যবহার করে সহজে সঠিক কক্ষপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে।

এবার আসা যাক হোম্যান ট্রান্সফারে। যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ পুরোপুরি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ কম উচ্চতার কক্ষপথ থেকে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে অথবা উল্টোটা, তাহলে কীভাবে সেটি করা হয়? ছবি ৩ লক্ষ করুন। সেখানে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের পথে ঘূর্ণমান রয়েছে। সেখান থেকে এটিকে নিয়ে আসতে হবে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে। সে জন্য প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহের গতিবেগে পরিবর্তন আনা হয়। গতিবেগ কমবেশি হলে এর কক্ষপথের আকার আগের মতো বৃত্তাকার থাকবে না; বরং সেটি হয়ে যাবে উপবৃত্তাকার। খুব সূক্ষ্মভাবে হিসাব–নিকাশ করে কৃত্রিম উপগ্রহের গতিবেগ এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যেন নতুন উপবৃত্তাকার পথের অপর প্রান্তের অবস্থান হয় কাঙ্ক্ষিত বেশি উচ্চতার কক্ষপথের পরিধির ওপরে। সেখানে পৌঁছানোর পর কৃত্রিম উপগ্রহের গতির মান ও দিক আরেক দফা পরিবর্তন করা হয়। ফলে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিভ্রমণ করতে পারে কৃত্রিম উপগ্রহটি। পুরো প্রক্রিয়াটির নাম হোম্যান ট্রান্সফার।

এ আলোচনার সমাপ্তি টানব মহাকাশযান চালানোর আরেকটি মজার কৌশলের কথা দিয়ে। এর নাম গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট বা গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশট। গোড়া থেকে শুরু করা যাক। রকেটে ব্যবহার করা জ্বালানির দাম অনেক। তাই যত কম জ্বালানি খরচ করা যায়, ততই মঙ্গল। জ্বালানি সাশ্রয় করার এক চমকপ্রদ উপায়ের নাম গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট। এ পদ্ধতিতে কোনো গ্রহের নিজস্ব ভরবেগ কাজে লাগিয়ে মহাকাশযানের গতিবেগ অনেক বাড়িয়ে নেওয়া যায়। ১৯১৯ সালের দিকে সোভিয়েত গণিতবিদ ইউরি কন্ড্রাটুকের হাত ধরে এ পদ্ধতির আবির্ভাব। গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট সম্পন্ন করতে হলে মহাকাশযানকে কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের বেশ কাছ দিয়ে উড়ে যেতে হয়। এ সময় সেটি যদি গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথের পরিভ্রমণের গতির দিকের সঙ্গে একই দিকে যায়, তাহলে মহাকাশযানে খুব সামান্য পরিমাণ ভরবেগের স্থানান্তর ঘটে। ফলে বেড়ে যায় মহাকাশযানের গতি। বিষয়টি অনেকটা টান দিয়ে গতি বাড়িয়ে দেওয়ার মতো। গ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় এই টান।

আরও পড়ুন
গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট পদ্ধতি প্রয়োগের বিপরীতে সবচেয়ে বড় বাধার নাম সময়। এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য একেবারে সঠিক জায়গায় ও সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হয় একটি মহাজাগতিক বস্তুর। নয়তো কাজে আসবে না এ পদ্ধতি।
ছবি ৪: গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট

পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে যেকোনো সিস্টেমে ভরবেগ সব সময় সংরক্ষিত থাকে। গ্রহ-উপগ্রহ ও মহাকাশযানের সিস্টেমও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের মাধ্যমে মহাকাশযানের ভরবেগ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমপরিমাণ কমে যাবে গ্রহ বা উপগ্রহের ভরবেগ। ভরবেগ দুইভাবে কমতে পারে। এক, হয় গ্রহ বা উপগ্রহের ভর কমে যাবে অথবা এদের পরিভ্রমণের বেগ কমে যাবে। গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের মাধ্যমে তাদের ভর কমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ভরবেগ সামান্য পরিমাণ কমতে হলে অবশ্যই কমে যাবে তাদের কক্ষপথে পরিভ্রমণের বেগ। তবে বেগ কমে যাওয়ার মাত্রা এতটাই কম যে খুব সহজে উপেক্ষা করা যায়। গ্রহ বা উপগ্রহের সামগ্রিক কক্ষপথে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে না। অন্যদিকে মহাকাশযানের ক্ষেত্রেও ভরবেগ বেড়ে যায় তার গতিবেগ বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে। কারণ, এখানেও ভর বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে মহাকাশযানের গতিবেগ বেশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যায়। এ সময় যদি ইঞ্জিন ব্যবহার করে মহাকাশযানকে গতির দিকে ধাক্কা দেওয়া যায়, তাহলে ভরবেগ বৃদ্ধির মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া যায় আরও অনেক গুণ। আমরা চাইলে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট ব্যবহার করে কোনো মহাকাশযানের গতিবেগ কমিয়ে ফেলতে পারি। সে জন্য একে অগ্রসর হতে হবে গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথের গতির বিপরীত দিক থেকে। তখন গ্রহ বা উপগ্রহের ভরবেগ বেড়ে যাবে এবং মহাকাশযানের ভরবেগ কমে যাবে।

আরও পড়ুন
১৯৭৭ সালে যাত্রা করে ভয়েজার এক আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে পৌঁছেছে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট
ছবি: উইকিপিডিয়া

গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট পদ্ধতি প্রয়োগের বিপরীতে সবচেয়ে বড় বাধার নাম সময়। এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য একেবারে সঠিক জায়গায় ও সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হয় একটি মহাজাগতিক বস্তুর। নয়তো কাজে আসবে না এ পদ্ধতি। ভয়েজার মিশনগুলোর কথাই ধরুন। মানবসভ্যতার মহাকাশভ্রমণের ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত দুটি মহাকাশযানের নাম ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২। তাদের বর্তমান অবস্থান ইন্টারস্টেলার স্পেসে। অর্থাৎ তারা ছাড়িয়ে গেছে আমাদের সৌরজগতের শেষ প্রান্ত। সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য কোনো মহাকাশযানকে পৃথিবী থেকে যাত্রা করতে হবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫ মাইল বেগে। এ জন্য দরকার পড়ে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি। ১৯৭৭ সালে আমাদের সৌরজগতের বেশ কিছু গ্রহ প্রাকৃতিকভাবে বিশেষ অবস্থানে চলে এসেছিল। এমনটা ঘটে প্রতি ১৭৫ বছরে মাত্র একবার। সে সময়ে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন এমনভাবে অবস্থান করছিল যে একটি মহাকাশযানের মাধ্যমে পরপর কয়েকটি গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হয়। অন্য সময় এমনটা করা এককথায় অসম্ভব। এ অনবদ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৯৭৭ সালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২। ফলে অনেক কম জ্বালানি ব্যয় করে তারা পৌঁছে যেতে সক্ষম হয় সৌরজগতের শেষ প্রান্তে। ভয়েজার মিশনগুলো ছাড়া এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মহাকাশ মিশনে সফলতার সঙ্গে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সত্যিই মনোমুগ্ধকর, তাই না?

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল) ৫৪. গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত